রামকিঙ্করবাবুকে অনেক দিন ধরেই চিনি, ওঁর কাজও দেখছি সেই কবে থেকে— প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল। তখন শান্তিনিকেতনে প্রভাতবাবু, নন্দলালবাবুর উৎসাহে কারুসঙ্ঘের পত্তন হয়েছিল, কো–অপারেটিভ ভিত্তিতে কাজ হত।মূর্তি গড়ার কাজের অর্ডার এলে রামকিঙ্করবাবু করতেন, পেন্টিং-এর কাজ পেলে হয়তো আমি করতাম, টাকা যাঁর যখন দরকার তিনি নিতেন। এইভাবে বেশ কিছুদিন হয়েছিল। কিন্তু টিকল না।রামকিঙ্করবাবু কারুসঙ্ঘের হয়ে কিছু কাজ করেছিলেন, তার মধ্যে মনে পড়ছে ও সি গাঙ্গুলির বাড়িতে কিছু রিলিফ কাজ করেছিলেন।সেই কাজ সব দোকানপাট হয়ে ঢাকা পড়ে গেলেও শুনেছি নাকি এখনও আছে।
রামকিঙ্করবাবু কলাভবনে কিছুদিন কাজ করার পরে যখন এখানেই মডেলিং শেখাতে লাগলেন তখন আমিও এখানে কাজ শুরু করেছি। সেই সময় ছুটি-টুটিতে আমরা এখানেই থাকতাম, উনিও থাকতেন, কাজেই দেখাসাক্ষাৎ প্রায়ই হত। গ্রীষ্মের ছুটি, পুজোর ছুটিতে সারাদিন ধরে কাজ করেছি, উনিও করেছেন। তখনই অন্তরঙ্গতার সূত্রপাত, উনি আমার কাছে এলেন, আমি ওঁর কাছে গেলাম, একসঙ্গে চা-টা খেলাম, সিগারেট খেলাম। কাজের অ্যাসোসিয়েশনটা আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ করে দিয়েছিল। আমার আর ওঁর কাজের মধ্যে একটা সময় সাদৃশ্য পাওয়া যাবে, এটা যখন উনি করছেন তখন আমি ওটা করছি— এইরকম ভাবে বেশ চেনা যায়।
রামকিঙ্করবাবু যখনএখানে এসেছেন, তখনই তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ, তাঁর শুধু যা বদলেছে, তা হচ্ছে যাকে বলে গিয়ে ‘রুচি’। আর্টিস্ট হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ওঁর বাঁকুড়া থাকতেই। ওখানেই ছবি আঁকতেন, মূর্তি গড়তেন। রামানন্দবাবু ওঁকে যখন এখানে নিয়ে এলেন তার বছর পাঁচেক আগে থেকেই আমি এখানে আছি। এখানকার স্কুলে পড়তাম। ১৯১৯ সালে কলাভবন খুলল। তখন আমিও তাতে জয়েন করেছি। গুরুদেব ডিক্লেয়ার করলেন, ‘এই কলাভবন হল, তোরা যে যে ছবি আঁকবি সব যা’। আমরাও চললাম ডরমেটারি ছেড়ে। আমার সঙ্গের দুজন এখন জীবিত— ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মন এবং সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়। কলাভবন ওপেন হল আমাদের দুজনকে নিয়ে— আমি আর ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মন। তারপর কলকাতা থেকে দুজন এলেন অসিতবাবুর সঙ্গে— অর্ধেন্দু ব্যানার্জি আর হীরাচাঁদ দুগার। তখন আরও একজন ছিল মনে আছে— ভাগলপুরের কেষ্টকিঙ্কর ঘোষ। এখনও মনে হলে অবাক লাগে, কলাভবনে যোগ দেওয়াটা কেমন যেন ফেয়ারি টেল্স-এর মতো। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী, কলাভবন, সঙ্গীতভবন আর রিসার্চের শুরু ডিক্লেয়ার করলেন। একদিন খেলার মাঠে বললেন, ‘কে কোনটায় যেতে চাও লাইন থেকে বেরিয়ে এসো।’ আমি তখন লাইনে ছিলাম না, চোখ খারাপ ছিল বলে ড্রিল না করে বেড়াবার অনুমতি পেয়েছিলাম। পরদিন ইস্কুলে যাচ্ছি, রাস্তাতে ধীরেনবাবু বললেন কলাভবনের কথা। ব্যস আমিও চললুম ইস্কুলের দিকে না গিয়ে উল্টোদিকে।
রামকিঙ্করবাবু মডার্ন কাজ করেছেন, উনি করেছেন— আমিও জানি উনি তা করেছেন। তাই নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব আলোচন হত। আমি, নন্দবাবু, রামকিঙ্করবাবু সবাই ন’টার সময় চা খেতে বসতাম, সেখানেই আলোচনা হত। নন্দবাবু জিজ্ঞেস করতেন, ‘এটা কেন করছ, ওটা কেন ভালো’— এইসব কত কথা। এখানে স্কাল্পচারও উনিই প্রথম করেন। প্রথম শিক্ষকও উনি। সুধীর খাস্তগীর ছিলেন কনটেম্পরারি। এখানে থেকে কলাভবনের ছাত্র হলেন ওঁরা, রামকিঙ্করবাবু হলেন শিক্ষক। উনি প্রথমে শেখাতেন মডেলিং। রামকিঙ্করবাবুর কাছেই শুনেছি— ওসব উনি শিখেই এসেছিলেন। বাঁকুড়ায় প্রতিমা গড়ত এক কারিগর, ওঁকে ভালবাসত খুব। সেই কারিগরই মডেলিং-এর কাজ হাতে ধরে শেখায়। এসব রামকিঙ্করবাবুর নিজের মুখে শোনা। এখানে রামকিঙ্করবাবু প্রথমে ছবি করেছেন— মিনিয়েচার, অবনীবাবুর মতো ওয়াশ-এ হাইলি ফিনিশ্ড, হত। অয়েল পেন্টিং-ও এখানে প্রথম করেন রামকিঙ্করবাবু। তার আগে এখানে যেটুকু হয়েছিল স্থায়ী হয়নি। ফরাসি মহিলা আঁন্দ্রে কারপেলে কলাভবনে ট্রেনিং দিয়েছিলেন, প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো অয়েল পেন্টিং শিখেছেন। এটা ১৯২১-’২২ সালের ঘটনা হবে, রামকিঙ্করবাবু তখনও আসেননি। এটা অনেকেই জানতে চান যে রামকিঙ্কর যখন কিউবিজম বা মডার্ন অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট নিয়ে কাজ করছেন তখন কীরকম রিঅ্যাকশন হয়েছিল। এটা বুঝে দেখুন— রি-অ্যাকশন যদি না হত, লোকে যদি ভাল না বলত, তবে উনি কাজ করতেন কী করে? কনজিনিয়াল অ্যাটমসফিয়ার ছিল বলেই না তা হয়েছে। তাছাড়া অবনী-নন্দলালের ধারা খুবই ইলাস্টিক, সেইজন্যেও এসব হতে পেরেছে। নন্দবাবুরই কয় ছাত্র দেখুন— ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মণ, এঁর কাজ হাইলি ফিনিশ্ড, সফিস্টিকেটেড। প্রথম শ্রেণীর কাজ। আবার রমেন চক্রবর্তী, তিনি গ্রাফিক করলেন, লিথো, উডকাট, এচিং তাঁর স্পেশালিটি। এইখানেই তো তা করতে পারলেন। নন্দবাবুই নানা সুযোগ দিলেন— মেটিরিয়ালস দিলেন, রবীন্দ্রনাথ বই আনিয়ে দিলেন। সেই যে কথা আছে না— ‘হাঁচড়ে-পাঁচড়ে শেখা’— এখানেও তাই হত। যে দুজনের কথা বল হল তাঁরা হচ্ছে গ্লেয়ারিং এগজাম্পেল। আমি করেছিলাম ইটালিয়ান ফ্রেসকো— সেটাও তো এখানে হল। স্বীকার করতেই হবে ইন্ডিয়ার মধ্যে প্রথম ফ্রেসকোর চর্চা এখানেই হয়েছে। ইটালিয়ান প্রসেস পাওয়া