কলাভবনের হাওয়ায়-ভাসা গল্প
শান্তিনিকেতনের কলাভবন শিল্পকলার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তার ঘটনাবহুল আঙিনায় গেলেই দেখা যাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আপনভোলা শিল্পীরা ডুবে রয়েছেন তাঁদের কাজে। কেউ শিক্ষক, কেউ শিক্ষার্থী। সকলের একটা একাগ্রতা আছে, কিন্তু তাই বলে তাঁদের জীবন আর তার আনন্দ দূরে চলে যায়নি। একটা খোলা, সাদামাটা বাঁধানো চাতালের পাশে, চিনা বটের নীচে লাল চা হাতে আলোচনায় বসে শিক্ষকেরা। সামনে-পিছনে শ্রুতকীর্তি শিল্পাচার্যদের নানা কাজ। তার মধ্যে একটা ম্যুরাল বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন দৃষ্টি একেবারে হারিয়ে ফেলার পর। দু’দুটো আস্ত বাড়ি নিজে হাতে এঁকে ভরিয়ে দিয়েছেন কে.জি. সুব্রহ্মণ্যন, যাঁর সহজ নাম মানিদা। ভারতের শিল্পকলার অনেক স্তম্ভেরা এই প্রতিষ্ঠানের ভার ধরে রেখেছেন। কলাভবন তার আদিকাল থেকে পেয়েছে কিছু বর্ণময় শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীদের। তাঁদের কাজ ছাড়াও, সাজ-পোশাক, চলাফেরা, শখ ও খেয়াল, রসিকতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, রাজনীতি, রেগে যাওয়া, ভালবাসা— সব কিছুতেই যেন এক এলোমেলো মানবিকতা আর অভিনবত্বের ছোঁওয়া। কলাভবনের হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় গল্প।
নান্দনিক রোদ্দুর
সংক্ষেপে কে.জি.। কল্পাতি গণপতি সুব্রহ্মণ্যন তখন ছাত্র। থাকেন ছাত্রাবাসে। রাত্রে পড়াশোনা করে ঘুমোতে দেরি হয়। রোজ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। এরকমই একদিন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেলা গড়িয়েছে। জানলা খোলা। সতীর্থরা সবাই ক্লাসে চলে গেছে। চড়া রোদ জানলা দিয়ে এসে পড়েছে মুখে। কে.জি. হঠাৎ অনুভব করলেন, রোদটা যেন নরম হয়ে এল, জানলাটা যেন কেউ বন্ধ করল। ঘুম চোখে জানলার পাল্লা ঠেলে দেখেন, খুঁজতে এসে উঁকি দিয়ে, রোজ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা ছাত্রকে ঘুমন্ত দেখে ধমকের বদলে মুখের রোদ একটু আড়াল করে দিয়ে ধীরে চলে যাচ্ছেন মাস্টারমশাই নন্দলাল।
কিঙ্কর ও কৌশিক
কলাভবনের পাঠ শেষ করে দিনকর কৌশিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন দিল্লিতে। একবার শান্তিনিকেতনে এলে শিক্ষক রামকিঙ্কর তাঁকে রাত্রে নিমন্ত্রণ করেছেন রতনকুঠির অদূরে, তাঁর বাড়িতে। সেখানে তখন তাঁর সবসময়ের সঙ্গিনী রাধারানী। ঠিক সময়ে কৌশিক হাজির মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। অনেক ডাকাডাকির পর ঘুম চোখে উঠে রামকিঙ্কর একটু লজ্জাই পেলেন। বললেন, ‘মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম, ভুলেই গেছিলাম।’ বাড়িতে তখন কাউকে খাওয়াবার মতো উপকরণ নেই। পাশের বাড়ির থেকে ধার করে রাধারানী রান্না চড়ালেন। অনেক রাতে খাবার তৈরি হল। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরে এলেন কৌশিক।
