বইয়ের দোকান নয়, নিখাদ আবেগ
মনে হয়, মূলত একটা বইয়েরই তো দোকান! কতই বা আর বড় হতে পারে? কিন্তু সে তার প্রচলিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে কী বিপুল এক শরীর আর পরিচিতি ধারণ করতে পারে, জাপানের ‘কিনোকুনিয়া’ তার বিরল এক উদাহরণ।
ছিল এক কাঠ আর কাঠ-কয়লার দোকান। এরপর এক সময় সেটাই হয়ে উঠল বিশ্বে জাপানের প্রতিনিধিত্ব করা চোখধাঁধানো এক গ্রন্থ প্রতিষ্ঠান, যাকে নিছক একটা বইয়ের দোকান আজ হয়তো আর বলা যাবে না। ১৯২৩ সালে জাপানের কান্তো এলাকায় বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে কাঠ আর কাঠ-কয়লার ব্যবসা গুটিয়ে মোইচি তানাবে শিন্জুকু শহরে ১৯২৭-এ খুলে বসলেন এক বইয়ের দোকান। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন জাপানের কি প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত। সেই স্মৃতি মনে রেখে তানাবে তাঁর নতুন দোকানের নাম দিলেন ‘কিনোকুনিয়া’ অর্থাৎ কি প্রদেশের দোকান। একটা ছোট দোতলা কাঠের বাড়ি, উপরে একটা গ্যালারি। পাঁচজন কর্মীকে নিয়ে শুরু হওয়া দোকানে রাখা হত সাহিত্যের বই আর পত্রিকা, সঙ্গে পড়াশোনার জগতের নানা বই। গ্যালারিতে শিল্পীদের ছবি প্রদর্শিত হত। ২০২২-এ ‘কিনোকুনিয়া’র বেড়ে ওঠার বহরে চোখ রাখা যাক। শুধুমাত্র জাপানেই ৬৮টা গুরুত্বপূর্ণ শহরে রয়েছে ‘কিনোকুনিয়া’র গ্রন্থবিপণি। তা ছাড়া জাপানে রয়েছে ৮৩টা বুক-সেন্টার। এই বুক-সেন্টারগুলো খোলা হয়েছে মূলত জাপানের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অঙ্গনে। শুধুমাত্র সেইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী আর কর্মীদের প্রবেশাধিকার রয়েছে সেখানে। এ তো গেল জাপানের কথা। ১৯৬৯-এ আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো শহরে একটা দোকান খুলে ‘কিনোকুনিয়া’র বিদেশে যাত্রা শুরু। তারপর আজ বিশ্বের প্রায় সাতটা দেশে ৪০টা দোকানের নাম ‘কিনোকুনিয়া’। আর পাঁচ থেকে বেড়ে তার কর্মীসংখ্যা ৫,০০০।
‘কিনোকুনিয়া’র মূল ব্যবসার অন্যতম— জাপানি এবং পাশ্চাত্যের বই আর পত্রপত্রিকা, অফিসের স্টেশনারি সরঞ্জাম ছাড়াও, নানা তথ্যমূলক প্রকাশনা, দৃশ্য-শ্রাব্য (অডিও-ভিসুয়াল) প্রকাশনা, শিক্ষামূলক সরঞ্জাম, গ্রন্থপঞ্জি নির্মাণ এমনকী নিজেদের প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া দেওয়া। প্রতিষ্ঠার পর পরই, শুধু বই বিক্রিতে আটকে না থেকে, ‘কিনোকুনিয়া’ নানা সময়ে প্রকাশ করে বিভিন্ন সাহিত্যপত্র। ১৯৩৮ থেকে নিজেদের প্রকাশনা বিভাগও প্রতিষ্ঠা করে এই সংস্থা। জাপানে বিশেষ মাপে ছাপা বইপত্রের সঙ্গে একটা মলাট বিনামূল্যে দেওয়ার প্রথা রয়েছে। ‘কিনোকুনিয়া’য় যাঁরা বই কিনেছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো মনে রাখবেন বইয়ের সঙ্গে পাওয়া ব্রাউন-পেপারে ছাপা একটা মলাটের কথা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এর অনুপ্রেরণায় ‘কিনোকুনিয়া’র জন্য এই মলাটের নকশা করেছিলেন ইয়াসুজিরো ফুরুসাওয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বহু ক্ষতি হয়। বোমাবর্ষণে ১৯৪৫-এ ধ্বংস হয়ে যায় ‘কিনোকুনিয়া’। যুদ্ধের আঘাত কাটিয়ে উঠে অতি অল্প সময়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় জাপান। ঘুরে দাঁড়ায় ‘কিনোকুনিয়া’ও। পনেরো লক্ষ ইয়েনের মূলধন নিয়ে শুরু হয় ‘কিনোকুনিয়া বুক স্টোর কোম্পানি লিমিটেড’। যে-বাড়িতে একদিন শুরু হয় ‘কিনোকুনিয়া’র যাত্রা, তার কাঠামোকে মনে রেখে কুনিও মায়েকাওয়ার নকশায় তৈরি হয় আদি বাড়ির প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি জায়গা নিয়ে একটা কাঠের দোতলা বাড়ি। আগের মতোই তার উপরে একটা গ্যালারি। ১৯৪৯-এ বিদেশি বইয়ের বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে শুরু হয় বিদেশি বইয়ের আমদানি। বইয়ের বিপণির সঙ্গেই চালু করা হয় একটা কফিশপ। ১৯৪৫-এ ‘কিনোকুনিয়া’র কর্মী হিসেবে তাঁর স্মৃতিচারণ করে এই বিপণির অর্ধ-শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থে মাসাহিদে হামাদা লিখেহেন, ‘যখন আমি কাজে যোগ দিই, তখন ‘কিনোকুনিয়া’য় জাপানি বইয়ের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ এবং পাশ্চাত্যের বই প্রায় কুড়িটা। … যখন ইংরেজি বই প্রথম এল, তখন সেই বই নিয়ে আসতে আমি গেলাম ব্রিটিশ দূতাবাসে আর জার্মান বই আনতে একটা গাড়িতে গিয়েছিলাম কাছের ডাকঘরে।’
১৯৫৫ থেকে আবার গ্রন্থ প্রকাশে মনোনিবেশ করল ‘কিনোকুনিয়া’। বই কেনাবেচার বাইরে গিয়েও প্রকাশনা এবং নানা সাংস্কৃতিক উদ্যোগের ভিতর দিয়ে ক্রমশ নিজের রুচি এবং অস্তিত্বের ভিন্নতা জাপান এবং সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়ে জাপানের বিশ্ববিশ্রুত এই বইঘর। ১৯৬৫-তে জাপানে তোলা এক ছবিতে কিনোকুনিয়ায় তার কর্ণধার মোইচি তানাবের সঙ্গে দেখা যায় সিমন দ্য বোভুয়া এবং জাঁ-পল সার্ত্রকে। ওই বছরই জাপানে নাটকের ক্ষেত্রে বিশেষ এক পুরস্কার চালু করে ‘কিনোকুনিয়া’। আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোয় ১৯৬৯-এ তার প্রথম বিদেশি শাখার প্রচলন হয়। আমেরিকায় জাপানের মাঙ্গা আর আনিমের বাজার প্রবলভাবে ধরে ফেলে ‘কিনোকুনিয়া’। ১৯৮৯-এ জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে জাপানের সর্ববৃহৎ গ্রন্থপঞ্জি নির্মাণ প্রকল্প ‘ওয়াইন’-এর সূচনা করে ‘কিনোকুনিয়া’। কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের বিবর্তনের সুযোগ গ্রহণ করে প্রসারিত হয়েছে ‘কিনোকুনিয়া’র গতিপথ। শিবুয়ার এবিসুতে গড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যালয়। বইয়ের পাশাপাশি ডিভিডি প্রকাশেও নেমে পড়ে ‘কিনোকুনিয়া’। তার নিজস্ব থিয়েটারগৃহ জাপানের নাট্যচর্চাকে নানা ভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে। শুধু ডিভিডি-বিপণি হিসেবে ‘কিনোকুনিয়া’ যেমন গড়ে তুলেছিল ‘ফরেস্ট প্লাস’, তেমনই ২০০৭ সালে ‘নেট লাইব্রেরি’ স্থাপন করে শুরু হয় তার ই-বুক বিক্রির জয়যাত্রা। ২০১০-এ ডানা মেলে ‘কিনোকুনিয়া’র দুটো নতুন উদ্যোগ হল, পাশ্চাত্যের কমিক-বুকের জন্য স্বতন্ত্র এক কেন্দ্র আর পাশ্চাত্যের চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইপত্রের অন্যতম বৃহৎ বিপণি ‘শিন্জুকু মেডিকেল বুক সেন্টার’। ২০১৩-য় কাদোকায়া আর কোদানশা প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে চালু করা জাপান ইলেক্ট্রনিক লাইব্রেরি গড়ে ওঠে বিদ্যালয় আর পাবলিক লাইব্রেরিগুলোকে ই-বুক ধার দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ‘কিনোকুনিয়া’র দেওয়া পুরস্কারগুলোর অন্যতম ‘কিনোকুনিয়া বেস্ট সেলার অ্যাওয়ার্ড’, যা দেওয়া হয় লেখক এবং প্রকাশককেও। জাপানের চা-সংস্কৃতি সুবিদিত। জাপানি চায়ের ক্যাফে ‘কিনোচা’-ও খুলে তাক লাগিয়ে দেয় কিনোকুনিয়া। জাপানকে বিশ্বে আর বিশ্বকে জাপানে এনে দিতে যেন জুড়ি মেলা ভার ‘কিনোকুনিয়া’র। আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আরব, মায়ানমার আর কম্বোডিয়ার মতো দশটা দেশে ব্যস্ত দিনের শেষে আজ পড়ে থাকে ‘কিনোকুনিয়া’র ছায়া।
২০০৯-এ ‘কিনোকুনিয়া’ শুরু করেছিল সদস্যভুক্তি এবং পয়েন্ট সার্ভিস। ২০২০-তে চালু করা ‘কিনোকুনিয়া পয়েন্ট অ্যাপ’-এর সদস্য প্রায় ৭.৩ মিলিয়ন। নিজের মোবাইল থেকে ‘কিনোকুনিয়া’র অ্যাপ-এ দোকানে আসার আগেই পছন্দের বই খুঁজে ক্যাশ কাউন্টারে পৌঁছে দেবার সুযোগ করে দেয় এই বইয়ের দোকান। সদস্যদের মোবাইলেই নিয়মিত পৌঁছে দেওয়া হয় বই নিয়ে নতুন-নতুন তথ্যের সম্ভার। শুধু তাই নয়, পাঠক এবং ক্রেতাদের পছন্দ-অপছন্দ, পাব্-লাইন-এর মতো অ্যাপ-এ সদশ্য-প্রকাশকদের হাতেও নিমেষে পৌঁছে দেয় ‘কিনোকুনিয়া’, যা প্রকাশনার ক্ষেত্রে হতে পারে বড় এক সহায়ক। ঝকঝকে, সুবিশাল এবং অনেক ক্ষেত্রে বহুতল গ্রন্থবিপণি জাপানের সর্ববৃহৎ বুকস্টোর চেইন ‘কিনোকুনিয়া’র বৈশিষ্ট্য। নিত্যনতুন সাড়া-জাগানো উদ্যোগ, বই আর জাপান নিয়ে আবেগ, সময়ের সঙ্গে তাল রাখার ছন্দ, আর প্রথা ছাড়িয়ে যাবার সাহসে জাপানের এক প্রান্তের ধিকিধিকি-একাকী এক কাঠকয়লা এভাবেই বিশ্বে ছড়িয়ে দিল বইকে ঘিরে জ্বলে ওঠা নিরুত্তাপ এক অগ্নি।