বিয়ে
কোথাও আর যাই না বিশেষ। এই না যেতে-যেতে একটা ব্যাপার হয়েছে, কেউ ডাকেও না। ‘এসো না একদিন, একটু আড্ডা-ফাড্ডা হোক, খেয়ে নেবে না হয়, ওই আমাদের যা হবে’, কেউ বলে না। না ইচ্ছে করে বেরোতে, না ঢুকতে। ওই তো সেই একই ঘর। একটু ঘোলাটে ঠান্ডা পড়েছে। কুয়াশা এখনও নয়, দিনের বেলা রাস্তায় লোক বেশি ঘুরছে, বাজার দুপুর অবধি। দরকার না থাকলেও সকালে বাজারে ঘুরতে যাই, নতুন রংচঙে সবজিগুলো দেখি। সন্ধের পর সেজেগুজে লোক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি আজকাল। বিয়ের মরশুম বোধ হয়। অনেকদিন বিয়েবাড়ি দেখিনি। আমার গুষ্টির কারুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় আমার যাওয়ার উপায় নেই। যদি অচেনা কোনও বাড়িতে ঢুকে পড়ি, বলি যে এমনি এসেছি, খাব না, চলে যাব একটু পরে, তাহলে কি সে-বাড়ির লোকরা খুব রেগে যাবে? ক’দিন ধরে ওইটা ভাবছিলাম। বিয়েবাড়ির খোঁজ করছিলাম। সামনের গেট, সাজসজ্জা, আলোর বাহার, সিকিউরিটি আছে কি না দেখে আন্দাজ করতে চেষ্টা করছিলাম, হানা দেওয়া যেতে পারে কি না। সবই নাকচ করে দিচ্ছিলাম, নিজেই। ভয় করছিল। নিজের বাড়িতে থেকে আজকাল বিয়ে হয় না বিশেষ, হলে, সেখানে ঢুকলে মুশকিল হতে পারে। ভাড়া করা বিয়েবাড়িতে কি শুধু ছেলে বা মেয়েপক্ষের লোকরাই ঢোকে? কেটারিংয়ের, ইলেক্ট্রিকের লোকও তো আসে-যায়। দু’পক্ষের লোক সবাই সবাইকে চেনে এমন নয়। শেষমেশ ঢুকে পড়লাম একটায়। ঢুকতাম না, এমনি দেখছিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে। একজন বলল, ‘বরের টাইম হয়ে গেছে কিন্তু’, শুনে খুব নিশ্চিন্ত হয়ে আমিও বরের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বর নামল, নামার সময় গাড়ির দরজায় টোপর আটকে গেল, আমি সামলে দিলাম। ‘ওরে বর মাস্ক পরেছে, খুলে দেখে নে, দেখে নে না, আমাদের বর কি না’, হ্যা-হ্যা হল। বরের চেহারা নিয়েও কটূক্তি কানে এল একটু দূর থেকে। ‘টোপর আর পাঞ্জাবির মাঝখানে বরকেই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ও-মেয়ের জন্যে এই ঠিক আছে।’ সম্প্রদানের সময় হাতে হাত রাখা অবস্থায় তার ওপরে কীসব রাখা হবে, তখন, ‘গামছার তলায় কী নড়ছে রে?’ ওই রগড়টা রিপিট হবে, জানি। বিয়ে মানেই এইসব। শাঁখ, উলু, গোলাপজলের ঝালরের মধ্যে দিয়ে আমিও ঢুকে পড়লাম সবার সঙ্গে। আমার মতো এমনি জামা-প্যান্ট পরা লোকও ছিল। অফিস থেকে যারা সরাসরি চলে আসে, তারা এইরকম হয়। তারা আগে খেয়ে চলেও যায়।
