ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হেঁশেলের হিস্‌সা: পর্ব ৫


    জয়ন্ত সেনগুপ্ত (May 28, 2021)
     
    মোগলাই মহাকাব্য

    খাওয়াদাওয়ার ইতিহাস আদতে সংযোগ আর আদানপ্রদানেরই ইতিহাস। কিছু নির্বোধ মানুষ অবশ্য আছেন, যাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতিকে এক স্ব-নির্মিত, স্বয়ম্ভূ বুদ্বুদের মতো দেখেন, যে কারও কাছে ঋণী নয়, যেন ‘তুমি যে তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ’। অথচ ভারতের ইতিহাসকে আমরা যদি তার খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসের দৃষ্টিতে বিচার করি, তাহলে দেখব যে ভারতীয় সংস্কৃতি নির্দ্বিধায় এবং নির্বিচারে তার খাবারদাবার এবং রন্ধনশৈলী গ্রহণ করেছে দুনিয়ার হরেক প্রান্ত থেকে। সেই ঋণ বস্তুতই পরিব্যাপ্ত এবং অপরিশোধ্য। এর এক মোক্ষম উদাহরণ দিয়েছিলেন প্রয়াত বরেণ্য ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন, ভারতীয় খাদ্যভুবনের সবচেয়ে নির্ভুল দুটি দিকচিহ্ন— আলু এবং লঙ্কা— দুইই এসেছে মাত্র পাঁচশো বছর আগে আবিষ্কৃত ‘নতুন বিশ্ব’ অর্থাৎ পশ্চিম গোলার্ধ থেকে। টোম্যাটো (যাকে কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমরা ‘বিলিতি বেগুন’ বলে জানতাম, রাজমা, ভুট্টা, ঢ্যাঁড়স, পেঁপে, আনারস, চা, কফির মতো আজকের নিত্যব্যবহার্য এই দুই খাদ্যবস্তুর ভারতে আগমনের জন্য দায়ী ছিল ষোড়শ শতক থেকে শুরু-হওয়া পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের মধ্যে খাদ্যশস্য, মানুষজন, চিন্তাচেতনা, ও রোগজীবাণুর এক বিশ্বায়িত বিনিময়, যাকে ইতিহাসবিদেরা বলেন ‘কলম্বীয় বিনিময়ব্যবস্থা’ (‘Columbian Exchange’)। ওই শতাব্দীতে পর্তুগিজরা ব্রেজিল থেকে জাপান পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত এক সমুদ্র-সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, আর অন্য দিকে স্পেনীয়রা ১৫৬০-এর দশকে ফিলিপিনসের দখল নেয়, আর এই দুই সূত্র ধরে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম এবং পূর্ব, দু’দিক থেকেই ভারতে ঢুকে পড়তে থাকে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে ‘নয়া দুনিয়া’-র খাবারদাবার। আজ আমরা হয়তো খানিক অচেতন ও অন্যমনস্ক ভাবে এ সব খাবারদাবার খেয়ে থাকি, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই সাংস্কৃতিক স্বয়ম্ভূবাদীদের বক্তব্যের অসারত্ব ধরা পড়ে।

    বাঙালির খাওয়াদাওয়ায় মুসলমানী রীতিনীতির অবদান কতটুকু? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, তার জন্য বাংলায় মুসলমান শাসনের পাঁচ শতাধিক বছরের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়কে ফিরে দেখতে হবে। প্রধানত পূর্ব বাংলার কৃষক মানুষজন ব্যাপক হারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, যার ফলে অবিভক্ত বাংলা হয়ে ওঠে এই এক সুবিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাসভূমি। তা সত্ত্বেও বাংলা তো পারস্য বা উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার আরবদের মতো আপামর মুসলিম হয়ে যায়নি, বাংলা ভাষা বা প্রাক্-মুসলিম সময়ের যাবতীয় স্মৃতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তাই মোটের, ঈশ্বর গুপ্তের উক্তি— ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল’— হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে  সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল, এখনও আছে। মুঘল আমলেও খানদানি কর্মকর্তারা মেছো বাঙালিকে গেঁয়ো জেলে বলে হেলাছেদ্দা করতেন। তাঁরা নিজেরা বাংলায় নিয়ে আসেন গোমাংস ও মুরগি খাওয়ার প্রচলন। মুরগি জবাই করে মোল্লা পয়সাও পেতেন। তো নিয়মিত মাংস খাওয়ার অভ্যাস বাংলায় চালু করলেন সম্পন্ন মুসলিমরাই। এ ছাড়া সুলতানি আমলের তুর্ক-আফগানরা যেসব নতুন খাবার চালু করলেন তার মধ্যে ছিল সুগন্ধী মশলা (বিশেষ করে পর্তুগিজদের কাছ থেকে কেনা) আর চাল সহযোগে নানাবিধ পোলাও (তুর্কি ‘পিলাফ’ শব্দ থেকে), আর দুধ চাল বাদাম কিসমিস এলাচ দিয়ে তৈরি ফিরনি (যার কাবুলি সংস্করণকে বলে ‘শিরবিরিঞ্জ’), যা আমাদের পায়েসেরই গোত্রান্তর, আর যাকে এখনও অনেকে বলেন ‘আফগান কাস্টার্ড’। ভাবুন তো, যে চাল মধ্য এশিয়া আর ইউরোপে গেল ভারতের (প্রধানত বাংলার) শস্যাগার থেকে, সেই আবার ফিরে এল মাংস মশলা বাদাম কিসমিস সহযোগে  পোলাও বা ফিরনি হয়ে। ওই যে সংযোগের কথা বলছিলাম না?