অন্ধকারের মতলব
আশ্রমে হঠাৎ আলো চলে গেছে। এক ছাত্রী একা একা কলাভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরছে ছাত্রীনিবাসে। হঠাৎ রামকিঙ্কর তার পিছু নিলেন। অন্ধকার দ্রুত নেমে আসছে, ধারে-কাছে কেউ নেই। এলোমেলো চেহারার অচেনা লোককে পিছু নিতে দেখে ছাত্রীটি শঙ্কিত হয়ে তার চলার গতি বাড়িয়ে দিল। যত জোরে সে হাঁটে, রামকিঙ্কর হাঁটেন তত জোরে। ঘন ঘন পিছনে ফিরে ছাত্রীটি দেখছে, আবার হাঁটছে। একসময় মেয়েটি ঢুকে পড়ল হস্টেলে। অন্ধকারে একা ছাত্রীকে নিরাপদে ছাত্রীনিবাস অবধি পৌঁছে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে রামকিঙ্কর ফিরে এলেন কলাভবনে, নিজের কাজের ভুবনে।
এপ্রিল ফুল
কলাভবনের একটা পুরনো জামগাছে গলায় দড়ি দিয়ে এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। তার ঘনিষ্ঠ সতীর্থ গাছের নীচে বসে হাপুস নয়নে কান্নাকাটি করছে। ভিড় জমছে। শোকে পাথর অধ্যক্ষ সোমনাথ হোর পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশ ‘বডি’ নামাতেই গলায় দড়ি দেওয়া ছাত্র বলে উঠল, ‘এপ্রিল ফুল’। পুলিশ বিরক্ত, অধ্যক্ষ ক্রুদ্ধ। অতি অল্পসময়ের মধ্যে ওই দুই ছাত্রকে কলাভবন থেকে বহিষ্কারের চিঠি হাতে ধরিয়ে, ছাত্রাবাস থেকে তাদের সব জিনিসপত্র-সহ, নিজে টিকিট কেটে সোমনাথ তাদের ট্রেনে তুলে দিতে গেছেন। বোলপুর স্টেশন। ট্রেনের ভিতরে দুই বিমর্ষ ছাত্র, জানলার বাইরে সোমনাথ। তারা কাঁদছে, সোমনাথ দেখছেন। ট্রেনের বাঁশি বাজতেই সোমনাথ হোর বলে উঠলেন, ‘এপ্রিল ফুল!’ দুড়দাড় করে ট্রেন থেকে নেমে অধ্যক্ষের সঙ্গে ভবনে ফিরে এল দুই ডানপিটে পড়ুয়া।
সি.বি.আই.-এর ঠিকানা
কথায় কথায় মেজাজ হারানো চিত্রকলার শিক্ষক সেলিম মুন্সীর জুতোয় ছাত্র দীপঙ্কর দাশগুপ্ত কালি ঢেলে রেখেছে। সেলিম মুন্সীর এক বন্ধু সেই সময় সি.বি.আই.-এর উচ্চপদে আসীন, তাই তিনি প্রায়ই বন্ধুকে স্মরণ করতেন। কালিমাখা জুতো হাতে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি অধ্যক্ষ যোগেন চৌধুরীর ঘরে ঢুকলেন। পিছন পিছন নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা। গলা চড়িয়ে সেলিম মুন্সী বলছেন, ‘আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। সি.বি.আই. তদন্ত চাইব।’ তখন এখনকার মতো ইন্টারনেটে সব কিছু এত সহজে পাওয়া যেত না। হাতে হাতে মোবাইল ফোনও ছিল না। সদাহাস্যময়, ঠান্ডা মাথার, ছাত্রদরদী শিক্ষক যোগেন চৌধুরী অকারণ বাদানুবাদের পক্ষপাতী ছিলেন না। ছিলেন গোলমাল দ্রুত মিটমাটের পক্ষে। হাসতে হাসতে তিনি তাঁর ভবনের সহকর্মীকে বললেন, ‘কিন্তু সি.বি.আই.-এর ঠিকানাটা তো জোগাড় করতে হবে। সেটা পাওয়া যাবে কীভাবে?’ শিক্ষকের জুতোয় কালি মাখানোর তদন্ত অধ্যক্ষের হস্তক্ষেপে সেবারের মতো আর সি.বি.আই.-এর হাতে যায়নি। শিক্ষককে শান্ত করেছিলেন। ভবনের দুষ্টুমির বুদবুদ, ভবনের জলেই মিলিয়ে দিয়েছিলেন যোগেন।
সাপেদের প্রবেশ নিষেধ
সপ্তম বর্ষে কাজ করার জন্য ছেলেমেয়েরা নিজেদের একটা স্টুডিও পেয়ে থাকে। চিত্রকলার ছাত্রী মিঠু সেনও পেয়েছে। একচিলতে ঘর। প্রকৃতির পরশ পাওয়া যায়। জানলা খোলাই থাকে। মাটিতে চুল এলিয়ে বসে ক্ষীণতনু মিঠু একমনে ছবি এঁকে যায়। পাশেই একটা চেয়ার, শিক্ষকদের এসে পরামর্শ দিয়ে যাওয়ার জন্য। সেলিম মুন্সী জানলা দিয়ে মিঠুর কাজ একবার দেখে যেতে এসে দেখলেন তাঁর জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে কী একটা জড়িয়ে আছে। শঙ্কিত হয়ে মিঠুকে বললেন, ‘ওটা কী দেখছি?’ মিঠু নির্বিকার। মুখ তুলে বলল, ‘সাপ। আগেই দেখেছি। এখানেই থাকবে। কিছু তো করছে না।’ আতঙ্কিত সেলিম মুন্সী অভিযোগ নিয়ে ছুটলেন অধ্যক্ষ যোগেন চৌধুরীর ঘরে। বিচারসভায় সেখানে ডাক পড়েছে মিঠুর। সেলিম বলছেন, ‘সপ্তম বর্ষের ছাত্রী, তাও এরকম কথা বলছে! বলছে সাপ থাকুক!’ যোগেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টায়। প্রিয় ছাত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করে বললেন, ‘সাপটা ঘরে ঢোকানো মনে হছে ঠিক হয়নি। সাপটাকে ঢোকালে কেন?’ মিঠু ফিরে গিয়ে দরজায় ঝোলাল এক নোটিশ: ‘সাপেদের প্রবেশ নিষেধ।’ সেই বিজ্ঞপ্তি একদিন চোখে পড়ল, সাধারণত ভাববাচ্যে কথা বলা যোগেন চৌধুরীর। ডানপিটে ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু সাপটা যে শিক্ষিত, নোটিশ পড়তে পারে, সেটাই বা বোঝা যাবে কীভাবে?’
বোরখায় রাধা
দুই শিক্ষক-শিল্পী পকেটে দুটো খাম নিয়ে হয়ে এ ওকে দেখাচ্ছেন। লালুপ্রসাদ সাউ আর যীশু-রাধা-কাক এঁকে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সুহাস রায়। দুজনের পকেটে দুটো চিঠিকে কেন্দ্র করে পুলকিত দৃষ্টির চালাচালি দেখে মানিদা জানতে চাইলেন, ‘ব্যাপারটা কী?’ তখন সদ্য বিভিন্ন আর্ট ক্যাম্প-এর আয়োজন করে শিল্পীদের ডেকে ছবি আঁকানোর একটা হিড়িক পড়েছে। সুহাস রায় বললেন, ‘একটা আর্ট ক্যাম্প-এ আমরা দুজনেই ডাক পেয়েছি।’ মানিদা বললেন, ‘এরা তো এখন আর্টিস্টদের সাবজেক্ট বলে দেয়। সেরকম কিছু বলেছে নাকি?’ সুহাস রায় বললেন, ‘হ্যাঁ। ন্যাশনাল ইনটিগ্রেশন।’ মানিদা স্মিত হেসে সুহাস রায়কে বললেন, ‘আপনার তো তাহলে সুবিধাই হয়ে গেল। রাধাকে শুধু এখন একটা বোরখা পরিয়ে দেবেন!’
উল্টো শর্বরী
ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক শর্বরী রায়চৌধুরী রাশভারী মানুষ ছিলেন। গোল চশমা পরতেন। ঘন দাড়ি রাখতেন, দাড়িতে একটা ফুল গুঁজে আসতেন। একবার দিল্লির ললিতকলা আকাদেমির ‘ট্রিয়েনাল’-এ তাঁর একটা ভাস্কর্য পুরস্কার পেল। পরে দেখা গেল, প্রদর্শনীতে আসলে সেই কাজ সাজানো ছিল উল্টো করে, যা দেখে বিচারকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানের আগে শিল্পীকে বারবার সতর্ক করা হল, পুরস্কার নেবার দিন দাড়িতে কোনও মতেই ফুল গোঁজা যাবে না। শর্বরী এগোচ্ছেন পুরস্কার নিতে। দাড়িতে ফুল নেই, নিশ্চিন্ত আয়োজকরা। পুরস্কারদাতার কাছাকাছি যেতেই সবাইকে হতভম্ব করে পকেট থেকে একটা ফুল হাতে নিয়ে দাড়িতে গুঁজে নিলেন শিল্পী। উল্টে দেখা কাজ অথবা খেয়ালি শিল্পীর দাড়িতে গোঁজা ফুলের জন্য পুরস্কার কিন্তু ফেরত নেয়নি রাষ্ট্র।
সাক্ষাৎ ‘বাফেলো’
ভাস্কর্যের শিক্ষক বিকাশ দেবনাথ পনেরো দিন সময় দিয়েছেন পরীক্ষার জন্য একটা ‘বাফেলো’ তৈরি করতে। তার আগে ছাত্রদের অনেক কাজ থাকে। গ্রামে যাওয়া, বাফেলোর চলাফেরা বা ওঠা-বসা দেখা, তার স্কেচ করা এইসব। কেরালার ছাত্র কে. এস.রাধাকৃষ্ণন সে-সব মন দিয়ে করে চোদ্দটা দিন কাটিয়ে আগের রাত্রে ফাঁকা স্টুডিওয় একটা ‘বাফেলো’ বানিয়ে রেখে এল পরীক্ষার জন্য। শিক্ষক চোখের সামনে এতদিন অন্যদের মতো তাকে কাজ করতে দেখেননি, তাই ভেবেছেন রাধা কাজ করেনি। যাচাই না করেই পরীক্ষায় শূন্য দিয়েছেন। খবর পেয়ে শিক্ষককে ডেকে রাধা নিজের কাজ দেখাল। বিকাশ বুঝলেন একটা ভুল হয়ে গেছে, রাধা আসলে কাজ করে রেখেছে। অথচ তিনি দমবারও পাত্র নন। বললেন, ‘কিন্তু কাজটা তো আমাকে সামনে রেখে তুমি করোনি!’ রাধার মাথাটা গরম! বলল, ‘আপনাকে সামনে রেখে বাফেলো তৈরি করা যায় কি?’ ‘বেয়াড়া’ রাধাকে কলাভবন থেকে বহিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হল, আবার কলাভবনের নিয়মে তা থিতিয়েও গেল।
পুতিন থেকে প্রণব, রাশিয়া থেকে রতনপল্লী
এই গল্পটা যোগেন চৌধুরীর মুখেই আমার শোনা। পূর্বপল্লীতে আমার বাড়িতে এসেছেন যোগেনদা। আমার ছেলেবেলার বান্ধবী সুদর্শনাও এসেছে। গল্পে আর হাসিঠাট্টায় কেটে গেল খুব সুন্দর একটা সন্ধ্যা। বাড়ির অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেন বাতিল করা যাচ্ছে না, কেন কিছু ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না, কেন সব কিছুর উপর এত মায়া রয়ে গেল— আলোচনা হচ্ছিল সেই নিয়ে। যোগেনদা বললেন, ‘অনেক কিছু ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারি না। এই ধরো যেমন একটা ছোট্ট, সুন্দর হুইস্কির বোতল। সেদিন দেখলাম সামান্য হুইস্কি পড়ে আছে ওটায়। কিন্তু বোতলটার একটা মজার ইতিহাস আছে।’ জানা গেল, চমৎকার ওই বোতলটা যোগেনদাকে দিয়েছিলেন প্রকাশক ও বন্ধু প্রিয়ব্রত দেব। প্রিয়ব্রত দেবকে ওটা আবার দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়বন্ধু, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণববাবুকে রাশিয়ায় নিজে হাতে ওই হুইস্কি-ভরা বোতল উপহার দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রধান ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিনের বোতল, পল্টুদার হাত ঘুরে শেষ অবধি চলে এল রাশিয়া থেকে রতনপল্লী, যোগেন চৌধুরীর আস্তানায়। সত্যি, কী বিচিত্র এই শান্তিনিকেতন!
কৃতজ্ঞতা: যোগেন চৌধুরী, রমণ শিবকুমার, কে.এস. রাধাকৃষ্ণন, মিঠু সেন, সুশোভন অধিকারী, শমিত দাস, অমিত দণ্ড।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র