একটা মানুষ ছোটবেলা থেকে যখন ক্রমে-ক্রমে বড় হয়, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে একটা আকৃতি নেয় সে। বাইরের আর ভেতরের তাগিদে তার মনের গঠন শুরু হয়। তারপর কেউ প্রতিষ্ঠা পায়, কেউ হারিয়ে যায় জনতার ভিড়ে। জনতার ভিড়ে যে হারিয়ে গেল, সে আর খুঁজে পেল না নিজেকে। সে আর জানতে পারলে না পৃথিবীকে। সে আর চিনতে পারলে না তার অস্তিত্বকে। কিন্তু যে হারিয়ে গেল না, সে হয় গুরু দত্ত। আমার এই ‘বিনিদ্র’ তাই তাদেরই প্রতীক, যারা গুরু দত্তের মতো অতন্দ্র হয়ে জীবনে দাগ কেটে যাওয়ার প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়-সংকল্প। এর পরে আমি কলকাতা চলে আসি। আবার সেই লেখা। আর লেখার মধ্যে ডুবে যাই।
কিন্তু আবার বড় অদ্ভুতভাবে বোম্বে যাবার ডাক এল আমার। ১৯৬১ সালের ১ জানুয়ারি বোম্বেতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উৎসবের উদ্বোধন করার জন্য আমার কাছে আমন্ত্রণ এল সরকারের তরফ থেকে। আমাকে বোম্বে যেতে হবে। আমার সঙ্গে আরো কিছু সাহিত্যিক থাকবেন। এবার যাব ট্রেনে। ভাবলাম, বোম্বে যখন যাচ্ছি তখন গুরু দত্তের সঙ্গেও একবার দেখা করা যাবে। সেই ভেবে একটা ফোন করে জানিয়ে দিলাম গুরুকে যে আমি আবার বোম্বে যাচ্ছি, আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
৩০ ডিসেম্বর ১৯৬০ সালের সকাল দশটার সময় গিয়ে বোম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া টারমিনাসে পৌঁছোলাম। সঙ্গে আরো অনেক সাহিত্যিক বন্ধু। ‘দেশ’-এর সাগরময় ঘোষও সঙ্গে আছেন, প্রমথনাথ বিশী, রমাপদ চৌধুরী আছেন, গজেন্দ্রকুমার মিত্র আছেন। আরো অনেক সহযাত্রী হয়েছেন।
ট্রেন থেকে নেমে মালপত্র নিয়ে গেট থেকে বেরোচ্ছি হঠাৎ দেখি রতন দাঁড়িয়ে। গুরু দত্তর খাস চাপরাশি সেই রতন। সেই নির্বিকার দৃষ্টি, সেই পাথরের মুখ। বললাম— কি খবর রতন? সাহেব তোমার কেমন আছেন?
রতন বললে— ভালো আছে হুঁজুর, আপনার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, আপনাকে নিতে এসেছি।—
বললাম— তুমি তোমার সাহেবকে গিয়ে বল আমি দু-তিন দিন পরে যাব সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে—
রতন বললে— আপনার ঠিকানাটা এই কাগজে লিখে দিন—
পকেট থেকে কাগজের একটা টুকরো বার করে দিলে তাতে আমি আমার হোটেলের নাম-ঠিকানা লিখে দিলাম। রতন সেলাম করে চলে গেল।
ম্যাজেস্টিক হোটেল। একসঙ্গে সবাই উঠেছি সেখানে। পাকিস্তান থেকে ডেলিগেট হয়ে এসেছে জসীমউদ্দীন সাহেব। বহুদিন পরে সকলের সঙ্গে দেখা। কিন্তু মনে শান্তি নেই। পুরোপুরি মন খুলে আড্ডা দিতে পারছি না। ১লা জানুয়ারি তারিখে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসবের উদ্বোধন। পণ্ডিত নেহরু উদ্বোধন করবেন।
বোম্বাই তখন আমার কাছে পুরোনো জায়গা। ১৯৫৮ সালে আগে একবার গিয়ে কাটিয়ে এসেছি, তখনই সব দেখা হয়ে গেছে। সবাই মিলে আবার সেদিন বেড়াতে বেরোলাম। সমুদ্রের ধারে জাহাজের ভিড়। কিন্তু মনে আমার তবু অশান্তি। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ তখন পুরোদমে চলছে। পাঠক-পাঠিকারা উদ্গ্রীব হয়ে পড়ছে, আর আমি বিশ্রাম নিচ্ছি— এটা ঠিক নয়। লেখকের বিশ্রাম থাকতে নেই। লেখক বিনিদ্র। তার আরাম, ঘুম, খিদে থাকলে লেখা খারাপ হয়। তাকেও পাঠকের সঙ্গে সমান আগ্রহে সমান কৌতূহলে লিখে যেতে হয়। পাঠকরা বিনিদ্র, লেখকও বিনিদ্র।