    ঈশ্বর গুপ্তের উক্তি— ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল’— হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে  সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল, এখনও আছে। মুঘল আমলেও খানদানি কর্মকর্তারা মেছো বাঙালিকে গেঁয়ো জেলে বলে হেলাছেদ্দা করতেন। তাঁরা নিজেরা বাংলায় নিয়ে আসেন গোমাংস ও মুরগি খাওয়ার প্রচলন। মুরগি জবাই করে মোল্লা পয়সাও পেতেন। তো নিয়মিত মাংস খাওয়ার অভ্যাস বাংলায় চালু করলেন সম্পন্ন মুসলিমরাই।

    আর সেই সংযোগ আরও জোরদার হল মুঘল আমলে। শেরশাহের তাড়া খেয়ে সফাভিদ সাম্রাজ্যশাসিত পারস্যে পলাতক হুমায়ুন যখন ভারতে ফিরে এসে আবার সাম্রাজ্যের দখল নেন, তাঁর সঙ্গে ভারতে আসেন অনেক ইরানি অভিজাতবর্গ, সমরকুশলী, পণ্ডিত, শিল্পী, এবং সেই সঙ্গে বাবুর্চিও। ক্রমশ তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন ভারতে, আর ১৫৭৬ সালে আকবরের বঙ্গবিজয়ের কয়েক দশক পর যখন ঢাকায় গড়ে উঠল মুঘল বাংলার রাজধানী, তখন সেখানে রীতিমতো জাঁকিয়ে বসলেন এই ইরানি অভিজাতরা, তাঁরাই পরিচিত হলেন কুলীন বংশমর্যাদা-সম্পন্ন আশরাফ মুসলিম হিসেবে। আর তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় হইহই করে ঢুকে পড়ল ইরানি কেতার নানান রান্নাবান্না খাবারদাবার— সর্বাগ্রে বিরিয়ানি তো বটেই, তার সঙ্গে আরও নানান বাহারি পোলাও, মশলা মাখিয়ে ম্যারিনেট করে তন্দুর উনুনে তৈরি রকমারি কাবাব, হরেকরকম পরোটা, নান, শীরমাল (বা ঢাকার সুস্বাদু বাকরখানি, যা আমাদের জ্যাকারিয়া স্ট্রিটেও ঈদের সিজনে দেদার পাওয়া যায়), সিঙাড়ার মতো মুখরোচক জলখাবার, হালুয়া, ফালুদা, শরবত, আর কোর্মা, কোফতা, কালিয়ার মতো মণিমুক্তো। সেই সঙ্গে বাদাম পেস্তা কিসমিস দারচিনি এলাচ জাফরান দিয়ে রান্না। এরপর সময় যত এগিয়েছে, বাঙালি মজ্জায় মাংস মজেছে আরও বেশি করে, মুসলিম শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে হিন্দু বাঙালির যজ্ঞিবাড়ির আদা-জিরের মাংসের— বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় দুর্গাপূজার অজ মাংস (যা) শুধু একটি দুটি নম্রভাষী তেজপাতা দিয়ে সুবাসিত— জায়গা উত্তরোত্তর নিয়েছে পেঁয়াজ রসুনের গরগরে ঝোল। আর মুঘলরা যে নিতান্ত ঘরোয়া, আটপৌরে খিচুড়িকেও খানদানি রান্নার স্তরে উঠিয়েছিল, এই ঘোর বর্ষার দিনে সেই অতি প্রিয় ‘কমফর্ট ফুড’টি খেতে খেতে সেই জরুরি তথ্যটিকে স্মরণ করা অবশ্যই প্রয়োজন। আর আমাদের জিভে সেই স্বাদগন্ধ যে চারিয়ে গেল, তার আর যাবার নামটি নেই। নয়তো কি আর আলু ফুলকপি পনির থেকে শুরু করে দেদার নিরিমিষ জিনিসকেও আমরা মোগলাই ঘরানায় তন্দুরি কেতায় খোলতাই করার চেষ্টা করি? তবে বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, আমরা মুঘল বাদশাদের নানা রেসিপির উপরে খোদকারি করতে ছাড়িনি কোনওদিন, তাই তো ঢাকায় শাহি মোরগ পোলাওকে একটু কায়দা করে তেহরি বানাই, কষিয়ে সাঁতলে খিচুড়ির ভুনি ভার্শনের নির্জলা স্বাদসৌকর্য উপভোগ করি, এমনকী খোদ বিরিয়ানিতে মাংসকে উপেক্ষা করে (কখনওসখনও) সগর্বে আসরে নামিয়ে দিই আমাদের সেই নির্ভুল অভিজ্ঞান-কবচ, ইলিশ মাছ। 

