সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ, পদে-পদে নতুন-নতুন ফ্যাকড়া পেরিয়ে অবশেষে গাড়িটা ছাড়ল। এর চাইতে যুদ্ধে যাওয়াও মনে হয় ঢের সহজ কম্মো!
প্রথমে তো থার্ড পোলিং অফিসারের জন্যে একপ্রস্থ নাটক। ভদ্রলোক নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও রিপোর্ট করলেন না। এদিকে চেকলিস্ট মিলিয়ে ভোটের জন্যে সাড়ে পঞ্চান্ন রকম সরঞ্জাম বুঝে নেওয়া। বোলোকের বাবুদের বদান্যতায় মেন বিল্ডিং-এর সামনে এক পেল্লাই ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার নীচে তিলধারণের ঠাঁই নেই। পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন বই-খাতায় শেষবার চোখ বুলিয়ে নেয়, ভোটকর্মীরা তেমনি মগ্ন হয়ে সব কিছু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। ডি.সি.আর.সি. থেকে পাওয়া তাবড়া কাগজের মধ্যে পৌনে উনষাট রকমের ফর্ম আছে কি না, চেকলিস্টের সঙ্গে মেলাচ্ছেন। তাঁরা জানেন, কিছু ভুলচুক হলে মহান গণতন্ত্র রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ বলে কেউ রেয়াত করবে না।
আমাদের মতো যাঁদের সেই মহার্ঘ্য ম্যারাপের নীচে জায়গা জোটেনি, বৈশাখের নির্মেঘ আকাশ থেকে নেমে আসা অবিরল আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কর্তব্য প্রতিপালন করা ছাড়া উপায় নাস্তি।
অভয়পদ রক্ষিত বি.এল.আর.ও. অফিসের আমিন, খাঁটি জার্মান। তিনিই আমার টিমের ফার্স্ট পোলিং অফিসার। মহাশয় ব্যক্তি, অনেকগুলো ভোট করানোর অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। বলতে গেলে গোটা ইলেকশন প্রসিডিওর তিনি গুলে খেয়েছেন। কিন্তু তাঁর উপর যে ভরসা করব, তেমন ভরসা পাচ্ছি নে। ভদ্রলোক শুরু থেকেই নানা রকম প্যাঁচ কষছেন। কন্টিজেন্সির টাকাটা কীভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে, প্রিসাইডিং অফিসারকে যখন বাড়তি টাকা দেওয়া হয়েছে, বাড়তি দায়দায়িত্ব অন্যেরা কেন সামলাতে যাবে, এসব নিয়ে ভদ্রলোকের কূট প্রশ্ন আর চাঁছাছোলা মন্তব্যে মনটা শুরু থেকেই বিরূপ হয়ে উঠেছে। সেকেন্ড পোলিং অফিসার প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টারমশাই। স্বল্পবাক মানুষ, সেকেন্ড ট্রেনিংয়ে প্রথম পরিচয়েই জানিয়ে রেখেছেন, তাঁর হাঁফের ব্যামো। বিস্তর আবেদন-নিবেদনেও ছাড় মেলেনি বলে চাকরি বাঁচাতে ডিউটি করা। কিন্তু বেশি দৌড়ঝাঁপ তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ভোটের মালপত্র তাঁর জিম্মায় রেখে থার্ড পোলিং অফিসারকে খুঁজে বের করার জন্যে একা-একা পুরো চত্বরটা চষে ফেলেও তাঁর টিকির নাগাল পাওয়া গেল না। অগত্যা ডি.সি.আর.সি.-র দেবতাদের কাছে গিয়ে রিজার্ভ থেকে একজন থার্ড পোলিং অফিসার দেওয়ার জন্যে আবেদন-নিবেদন, বিস্তর বাদানুবাদ এবং অজস্রবার ভুল স্বীকারের পর যখন একজন অফিসার সত্যি-সত্যি মঞ্জুর হল, তখন সহাস্যবদনে নিখোঁজ তৃতীয় পাণ্ডবের আগমন।
ফলে এতক্ষণের চেষ্টায় নবলব্ধ ভাড়াটে সেনাকে পুনরায় রিজার্ভ বেঞ্চে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে নতুন করে আবেদন-নিবেদন, কাকুতি-মিনতি এবং ভুল স্বীকারের পুনরাবৃত্তি। ডি.সি.আর.সি.-তে বসা দেবদেবীদের কাছে প্রিসাইডিং অফিসার অনেকটা খুন কিংবা ধর্ষণের আসামির মতো, যেমন ইচ্ছে রগড়ানোটা ওদের নৈতিক কর্তব্য।
এবার পুলিশ খোঁজার পালা। একেই বুঝি সত্যিকারের চোর-পুলিশ খেলা বলে। প্রথমে একক উদ্যোগে খোঁজাখুজি, তারপর অনেক অনুনয়-বিনয় করে বারকয়েক মাইকে ঘোষণা। সকলেই রিপোর্ট করেছেন, অথচ কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। এঁদের দেখেই বুঝি কবিগুরু গেয়েছিলেন, ‘এসেছিলে তবু আসো নাই’!
