কোম্পানি, রাজনীতি, গির্জা
ষোড়শ শতকের তিনের দশক অবধি ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক গির্জার ক্ষমতা ছিল প্রবল এবং তৎকালীন রাজা অষ্টম হেনরির শাসনকালে তীর্থযাত্রা, সাধু-সাধ্বীদের পর্ব, ধর্মীয় নাটকের মতো সকল ধর্মানুষ্ঠান সমারোহে পালিত হত। অষ্টম হেনরি এবং তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিনের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাই হেনরি চেয়েছিলেন এই বিবাহ বাতিল/খারিজ (Annul) করতে, তাঁর এই আবেদন পোপের কাছে পৌঁছলেও বিবাহ বাতিল/খারিজ করতে পোপ অস্বীকৃত হন। এর পরে হেনরি ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করেন এবং ‘অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি’-র (১৫৩৪) মাধ্যমে ইংল্যান্ডের গির্জার সর্বোচ্চ প্রধান হিসেবে পরিণত হন। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সূচনা এখান থেকেই, অ্যাংলিকান নামে পরিচিত হয়ে ওঠা এই প্রোটেস্ট্যান্ট শাখার সঙ্গে কলকাতাকে পরিচয় করিয়ে ছিলেন ইংরেজরা।
কলকাতা শহরে পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন ইংরেজদের তৈরি প্রথম গির্জা ‘সেন্ট অ্যান’ (১৭০৯) কুমারী মারিয়ার মা অ্যানের নামে নিবেদিত হয়েছিল। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ঠিক সেই সময়ে যিনি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসে আছেন, তিনি রানি অ্যান। স্টিফেন নীল তাঁর ‘আ হিস্ট্রি অফ ক্রিসচিয়ানিটি ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে বলেছেন, “the church was dedicated to St. Anne, the reference being in reality not so much to the mother of the Virgin Mary as to the sovereign at that time reigning in England.”
বর্তমানে শহরের প্রাচীনতম প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা ওল্ড মিশন চার্চ (১৭৭০)। যদিও রাধারমণ মিত্র গির্জাটির নামের উৎপত্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখিয়েছেন গির্জাটির আসল নাম ‘ওল্ড অর মিশন চার্চ’। যিনি নিজ উদ্যোগে এই গির্জাটি নির্মাণ করেছিলেন, তিনি জন জ্যাকারায়া কিয়েরন্যান্ডার, একজন লুথেরান শাখার মিশনারি।



ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের ব্যবসায়িক সফলতার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, কোম্পানি নিজের এলাকায় কোনও মিশনারিদের বসবাস বা ধর্ম প্রচার করতে দিতে চাইতেন না, পাছে কোনও বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং প্রাচ্যে তাদের সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এসব প্রতিকূলতার মাঝেও কিয়েরন্যান্ডার ধর্মপ্রচার করতে কলকাতায় এসে পৌঁছচ্ছেন ১৭৫৮ সালে। এই সুইডিশ মিশনারি তার আগে ধর্ম প্রচারের কাজ করেছিলেন দক্ষিণ ভারতের কুড্ডালোরে, সেখানে থাকাকালীন রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। ফরাসিরা কুড্ডালোর দখল করে নেওয়ার পরে সেখানে কিয়ারন্যান্ডারের মিশনারি কাজ বন্ধ হয়ে যায়, এর পরে রবার্ট ক্লাইভের আমন্ত্রণে তিনি কলকাতায় আসেন, ফলত অনুমান করা যায় অন্য মিশনারিদের মতো তাঁকে