    শহর কলকাতায় মোগলাই কায়দার খাওয়াদাওয়ার ইতিহাসও প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো, সেই পলাশী আর বক্সারের যুদ্ধের উত্তরপর্বে বাংলার উপ-নবাব মহম্মদ রেজা খান যখন চিৎপুরে জব্বর মহল বানান, আর সেই এলাকায় গড়ে ওঠে কিছু মুসলিম বসতি, আর তার সঙ্গে মানানসই কিছু কাবাব পরোটার দোকান। টিপু সুলতানের কলকাতায় নির্বাসিত পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ ১৮৩০ আর ’৪০-এর দশকে ধর্মতলা আর টালিগঞ্জে বানালেন দুটি মসজিদ, তখন তাদের আশেপাশেও ঝাঁপ খুলল দু’চারটি খাবারের দোকান। কিন্তু, আমরা তো সকলেই জানি শহরে মোগলাই খানার বিবর্তনের ইতিহাসে সেই যুগান্তকারী ঘটনার কথা– ১৮৫৬ সালে আওধের তখত থেকে চ্যুত হওয়ার অনতিকাল পরে কলকাতায় নির্বাসিত হয়ে মেটিয়াবুরুজে আস্তানা গাড়লেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ, আর তাঁর গড়ে-তোলা কলকাতার উপকণ্ঠে সেই টুকরো-লখনউতে দলে দলে ভিড় জমালেন পুরনো আমির-ওমরাহদের সঙ্গে সঙ্গে নবাবি রসুইখানার বেশ কিছু বাবুর্চি আর রকাবদার, অর্থাৎ যাঁরা পাকাতেন নবাবের নিজস্ব খানা। সেই রকম কারও হাতেই আওধি বিরিয়ানির সঙ্গে ভুরভুরে খুশবুদার সুসিদ্ধ আলুটির রাজযোটক সম্বন্ধ, সেই বিবাহেরই সন্তান সর্বধর্মের আশীর্বাদধন্য আজকের ‘ক্যালকাটা বিরিয়ানি’। প্রমাদবশত কেউ কেউ ভেবে থাকেন, রাজ্যহীন, পেনশনভোগী, অসচ্ছল কিন্তু ঔদরিক নবাবের বিরিয়ানিতে মাংসের যথেষ্ট জোগান হত না, সেই ঘাটতি মেটাতেই আলুর গৌরবময় প্রবেশ। আসলে তা মোটেই নয়, উনিশ শতকে আলু কলকাতার বাজারে দুষ্প্রাপ্য নতুন সব্জি, পর্তুগিজদের হাত ধরে তার আগমন। অতএব আলুর এক্সপেরিমেন্ট ছিল কোনও এক সৃষ্টিশীল রকাবদারের ‘ব্রেনওয়েভ’, যাতে মজে গেলেন মেটিয়াবুরুজের নবাব, আর তার পর আস্তে আস্তে সারা বাংলা। সেই জন্যই গোড়াতেই বলছিলাম না, ‘নতুন বিশ্বের’ আমেরিকা থেকে পর্তুগিজ বণিকদের হাত ধরে আলু এল ইউরোপে, তার পর ভারতে, আর সে জাঁকিয়ে বসে গেল ইরানি কায়দায় রাঁধা, ভারতীয় মশলায় খুশবুদার, আওধ হয়ে কলকাতায়-আসা বিরিয়ানির প্লেটে, একে সংযোগ আর মেলবন্ধনের মহাকাব্য ছাড়া আর কী বলবেন? আর ভারতীয় খাওয়াদাওয়াকে যদি মহাকাব্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে বিরিয়ানিই তার অবিসংবাদিত নায়ক, আদতে মুসলিম রান্না হলেও সে-ই আমাদের ‘ন্যাশনাল ডিশ’, সে আজ মুঘলসরাই ধাপ্পা দিয়ে নিজেকে ‘দীনদয়াল উপাধ্যায়’ বলে চালানোর যতই চেষ্টা করুক না কেন।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook