সংবাদ মূলত কাব্য : পর্ব ২৬

প্রতিশোধের আঁতুড়

লন্ঠনের সারি কাছাকাছি আসতে আমরা দেখলাম বালক-বালিকাসহ জনাপনেরো মানুষ আসছেন আমাদের কাছে। তাঁদের পিছনে আসছে একটি গরুর গাড়ি। লন্ঠন ঝুলছে সে-গাড়ির ছইয়ের ওপর। সঙ্গে আসা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কৌতূহল বেশি। নতুন দুই মানুষ দেখে আমোদে হাসছে তারা। আমাদের সমবয়সি দুই তরুণ ‘আইয়ে, আইয়ে’ বলে স্বাগত জানিয়ে আমাকে আর সৌগতকে ওই গরুর গাড়িতে চড়িয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে গ্রামের পথ ধরল। ওই তরুণ দু’জন— একজন রণবীর সিং তোমর, খিদিরপুরের সেই অবাঙালি ব‍্যবসায়ীর ছোটভাই, আর অন‍্যজন সুঘর সিং তোমর, ওই ব‍্যবসায়ীর খুড়তুতো ভাই। আর একজন ছিলেন ওদের সঙ্গে, তিনি সুখদেব বাঘেল, এই রছেড় গ্রামের মাস্টারজি। আরেকজন, তাঁকে আমরা পরের দিনগুলিতে চাচা বলে হইহই করেছি, চম্বল সফরে ইতিউতি যাতায়াতে তিনি আমাদের সঙ্গী হয়েছেন, তিনি মোহর সিং, আমাদের চাচা মোহর সিং। ছয়ের দশকে চম্বলে মোহর সিং নামেই এক বাগীসর্দার ছিলেন। আমাদের চাচা মোহর সিং সেই মোহর নন। তবে কিনা, কয়েকদিনের মধ‍্যে কখনও কখনও মনে হয়েছে আমাদের চাচা মোহর সিং হলেও হতে পারেন বেহড়ে আত্মগোপনকারী বাগিদের মুখবীর! নচেৎ, ওই উত্তরপ্রদেশের জালাউনে, রাজস্থানের কোটা, ঢোলপুরে গ্রামে-গ্রামে চাচা মোহর সিংয়ের এত যোগাযোগ, রিস্তেদার, দোস্ত বেরাদর কেন! তবে এই নিয়ে কখনও ঘাঁটাইনি চাচাকে। খুব দেখভাল করতেন আমাদের। হাস‍্যোজ্জ্বল মানুষটিকে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে।

সুঘর সিং, রণবীর সিং— আমাদের সেই সমবয়সি দুই বন্ধুর নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা ‘তোমর’ শব্দটি সম্ভবত কোনও গ্রামের, যা ওদের পরিবারের উৎস। অনেক বছর পরে রাঁচি বিশ্ববিদ‍্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন রাম সিং তোমর, সুপণ্ডিত মানুষটি সিন্ধুলিপির সঙ্গে অলচিকির সাযুজ‍্য পেয়েছিলেন, সংবাদপত্রের খবরে জেনেছিলাম। তিনি নিশ্চয় চম্বলের ওই অঞ্চলের মানুষ।

চম্বল নদীর প্রাচীন নাম চর্মণ্বতী। মহাভারতে বর্ণিত পাঞ্চাল রাজ‍্যের পশ্চিম সীমান্তবর্তী এই চম্বল নদীর কিনারে ঘটেছিল কৌরব-পাণ্ডবদের পাশাখেলা। এখানেই দুর্যোধনের কুকীর্তিতে বস্ত্রহরণের পর ক্রুদ্ধা দ্রৌপদী অভিশাপ দিয়েছিলেন চম্বল নদীটিকে, এ-নদীর জল যে পান করবে, সে-ই প্রতিহিংসাপ্রবণ হয়ে যাবে। প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠবে তার।

আরও পড়ুন : অম্বা যাওয়ার পথে দেখলাম আমাদের বয়সি তরুণদের কাঁধে বন্দুক! মৃদুল দাশগুপ্তর কলমে ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ পর্ব ২৫…

যা বলছিলাম, গরুর গাড়িতে চড়িয়ে আমাদের দু’জনকে তো গ্রামে নিয়ে এল রণবীর, সুঘর, মাস্টারজিরা। দাঁড় করাল একটি বাড়ির সামনে। ইটগাঁথা পাকা বাড়ি। একটিই মস্ত বড় ঘর। দেখলাম, সে ঘরে দু-পাশে দু’টি খাটিয়ায় দু’টি বিছানা। ঝকঝকে তকতকে বিছানা পাতা। দুই খাটিয়ার মাঝে একটি টেবিল, দু’টি চেয়ার। টেবিলে একদিস্তা কাগজ। দু’টি ডটপেন। আমাদের জন‍্য সব সাজানো। টেবিলে একটি হ‍্যারিকেন। তখন, সেই তখন বিদ‍্যুৎ ছিল না চম্বলের গ্রামগুলিতে। ঘরটির পাশে দোতলা হাভেলিটি রণবীর-সুঘরদের।

চম্বল নদী

ঘরটির সামনে ইঁদারা। মুখ-হাত-পা ধুয়ে পোশাক বদলে ওদের সঙ্গে বসলাম। ঘন দুধের চা এল গ্লাসে গ্লাসে আমাদের জন‍্য। আর বাড়িতে বানানো গোল গোল নিমকির মতো কিছু। বাড়ির ভেতর থেকে মহিলারা ডাকলেন, বালক-বালিকারা দৌড়ে ভেতর থেকে চা-নিমকি নিয়ে এল। মস্ত ঘোমটা ঢাকা মহিলাকে একঝলক দেখলাম। দু-একদিনে বুঝলাম বালিকারা ছাড়া মহিলারা সাধারণত বাইরে বেরন না। আমরা রছেড় গ্রামটিতে পৌঁছেছিলাম সন্ধে ছ’টা নাগাদ। শীতকাল, তখনই অন্ধকার নেমে গিয়েছিল। মনে হল, আমরা যখন হাইওয়ের বাসস্টপে ঠায় অপেক্ষায় ঘণ্টা দুই-আড়াই ছিলাম, উদ্বিগ্ন ছিলাম, তখন আমাদের জন‍্য ঘর সাজিয়েছে ওরা। হয়তো আমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেও। তবে তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। হাইওয়ের ওপারে খাটিয়ায় বসেছিল দু-তিন জন, দেখেছিলাম।

শেষ পর্যন্ত রছেড় গ্রামে এলাম। আমাদের ওই ঘরটির সামনে একটি বড়সড় চত্বর। সেই চত্বরে কাঠকুটোয় আগুন ধরিয়ে গোল হয়ে বসে গ্রামবাসী অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল। রাতে খাওয়ার আগে দেখলাম ওই চত্বরে আগুন ঘিরে বসলেন রণবীর, সুঘর-সহ ওদের পরিবারের সকলে, কয়েকজন গ্রামবাসীও বসলেন। আমরাও। রণবীর-সুঘররা সবার হাতে দিল থালা, জলের গেলাস দেওয়া হল সাজিয়ে। হঠাৎ ঘিয়ের গন্ধে ভরে গেল চারদিক। দেখলাম মস্ত বড় একটি কাঠের জালা, তার তলায় লোহার চাকতি লাগানো, মাটি খুঁড়ে একটা গর্তেও উনুনমতো করা হয়েছিল, তাতে গরম হতে লাগল শীতে জমাট হওয়া ওই ঘি। অদূরে হাভেলির দাওয়ায় ঘোমটা ঢাকা রমণীরা উনুন রুটি তৈরি করছিলেন। এমনই ঘোমটা, আলোছায়ায় তাদের মুখ দেখা গেল না। সেখান থেকে থালায় থালায় আসছিল গমের আটা নয়, জোয়ার, বাজরার পুরু গরম রুটি। আর বাটি বাটি পালক, পালংশাকের ঘন সুরুয়া, স‍্যুপ বলা যায় তাকে। পালক পনির তো এখন বাঙালি খাদ‍্যাভাসে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। ঘিয়ের জালায় রুটি ভিজিয়ে ওই পালক খেলাম, ওদের দেখে, আমরাও। থালার কোণে আচার মাখানো ফিনফিনে টুকরো ছিল মুলোর। চম্বলের গ্রামগুলিতে আমাদের মধ‍্যাহ্ন ও নৈশভোজ ছিল এইরকম। সুদূর সেই সুস্বাদ হাওয়া বেয়ে যেন চলে এল মনে। ওরা নিরামিষাশী। সুঘর বলেছিল, ভিন্দ, মুরেনা যখন যাবে বড় কোনও হোটেলে, ধাবায় মছলি-মাংস পাবে। পাঞ্জাবি লোক মাংস খায়। বাঙ্গালি মছলি খায়— এতে চোখমুখ কুঁচকে ছিল ওরা। জাতপাতে পদবির শেষাংশ ‘গুপ্ত’ হওয়ায় খুব সম্মান পেয়েছিলাম রাজা চন্দ্রগুপ্তর কারণে। সৌগত রায়বর্মণের ‘বর্মণ’-এ ওরা খাতির করে বলেছিল, বানিয়া।