হয়তো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। জানা যায়, কলকাতায় আসার পর প্রথম বছরেই তিনি পনেরো জনকে ব্যাপটাইজ করেন, এদের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণও ছিল। কিয়েরন্যান্ডার লুথেরান শাখার হলেও কলকাতায় অ্যাংলিকানদের মাঝে কাজ করতে তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি। মিশন রো-তে অবস্থিত নিজের গির্জাকে কিয়ারন্যান্ডার ‘Beth Tephillah’ ( প্রার্থনার গৃহ) বলতেন।
কিয়েরন্যান্ডারের গির্জাতেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তবে এই গির্জাও হারিয়ে যেতে পারত কালের নিয়মে।

১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কিয়েরন্যান্ডারের পুত্র রবার্টের ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এক বিশাল ঋণের দায়ভার এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। পুত্রের জামানত/জামিনদার ছিলেন তিনিই। এই বিশাল ঋণ তাঁর পক্ষে শোধ করা অসম্ভব ছিল। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাই নিলামে ওঠে। চার্চের মালিকানা যেহেতু তাঁর, এবং এমনকী, ধর্মীয় কারণেও এর রেহাই নেই, তাই নিলামে উঠলে আসল মূল্যের থেকে খুবই কম দামে এর বিক্রি হত। এই সংকটময় মুহূর্তে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত চার্লস গ্র্যান্ট অবতীর্ণ হয়ে গির্জাটি কিনে নেন। সে-যাত্রায় রক্ষা পায় গির্জা। এরপর এই গির্জাটি তিনজন ট্রাস্টির কাছে হস্তান্তর করা হয়— রেভারেন্ড ডেভিড ব্রাউন, মি. উইলিয়াম চেম্বার্স এবং মি. চার্লস গ্রান্ট। বিশপ চ্যাটারটন বলেছেন, ‘From this time onwards this Church became famous as a great centre of evangelicalism in India.’
ওল্ড মিশন চার্চ তৈরি হওয়ার দু’বছর পর কলকাতায় অ্যাংলিকানদের চ্যাপলিন হয়ে এসেছিলেন রেভারেন্ড উইলিয়াম জনসন। কলকাতা শহরে প্রোটেস্ট্যান্টদের উপাসনার জায়গার অভাব অনুভব করে তিনি গভর্নর জেনারেল এবং কাউন্সিলকে চিঠি লিখে একটি গির্জা নির্মাণের জন্য আবেদন করেন। জনসনের চিঠিটি ওয়ারেন হেস্টিংস ও তাঁর কাউন্সিল সদয়ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে তাঁরা জানান যে, এই আবেদন মঞ্জুরের ক্ষমতা তাঁদের আছে বলে তাঁরা মনে করেন না, যদিও তাঁরা চিঠিটি লন্ডনে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের কাছে পাঠিয়ে দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু কোর্ট অফ ডিরেক্টরস তখন অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিলেন না, ফলে সাত বছর ধরে বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যায়।





কিন্তু জনসনও হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না, কোম্পানির সাহায্য ব্যতিরেকে বিকল্প পথে অনুদান ও লটারির মাধ্যমে গির্জা নির্মাণের অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ওয়ারেন হেস্টিংস ব্যক্তিগতভাবে গির্জা নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁর কারণেই রাজা নবকৃষ্ণ দেব গির্জা নির্মাণের জন্য জমি দান করেন, তবে এই জমি পাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত ভাবে হেস্টিংসের দশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল, সে-কথা তিনি গির্জা নির্মাণ কমিটির কাছে উল্লেখ করেননি। ১৭৮৭ সালের “সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্ট’স ডে”-তে উৎসর্গ হওয়া লন্ডনের ‘সেন্ট মার্টিন ইন দ্য ফিল্ডস’-এর আদলে তৈরি এই গির্জা সুপরিচিত “সেন্ট জন’স চার্চ” নামে। জব চার্নকের সমাধি, জন যোফানির পেইন্টিং, বিতর্কিত ব্ল্যাকহোল মনুমেন্ট ছাড়াও অজস্র সমাধি, স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিফলকের আবরণে মোড়া এই গির্জা আক্ষরিক অর্থে ধর্মীয় পরিচিতিকে অতিক্রম করে কবেই যেন হয়ে উঠেছে শহরের এক বিকল্প মিউজিয়াম। তবুও আমরা যেন না ভুলে না যাই, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত ক্যাথিড্রালের মর্যাদায় ভূষিত ছিল এই গির্জা, এই গির্জাতেই ভারতের অ্যাংলিকানদের প্রথম বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন থমাস মিডলটন। পাশাপাশি আমরা যেন এটাও মনে রাখি, যে, এই গির্জার মেঝে নির্মাণ হয়েছিল গৌড়ের রাজাদের সমাধি থেকে খুলে আনা নীল মার্বেল দিয়ে।
ভারতে ধর্মপ্রচারের অভিপ্রায়ে আগত মিশনারিদের সামনে এক বিরাট সম্ভাবনাময় সময়পর্বের সূচনা হয় ১৮১৩ সালের ১৩ জুলাই চার্টার অ্যাক্ট নবীকরণ/নবায়ন হওয়ার মাধ্যমে। এর পরে মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পায়। ১৮১৩ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টার নবীকরণ/নবায়ন করা হচ্ছিল, তখন চার্চ অফ ইংল্যান্ডের একটি অংশ কলকাতায় একটি ‘বিশপরিক’ বা বিশপের পদাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রবল প্রচেষ্টা চালায়। এই প্রচেষ্টা হাউস অফ কমনসে তীব্র বিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত বিলটি পাশ হয়, এর পরে কলকাতার জন্য একজন বিশপ এবং কলকাতা, বম্বে ও মাদ্রাজের জন্য আর্চডিকন, অর্থাৎ বিশপের ঠিক পরের স্তরের পদাধিকারী, নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়।

১৮১৩ সালের পরে কলকাতায় কর্মরত মিশনারিদের মধ্যে যারা উপাসনালয় নির্মাণ করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘লন্ডন মিশনারি সোসাইটি’, এরা ভারতে নিজেদের মিশনারি প্রথম প্রেরণ করেছিল ১৭৯৮ সালে, তবে চার্টার অ্যাক্ট নবীকরণ/ নবায়নের পর লেনিন সরণীতে এরা গড়ে তোলে ‘ইউনিয়ন চ্যাপেল’ (১৮১৮)। যদিও প্রাথমিকভাবে উপাসনালয়টি ইউরোপীয়দের জন্য ব্যবহৃত হত, তবে ইউনিয়ন চ্যাপেল তাড়াতাড়ি স্থানীয় মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করে এবং অন্যান্য খ্রিস্টীয় শাখার বিশ্বাসীদের উপাসনার জন্য স্বাগত জানায়। এই লন্ডন মিশনারি সোসাইটি দ্বারা পরিচালিত এলএমএস ইনস্টিটিউশন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। ১৮৪৩ সাল থেকে লন্ডন মিশনারি সোসাইটি দ্বারা ধর্মান্তরিত অধ্যাপক, ছাত্র এবং কিছু সাধারণ মানুষ এই কলেজ প্রাঙ্গণের মধ্যে কোনও এক পুরনো বাংলোয় প্রতি রবিবার বাংলায় উপাসনা করতে শুরু করেন। পরে ১৮৬৮ সালে লালা লাজপত রাই সরণিতে অবস্থিত ‘ভবানীপুর কংগ্রিগেশনাল চার্চ’ নামে পরিচিত এদের বর্তমান গির্জাটি উৎসর্গ করা হয়।

মিশনারি দলের পাশাপাশি এই সময় নগর কলকাতা পরিচিত হচ্ছে আরও এক খ্রিস্টীয় শাখার সঙ্গে, সেটি হল ‘প্রেসবিটেরিয়ান’ অথবা ‘চার্চ অফ স্কটল্যান্ড’। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশনের সময় ফরাসি ধর্মতত্ত্ববিদ জন কেলভিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই শাখার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জন নক্স। বিবাদি বাগ অঞ্চলে সাদা রঙের সুউচ্চ চূড়া বিশিষ্ট গির্জা “সেন্ট অ্যান্ড্রু’স চার্চ” (১৮১৮) প্রেসবিটেরিয়ানদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট-পরবর্তী সময় শুধু মিশনারিদের কাজ করার পথ সুগম করছে না, অ্যাংলিকান চার্চের ক্ষমতার ক্ষেত্রে ও নতুন বিন্যাস তৈরি করছে। ‘বেঙ্গল : পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়— এই সময় ভারতের তিন প্রেসিডেন্সিতে প্রেসবিটেরিয়ানদের জন্য নিজস্ব চার্চ তৈরি এবং মিনিস্টার নিয়োগের বিষয় উল্লেখ করে কোর্ট অফ ডিরেক্টর চিঠি পাঠাচ্ছেন বাংলার গভর্নর জেনারেলের কাছে। এরপরে প্রেসবিটেরিয়ানদের চ্যাপলিন হয়ে কলকাতায় আসেন রেভারেন্ড জেমস ব্রাইস। প্রেসবিটেরিয়ানদের প্রতিনিধি হিসেবে অ্যাংলিকান বিশপ মিডলটনের সমমর্যাদা লাভ করার আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ ছিল তাঁর মন, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর গির্জা ‘সেন্ট অ্যাান্ড্রু’ যেন অ্যাংলিকানদের ক্যাথিড্রালের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, এমনকী, ক্যাথিড্রালকেও যেন ছাড়িয়ে যায়। চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের মিশনারি হয়ে প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ (১৮৩০)। পরে প্রেসবিটেরিয়ানদের মধ্যে ভাঙন ধরলে ডাফ এবং তাঁর কিছু সহকর্মী মূল প্রেসবিটেরিয়ান শাখা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘ফ্রি চার্চ অফ স্কটল্যান্ড’ শাখায় যোগদান করেন। এরপর রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে তৈরি হয়েছিল তাঁদের নিজস্ব গির্জা। গির্জাটি আজও আছে। তবে ‘প্রভু যিশুর গির্জা’ নামে নতুনভাবে পরিচিত এই উপাসনালয়টি বর্তমানে রোমান ক্যাথলিক চার্চে রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়াও মানিকতলা অঞ্চলে এদের আর-একটি গির্জা অবস্থিত। আগে ‘দ্য ইউনাইটেড ফ্রি মিশন চার্চ’ নামে এই গির্জা পরিচিত হলেও ১৯১০ সালে আলেকজান্ডার ডাফের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গির্জাটির নাম হয় ‘ডাফ চার্চ’।
সমান্তরাল গতিতে অ্যাংলিকানদের উপাসনালয়ের সংখ্যাও বৃদ্ধি হচ্ছিল। বর্তমান মির্জা গালিব স্ট্রিটের যে অংশে ইংরেজদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ফ্রি স্কুল, (পরবর্তীকালে খিদিরপুরে স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমানে সেন্ট থমাস স্কুল নামে পরিচিত) সে-স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রার্থনার জন্য বিশপ টার্নার ১৮৩০ সালে এক চ্যাপেল তৈরির প্রস্তাব দেন। বিশপের প্রস্তাবটি গৃহীত হয় এবং তার পরের বছর চ্যাপেলের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে-বছর বিশপ টার্নার মৃত্যুবরণ করেন। ফলে বিশপবিহীন অবস্থায় চ্যাপেল উৎসর্গ করার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তাই আর্চডিকন কোরি-র উপস্থিতিতে চ্যাপেলটি খোলা হয় জনসাধারণের উপাসনার জন্য। নতুন বিশপ ড্যানিয়েল উইলসনের আগমনের পর ১৮৩৩ সালেই চ্যাপেল উৎসর্গের অসমাপ্ত কাজটুকু সম্পূর্ণ হয়। মির্জা গালিব স্ট্রিটের চ্যাপেলটিকে আজ আমরা সেন্ট থমাস চার্চ নামে চিনি। গ্যাসের আলো বা বৈদ্যুতিক সংযোগ যখন আসেনি, অথবা ক্যান্ডেলেব্রার ব্যবহারও শুরু হয়নি, সেসময় আঁধার নেমে আসার আগে এই উপাসনালয়ের সান্ধ্য প্রার্থনা সেরে ফেলা হত।
কলকাতা শহরে আগত তামিলরা শুধু ক্যাথলিক হননি, তাদের অনেকে প্রোটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসে যিশুকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, যেমনটি ধারণ করে আছে তাদের গির্জা “সেন্ট সেভিওর’স চার্চ” (১৮৪৯)। গির্জাটি তৈরি হয়েছিল ‘ইউনাইটেড সোসাইটি ফর দ্য প্রোপাগেশন অফ দ্য গসপেল’-এর সহায়তায়। তবে ১৯৩৮ সালের আগে অবধি এই গির্জার ভেতরে তারা প্রার্থনা করত না, ততদিন অবধি এই গির্জা বাঙালি মণ্ডলীর ছিল, তামিলরা প্রার্থনা করত গির্জার বাইরে প্যারিশ হলে।
খিদিরপুর অঞ্চলে ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপরে রকেট আকৃতি চূড়াবিশিষ্ট “সেন্ট স্টিফেন’স চার্চ” নামে যে গির্জাটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি উৎসর্গ করা হয়েছিল ১৮৪৬ সালে। সম্ভবত এই গির্জাটি ছিল গভর্নর জেনারেলের চ্যাপেল। গির্জার চূড়াটিকে রকেটের আকার ভেবে অনেকে ভুল করলেও, আসলে এটি তৈরি করা হয়েছিল তৎকালীন সময়ে জাহাজের লন্ঠনগুলির আকৃতি অনুসরণ করে। হুগলি নদীর তীরবর্তী বন্দর ও ঘাটগুলোর খুব কাছাকাছি অবস্থানের কারণে এই উপাসনালয় নাবিক এবং জাহাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের প্রিয় ছিল। গির্জার ভেতরে সংরক্ষিত স্মৃতিফলক আজও বয়ে বেড়ায় সেরকম অনেক উপাসকের স্মৃতি— যারা মারা গিয়েছিলেন নদীপথে অথবা ডুবে গিয়েছিলেন হুগলির গভীরে।

কলকাতা শহরে আগত তামিলরা শুধু ক্যাথলিক হননি, তাদের অনেকে প্রোটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসে যিশুকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, যেমনটি ধারণ করে আছে তাদের গির্জা “সেন্ট সেভিওর’স চার্চ” (১৮৪৯)। গির্জাটি তৈরি হয়েছিল ‘ইউনাইটেড সোসাইটি ফর দ্য প্রোপাগেশন অফ দ্য গসপেল’-এর সহায়তায়। তবে ১৯৩৮ সালের আগে অবধি এই গির্জার ভেতরে তারা প্রার্থনা করত না, ততদিন অবধি এই গির্জা বাঙালি মণ্ডলীর ছিল, তামিলরা প্রার্থনা করত গির্জার বাইরে প্যারিশ হলে। ১৯৩৮ সালের ইস্টার পর্বের পর থেকে তাদের নিজস্ব গির্জা হয়ে ওঠে হাজি মহম্মদ মহসিন স্ট্রিটের ‘সেন্ট সেভিওর’। জীবিকার সূত্রে কলকাতায় আসা তামিল প্রোটেস্ট্যান্টদের বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যকে বেঁধে রেখেছে এই উপাসনালয়। যদিও বাঙালিদেরও আগে, একদম গোড়া থেকে এই গির্জার সদস্য ছিলেন হিন্দিভাষীরা, তাদের নিজস্ব মণ্ডলী এবং পৃথক প্রার্থনার ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে এই গির্জায়।