গেল প্রথম, তখন তাই করা হল। তারপর মনে হল— জয়পুরে তো ফ্রেসকো করা হত, তা সেই মিস্ত্রি-টিস্ত্রি আছে নাকি বেঁচে? শৈলেন দে জয়পুর থেকে ফার্স্ট ক্লাস মিস্ত্রি পাঠালেন, সুন্দর কাজ হল। সুতরাং অবনী-নন্দবাবুদের ধারার সঙ্গে পরবর্তী যুগের মডার্ন ধারার বিরোধের কথা লিখবেন না। ওটা ঠিক নয়। রামকিঙ্করবাবু নন্দবাবুর মৃত্যুর পরে এখানকার শোকসভাতে বলেছিলেন— ‘অনেকে মনে করেন, নন্দবাবু মডার্ন আর্ট সম্বন্ধে অল্প কিছু লিখলেও আমরা বুঝি আলাদা। কিন্তু বলছি তিনি না থাকলে আমি কাজ করতে পারতাম না।’ পুরনো গেস্টহাউসের সামনে যে কাজটা, ওটা যখন হচ্ছে তখন আমরা তিনজনে একসঙ্গে বসে চা খেয়েছি। উনি কাজ করেছেন। নন্দবাবু বললেন— ‘এটা কী করলে? ওটা করে দাও’— এইসব। সাজেশনও দিলেন। সুতরাং এটা কখনওই ঠিক নয় যে ওঁদের সঙ্গে ফাইট করে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। মনে রাখবেন ১৯২১-এ স্টেলা ক্রাম্ররিশ আপ টু ডাডাইজম লেকচার দিয়েছেন। সেই লেকচার ওয়াজ কম্পালসারি ফর টিচার অ্যান্ড স্টুডেন্টস। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এটা কিন্তু বাধ্যতামূলক নন্দলাল। এটা তোমাদের অ্যাটেন্ড করতেই হবে।’ স্টেলা ক্রাম্ররিশ লেকচার দিয়েছিলেন সমস্ত পাশ্চাত্য শিল্প সম্বন্ধে— তাতে ডাডাইজম, কিউবিজম, সুররিয়ালিজম সবই ছিল। শুধু যেটা হয়নি সেটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট। আর হয়নি কোলাজ প্রভৃতি আমেরিকান ধারা। ক্রাম্ররিশ তখন যেরকম শিখিয়েছিলেন তাতে এখনও কাজ চলে যায়। ইন্ডিয়াতে তখন ডাডাইজম-এর নাম এই শান্তিনিকেতনের মুষ্টিমেয় ছাত্র ও শিক্ষক ছাড়া আর কেউ জানত না।
কাজেই মডার্ন অ্যানালিসিস অফ পেন্টিংস ইত্যাদি সব শান্তিনিকেতনে শেখানো হয়েছে রামকিঙ্করবাবু আসার আগেই। উনি এখানে আসেন ১৯২৫ সালে। তখনই আমরা পারি বা না পারি মুখে তো কপচাতে পারি। অর্থাৎ আবহাওয়া তৈরি ছিল। আর্টের উপর বইও পাচ্ছিলাম লাইব্রেরিতে। ছবির কপি, প্লেট ছিল। বা এখনও হয়তো কলাভবনে আছে।
কিউবিজম সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে— ইট ইজ নট দ্য টেকনিক, ইট ইজ দ্য অ্যাপ্রোচ। অ্যাপ্রোচটা হল ইন্টেলেকচুয়াল। টেকনিক তা নয়। ওয়েস্টার্ন এলিমেন্টস বা মডার্ন এলিমেন্টস সবাই নিয়েছেন যে যেভাবে পেরেছেন। যেটুকু তাঁর দরকার। আমরা ওয়েস্টার্ন এলিমেন্টসকে কপি করতে যাচ্ছি না। একটা ফোক আর্ট, ধরুন প্যাঁচা— দেখতে দেখতে মনে হবে ‘আরে এটা কেটেছে কেমন দেখছ! ঠিক যেন কিউবিজম।’ আমরা যেমন বুঝেছি, যে কট্টর কিউবিস্ট সে হয়তো বলবে, ‘না এটা হয়নি। শুদ্ধ হয়নি। কৌলিন্য নেই। ব্রাহ্মণত্ব বজায় রইল না।’ আমরা কৌলিন্য রাখার চেষ্টা করিনি। আমরা তো বর্ণসংকরের যুগের লোক। তবে এটা জানবেন এখন যেসব পন্ডিত আছেন, কিউবিজম ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁদের ধারণা স্কিনডিপ। ক্রাম্ররিশ আমাদের যা শিখিয়েছেন, কষ্ট করে অ্যানালিসিস শিখিয়েছেন, তাতে এখনকার— ধরুন বরোদা ইত্যাদিতে যা শেখানো হয় খুবই সুন্দর শেখানো হয়। কিন্তু দেখি যে আমরা বুড়ো হলেও খুব ব্যাকডেটেড নই। দু-পাঁচটা রেফারেন্স হয়তো আমাদের জানা নেই। কিন্তু মোটামুটি ফান্ডামেন্টাল যা, তা ক্রাম্ররিশ আগেই শিখিয়েছেন।
আর যেমন পেয়েছি তেমন করেছি। রামকিঙ্কর দেখুন— এও করেছেন, ও-ও করেছেন। একটা লোকের ইলাস্টিসিটি না থাকলে এত বড় হয় না। তাঁর যেটা গ্রেটনেস সেটা বলি— পাশাপাশি দেখুন, গেস্টহাউসের সামনে আছে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্কিটেক্ট, তারপর সাঁওতাল, সাঁওতাল মেয়ে দৌড়াচ্ছে— গ্রেকো-রোমান রিয়েলিটির দারুণ কাজ, তারপরেতে ‘বুল’, সেটা তো আমি চোখে দেখিনি, মোটামুটি শুনেছি। একটা লোক যে এইরকম করতে পারে— এছাড়াও আরও কাজ আছে, স্কাল্পচার আছে, ছোট ছোট কাজ আছে কলাভবনের গায়ে, দিল্লিতে বড় কাজ করেছেন ‘যক্ষ-যক্ষী’— একটা লোকের খুব একটা ফ্রি ইয়ে না থাকলে, চিন্তাভাবনায় ফ্রি ও ফ্রেশনেস না থাকলে সে এটা করতে পারে না। রামকিঙ্করবাবু পরে আমায় বলেছেন, ‘বিনোদবাবু, ইচ্ছা হল একটা রিয়ালিস্টিক করি। কী আপত্তি তাতে? কী আর লোকসান?’ কথাটা বলছিলেন সাঁওতাল পরিবারের সেই কাজটা, ‘মিল কল’ করবার সময়। কিউবিজম তাঁর একটা ফেজ, অমুক একটা ফেজ, কিন্তু তাঁর কনসিসটেন্সি? সেটা হচ্ছে স্কাল্পচারাল এলিমেন্ট, তার স্ট্রাকচার, তার ভল্যুম— এগুলো রামকিঙ্করবাবুর, এইটারই এভোলিউশন। আর থেকে থেকে স্ট্রাগল করেছেন, নানাদিক দিয়ে দেখেছেন, অ্যাপ্রোচ করেছেন— এতে হয় কি না, না হলে ওতে হয় কি না। যেমন একটা রচনা লিখবেন— শুরু করলেন রাবীন্দ্রিক ভাষাতে, তাতে হচ্ছে না, তারপরে ধরলেন গুরুচন্ডালিতে, তাতে হয়তো হল। এইরকম হয়। আমরা তো গুরুচন্ডালি যুগের লোক। বর্ণসংকর। রামকিঙ্করবাবু এটা অস্বীকার করেন না। তাঁর হয়েও আমি এটা বলতে পারি।
রামকিঙ্করবাবু বলবেন, উনি একটা লেখা লিখেছিলেন, কার জন্য লিখেছিলেন ভগবান জানে। সেই লেখাটি কোনরকম সংগ্রহ করে বাংলাতেই তাঁর যে ভাষা আছে সেই ভাষাতেই ছাপাবেন। নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে এমন অনবদ্য তাঁর রচনা— আমি কেন পেন্টিং করি, কেন স্কাল্পচার করি— কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উনি তাঁর উত্তর দিয়েছিলেন। আমি আপনাদের আবার বলছি— এরকম একটি রচনা খুব কমই দেখা যায়। প্রভাস সেন আমাকে লেখাটা এনে শুনিয়েছিল। ওর যা আছে— তার বানান ভুল, ভাষা ভুল সব নিয়েই ছাপাতে হবে। প্রভাস বলেছিল— ‘এরকম লেখা রঁদার সঙ্গে কমপেয়ার করা যায়।’ সত্যি অসাধারণ লেখা। ওঁর কাছে থাকলে খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে। প্রভাসকেই আমার নাম করে বলুন। ওই লেখাটি পেলে রামকিঙ্করবাবুর আর জীবনচরিত লেখাবার দরকার হবে না। রচনার কিছুটা আমার মনে আছে— সঠিক হয়তো নেই। ‘জীবনের উদ্যানে আমি ঘুরে বেড়াই। যা দেখি, হাসি, কান্না, ছোট শিশু, ফুল বা অমুক তা আমি ছবিতে আঁকতে থাকি। আর অন্ধকার রাত্রে আমার ছেলে যখন আমার বুকের উপর এসে পড়ে, তাকে যখন আমি জড়িয়ে ধরি, সেই অভিজ্ঞতা আমি স্কাল্পচারের মধ্যে রাখি।’ আপনি পাবেন না, পৃথিবীতে পাবেন না এই জিনিস। কাজেই তিনি কিউবিজম করছেন, কী কী করছেন, তাতে কী এল গেল! যার এরকম কনসিসটেন্সি তিনি সবই করতে পারেন। কিউবিজম দেখুন না— সেটা তিনি অ্যাসিমিলেট করে দিয়েছেন। এখন যাঁরা স্কাল্পচার, যাঁরা কিউবিজম দ্যাখেন, একবার তাঁদের রামকিঙ্কর বেইজকে দেখতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ কবে কালিদাস পড়েছিলেন বা অমুক পড়েছিলেন তা তো আমরা হিসাব রাখছি না কাব্য রসাস্বাদনের সময়। সেগুলো অ্যানালিসিস শিখতে দরকার হতে পারে। তার এভোলিউশন তো অন্যরকম।রামকিঙ্করবাবুর বেলাতেও তাই।
স্কাল্পচার হয় দু’রকমের— এক, ফ্রম নাথিং টু সামথিং। কিছু ছিল না ক্লে লাম্প এখানে বসিয়ে দিলাম। ক্লে থেকে অ্যাড করে করে ফর্ম তৈরি হল। দুই, বাই কাটিং অ্যান্ড এলিমিনেটিং ইউ গেট সামথিং। রামকিঙ্করবাবুর মধ্যে দুটোই আছে। শান্তিনিকেতনে যে বড় বড় কাজ তা নট বাই এলিমিনেটিং, বাই অ্যাডিং। এলিমিনেট করেছেন বৈকি। কিন্তু ফান্ডামেন্টাল প্রসেস হল— বাই অ্যাডিং। কিছু ছিল না, একটা আর্মেচার তৈরি করে বাই অ্যাডিং মেটিরিয়ালস জিনিসটা তৈরি হল। আবার ‘যক্ষ-যক্ষী’ করেছেন বাই এলিমিনেটিং। একটা ব্লক অফ স্টোন তিনি পেলেন, তার থেকে কেটে কেটে বার করলেন।
শান্তিনিকেতনের কাজগুলোর মধ্যে প্রথম করেছেন ‘সুজাতা’, তারপর মাটির বুদ্ধ ভেঙ্গে যাওয়ায় বর্তমান মূর্তি অনেক পরে তৈরী হয়, তারপর ‘সাঁওতাল দম্পতি’, গেস্টহাউসের সামনে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট, ‘ধান ঝাড়া’, ‘মিল কল’, এবং তার ফাঁকে-ফাঁকে কলাভবনের কালোবাড়ির কাজগুলো।
রামকিঙ্করবাবুর এই গুণগুলো পেন্টিংস-এও এসেছে। শেষের দিকের পেন্টিংস আমি দেখিনি। আগেরগুলোতে মনে হয়েছে, ওঁর পেইন্টিংস-এ কালার খুব প্রধান করে দিয়েছেন বলে পেইন্টারলি কোয়ালিটি আছে। তাই তাতে টাচ অপেক্ষা ভিসুয়াল এফেক্ট বেশি। সর্বত্রই এটা স্ট্রিক্ট বা রিজিডলি ভাববেন না। ওই যে বলেছেন, ‘জীবনের উদ্যানে যেটা দেখি, চোখের সামনে দিনের আলোয় তা ছবিতে আঁকি। আর যা টাচ করি অন্ধকারে, তা স্কাল্পচারে ধরি।’