ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোকিত ছায়াপথের শেষে


    শ্রীজাত (December 31, 2021)
     

    এই বছর নাহয় কোভিডের নবতম ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে, তাই বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটের উত্তাল ভিড় দেখে ভয় সিঁটিয়ে যাচ্ছি আমরা। যেমন পুজোর সময়েও আতঙ্কিত হচ্ছিলাম অনেকে। কিন্তু কোভিডকে যদি স্মৃতির অভিধান থেকে বাদ দিই, তাহলে বলতে পারি, পার্ক স্ট্রিট, সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল আর বো ব্যারাক-সহ কলকাতার নানা অঞ্চলে বড়দিনকে ঘিরে যে-ঝলমলানি চলকে ওঠে প্রতি বছর, আমার অন্তত তা মন্দ লাগে না। কিন্তু আমি অনেককে চিনি, যাদের বেশ মন্দ লাগে। তাঁদের কথা হল এই যে, কলকেতায় এমন ম্লেচ্ছ মোচ্ছব হবে কেন? যিশুখ্রিস্ট সাহেবদের দেবতা, সেই খোদ সাহেবদের দেশেও এমন বাঁধনহারা উদযাপন হয় না বড়দিনে। হ্যাঁ, মানুষজন ঘরবাড়ি সাজায়, নতুন কেনাকাটা করে, বাড়িতে-বাড়িতে ভোজ বসে ঠিকই। কিন্তু এই যে শহরের রাজপথে লাখো মানুষের ভিড় বইয়ে দেবার পাগলামি, সে এমনকী তাঁদের ফর্সা দেশেও নেই। খামোকা আমাদের বাদামি শহরে এত মাতামাতি কীসের বাপু?

    এখন এ-প্রশ্নের সত্যিই কোনও লাগসই উত্তর নেই। কলকাতা তার পুরাতনী সময়ের উত্তরাধিকার হিসেবে বাবু শ্রেণির, বিবি গোছের কিছু মানুষজন রেখে দিয়েছে, যাদের অনেক কিছুতেই আপত্তি। ভাবখানা এমন যেন, এ-শহর তাঁদেরই পত্তন করা, এবং এর পতনও তাঁরাই করে যাবেন। অন্য কিছু সেখানে চলবে না। আমিও এঁদের কিছু-কিছু চিনি। প্রত্যেক বছর শীতের কোনও-না-কোনও আড্ডায় এঁরা এই বলে আক্ষেপ করেন যে, শহরটা গোল্লায় গেল। নইলে কোথাকার কোন এক বড়দিনকে ঘিরে এমন আলোয়-আলোয় সেজে উঠতে পারে কলকাতা? নইলে ভিড় সামলাতে মোড়ে-মোড়ে পুলিশ নামাতে হয় কখনও? নইলে গির্জের বাইরে লাইন দিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, ক্যারল শুনবে বলে? নইলে দোকানপাটে বিক্কিরি দশগুণ হয়ে যেতে পারে এই একটা দিনের আনন্দকে ঘিরে?