তবে সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭) পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর ব্রিটিশ রাজের শাসনপর্বে কলকাতায় ইন্দো-গথিক এবং নরম্যান শৈলীযুক্ত (elements of Norman details) প্রারম্ভিক ইংরেজ-গথিক রীতিতে (Early English Gothic) নির্মিত অ্যাংলিকানদের দু’টি গির্জা শৈল্পিক দৃষ্টিতে ভীষণ আকর্ষণীয়। একটি হল সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল (১৮৪৭) অপরটি হল পুনর্নির্মিত সেন্ট জেমস চার্চ (১৮৬৪)। সেন্ট জেমস গির্জাটি দ্বিচূড়াবিশিষ্ট হওয়ার কারণে লোকমুখে জোড়া গির্জা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এজেসি বোস রোডে বর্তমান গির্জাটি তৈরি হওয়ার পূর্বে ১৮২৬ সালে গির্জাটি ছিল লেবুতলা অঞ্চলে, কিন্তু উইপোকার আক্রমণে গির্জাটির কড়িবরগার শোচনীয় অবস্থা হয়, পরে মেরামত করেও গির্জাটির ছাদ ভেঙে পড়া রোধ করা যায়নি। ভেঙে পড়া গির্জাটির হয়তো আর কোনও নিদর্শন নেই, তবে জানা যায় গির্জাটি মির্জা গালিব স্ট্রিটে অবস্থিত সেন্ট থমাস চার্চের স্থাপত্যরীতি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছিল। অপরদিকে, সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল নির্মাণ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল শহরে অ্যাংলিকানদের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং সেন্ট জন’স চার্চে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কারণে। নতুন ক্যাথিড্রাল নির্মাণের ভাবনা প্রস্তাবিত হয়েছিল শহরের প্রথম বিশপ মিডলটনের দ্বারা, তবে তিনি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া দেখে যেতে পারেননি, মিডলটন পরবর্তী আরও তিনজন বিশপের কালেও এটি সম্ভব হয়নি। আসলে ক্রান্তীয় জলবায়ুপ্রধান দেশে তাঁদের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়, আগমনের পর খুব বেশিদিন তাঁরা কেউ বাঁচেননি। প্রথম মেট্রোপলিটন এবং পঞ্চম বিশপ উইলসনের সময়ে ক্যাথিড্রালের আকাঙ্ক্ষিত রূপটি মূর্ত হয়েছিল। শাসক ভিক্টোরিয়া এই ক্যাথিড্রালের জন্য উপহার পাঠিয়েছিলেন দশটি সিলভার-গিল্ট প্লেট।
সেন্ট জন’স গির্জায় স্থপতি ফ্রান্সিস লেগাত শ্যান্ট্রির তৈরি বিশপ হেবারের এক অপূর্ব মূর্তি ছিল, ১৮৪৭ সালে সেন্ট পলসের প্রতিষ্ঠাকালে সেই মূর্তিকে বিশপ উইলসন সরিয়ে আনেন নবনির্মিত ক্যাথিড্রালে, মূর্তির সঙ্গে বিশপের জন্য নির্দিষ্ট আসনটিরও (Episcopal Throne) স্থানান্তর হয়।
বিশপ চ্যাটারটন বলেন— The new Cathedral was designed to answer several needs. First, ‘to be a Parish Church for a large district of Calcutta; secondly, to be served by a body of Clergy under the designation of a Dean and Chapter who were to bear a missionary character and to carry out missionary work; thirdly, it was to be the Cathedral of the Metropolitical See of Calcutta.’
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে কলকাতার অ্যাংলিকান বিশ্বাসজাত গির্জাগুলি C.N.I (Church of North India) উত্তর ভারত মণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক পরিচয় থেকে গির্জাগুলির ভারতীয়করণ অন্য আর-এক গল্প।