সকালবেলা গিন্নি ভালো করে খাইয়েদাইয়ে যত্ন করে টিফিন, জলের বোতল, মশার ধূপ, চিঁড়ে-মুড়ি, জেলুসিল, মেট্রোজিল-সহ হাজারও ফাটকি-নাটকির সঙ্গে পকেটে কোন এক ঠাকুরের পায়ের শুকনো একটা জবাফুল গুঁজে দিয়ে তবে ছেড়েছেন! প্রত্যেকবার ভোটে যা গন্ডগোল হয়, তাতে বলা তো যায় না!
ফার্স্ট পোলিং অফিসার হঠাৎ আমার কানে-কানে বললেন, ‘গতিক য্যান সুবিধের লাগদেয়াসে না!’
সভয়ে বুরবকের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে তিনি আবার বললেন, ‘দ্যাহেন নাই, আমাগো বুথে দুই জন রাইফেলধারী দিছে!’
আমি বললাম, ‘ভালোই তো! বাড়তি সিকিওরিটি পাওয়া যাবে! পুলিশকে তো আর আমাদের মারার জন্যে রাইফেল দেওয়া হয়নি। রাইফেল চলবে আমাদের নির্দেশে!’
ভদ্রলোক খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওই আমোদেই থায়েন মোহাই! পুলিশ কি আপনের বাপ, না পুলা? নরম মাটি দ্যাখলে হ্যারা মেকুরের লাহান আঁচড় কাটে, কিন্তু বেগতিক দ্যাকলেই পগার পার! কম ইলেকশন তো করলাম না ভাইডি, অগো আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি!’
‘ভাইডি’ সম্বোধন শুনে বুকে একটু বল এল। যতটা সম্ভব মিষ্টি করে ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতাকে কুর্নিশ করি! তুষ্ট হয়ে তিনি বললেন, ‘দুইজন আর্মড ফোর্স মানেই কেস জন্ডিস! সুপার সেন্সিটিভ বুথ, পরে মিলাইয়া নিয়েন!’
ভদ্রলোকের মুখে বিজ্ঞের হাসি। কিন্তু শুধুমাত্র আর্মড ফোর্স দেখেই ওয়েদার রিপোর্টের মতো উনি জন্ডিস কেস সম্পর্কে আগাম নিশ্চিত হলেও আমি হতে পারলাম না।
উনি বুঝি আমার মুখ দেখে মনের কথা আঁচ করে থাকবেন। বললেন, ‘বিশ্বাস হইল না তো? আপনে ইলেক্টোরাল রোলখান দ্যাকসেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঘুরার আন্ডা দ্যাকসেন! রোলে একডাও হিন্দু নাম পাইছেন? সবগুলানই পবিত্র!’
ভদ্রলোক থুতনিতে হাতের মুঠো ঠেকিয়ে দাড়ির ইঙ্গিত করলেন। তারপর ভয়-ধরানো গলায় বললেন, ‘হ্যাগোরে বিশ্বাস নাই, মোহাই! প্যাঁজ রসুনের ত্যাজ। খাওন-দাওন দেইখ্যা-শুইন্যা কইরেন! কী খাওইয়াইতে কী দিয়া দিব, আপনের জাইত নিয়্যা না শ্যাষে টান পড়ে! আপনে আবার বামুনের পুলা!’
এতক্ষণে ব্যাপারটা খানিকটা খোলসা হল। হেসে বললাম, ‘আমার জাতপাত নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই, আমি ওসব মানিও না, কিন্তু আপনি খাবেন না?’
ভদ্রলোক প্রায় আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘আমারে কি পাগলা কুত্তায় কাটছে? এই দ্যাহেন, ঘর থিক্যা চিড়া-মুড়ি নিয়্যা আসছি। তবে হ্যাঁ, একখান কথা আপনেরে পেত্থমেই কইয়্যা থুই, মুই আপনেগো লগে খাই-না-খাই হেইডা কোনো ফ্যাকটোর না, কন্টিজেন্সির ভাগের পুরা টাকাডা আমারে নগদ দ্যাওন লাগব, হেইডা য্যান মনে থায়ে।’
কথা শুনে মনে হল, কন্টিজেন্সির ওই ক’টা টাকার উপরেই ভদ্রলোকের জীবন-মরণ নির্ভর করছে। হাসি পেয়ে গেল আমার।
মেঠো পথের ঝাঁকুনি আর মিহি ধুলোর আদর খেতে-খেতে এক সময়ে একটা একতলা পাকা বাড়ির সামনে গাড়িটা থামল। ডি.সি.আর.সি. থেকে একটা গাড়িতেই তিনটে পোলিং পার্টি এবং তাদের মালপত্রসমেত লোকলস্কর ট্যাগ করে, অর্থাৎ ঠেসে ভরে দেওয়া হয়েছিল। গাড়িটা থামতে জানা গেল, ছাব্বিশ এবং সাতাশ নম্বর পোলিং বুথের জন্যে বরাদ্দ এই প্রাইমারি স্কুল। আমাদের আঠাশ নম্বর বুথটা আরও খানিকটা দূরে, গাড়ি যাবে না। আলপথ ধরে হেঁটে যেতে হবে। অগত্যা সকলকে লটবহরসমেত নেমে পড়তে হল।
আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই একটা করে ঢাউস ব্যাগে ব্যক্তিগত খাবার-দাবার থেকে শুরু করে বেডিংপত্র, তার ওপর ভোটের বাক্সপ্যাঁটরা, ভোটিং মেশিন এবং হাজারও কাগজের গন্ধমাদন, অথচ থামার উপায় নেই! সারাদিনের খাটাখাটুনি-দৌড়ঝাঁপে শরীর অবসন্ন হলেও উপায় কী, মহান গণতন্ত্র রক্ষার দায় সামলানো কি মুখের কথা! অতএব চলো মুসাফির, উঠাও গাঁটরি!
সাইকেল মেসেঞ্জার ছোকরা আমাদের অবস্থা দেখে ভোটিং মেশিনখানা সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে পথ দেখিয়ে চলল। রাইফেলধারীরা শান্তিরক্ষক, ফলে শান্তি বিঘ্নিত না হওয়া পর্যন্ত কোনও কিছুতেই হাত লাগাতে তারা রাজি নয়। অভয়পদ পদে-পদে ভয় দেখিয়ে চলেছেন, ‘কন্টিজেন্সির টাকার থিক্যা হালার পো হালাগো এক কাপ চাও যদি খাইতে দিছেন, তয় জানবেন, আপনের লগে আমি নাই। মনে রাইখেন, ভোট কিন্তু একজনের কাম না!’
বৈশাখের গনগনে সূর্যটা তখনও চাঁদির উপর অকৃপণ ভাবে আগুন ঢেলে যাচ্ছে, সারা গায়ে ঘামের উপর এক পরত ধুলোর আস্তরণ, তার উপরে অভয়পদ-র নিষ্ঠাভরে এই অনলস ভীতি প্রদর্শনে হাসব না কাঁদব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
প্রায় মাথার ওপর নেমে আসা করোগেটেড টিনের একটা পরিত্যক্ত চালাঘরের সামনে থেমে সাইকেল মেসেঞ্জার ছোকরা দাঁত বের করে বলল, ‘ছার, এই আপনাদের বুথ।’
মালপত্র কাঁধ থেকে নামিয়ে বুথটা ভালো করে নজর করে দেখি। মাটির দেওয়ালে বড়-বড় ফাটল, এবড়োখেবড়ো মেঝের জায়গায়-জায়গায় ইঁদুরে মাটি তুলে ডাঁই করে রেখেছে, ইলেকট্রিক সংযোগের বালাই নেই। মেসেঞ্জার ছোকরার দিকে তাকাতে সে বলল, ‘আগে একেনেই প্রাইমারি স্কুল বসত, একন সব্বশিক্ষে মিশনের নতুন বাড়িতে সে ইস্কুল উঠে গেচে, অতএব ছার…’
আমাদের ছেড়ে দিয়ে সেক্টর অফিসে আমাদের আগমনবার্তা পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্ব তার ঘাড়ে। ফলে সে আর দাঁড়াল না। তড়িঘড়ি সাইকেলে উঠে প্যাডেল মারতে-মারতে দ্বিচক্র শকটারূঢ় নব্য সঞ্জয় আমাদের সাবধান করে দিয়ে গেল, ‘চাদ্দিকে ভালো করে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দেবেন ছার। একেনে খরিস আর আল কেউটের বড় উৎপাত!’
টিনের চালার মধ্যে মালপত্র রেখে সামনের এক চিলতে খোলা চত্বরে চট বিছানো হল। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরোবার পর থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি। পেটে ছুঁচোয় ডন দিতে শুরু করেছে। সঙ্গে খাবার-দাবার অবশ্য কিঞ্চিৎ আছে। কিন্তু সর্বাঙ্গে ধুলো আর ঘামের পুরু আস্তরণ, তার ওপর সারাদিন রোদ খেয়ে শরীর জ্বলে যাচ্ছে; খাবারে হাত দেবার আগে একবার চান না করলেই নয়! অথচ আশপাশে কোনও টিউবওয়েল নজরে আসছে না।
লটবহর সমেত ভিনদেশি লোক দেখে গাঁয়ের কচিকাঁচারা এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। বেশির ভাগেরই আদুল গা, রুগ্ন কালোকোলো চেহারা, তার মধ্যে দু’একটা একেবারে ন্যাংটোপুটো। রাইফেলধারী পুলিশদের তারা খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনছে বলে মনে হল না।
অভয়পদ ইতিমধ্যেই একটা পেল্লাই টিফিনকৌটো খুলে দিস্তে-দিস্তে লুচি গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছেন। আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘কী মোহাই! সঙ্গে খাবার-দাবার কিছু আনেন নাই?’
বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘সে-খবরে আপনার কী দরকার মশাই? নিজেরটা নিয়ে তো দিব্যি বসে পড়েছেন!’ কিন্তু বললাম না। প্রিসাইডিং অফিসার মানে কন্যাদায়গ্রস্ত বাপ, সকলের মন জুগিয়ে কাজ উদ্ধার না করতে পারলেই কেলো।
রাস্তা দিয়ে কয়েকজন লোক যাচ্ছিল। বাক্সপ্যাঁটরাসমেত ভোটবাবুদের দেখে তারাও দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে তাকাতে-তাকাতে ওদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ভোটের কাজে এসেছেন বুঝি?’
প্রশ্নকর্তার পরনে হাতকাটা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি; থুতনির নীচে সামান্য দড়ির আভাস। কিন্তু হাসিখানা ভারি আন্তরিক।
ঘাড় নেড়ে ছেলেটির দিকে তাকালাম। সে বলল, আপনারা কোনও চিন্তা করবেন না দাদা। খুবই শান্তিপূর্ণ জায়গা।
এবার ভালো করে খুঁটিয়ে দেখি ছেলেটিকে। বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ হবে বড়জোর। শ্যামলা গায়ের রং, কিন্তু নাক-চোখ-মুখ বেশ সুন্দর, অনেকটা মহাভারত সিরিয়ালে দেখা কৃষ্ণরূপী নীতিশ ভরদ্বাজ যেন!
ট্রেনিং-এর সময় আমাদের পই পই করে সাবধান করা হয়েছিল, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে যেন একদম মাখামাখি না করি। কে কোন দলের, কার সঙ্গে কথা বললে কার গোঁসা হবে, আগাম বোঝা মুশকিল।
সকলেই জানে, পঞ্চায়েত মানে করে খাওয়ার জায়গা! সেই ভোটে পক্ষপাতিত্ব কিংবা কারচুপির অভিযোগে হাঙ্গামা হলে স্বয়ং ভগবানও বাঁচাতে পারবেন না। একশো শতাংশ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে মহান গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে!
ভাবলাম, ওসব কেতাবি সাবধানবাণী মাথায় থাক, আপাতত যে করেই হোক একটু চান না করতে পারলে প্রাণে মারা যাব! মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘আচ্ছা ভাই, আশপাশে কোনও টিউবওয়েল নেই? একটু চান না করতে পারলে…’
ওদের মধ্যে একজন বলল, ‘থাকবে না কেন? ওই যে বাঁশঝাড়খানা দেখছেন, ওটা পেরিয়ে গেলেই একটা চাপাকল। তবে গ্রীষ্মকাল তো, এক বালতি পানি তুলতি বাপের নাম খোদাবক্স হয়ে যাবে!’
আগের ছেলেটি আসা ইস্তক হাসি-হাসি মুখে আমাকে জরিপ করছিল। সে বলল, ‘আপনি সাঁতার জানেন? একটু এগোলেই হালিম মিয়ার পুকুরে এখনও টলটলে পানি। যাবেন তো চলেন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
পাশ থেকে ওর সঙ্গী টিপ্পনী কাটল, ‘পানি বলছিস যে বড়? দু’দিনেই বুঝি বড় মুছুল্লি হয়ে গিয়েছিস, তাই না?’
ওপাশ থেকে আরেকজন ফুট কাটল, ‘হালে হলি মোচলমান, দেশের গরুর যায় জান!’
লুঙ্গি-কেষ্টর মুখে অপ্রস্তুতির হাসি। কথা না বাড়িয়ে চললাম ওর পিছু-পিছু।
সত্যিই হালিম মিঞার পুকুরে টলটলে ‘পানি’। সেকেন্ড পোলিং অফিসারও আমার সঙ্গে এসেছিলেন। ট্রেনিং-এর প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ক’টা বাক্য বলেছেন গুনে বলে দিতে পারি। বুক-জলে দাঁড়িয়ে কুলকুচি করতে-করতে তিনি পশ্চিমদিকে তাকিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দেখুন, দেখুন!’
চমকে তাকিয়ে দেখি অজস্র গাছগাছালির মাথায় যেন রাশি-রাশি রক্তিম আবির ছড়ানো। পুকুরে তার ছায়া পড়ে বেবাক ‘পানি’ও লালচে হয়ে উঠেছে। সূর্যাস্তের এমন অপরূপ শোভা আগে কখনও দেখেছি কি না মনে পড়ে না। টলটলে ‘পানি’তে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে শরীর জ্বলুনি অনেকটাই প্রশমিত হয়ে এসেছিল। এবার সূয্যিদেবের সাড়ম্বর অস্তাচল গমনের দৃশ্য দেখতে-দেখতে ভোটের কথা প্রায় ভুলেই গেলাম।
রাতভর পড়াশুনো করেও প্রশ্নপত্র দেখে সব গুলিয়ে যাওয়ার মতো ট্রেনার আর শুভানুধ্যায়ীদের যাবতীয় সতর্কবার্তা আসল সময়ে এক্কেবারে ঘেঁটে ঘ! কথায়-কথায় ওদের সঙ্গে যে কখন ভাব হয়ে গেছে, টেরই পাইনি।
আশেপাশে কোনও হোটেল থাকার কথা নয়। তবু পেটের চিন্তায় সে-কথা তুলতেই লুঙ্গি-কেষ্ট বলল, ‘মোচলমানের মেয়ের রান্না খেতে যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনওকালেই কোনও সংস্কার ছিল না। পোলিং পার্টির অন্যান্যরাও রাজি হয়ে গেল। শুধু অভয়বাবু ছাড়া। তিনি চিঁড়ে-মুড়ির স্তূপের উপর অটল হয়ে বসে রইলেন।
ছেলেটি বলল, ‘তবে আপনারা কাজকম্মো করুন, আমি দেখি, রান্নাবান্নার কী ব্যবস্থা হয়। আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই, আমিই রাতে খাবার পৌঁছে দেব। আপনারা হলেন গাঁয়ের মেহমান! না খাইয়ে তো আর রাখা যায় না!’
ওরা চলে যেতেই অভয়বাবু রাগে ফেটে পড়লেন, ‘আচ্ছা মাথামোটা লোক তো মোহাই আপনে! চিনা নাই, জানা নাই, কুন পার্টির লোক হেইডা পয্যন্ত জিগানো নাই, ফস কইর্যা খাওনের কথাডা কয়্যা ফ্যালাইলেন! আমি সাফ কয়্যা দিত্যাসি, পরে যদি চিপায় পড়েন, হ্যার মইদ্যে য্যান আমারে জড়াইয়্যেন না!’
তারপর নিজের মনেই গজগজ করতে লাগলেন, ‘কী কী খাইবার দিব, কত দাম নিব, হেই কথাগুলান তো অন্তত জিগাইবার লাগে! শ্যাষে আলুভর্তা-ভাত দিয়্যা যহন একশো টাকা দাবি করব, তহন ট্যার পাইবেন মজা কারে কয়! এই পাজিগুলানরে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি। আগের বার ক্যাকড়াখুলিতে ভোটে গিয়্যা সে কী প্যাঁচে পড়সিলাম রে ভাই! যাউক গা হেই কথা। ভোট শ্যাষে কন্টিজেন্সির মোর ভাগ থিক্যা পাচডা পয়সাও ছাড়ুম না, হেইডা য্যান ভুল্যেন না।’
ভদ্রলোক আয়েস করে বিড়ি ধরালেন।
এবার বাসর সাজাবার পালা। তে-ঠেঙে টেবিলটাকে চট দিয়ে ঘিরে ভোটিং কম্পার্টমেন্ট বানাতে হবে। ছোটবেলায় কঞ্চি-বাখারি দিয়ে এমন বিস্তর খেলাঘর বানিয়ে রান্নাবাটি থেকে বর-বউ, সবই খেলেছি বটে, কিন্তু ভোটিং কম্পার্টমেন্ট বানাতে গিয়ে আমার শৈশবে শেখা যাবতীয় বিদ্যা ফেল। একপাশ খাড়া রাখতে গেলেই আরেক পাশের চট ঝুলে যায়!
এর মধ্যেই রাইফেলধারী শান্তিরক্ষকদের একজন বারকয়েক এসে ক্ষোভ জানিয়ে গেছেন, ‘নিজেদের খাওয়ার ব্যবস্থা তো ঠিকই করে ফেললেন, আমাদের কথা একবার ভাবলে না!’
থার্ড পোলিং অফিসারের আর্জি, ‘জীবন বাজি রেখে ভোট করতে এসেছি, মাগ্যিগণ্ডার বাজারে সরকার ডি.এ. দেওয়ার নাম করছে না। দেখবেন স্যার, সব টাকা যেন খেতে না চলে যায়! দুটো টাকা যদি ঘরে না নিয়ে যেতে পার, তাহলে ডিউটি করে লাভ কী!’
হক কথা। ডি.এ.-বঞ্চিত গণতন্ত্রের মহান রক্ষক ভোটের কাজে উপরি পাওয়া সব ক’টা টাকাই যদি খেয়ে শেষ করে দেয়, তাহলে বাড়িতে মুখ দেখাবে কোন লজ্জায়!
‘কী মোহাই, অমন উদাস হইয়্যা ভাবেন কী? স্বাক্ষরখান ছোডো কইর্যা করেন! এত্তগুলান ফর্ম, লম্বা কইর্যা লেখলে তো স্বাক্ষর করতেই রাইত কাবার হয়্যা যাইব গা! আপনে প্রিসাইডিং হয়্যা দুইডা টাকা বেশি পাইছেন বটে, কিন্তু স্বাক্ষর করতে করতেই পুঙ্গা দিয়্যা রাঙ্গা হুতা বাইর্যাইয়্যা যাইব, কয়্যা দিলাম!’
ফার্স্ট পোলিং অফিসার আয়েস করে মুড়ি চিবুতে চিবুতে হাসেন।
অনেক কষ্টে প্রাথমিক কাজটুকু সারতে-সারতে ঘড়ির কাঁটা দশটায়। এখনও রাতের খাবার আসার নাম নেই। রাত্রে কোথায় শোওয়া হবে, সেটা এক গভীর গবেষণার বিষয়। সারা ঘরে ইঁদুরের গর্ত, কোনটা দিয়ে যে কেউটে ফণা বের করবে, সেই আতঙ্কে সকলেই দিশেহারা। থার্ড পোলিং অফিসার সারা ঘরে বার বার কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে চলেছেন, তবু ভয় যায় না। হ্যারিকেনের আলোটাকে যতটা সম্ভব উসকে নিয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সরকারি হ্যারিকেনের সেটা সহ্য হল না। দপ দপ করে সেই যে তিনি চোখ বুজলেন, আবার জ্বালায় কার বাপের সাধ্যি! অগত্যা সরকারি টেন্ডারে কেনা লিকলিকে মোমবাতি ভরসা।
ইঁদুরের গর্ত বাঁচিয়ে বিছোনো শতরঞ্চির উপর পেটে কিল মেরে দেহরক্ষা করা যখন এক প্রকার সাব্যস্ত হয়ে গেছে, হেনকালে অ্যালুমিনিয়াম-নির্মিত তৈজসাদি-সহ তাহাদের আগমন! আমরা হইহই করে উঠতে লুঙ্গি-কেষ্ট একটু অপ্রস্তত হয়ে হাসল।
‘একটু দেরি হয়ে গেল দাদা। আপনি বামুন শুনে আমার বউ তো প্রথমে রাঁধতেই রাজি হচ্ছিল না, পাছে বামুনের ছেলের জাত চলে যায়!’ লুঙ্গি-কেষ্টর মুখে লাজুক হাসি।
‘ও, তোর বউ বুঝি এই প্রথম বামুনের জাত মারল?’
পাশ থেকে ওর বন্ধু ফুট কেটে খিক খিক করে হাসতে লাগল। লুঙ্গি-কেষ্ট সে-টিপ্পনীকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘ওদের আজাবাজে কথায় কান দেবেন না তো দাদা! গরম-গরম খেয়ে নেন। বউ বলে দিয়েছে, রান্না যা হয়েছে, ঠান্ডা মেরে গেলে আর গলা দিয়ে নামবে না।’
মোটা লালচে চালের ভাত, ডাল, আলুভাজা আর হাঁসের ডিমের ঝোল। পেটে খিদে ছিল বলে নয়, রান্নাটা সত্যি ভাল। তার উপরে ভাতটা বেশ অন্য রকম, সম্ভবত ঢেঁকি-ছাঁটা চালের।
আমি বললাম, ‘বাহ! তোমার বউ তো চমৎকার রাঁধে! বিশেষ করে ডিমের ঝোলটা অপূর্ব!’
‘ওই ডিম খুঁজতে গিয়েই তো এত দেরি! পাইকারদের জ্বালায় কারো ঘরে ডিম রাখবার জো আছে? সারা পাড়া ঘুরে এই ক’টা মাত্তর পেয়েছি।’
‘আচ্ছা, এই যে তুমি আমাদের খাওয়াচ্ছ, এ-নিয়ে আবার কোনও ঝামেলা হবে না তো? মানে এবার ভোট নিয়ে যা হচ্ছে চারিদিকে!’
‘আপনি নিশ্চিন্তে খান দাদা। আমি কোনও পার্টির নই। তার ওপরে আমি আপনার বুথের ভোটারও নই। আমার ভোট ছাব্বিশ নম্বর বুথে। আপনাদের গাড়ি যেখানে থেমেছিল, সেখানেই আমার আদি বাড়ি। আমার বাবা শশধর চট্টোপাধ্যায় ওই প্রাইমারি ইস্কুলের হেডমাস্টার।
‘সে কী! তবে যে তুমি তখন থেকে বলে আসছ, মুসলমানের মেয়ের রান্না?’
প্রশ্ন শুনে কেষ্টঠাকুরটি লাজুক হাসল। ওর বন্ধুরা মজা পায়ে ওকে চেপে ধরল, ‘বল, এবার বল, ব্যাপারখানা কী?’
ছেলেটি বারকয়েক ঘাড়-টাড় চুলকে লজ্জায় বেগুনি হয়ে অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে শুরু করল, ‘সে এক কাণ্ড দাদা! আমি বামুনের ছেলে হলে কী হবে, আমার শ্বশুরের নাম কুরবান আলি। এই গ্রামেরই মানুষ, জমিজমা কিছু আছে, চাষবাস করেন। বি.এস.সি. পাশ করে চাকরির চেষ্টার সঙ্গে-সঙ্গে টুকটাক টিউশনি শুরু করেছিলাম। আর সেখান থেকেই সাকিনার সঙ্গে ভাব। তার পর যা হয় আর কি! সেই বস্তা-পচা প্রেমের গল্প। সাকিনা অবশ্য আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল, তুমি বাপ-মার কথা অমান্যি কোরো না। আমি মোচলমানের মেয়ে, আমার জন্যে তোমার ধম্মো নাশ হলে লোকে আমাকেই দুষবে।’
আমিও জেদ ধরে বসে রইলাম। সাকিনাকে যতবার জিজ্ঞেস করি, তোর যদি অমত থাকে তো বল, ততবারই সে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘বলছি তো আমার মত নেই!’ কিন্তু দাদা, সে-কথা বলতে গিয়ে প্রত্যেকবার সে কেঁদে ভাসায়!
লায়লা-মজনুর প্রেমের উপাখ্যান শুনতে-শুনতে আমাদের খাওয়া যে কখন থেমে গেছে, টের পাইনি। ছেলেটি বলল, ‘কী হল দাদা, আপনারা খান। ঝালটা মনে হয় বেশি দিয়ে ফেলেছে সাকিনা। মোচলমানের ঘরের রান্নার হাত তো!’
লুঙ্গি-কেষ্ট দাঁত বের করে হাসে।
‘আমার বাবা তো বৃত্তান্ত শুনে আমাকে জুতোপেটা করল। মা কান্নাকাটি শুরু করে দিল। এমনকী আত্মহত্যা করবে বলে ভয়ও দেখাল। আমার শ্বশুর নিরীহ চাষি মানুষ, লেখাপড়া বিশেষ জানেন না, কিন্তু অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েন। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, ‘শ্যামল, তুমি জাত-ধম্মো না মানলিও অন্যরা তো মানে! আমাদের জাতের লোকরা তলে তলে জোট বাঁধছে। ওদিকে হিঁদুপাড়ার লোকেরাও এককাট্টা হয়ে উঠেছে। শেষে তোমাদের জন্যে যদি একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেঁধে যায়, তখন দু’পক্ষেরই ক্ষয়-ক্ষতির শেষ থাকবে না। তার চাইতে তুমি মত বদলাও। আমার মেয়েরে আমি যে করে হোক বুঝিয়ে-সুজিয়ে…’’
মোমবাতির কাঁপা-কাঁপা আলোয় কেষ্টঠাকুরের চোখে যেন রাজ্যের বিষণ্ণতা। কিন্তু পরক্ষণেই হাসতে-হাসতে বলল, ‘আপনি কখনও টের পেয়েছেন কি না জানি নে দাদা, মন এমন জিনিস, একবার দিয়ে ফেললে আর ফেরানো যায় না।’
‘তোমার বউ বুঝি খুব সুন্দরী?’
‘অন্যদের চোখে হয়তো না। আমার মা তো বলে, সাড়া গাছের পেত্নি ঘাড়ে চেপেই আমার সর্বনাশটা করেছে! ওরা তো আর আমার চোখ দিয়ে দেখে না দাদা! আমার চোখে সে…’
হঠাৎ লজ্জা পেয়ে শ্যামল চুপ করে গেল। আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাসনপত্র গোছাতে-গোছাতে বলল, ‘রান্না যদি খারাপ না লেগে থাকে দাদা, কাল দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থাও আমিই করি?’
আচমকা ফার্স্ট পোলিং অফিসারের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, এবার খাবারের দরদাম জেনে নেওয়া যাক। তাতে যদি ‘মাথামোটা’ বদনাম ঘোচে। কিন্তু সে-কথা পাড়তেই শ্যামল হেসে উঠল। বলল, ‘ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না দাদা। দু’টো ডাল-ভাত বই তো নয়!’
‘তবুও দামটা জেনে রাখলে উভয়পক্ষের সুবিধে হয়, তাই না?’
‘সে পরে হবে, দাদা। ছিলাম যজমানি বামুন মাস্টারের ছেলে, এখন মোচলমান চাষার জামাই। নিজে টিউশ্যানি করি, সেলাই-ফোঁড়াই করে, হাঁস-মুরগি পেলে বউও কিছু রোজগার করে। ভাতের হোটেলের ব্যবসা এই প্রথম। দেখি আমার কাত্তিকদাদার গলা কতটা কাটা যায়!’
আমি বললাম, ‘কাত্তিকদাদাটি আবার কে?’
সে হেসে বলল, ‘কেন, আপনি? প্রথম নজরেই আপনাকে ঠিক কাত্তিক ঠাকুর মনে হয়েছিল আমার। বউকে গিয়ে বললাম, দেখতে তো পেলি নে, হিঁদুদের কাত্তিক ঠাকুর কেমন দেখতে হয়! দাদাকে দেখলে বুঝতিস। সে কথা শুনে বউ তো আরও বেঁকে বসেছিল। মানুষ হলে তাও মানা যায়, তাই বলে ঠাকুর-দেবতার জাত নিয়ে কথা? আমি কী বলেছি জানেন দাদা? আমি বলেছি, ঠাকুর-দেবতা কি মানুষ, যে, কথায়-কথায় তাঁদের জাত যাবে?’
এবার আমার অপ্রস্তুত হওয়ার পালা। গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, আর খোসামোদ করতে হবে না। কিন্তু কাল ভোট চলার সময় সবাই তো আর একসঙ্গে খেতে পারব না, একজন-একজন করে, সে অনেক হাঙ্গামার ব্যাপার, শ্যামল।’
‘আমি এখন সামসুল, দাদা।’
‘সে কী! তুমি নাম বদলে ফেলেছ?’
‘শুধু নাম? ধর্মটাও। শ্যামল চাটুজ্জে থেকে সামসুল আলম। বউ একেবারেই চায়নি, জানেন দাদা? বলেছিল, ‘তোমার ধর্মে তুমি থাকো, আমার ধর্মে আমি। সম্রাট আকবরেরও তো হিন্দু মহিষী ছিল!’ কিন্তু একদিকে হিন্দু রাজনীতির লোকরা লেগে গেল আমার পিছনে, অন্যদিকে মুসুল্লি-মৌলবিরা আমার নিরীহ শ্বশুরকে শাসাতে লাগল, শশধর মাস্টারের ছেলে তোমার বাড়িতে এলে গরু জবাই করার মতো করে জবাই করে ফেলব। মাঝখানে পড়ে সাকিনা আমার দিনরাত কাঁদে। একটাই তো জীবন দাদা, একটা মেয়েকে ভালবেসে নাহয় ধর্মটাই দিলাম!’
হাসতে-হাসতে সামসুল আলম থালাবাসন গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু মোমবাতির আলোয় ওর মুখখানা দেখে মনে হল, অনেক কান্না যেন সেখানে জমা হয়ে আছে।
আলো নিভিয়ে ভূমিশয্যা নিলাম বটে, কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। সাপের ভয় আর ভোটের হাজারও ঝঞ্ঝ্বাটের দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে শ্যামল-সাকিনার প্রণয়কাহিনি আমার মাথায় ঘুরতে লাগল।
এপাশ-ওপাশ করতে-করতে শেষ রাতের দিকে হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মসজিদের মাইকে ফজরের আজানে ঘুম ভেঙে গেল।
ভোটের দিন সকাল থেকেই বুথের সামনে লম্বা লাইন। একটা বুথে সাড়ে ন-শো ভোটার, প্রত্যেকের জন্যে তিনবার করে ব্যালট ইস্যু করা যে সহজ কম্মো নয়, তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছিলাম।
দিনভর আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরতে লাগল। ঘরে আলো নেই, বাতাস নেই, তার উপরে প্রায় মাথায় কাছে নেমে আসা টিনের চাল, সব মিলিয়ে গোটা ঘরটাই যেন একটা অগ্নিকুণ্ড। ভোটারদের যাতে দেখতে অসুবিধে না হয়, তার জন্যে ভোটিং কম্পার্টমেন্টের মধ্যে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে রাখতে হয়েছে। ফলে একদিনেই সারা গায়ে লাল-লাল ফোস্কা।
এত হাঙ্গামার মধ্যেও সামসুল যত্ন করে মাছের ঝোল-ভাত খাইয়ে গেছে। তবে ওর সঙ্গে কথা বলার অবকাশ হয়নি। বিকেল পাঁচটার সময়েও লাইনে জনা পঞ্চাশেক ভোটার। তবে একটাই সান্ত্বনা, বিরোধীশূন্য বুথে ভোট নির্বিরোধে সাঙ্গ করা গেছে। পোলিং পার্টির সকলের মুখেই স্বস্তির হাসি।
তবে শেষেরও শেষ থাকে। অসংখ্য প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ করা, সেগুলো নানা আকার ও প্রকারের খামে ভরে সিল করা, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনখানা কাপড়ে মুড়ে দফায়-দফায় সিল করা, সব মিটতে-মিটতে সন্ধে প্রায় কাবার। এবার সেসব ঘাড়ে নিয়ে আলপথে হেঁটে সেই গাড়ির কাছে পৌঁছনোর পালা।
কাজ শেষে বাইরে বেরিয়ে দেখি ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় পুরো চত্বরটা ভেসে যাচ্ছে। আজ বোধ হয় পূর্ণিমা। একটু দূরে সামসুল দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ে গেল, এবার পাওনাগণ্ডা মেটাবার পালা। মনে-মনে ক’টা মিল হয়েছে হিসেব করতে-করতে সামসুলকে ডাকলাম।
অবাক হয়ে দেখি আমগাছের আড়াল থেকে শাড়ি পরা একটা মেয়ে বেরিয়ে সামসুলের সঙ্গে আসছে। কাছাকাছি এসে বলল, ‘দাদা আমার বউ, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করবে বলে এসেছে। তারপর মেয়েটির দিকে ফিরে বলল, কাছে আয় সাকিনা, লজ্জা কী, এই তো আমার কাত্তিকদাদা!’
সাদামাটা চেহারা, প্রসাধনহীন মুখ, সস্তা তাঁতের শাড়ি, হাতে পলার মতো দেখতে লাল কাচের চুড়ি, চোখে সরল ভীরু চাহনি। কিন্তু চোখ আটকে গেল ওর কপালজোড়া মস্ত টিপে। জানা না থাকলে হিন্দু-মুসলমান ফারাক করা যেত না। তবু চাঁদের আলোয় বড় ভাল লাগল মেয়েটিকে। কেমন যেন এক নজরেই মায়াকাড়া মুখ। সামসুল বলল, ‘দাদা, ও আপনাকে একটা প্রণাম করতে চায়। আমার নিজের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, কাউকেই তো প্রণাম করার সুযোগ পায়নি। ওর বড় সাধ!’
বলতে-বলতে সামসুলের গলা বুজে এল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখি, চাঁদের আলোয় তার চোখজোড়াও চিকচিক করছে। নীচু হয়ে সে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
আমি বললাম, ‘শ্যামল, তোমার টাকাটা…’
‘আজ ওসব কথা থাক দাদা। আপনাকে প্রণাম করতে দিয়ে আমার সাকিনার এতদিনের সাধ পূরণ করে দিলেন, এর দাম কি কিছু কম দাদা?’
হাসতে-হাসতে কেঁদে ফেলল সামসুল। ধরা গলায় বলল, ‘গ্রামটা তো চেনা হয়ে গেল দাদা। যদি কখনও আমাদের কথা মনে পড়ে, একবার অন্তত আসবেন। আমার তরফে তো কোনও আত্মীয়স্বজন নেই!’
ফেরবার জন্যে অন্যেরা ডাকাডাকি করতে লাগলেন। মালপত্র বাঁধাছাঁদা করে আমার টিম যাওয়ার জন্যে তৈরি। থার্ড পোলিং কোত্থেকে একটা সাইকেলভ্যান জোগাড় করে এনেছে। সেটাতেই চাপানো হল সব। মসজিদের মাইকে ঈশার আজান ভেসে আসছিল। পেছন ফিরে দেখলাম, ফিনকি দেওয়া জ্যোৎস্নায় গা ডুবিয়ে ওরা তখনও আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার মুখে হয়তো বেদনার কোনও ছায়া ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে ফার্স্ট পোলিং অফিসার সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, যা যা কইসিলাম, মিলছে ত? আপনের মুখ দেইখ্যাই বুঝছি, হেই আপনের গলা কাটছে! তা কত খসছে?’
আমি ঘড়ঘড়ে গলায় বললাম, ‘সে-কথা আর নাই বা শুনলেন! ভয় নেই, কন্টিজেন্সি থেকে আপনার ভাগের পুরো টাকাটাই পাবেন।’
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত