প্রেক্ষাগৃহে তালা
অতিমারী-পরবর্তী পৃথিবীতে, অনেক কিছুর মধ্যে, সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে, কীভাবে মানুষ শিল্প বা শিল্পীদের অপ্রয়োজনীয় বা ‘নন-এসেনশিয়াল’ বলে মনে করেন, এর আগের কলামে এ নিয়েই লিখেছিলাম। মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা সাহসের উদ্ভব হয়েছে, যেখান থেকে শিল্পীদের প্রতি সকলের অন্তঃস্থিত অবজ্ঞা বেরিয়ে এসেছে। আগেই বলেছি এতে আশ্চর্য হইনি, কারণ এই রাগ/অবজ্ঞা নতুন নয়। চেপে রাখা ছিল বোধহয় এতদিন। যাঁরা সভ্য সমাজে গান গাওয়া, কবিতা লেখা, নাচের অনুষ্ঠান আয়োজন করা, থিয়েটার বা সিনেমা নির্মাণ করা বা আবৃত্তি করা-কে ‘বেকার’ বা ‘ফালতু’ বলতে পারতেন না ‘সোশ্যাল স্টেটাস’-এর কারণে, তাঁরাও লাগাম হারিয়ে বলেই ফেললেন প্রকাশ্যে।
সাহস হওয়ার পেছনে আর একটা বড় কারণও স্পষ্ট। অতিমারীর পর সমস্ত নিষেধাজ্ঞা কমতে শুরু করল। সবার শেষ স্থান পেল সিনেমা হল এবং থিয়েটার হল বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্মিত প্রেক্ষাগৃহ। পরিষ্কার করে বলি:
১. প্রথমবারের লকডাউনের পর যখন সমস্ত কিছুর ওপর ছাড় দেয়া আরম্ভ হল, সেখানে স্থান পেল না কোনওরকম শৈল্পিক ক্রিয়া। হতেই পারে, প্রয়োজনে আরও অনেক জরুরি ব্যবস্থা আরম্ভ করা দরকার। কিন্তু দীর্ঘ অনেক মাস পরেও যখন প্রায় সব কিছুই স্বাভাবিক গতিতে দৌড়োচ্ছে, তখনও প্রেক্ষাগৃহে তালা। চিঠি লেখা হল, মিটিং করা হল, কিন্তু সমাধান হল না।
২. সেই প্রথমবারের ঘটনার পর আমার মনে প্রশ্ন জাগল: ধার্মিক অনুষ্ঠানে রোগ ছড়ায় না, রাজনৈতিক মিটিংয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে না, কিন্তু সুস্থভাবে একটি নাটকের শো বা চলচ্চিত্রের পরিবেশন করলে (নিয়ম মেনে ৫০ শতাংশ দর্শকের উপস্থিতি এবং একটা করে আসন ছেড়ে বসা) ভাইরাস ছড়ায়? অন্য অনুষ্ঠানে, যেখানে কোভিড বিধি ও নিয়ম মেনে চলার সুযোগ প্রায় নেই, সেখানে বাধা না পড়লে, নিয়ম মেনে প্রদর্শনে আপত্তি কেন?
৩. এই বছরেও ব্যতিক্রম হল না। সদ্য সিনেমা হল খোলার নির্দেশ এসেছে এবং থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহ খোলা যেতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সেটা কবে? বাকি সবকিছু চালু হওয়ার দীর্ঘদিন বাদে। কারণ শিল্প অপ্রয়োজনীয়। এই কথা প্রকাশ্যে বলা না হলেও, গতিবিধি থেকে বার্তা স্পষ্ট। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যের মধ্যে শিল্পকর্মকে গণ্য করা হয় না, বা তার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা ‘নন-এসেনশিয়াল’— এই শিক্ষা আমাদের সমাজ আমাদের প্রতি পদক্ষেপে দিচ্ছে।
একজন শিল্পের ছাত্র হিসেবে তাই কিছু প্রশ্ন করতে হয়:
আনলক-পর্বে যখন আর কোনওরকম চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা নেই, বা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, বারবার প্রেক্ষাগৃহ সেখানে শেষ স্থানে কেন? যদি ভাইরাস-সংক্রমণের চিন্তা থাকে, তাহলে রাজনৈতিক রোড-শো, মিছিল বা সমাবেশে নিয়মের উল্লঙ্ঘন কেন? শুধু রাজনৈতিক অনুষ্ঠান নয়, আরও বহু সামাজিক, ধার্মিক ও ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানকে তাহলে একই যুক্তিতে বাধা দিতে হয়।
চারদিকের এই পরিস্থিতিতে মনে হয় যেন শুধু শিল্প-জগতের লোকেরাই প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠান করে জীবাণু ছড়াবেন। এদিকে বারবার প্রমাণ হয়েছে, প্রেক্ষাগৃহে সমস্ত নিয়ম মেনে মানুষ এসে সিনেমা, থিয়েটার, গানের কনসার্ট, নাচের অনুষ্ঠান, কবিতার সন্ধ্যা ইত্যাদি উপভোগ করেছেন।
এবার যদি রোজগারের প্রসঙ্গ ওঠে, তাহলে আরও জোর গলায় জানতে চাইতে ইচ্ছে করে, শিল্পীদের রোজগার কীভাবে হবে? যাঁরা গৃহবন্দি অবস্থায় নির্দ্বিধায় মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন এতদিন কোনও পারিশ্রমিকের কথা না ভেবে, তাঁদের সংসার চলবে কী করে? প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে যুক্ত হাজারে হাজারে কর্মচারী। তাঁদের একমাত্র উপার্জনে তালা দেওয়া থাকছে। যখন বাকি সবই স্বাভাবিক গতিতে চলছে। শিল্পীদের সংসার ও রোজগারের বিষয়ে যদি কর্ণপাত না-ও করা হয়, তাহলে অর্থনীতির কথা ভাবতে হবে— দিনের পর দিনের প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক, কর্মচারীদের অনিশ্চিত কালের জন্য অবসর দেওয়া হচ্ছে। সেই বিষয়ে কোনও নিউজ-রুমে কেউ আলোচনা করবে কি?
অদ্ভুতভাবে আমরা এমন এক ঐতিহাসিক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান ওপরের তাকে তোলা থাকতে পারে, কিন্তু নির্বাচন হতেই হবে, বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব অতি আবশ্যক। স্কুল বা কলেজের লাখে লাখে শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষার সঙ্গে কেবল ‘কম্প্রোমাইজ’-এর ভিত্তিতে বেঁচে আছে, সেটা নিয়েও আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি, কারণ যুক্তির মান দিনে দিনে নিম্নমুখী হচ্ছে। ‘রাত ন’টার পর কি ভাইরাস বেশি করে ছড়ায়?’— ঠিক যেমন আমরা যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন করিনি, তেমনই শিক্ষা বা শিল্প বা বিজ্ঞানের ওপরে আঘাতকেও আমরা চিনতে পারিনি।
শিল্পের কথা উঠলেই একটি অনির্দিষ্টকালের জন্য মিটিং শুরু হয়, আলোচনা চলে, চিঠি লেখা হয়, যখন হাজারে হাজারে মানুষ কর্মহীন হয়ে বসে থাকেন। কারণ সমাজ তাঁদের বলেছে, শিল্পকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা অপরাধ। সামাজিক এই সংকেত নিশ্চয়ই উদ্বুদ্ধ করছে গৃহবন্দি বহু নাগরিকদের, যাঁরা শিল্পীদের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন। আমার পরিচিত অনেক ভাইবোন আছে— আগামী প্রজন্মের শিল্পীরা— যারা নিজেদের ছবি আঁকছে, গান গাইছে, নাটক লিখছে, বা মোবাইলে সিনেমা বানাচ্ছে। তাদের অনুরোধ করি, চারপাশের মানুষদের প্রশ্ন করতে: প্রয়োজনীয় হওয়ার মাপকাঠি কী?