সন্ধেবেলা সাগরবাবু বললেন, কাল কিন্তু আপনার ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর কিস্তি দিতে হবে—
আমিও তাই ভাবছিলাম। বোম্বাইতে আছি বটে, কিন্তু মন পড়ে আছে লেখার পাতায়। আমি তখন কালীঘাটের রাস্তায় রাস্তায় দীপঙ্করের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
পরের দিন ৩১শে ডিসেম্বর। ভোর রাত্রে ঘুম থেকে উঠলুম। তখন আমাদের দলের সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি আমার ঘরের টেবিলে আলোটা জ্বেলে নিলাম। সাগরবাবু আমার ঘরে আর একটা বিছানায় ঘুমে অসাড়। তাঁর চোখে আলো না লাগে। তারপর লেখা চলছে। এক পাতার পর দু-পাতার পর তিন পাতা। পরপর পাঁচ পাতা লেখা হচ্ছে। হঠাৎ সেই অত ভোরে দরজায় ধাক্কা। বললাম— কে?
দরজা খুলে দিতেই দেখি প্রমথনাথ বিশী মশাই। ভোরবেলাই ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। বললেন— কি করছেন? লিখছেন? খুব ভালো, খুব ভালো, ভোরে উঠে রোজ লিখবেন। ভোরবেলাটায় লেখা ভালো হয়—
বললাম— না, তা নয়, ভোরবেলা জীবনে লিখিনি, এখানে এসে বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছে—
— সাগর ঘুমোচ্ছে বুঝি?
প্রমথবাবুর সেই জলদ্-গম্ভীর গলার আওয়াজে সাগরবাবুর ঘুমের যেটুকু বাকি ছিল, তাও হল না।
— সাগর তুমি উঠো না, ঘুমোও। আমি শুধু দেখতে এলুম কী করছ—
কিন্তু বিদেশে সবাই এক ছাদের তলায় আছি, গল্প না-করলেই বা চলবে কেন? প্রমথবাবু জমিয়ে গল্প করতে বসে গেলেন। আমিও একটা পাতায় এসে ‘ক্রমশ’ বসিয়ে দিলুম। তারপর লোক মারফত সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হল ‘দেশ’ পত্রিকার বোম্বাই অফিসে। সেখান থেকে তারা পাঠিয়ে দেবেন কলকাতায় পরের সপ্তাহে ‘দেশ’-এ ছাপাবার জন্যে।
সন্ধেবেলা হোটেলের বাইরে গিয়ে মিটিং-এর জায়গাটা দেখে এলাম। তার পাশেই বিরাট ‘এম-এল-এ’দের কোয়ার্টার। সেখানেও অনেক ডেলিগেট উঠেছেন। তাঁদের সঙ্গেও দেখা হল।
তারপর হোটেলে ফিরে এসে গল্প করছি। হঠাৎ আমার নামে টেলিফোন।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এখানে আমাকে কে টেলিফোন করবে?
— কে?
— আমি গুরু দত্ত। আপনি বোম্বাইতে এসে হোটেলে উঠেছেন? এখুনি চলে আসুন। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি—
বললাম— এখন আসা একটু মুশকিল হবে গুরুজী, আমি একটা কনফারেন্সে এসেছি। কাল পণ্ডিত নেহরু আসবেন এখানে লেকচার দিতে। নেহরুজীর লেকচার না হলে আমার এখান থেকে নড়ার উপায় নেই—
গুরু দত্ত বললে— ঠিক আছে, কালই তাহলে আপনাকে গাড়ি পাঠাব। আপনি ওখান থেকে সোজা আমার স্টুডিওতে চলে আসবেন—
— স্টুডিও কেন?
— কাল ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর মহরৎ হবে। তারপর ছবির প্রথম শুটিং শুরু হবে। আপনি ওখানেই আসবেন—