এসব গেল পুরাণের কথা। আধুনিক ইতিহাসে, ছত্রপতি শিবাজি এসব অঞ্চলের ভেতর দিয়েই গুটিগুটি হামলা চালাতেন দিল্লি ও আশপাশের মোঘল সেনাশিবিরগুলিতে। ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রবর্তক তিনি। শিবাজির বাহিনীর গেরিলারা সবাই কি মহারাষ্ট্রে ফিরেছিল? খেতিখামারিতে, প‍্যার-মোহব্বতে চম্বলের জনজীবনে মিশে যায়নি তো?

পরদিন ভোরে উঠেই চাচা মোহর সিংয়ের সঙ্গে আমরা ঘুরে বেড়ালাম রছেড় গ্রামের পিছনে বেহড়ে বেহড়ে। ভোরের আলোছায়ায় প্রকৃতির যথেচ্ছ নাচনকোদনের মহাক্ষেত্র বেহড়। অপরূপ এবং অবর্ণনীয়। বেহড়ে জঙ্গল নেই, আছে গুল্ম, ঝোপঝাড়। হাজার হাজার টিলা, ফাটল, গহ্বর, ফাটল, সুড়ঙ্গ, ফাঁকফোকরের এই বেহড় তৈরি হয়েছে হাজার হাজার বছরে, সহস্র সহস্র বছরের বর্ষায় চম্বল নদীর জলধারায়। এই অঞ্চলের শক্ত মাটিকে দুমড়েমুচড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ফুটো করে, ভেঙেচুড়ে মহাজল খামখেয়ালের খেলাটি খেলেছে মধ‍্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি জেলার ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্র জুড়ে। অপরূপ এই খামখেয়াল মন মাতিয়ে দিল আমাদের দু’জনের। দু’দিন আগের তাজমহল দর্শন ম্লান হয়ে গেল চম্বল-বেহড়ের কাছে। আমার এ-কথায় সহমত হল সৌগত। বেহড়ে ফাঁকে ফাঁকে সমতল ভূমি। আর সেই সমতলগুলিতেই গ্রাম। মধ‍্যপ্রদেশের বিন্ধ‍্য পর্বতের মউ অঞ্চল থেকে বের হয়ে মধ‍্যপ্রদেশে ভিন্দ মুরেনা, রাজস্থানে কোটা, ঢোলপুর হয়ে উত্তরপ্রদেশে যমুনায় মিশেছে। উত্তরপ্রদেশে যমুনা নদীরও কিছুটা বেহড় আছে। চম্বলের এই জলবিস্তারের কারণে এই অঞ্চল উর্বরা, কৃষিপ্রাচুর্যে ভরপুর। তা সত্ত্বেও কেন এখানকার স্বচ্ছল কৃষক, সম্পন্ন গৃহস্থ কাঁধে বন্দুক নিয়ে বেহড়ে চলে যান, কেউ জানে না। ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকে হাইজাম্প, লংজাম্প ও দৌড়— এই তিনটি খেলার মিলিত ইভেন্টে ব্রোঞ্চ পদক পেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর এই জওয়ান বন্দুক কাঁধে বেহড়ে চলে গিয়েছিলেন পারিবারিক প্রতিহিংসায়। তাঁকে নিয়ে হিন্দি চলচ্চিত্র হয়েছে। ষাট দশকের বাগীসর্দার মাধো সিংও ছিলেন সেনাবাহিনীতে। চম্বলের সর্বকালের নামডাকওয়ালা বাগী সর্দার মান সিং রাঠোর ছিলেন রাজপুত ঠাকুর বংশীয় ভূস্বামী।

প্রকৃতি উন্মুক্ত হয়েছে চম্বলে

দ্রৌপদীর অভিশাপের কথা আগে বলেছি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে এই নদীতীরে যুধিষ্ঠির যজ্ঞ করেছিলেন। পশুবলি দেওয়া হয়েছিল, পশুচর্ম, রক্ত নদীজলে মেশায় নদীর নাম হয় চর্মণ্বতী, বলা হয় এমন। আরেকটি মতে, রাজা রন্তিদেবও এই নদীতীরে যজ্ঞ করেছিলেন, পশুবলি দিয়েছিলেন, রক্ত মিশেছিল নদীতে। মহাভারতেই আছে অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যর ছেলে অশ্বত্থামা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব পক্ষের হয়েও জীবিত। তিনি মহাদেবের বরে চিরঞ্জীব। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর থেকে চম্বল অঞ্চলেই তিনি ঘোরাফেরা করছেন, এমন ভাবনার মানুষজন এখনও আছেন। বাবার মতো মহাযোদ্ধা ছিলেন তিনি, তবে দুর্বুদ্ধিময়, ঘুমন্ত পাণ্ডবদের হত‍্যা করেছিলেন, অভিমন‍্যুকে চক্রব‍্যূহে হত‍্যার চক্রীও অশ্বত্থামা। এই অশ্বত্থামা বাবার মতো অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছেন না তো!

এসব গেল পুরাণের কথা। আধুনিক ইতিহাসে, ছত্রপতি শিবাজি এসব অঞ্চলের ভেতর দিয়েই গুটিগুটি হামলা চালাতেন দিল্লি ও আশপাশের মোঘল সেনাশিবিরগুলিতে। ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রবর্তক তিনি। শিবাজির বাহিনীর গেরিলারা সবাই কি মহারাষ্ট্রে ফিরেছিল? খেতিখামারিতে, প‍্যার-মোহব্বতে চম্বলের জনজীবনে মিশে যায়নি তো?

নানাসাহেব সিপাহি বিদ্রোহে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এই অঞ্চলেই নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ কেউ বলেন, এই অঞ্চল ধরেই তিনি নেপাল চলে গিয়েছেন। তাঁর বাহিনীর সবাই তো আর নেপাল যায়নি। টগবগে ওই সব যোদ্ধাদের উত্তরসূরিরা কি ছড়িয়ে আছে চম্বলের সমাজে?

ইতালির সিসিলি দ্বীপটি এই রকম। পাথুরে মাটি প্রকৃতির খামখেয়ালে ভরা। মাফিয়াদের উৎপত্তি ওই সিসিলি থেকে। মেক্সিকো সীমান্তে আমেরিকার কলোরাডো নদীর অববাহিকা, ঢালু, উঁচু, দোমড়ানো-মোচড়ানো। তাই এত বন্দুকবাজ।

ছোট্ট একটুখানি বেহড় আছে আমাদের এই বাংলায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার কাছে গণগণি। শীলাবতী নদীর বেহড়। সাম্প্রতিককালে মাওবাদীরা অপহরণ করেছিল গড়বেতা থানার ওসি-কে।