বরের সঙ্গে আমি আর ভেতরে গেলাম না। সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে শামিয়ানা খাটিয়ে বসার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আমাকে বেয়ারা কাঠিতে গাঁথা কাবাব দিল টিস্যু-পেপার জড়িয়ে। চা-কফি ওপাশে। কয়েকটা আস্ত বাগান, তাতে লাল-নীল আলো-বদলানো ফোয়ারা বসানো আছে। পাজি বাচ্চারা ওখানে জলে হাত দিচ্ছে। একটার মা এসে বেধড়ক পিটিয়ে দিল। সে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কেঁদে নিল কিছুটা, নিয়ে আবার জলের দিকে গেল। বয়স্কা একজন, বসে ছিলেন, আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলে করে কী?’ বললাম, ‘আইটি-তে আছে ভাইটি আমার।’ পরমুহূর্তে ‘ঘর কোথায়’, বললাম, ‘গোবরা।’ আমার এসব বলতে অসুবিধে হয় না। বরং কারুর সঙ্গে গল্প করলে আমাকে বাড়ির কেউ একজন বলে মনে হবে। সন্দেহ হলে, কেউ চেপে ধরলে বলব, ‘অফিসের কলিগ’, বরের কাছে ডেকে নিয়ে গিয়ে এখন নিশ্চয়ই যাচাই করবে না। নানা রকম ধানাই-পানাই করে সানাই বেজে যাচ্ছে। আমার আর ভয় করছিল না তেমন। বেশ লাগছিল। এতটাই যখন হল, বউ দেখা উচিত। ওখানে দুটো সমস্যা। মেয়েরা বেশি। তাছাড়া গিফ্ট তো নেই কিছু। তাও গেলাম। একটু দূর থেকে দেখতে লাগলাম। ভিড় কমতে কনের সঙ্গে চোখাচোখি হল। হাত তুলে ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম পরে দেখা করব। শাড়ি, গয়না, সাজের ওজনে এমনিতেই জবুথবু, একবার খুব কষ্ট করে চোখ তুলে আমাকে সম্মতি জানিয়ে আবার মাথা নীচু করে ফেলল। সম্বন্ধ করে বিয়ে মনে হয়। এই যে এভাবে দুটো মানুষকে জুতে দেওয়া হল, হয়তো চেনেও না, বিয়ের পরের দিন থেকে তারা কী করে ধাঁই ধাঁই করে সংসার করবে কে জানে! অনেকেই পারে, দিব্বি থাকে। একজন আমাকে বলেছিল, ‘কো-প্যাসেঞ্জার ভাবলেই সংসারে অশান্তি থাকে না।’ ওপাশে খোলতাই চেহারার একজন জাঁকিয়ে বসেছেন, নানা রকম কথা বলছেন। ওঁকে ঘিরে অনেকে ভনভন করছে। একটু পরে-পরেই হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে। মনে হয় অশ্লীল জোকস। বিয়েবাড়িতে এটাও একটা মজা। যেহেতু বিয়ে, তাই এটা অ্যালাউড। আমাকে দেখে, নতুন শ্রোতা আন্দাজ করে বললেন, ‘আজ লাগবে না, বউভাতের পরেই কিন্তু লাগবে, পকেটে থাকে যেন, তোমরা ইয়ার দোস্ত, দিও। বর নিজেও তো রাখতে পারে, আফটার অল ওরই তো ব্যাপার’ বলতেই, ‘ধুতির এইটাই গেরো, পকেট থাকে না যে’, ‘খুঁটে বেঁধে রাখতে পারে’, ‘কনফিউশন হবে কিন্তু, কোনটা আগে খুলবে, ধুতি না খুঁট?’ আবার ভুকভুক করে হাসির ফোয়ারা। একটা মেয়েও আছে, নাভিতে গৌতম বুদ্ধের ট্যাটু, শাড়িটা ইচ্ছে করেই নামিয়ে পরেছে, সে ফিসফিস করে কী যেন বলল, আমি শুনতে পেলাম না। চালাক-চালাক, হাসি-হাসি মুখ করে রইলাম।
ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগলাম চারপাশ, কেউ আমাকে নিয়ে মাথা দিচ্ছে না। সবে সন্ধে সাড়ে সাতটা, এখন বুফের জায়গায় ভিড় নেই। চুপচাপ খেয়ে নিলে মন্দ হয় না। যদি পরিস্থিতি সুবিধের না হয়, তাহলে এমনি দেখছি এসব, এমন ভাব করা যাবে, এতে দোষের কিছু নেই। এখানে অবাঙালিদের কপি করে ফুচকা, দইবড়া এসব নেই। একদিকে থাই স্টাইলে নুডলস নিয়ে আগুনের খেলা দেখানোও নেই। টাইট বাঙালি মেনু মোটামুটি। লুচি-বেগুনভাজা আউট। বেবি নান, পনির ভর্তা ঢুকেছে। সাদা ভাত নয়, পোলাও জাতীয় কিছু। দরাজ হাতে কাজু, কিসমিস। ভেজদের লাইন এখান থেকে আলাদা হয়ে মটর পনির, পালং পসিন্দাতে ঢুকে গেছে। ননভেজদের জন্য ফিশ ডায়মন্ড ফ্রাই দিয়ে শুরু। ছোট প্লেটে ওটাই নিলাম একটা, গুচ্ছের কাসুন্দি ঢেলে। বুঝতে পারছিলাম অ-নিমন্ত্রিত হওয়ার দরুন তৈরি হওয়া পাপবোধ থেকে লোভ, দুঃসাহস দুটোই বাড়ছে। ফ্রাই পেরিয়ে নতুন প্লেট। সরাসরি চিকেনে চলে গেলাম। এক খাবলা নিলাম, সলিড মাংসের পিস, লাল গ্রেভি, পাহাড়প্রমাণ পোলাওয়ের ওপর। প্লেটে সাক্ষাৎ ভিসুভিয়াস। মনেও। দারুণ রান্না। ন্যাপকিনে কেটারারের নাম ছাপা আছে, আর একটা নিয়ে রেখে দেব। যদি কেউ ধরে, এই ভয়টা আর একবার হল, এদিক-ওদিক নজর রাখছিলাম। সন্দেহজনক লোক খুঁজছিলাম, যে আমাকে সন্দেহ করতেই পারে। পেলাম না। একজন তো সবাইকে, ‘নিজের মতো করে খাবেন প্লিজ’ বলতে-বলতে চলে গেল। একটু খচখচানি নিয়ে যথেষ্ট সাঁটিয়ে চাটনি-পাঁপড় স্কিপ করে ডেজার্টে চলে এলাম। মিষ্টি দই-এর ওপর মিহিদানা চাপালাম। আইসক্রিম। পান। টুথপিক দিয়ে দাঁতের ফাঁক ক্লিয়ার হয়ে যেতেই সারা শরীর শান্ত হয়ে গেল। আর কিছুক্ষণ থেকে চলে যাব।
নানা রকম আওয়াজের ওয়েভ আসছিল ভেতর থেকে। একটা শুনে মনে হল বর-বউ বিয়েতে বসেছে। মালা বদলটা দেখার লোভ হচ্ছিল। এক রাউন্ড বাইরে ঘুরে এলাম, সিগারেট খেলাম। নজরে এল, পাশের মাঠে সব গাড়ি রাখা হয়েছে। ভেতরে আর একবার হল্লা শুনে বুঝলাম, ক্লাইম্যাক্সের দেরি নেই। আজকাল শর্টে হয়ে যায় সব। বিয়েটা তো আসল নয়। বিয়ের নিয়মকানুন, আচার, উপকরণ, মন্ত্রের মানে আছে নিশ্চয়ই। সেগুলো কী, তা আজ অবধি কেউ জানে বলে শুনিনি। সেগুলো মোটামুটি মানে সবাই, ক্ষতি তো নেই। অনেক বেশিবার জোর করে পাক খাওয়ানো হবেই হবে। যে-ব্যাপারটা আমার ছোট থেকে দারুণ লাগে তা হল, গ্র্যান্ড ফিনেলের আগের মুহূর্ত অবধি প্রকাশ্যে সেলিব্রেশন। কয়েকজন খুব স্মার্ট, সারাক্ষণ রিস্কি ইঙ্গিতপূর্ণ কথা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মাতিয়ে রাখে। এখানেও একটা ডেঞ্জারাস বুড়িকে দেখলাম, মুখের আগল নেই, বাড়াবাড়ি করেই চলেছে। বিয়ে-বউভাতের ল্যাঠা চুকিয়ে জলভরা তালশাঁস সন্দেশের মতো বর আর সদ্য রস থেকে তোলা জিলিপির মতো বউকে চেপেচুপে ফুলশয্যায় গুঁজে দিয়ে লোকজন সরে পড়ে। আগে তো খাটের তলায় লুকিয়ে থাকা, মাইক্রোফোন রাখা, কত কী হত। এখন উঠে গেছে। যাদের বিয়ে তারা এবং অত্যুৎসাহী বাকিরা এতই ক্লান্ত থাকে যে, পরের দিন সকালে, ‘বস, অল ওক্কে?’ কেউ জিজ্ঞেস অবধি করে না আর। ওই দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বাসি বিয়ে। এসব যদিও আমার কুচুটে ভাবনা, আমার মনের মধ্যেই থাকে। একজনকে ‘কটায় লগ্ন’ জিজ্ঞেস করায়, ‘দেরি আছে’ শুনে আবার বেরিয়ে এলাম।
গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। আলো নেই বিশেষ। একটা স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর পড়ে আছে। একজন ড্রাইভার বাক্স খুলে খাচ্ছে। টুকটাক অল্পবয়সিদের খুচখাচ সিগারেটের আগুন। পায়ের তলায় কখনও ঘাস, কখনও শক্ত, কখনও চটচটে কীসব যেন। কী দরকার ছিল এখানে আসার ? না জমা পিচ হতে পারে, আমার চটি আটকে গেছে, ছাড়ছে না। কেউ দেখছে না সেটা বাঁচোয়া। উবু হয়ে বসে, ধৈর্য ধরে, সাবধানে ছাড়ালাম। ন্যাপকিনে হাত মুছে বেরিয়ে আসব, দুটো গাড়ির মধ্যে দিয়ে রাস্তায় পড়ব, কীসে যেন পা জড়িয়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। জায়গাটা ভিজে। একটু সামলে বুঝলাম, গাড়ির তলায় শুয়ে আছে কেউ। আড়াআড়ি ভাবে। তার বেরিয়ে থাকা পায়ে হোঁচট খেয়েছি। লাগেনি যদিও। যার পা, তার মাথার দিক থেকে গোঙানির শব্দ হল। কী যেন বলল। স্পষ্ট শুনলাম, ‘এসব কি ঠিক হল?’ ‘সরি দেখতে পাই নি’, কাকে বলব? যে ওইভাবে শুয়ে আছে, তাকে? তারপর ভাবলাম, কেন শুয়ে আছে সেটা জেনে নিলে ক্ষতি নেই। জামাতে নিশ্চয়ই ময়লা লেগেছে, ভালোই হল, আর ভেতরে বিয়ে দেখতে যেতে হবে না। জড়ানো গলায়, মদ খেয়েছে আমি শিওর, বলল, ‘কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না।’ আরে, আরে, এ কার লাইন যেন? আশেপাশে আরও কয়েকজনের গলার আওয়াজ শুনে আমি উল্টে হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ির তলায় ঢুকে পড়লাম। এবারে সেই লোক, আমার একদম পাশে, চিৎ হয়ে। কিছুক্ষণ চুপচাপ। সে এবারে একটু পাশ ফিরল। ‘এই যে আমি আর তুমি শুয়ে আছি, পস্চারটা খেয়াল করা দরকার, খুবই সিনেম্যাটিক কি?’ উত্তরের আগেই আবার, ‘আগামীকাল, ওরাও এভাবেই শোবে।’ এই অবধি ঠিক আছে। ‘যেটা নেই সেটা হল, আমি নই। এটা কি ঠিক হল?’ আমরা দুজনেই পা ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের মাথা দুটো গাড়িটার গিয়ার-বক্সের ঠিক তলায়। ওখান থেকে টপটপ করে নাকি তেল পড়ে! পড়লে, ঘুরে শোব। টের পেলাম, আমাদের আশেপাশে কিছু লোক ঘুরছে, কাউকে একটা খুঁজছে, আমরা চুপ করে আছি। লোকগুলো চলে যেতে শুনলাম, ‘আমাকেই খুঁজছে, মারবে।’ কেন, জিজ্ঞেস করলাম না, বলবে নিশ্চয়ই। কয়েক মুহূর্ত আগে একটা বিয়েবাড়িতে চোরের মতো ঢুকে খাবার খেয়েছি। আমার নিজের খাবারের অভাব আছে তা নয়। অভাব লোকের। হতেই পারে। এর অনেক সুবিধেও তো আছে। কেউ চেনে না, কেউ পোঁছে না। কেউ মাথা দেয় না আমার ব্যাপারে। এখন একটা উদ্ভট পরিস্থিতে ঢুকেছি। কোনও মানে হয় না। কেউ বারণ করার নেই, এটা আবার অ্যাডভান্টেজ। কী আর হবে, বেরিয়ে, ধুলো ঝেড়ে চুপচাপ কেটে পড়ব একটু পরে। এক্সপিরিয়েন্সটা হল তো!
নেশা করা লোক মানেই খারাপ নয়। টুকরো-টুকরো কথা শুনলাম। ও বলতে চাইছে, যে-মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে, তার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল। শেষ মুহূর্তে বাড়ির লোক সব ভণ্ডুল করে দিয়েছে। অন্য ছেলে ফিট করে বিয়ে দিচ্ছে। দুজন অ্যাডাল্ট বিয়ে করতে চাইলে কেউ আটকাতে পারবে না। গোলমাল অন্য জায়গায়, মেয়েটা পাল্টি খেয়ে গেছে। গতকাল মেসেজ করে জানিয়েছে। তারপর আর ফোন ধরছে না। বিয়ের কনে তার ত্যাগ করা পূর্ব প্রেমিকের ফোন থোড়াই ধরবে! কিন্তু এসব তো মেনে নেওয়া যায় না। তাই ও গিয়েছিল গতকাল। ছিনিয়ে আনতে। ‘তোমার মুখ দিয়ে ভকভক করে গন্ধ বেরোচ্ছে’ বলে বের করে দিয়েছিল। মেয়ের আপত্তি যখন, বাড়ির লোকও জোর পেয়ে গেছে। অথচ, আগে, ওরা দুজনে একসঙ্গে কত মদ খেয়েছে। কত কী করেছে। আজ বিকেলেও একটা ফাইনাল হামলা চালিয়েছিল। একটা আংটি অবধি নিয়ে গিয়েছিল। ‘দেখাচ্ছি, এই যে’ বলে পকেটের মধ্যে আংটি খুঁজতে লাগল। সেই সময় মেয়েটার বাড়ির লোক কড়া ব্যবহার করে, শাসানি দেয়। ‘দেখে নেবো, এই বিয়ে আমি ভণ্ডুল করে দেব’ বলে বেরিয়ে এসে সেই যে এখানে ঢুকেছে, আর বেরোয়নি। শুধু ভুল করে মেয়ের বাবাকে একটা মেসেজ করেছিল একটু আগে।
কী হলে কী হতে পারত দুনিয়ার কেউ কোনও ব্যাপারেই তার গ্যারান্টি দেওয়া উত্তর খুঁজে পাবে না। পেতে পারে না। আজ অবধি কিছুই মেলেনি। কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। কেউ-কেউ গড়িয়ে গেছে যা হোক করে, এই আর কি! এখানে তো নয়ই। এ তো সিরিয়াস ব্যাপার একটা। আমার মহা দোষ, স্থান-কাল-পাত্র খেয়াল থাকে না। ফিসফিস করে গুনগুনিয়ে উঠলাম, ‘না না না, আজ রাতে আর যাত্রা করতে হব্বেহ না। তুমিও যাবে না। আমিও যাব না।’ লোকটা ভুড়ুক করে উঠল হাসিতে। মাথাটা ঠুকে গেল ইঞ্জিন থেকে বেরোনো সাইলেন্সারের পাইপে। চুপ করে গেল। ‘এখনও গরম মাইরি।’ প্রস্তাব দিলাম, এখানে না শুয়ে থেকে বরং অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলা যেতে পারে। যার গাড়ি সে এসে চালিয়ে দিলে বিপদ। ‘আরে, গাড়ি তো আমি, আমি নিজে এনেছি, এইটাই তো আসল বরের গাড়ি, ওকে নিয়ে এই গাড়িতেই চলে যাব।’ যাব, অর্থাৎ এখনও আশা আছে এর। সিগারেট খাওয়ালাম। একটু শান্ত করা দরকার, নেশা কেটে যাবে এবারে। সিগারেট টানার সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখটা লাল হয়ে উঠছিল। বয়স বেশি নয়। দেখলে মনে হয়, ভাল ছেলে, পরিষ্কার চোখমুখ, জানি না, হয়তো ভাল ঘরের ছেলে। আইটি-তেই আছে। সম্পর্ক মহা মুশকিলের ব্যাপার। ঠিকঠাক মিলমিশ, মাখোমাখো না হলে সব গোলমাল হয়ে যায়। মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। শরীর ভেঙে যায়। কত কী হয়! এই আমার যেমন, শরীর ঠিকই আছে। কারণ আমার সম্পর্কের সমস্যা নেই। আমার বরাবরের হালচাল দেখে অন্যেরা বলত, মরেই যাব। মরিনি। একটু আগে এক গাদা খেয়েছি। পড়ে গিয়ে ভড়কাইনি। ঢুকেছি জীবনের প্রতি তুমুল কিউরিওসিটি নিয়ে বেয়াড়া জায়গায়। জ্বলন্ত সিগারেটটা গাড়ির তলায় এখানে-সেখানে ঠেকাচ্ছিল ও। বলল, ‘উচিত শিক্ষা দেব।’ কাকে? মেয়েটাকে? কী? ছ্যাঁকা? আর দেরি নয়, একে এক্ষুনি এখান থেকে বের করা দরকার। বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের হাতে মার খাবে। তা ছাড়া, ভাবতে খারাপই লাগছে, যে-মেয়ে এইভাবে হঠাৎ ছেড়ে চলে যায়, তার সঙ্গে এ, অন্তত এর মতো মানুষ জীবন কাটাতই বা কী করে! একটু দূরে বিয়েবাড়ি থেকে ফের আওয়াজ উঠল। উলু। শাঁখ। আমি প্রমাদ গুনলাম। কিন্তু লোকটা দেখি শান্তভাবে হাসতে লাগল। হাসছে তো হাসছেই। ওদিকের কলরব কমার সঙ্গে-সঙ্গে এও হাসি বন্ধ করলো। সানাইটা এখন আর বাজছে না। মালাবদল, সিঁদুর দেওয়া হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। আমি অনেক ভেবেও আর কিছু বলতে পারছিলাম না। লোকটা পকেট থেকে ফোন বের করে তার আলোতে আংটিটা দেখল। হাত বাড়িয়ে একটু দূরে ফেলে দিল। একগাল হেসে বলল, ‘সস্তা, ফালতু, কোনও দাম নেই।’ ফোনে আরও কীসব করল, বলল, ‘সব ডিলিট করে দিয়েছি, সব।’ নিজেই বেরোল আস্তে-আস্তে। ধুলো ঝেড়ে খাড়া করল নিজেকে। আমিও। দূরের আলো ঝলমলে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে উঠল, ‘মেড ফর ইচ আদার?’, তারপর চিৎকার করে, ‘বিইচ!’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র