    এই গেল-গেল রব অবিশ্যি কেবল ক্রিসমাসকে ঘিরে নয় তাঁদের, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত কিছুকে নিয়েই এ-ধরনের ওজর-আপত্তি তাঁরা জাহির করেই থাকেন। আমার কাজ যদিও মনে-মনে সেসব উড়িয়ে দেওয়া, নাকচ করা। মনে-মনেই, কেননা এসব মানুষের সঙ্গে তর্ক করতে নেমে আখেরে গলা ব্যথা ছাড়া লাভ কিছুই হয় না। এঁরা ঠিক করেই আসেন কী ভাববেন এবং কোনটাকে খারাপ বলবেন। স্বয়ং চার্চিল এসে বললেও তাঁদের মত পাল্টাবে বলে মনে হয় না, আমি তো কোন ছার! বরং জোর গলায় এসব তক্কো যখন চলে, আমি দেখতে পাই আলোয়-আলোয় মোড়া, ঝলমলিয়ে বয়ে যেতে থাকা এক প্রাণবন্ত কলকাতাকে, যাকে দূর থেকে দেখে, কাছ থেকে ছুঁয়ে, নিজের শহর বলে ভাবতে ভারি গর্ব হয় আমার। তার কারণ আর কিছুই নয়, কেবল এই যে, কলকাতা পেরেছে নানান সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে নিজের স্রোতে অনায়াসে মিশিয়ে নিতে, মিলিয়ে নিতে। অনায়াসে বললাম বটে, কিন্তু কাজটা তেমন সহজ নয়। হলে, সব শহরই এমনটা পারত। কিন্তু কলকাতা পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকখানা শহরের একটা, যার আগল সবসময় সকলের জন্য, সমস্ত কিছুর জন্য খোলা। এই ব্যাপারটা সহজ নয় মোটেই।

    যিশুখ্রিস্ট সাহেবদের দেবতা, সেই খোদ সাহেবদের দেশেও এমন বাঁধনহারা উদযাপন হয় না বড়দিনে। হ্যাঁ, মানুষজন ঘরবাড়ি সাজায়, নতুন কেনাকাটা করে, বাড়িতে-বাড়িতে ভোজ বসে ঠিকই। কিন্তু এই যে শহরের রাজপথে লাখো মানুষের ভিড় বইয়ে দেবার পাগলামি, সে এমনকী তাঁদের ফর্সা দেশেও নেই। খামোকা আমাদের বাদামি শহরে এত মাতামাতি কীসের বাপু?

    সহজ নয়, কেননা কেবল মানুষ দিয়ে একটা শহর তৈরি হয় না। তা যদি হত, তা হলে সব শহরের দরজাই সকলের জন্য কিছুটা খোলা থাকত। খোদ কলকাতাতেই তো এমন মানুষেরও অভাব নেই, যারা মোটেই অপর সংস্কৃতি, অন্য ধারার ঐতিহ্যকে কাছে ঘেঁষতে দিতে চান না। তা সত্ত্বেও যখন কলকাতা হয়ে উঠতে পারে সকলের শহর, তখন বুঝে নিতে হয়, কেবল মানুষ নয়, কেবল ইট-কাঠ নয়, কেবল জল-হাওয়া নয়, একটা শহরের আত্মায় মিশে থাকে আরও অনেক কিছু, যা তাকে চালিত করে, লালিত করে। মিশে থাকে তার গড়ে ওঠার ইতিহাস, মিশে থাকে তার তৈরি হবার কাহিনি, মিশে থাকে তার বয়ে চলার আখ্যান। তবে একটা শহর, কলকাতার মতো একটা শহর হয়ে ওঠে কল্লোলিনী, হয়ে ওঠে মহানগরী, হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক। আর সেখানেই স্বাভাবিকতার তকমা আদায় করে নিতে পারে কলকাতার বড়দিন। 

    এই সেদিন, বড়দিনের দিন দুয়েক পর, রাতে ফিরছিলাম ধর্মতলা থেকে সেলিমপুর। ইচ্ছে করেই চালক মশায়কে বললাম, পার্ক স্ট্রিট ধরতে। এমনিতেও দেখেছি, অন্য সব রাস্তা থেকে পার্ক স্ট্রিটকে আলাদা মনে হয়। হতে পারে তার জৌলুস, হতে পারে তার আভিজাত্য, হতে পারে তার বিলাস, হতে পারে তার সঙ্গোপন। কিন্তু তার আবেদনকে কলকাতায় এত বছর থাকার পরেও অস্বীকার তো করা যায় না! যাই হোক, ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ নাগাদ পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে যথারীতি চোখ ধাঁধিয়ে গেল এবং জুড়িয়েও গেল বইকি। মাথার উপর দিয়ে যে-নাগরিক ছায়াপথ আলোকিত অবস্থায় বয়ে যাচ্ছে, তার তুলনা মেলা ভার। সেই আলোর তপ্ত আভায় শীতের পিচকালো পার্ক স্ট্রিট গনগন করছে, যেন এই যাত্রাপথের শেষে আছে কোনও মহাউন্মীলন, মনে হচ্ছে এমনটা। এখন কথা হচ্ছে, এই যে সাজসজ্জা, এই যে আয়োজন, এই যে উদযাপনের প্রস্তুতি, এই যে অপেক্ষা, এসব কার জন্যে?

    নিউমার্কেটের নাহুম’স-এ আজও যাঁরা রাত জেগে লাইনে দাঁড়ান সকালের উষ্ণ কেক হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্যে, তাঁরা সকলে কি ক্রিশ্চান? বড়দিন আসছে বলে যারা বাড়ির এককোণে ক্রিসমাস-ট্রি এনে তাতে টুনি আলো জ্বালিয়ে ঘর আলো করে রাখেন, তাঁরা সকলে কি ক্রিশ্চান? ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ রাতে কলকাতা দেখতে বেরোবেন বলে যাঁরা গাড়ি ভাড়া করেন আর পরিবারের সকলকে নিয়ে ঝলমলে সেলফি তুলে পোস্ট করেন, তাঁরা সকলে কি ক্রিশ্চান? মানুষের ভিড় ঠেলে কোনও রকমে ক্যাথিড্রালে পা গলিয়ে যারা ক্রিসমাস ক্যারলের সুরে গলা মেলান, তাঁরা সকলে কি ক্রিশ্চান? যারা বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়ির ছাদে জড়ো হয়ে ক্রিসমাস ইভের পার্টিতে গানবাজনায় মেতে ওঠেন, তাঁরা সকলে কি ক্রিশ্চান? যারা পথশিশুদের আর অনাথ বাচ্চাদের মধ্যে জামাকাপড় আর খাদ্য বিতরণ করেন কেবল এই বড়দিনকে ঘিরে, তাঁরা সকলে কি ক্রিশ্চান? নাকি যে-বাবা নিজের সামান্য আয় থেকে ক’টা টাকা খরচা করে মেয়ের জন্যে একটা সস্তা খেলনা কিনে এনে বালিশের তলায় রেখে দেন ২৪ ডিসেম্বর রাতে, তিনি ক্রিশ্চান?

    এঁরা কেউ কোনও এক ধর্মের মানুষ নন। অন্তত কলকাতায় তো ননই। এঁরা হিন্দু, এঁরা মুসলিম, এঁরা শিখ, এঁরা জৈন, এঁরা বৌদ্ধ এবং হ্যাঁ, এঁদের কেউ-কেউ ক্রিশ্চানও বটে। এঁদের মধ্যে মিল একটাই, এঁরা সক্কলে সেই মানুষটিকে চেনেন, যিনি বহু যুগ আগে ভালবাসার কথা, উপশমের কথা, সত্যের কথা বলতে গিয়ে ক্রুশে চড়েছিলেন। তাঁর জন্মদিনকে ঘিরে তাই যে উৎসব, এঁরা কেউ তার স্বাদ ছাড়তে রাজি নন। আর এই অরাজি হবার পরিসর তাঁদের উপহার দেয় আমার শহর, কলকাতা। তাই ক্রিসমাস হয়ে ওঠে সকলের উৎসব, সব্বার বড়দিন। আজ বুঝি, পার্ক স্ট্রিটের ওই আলোকিত ছায়াপথের শেষে সত্যিই এক মহাউন্মীলন অপেক্ষা করে থাকে, মানুষের স্রোতে মিশে, নিজের পরিচয় হারিয়ে যা খুঁজে পেতে হয়। আর কলকাতা সেটা পারে বলেই সে মহানগরী।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook