গির্জানগর : পর্ব ১

গড়ে ওঠার আখ্যান

পৃথিবীর প্রাচীন শহরগুলোর সঙ্গে বয়সের তুলনায় কলকাতা নেহাতই নবীন। তবু যাত্রাপথের আদিলগ্ন থেকেই এ-শহর সমৃদ্ধ হয়েছে বহুবিধ উপাদানে। এ-শহরে এসে মিলেছে নানা জাতি‌র মানুষ, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কলকাতাকে দিয়েছে বর্ণময় বিশিষ্টতা।

মসজিদ-সিনাগগ-অগ্নি মন্দির কি নেই কলকাতায়? তবে সংখ্যার হিসেবে এসব ছাপিয়ে বরং‌ প্রকট হয়েছে গির্জার উপস্থিতি। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি সত্য যে, ঔপনিবেশিক আমলের প্রথমদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনওভাবেই গির্জা নির্মাণে আগ্রহী ছিল না, তাদের সতর্ক দৃষ্টি আর বৈষয়িক মন কেবল মুনাফা লাভে মগ্ন হয়ে ছিল। 

অ্যাংলিকান‌ বিশপ এয়ার চ্যাটারটন তাঁর ‘আ হিস্ট্রি অফ দ্য চার্চ অফ ইংল্যান্ড ইন ইন্ডিয়া’ বইতে লিখছেন, ‘If Calcutta is no longer the Captial of India, Calcutta will always be the capital of our Church in India. Nowhere in the East has the Church received a stronger and more generous backing from its laity.’

বিশপ চ্যাটারটন মূলত বলেছেন, অ্যাংলিকান শাখা অথবা চার্চ অফ ইংল্যান্ডের অনুসারীদের কথা। তবে কলকাতা জুড়ে রয়েছে আরও নানা শাখার খ্রিস্ট-বিশ্বাসীদের বসবাস। শহরের প্রাচীনতম গির্জা ‘আর্মেনিয়ান চার্চ অফ দ্য হোলি নাজারেথ’ আর্মেনিয়ান অর্থোডক্সদের দ্বারা নির্মিত। এ-শহরে এসেছিল রোমান ক্যাথলিক শাখার অনুসারী পর্তুগিজরা। এছাড়া অ্যাংলিকানদের পরে এসেছিল ব্যাপ্টিস্ট, প্রেসবিটেরিয়ান, মেথডিস্ট, এমনকী, তুলনামূলকভাবে নতুন ‘সেভেন ডে অ্যাডভেনটিস্ট’ শাখার বিশ্বাসীরাও ছড়িয়ে আছেন এই শহরে।

আরও পড়ুন: এখান থেকেই কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রকাশ করতেন মহাভারত, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে হারিয়ে গেল সবই!
লিখছেন ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী

এদের প্রত্যেকের বিশ্বাস,‌ ধর্মাচরণ, সর্বোপরি যেসব গির্জাকে কেন্দ্র করে এদের ধর্মীয় জীবন আবর্তিত হয়, সেসবের নির্মাণ শৈলীর মধ্যেও‌ অনেক পার্থক্য রয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে কলকাতার বুকে গড়ে ওঠা এসব গির্জার প্রত্যেকটি আসলে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। কলকাতার প্রথম বিশপ থমাস মিডলটন বিশ্বাস করতেন, সকল গির্জা সুউচ্চ চূড়া যুক্ত হওয়া উচিত, যাতে সেগুলি খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের সাক্ষ্য হিসাবে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। একবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় গির্জাগুলির কোনওটির চূড়া আজ আর নেই, কোনওটির চূড়া আজও টিকে আছে খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন রূপে। আমরা‌ ফিরে তাকাব তাদের প্রাচীন অবয়বগুলির দিকে।

বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ধারাটি যারা বয়ে এনেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাসে রোমান ক্যাথলিক। নগর কলকাতার ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। কলকাতা শহরের গির্জার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে স্থাপত্যশৈলীর বিচারে হয়তো দৃষ্টিনন্দন, ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম গির্জা সেন্ট অ্যান। সিরাজের কলকাতা আক্রমণকালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সে-গির্জাকে আমরা দেখতে পাই জর্জ ল্যামবার্ট এবং স্যামুয়েল স্কটের আঁকা ছবিতে। তবে তারও আগে রোমান ক্যাথলিকদের দ্বারা নির্মিত খ্রিস্টীয় উপাসনালয়ের অস্তিত্ব ছিল। এক অতি সাধারণ মেটেঘর ছিল ক্যাথলিক অগাস্টিনিয়ান সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের উপাসনার স্থল, যাকে কলকাতার গির্জার প্রাচীনতম রূপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। জে জে এ ক্যাম্পোস তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল’ বইতে জানাচ্ছেন, কলকাতায় ক্যাথলিক মতের সূচনা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীর অন্তে জোব চার্নকের আগমনকালে। চার্নককে অনুসরণ করে একদল পর্তুগিজ কলকাতা শহরে আসেন এবং তাঁর অনুগ্রহে দশ বিঘা জমি পেয়ে মেটেঘরখানি নির্মাণ করেন, ‘বেঙ্গল ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ও এই ঘটনাটিকে সমর্থন করে।

কিন্তু প্রচলিত এই ইতিহাসকে নাকচ করেছেন রাধারমণ রায় তাঁর ‘কলকাতা বিচিত্রা’ বইয়ে— তাঁর মতে, ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে চার্নক-পূর্ব কলকাতায় পর্তুগিজদের বসতি ছিল লালদিঘি ও গঙ্গার মাঝামাঝি কোনও এক জায়গায়। সেসময় হিন্দু অধ্যুষিত সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুরের যেখানে খুশি বিদেশি বিধর্মীরা বসতি স্থাপন করতে পারতেন না, তাই ইংরেজরা বসবাসের জন্য পর্তুগিজদের এলাকাটিকে বেছে নেন। আর সে-সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজেদেরই অবস্থা স্থিতিশীল নয়, তাই জমি দানের ঘটনাটিকে তিনি ‘অবাস্তব’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে প্রাচীনতম উপাসনালয়ের স্বীকৃতিকে তিনি অস্বীকার করেননি।

ক্যাথিড্রাল অফ দ্য মোস্ট হোলি রোজারি

ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রোমান ক্যাথলিক গির্জার ইতিহাসকে মোটা দাগে দুই পর্বে চিহ্নিত করা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে গির্জাগুলি নিয়ন্ত্রিত হত পর্তুগিজদের দ্বারা, পরবর্তীকালে সব গির্জা চলে যায় সরাসরি ভ্যাটিকানের অধীনে। পোপ এবং পর্তুগালের শাসকদের মধ্যে হওয়া কিছু চুক্তির কারণে পর্তুগালের শাসকরা গির্জা পরিচালনার জন্য বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, ক্যাথলিক গির্জার ইতিহাসে এটি ‘পাদ্রোয়াদো’ নামে পরিচিত।

প্রশ্ন জাগতে পারে, রোমান ক্যাথলিক গির্জার সর্বোচ্চ স্তরে যেখানে‌ স্বয়ং পোপের স্থান, সেখানে আলাদা করে পর্তুগিজ শাসকরা গির্জা পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক অধিকার পেলেন কেন? আসলে বাণিজ্যের প্রয়োজনে পর্তুগিজদের তরী ভাসাতে হত সাগরে,‌ ক্রমাগত সামুদ্রিক অভিযানে তারা খুঁজে পেতেন বিভিন্ন অ-খ্রিস্টান জনপদ। বাণিজ্যের পাশাপাশি অ-খ্রিস্টানদের খ্রিস্টান বানানোর কাজকে তাঁরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। অনুমান করা যায়, ভৌগোলিক দূরত্ব অথবা সরাসরি ভ্যাটিকানের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য পরিকাঠামোগত খামতি থাকায় ‘পাদ্রোয়াদো’ ব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্ম প্রচারের জন্য পোপ কর্তৃক বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তারা। অথবা তাঁদের ক্যাথলিক গির্জার প্রতি আনুগত্য, এবং ধর্ম প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল ক্ষমতা, সম্পদের প্রাচুর্য ও আর্থিক সংস্থানের কারণে তাঁরা পোপের কৃপাদৃষ্টি লাভ করেন। এই ক্ষমতাবলে তাঁরা গির্জা-কনভেন্ট-ওরাটরি-সেমিনারি নির্মাণ ও পরিচালনা করতে পারতেন, এছাড়া মিশনারি প্রেরণ এবং বিশপ ও পুরোহিত নির্বাচনের অধিকারও তাদের ছিল।

তবে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলায় রোমান ক্যাথলিকদের নিজস্ব কোনও ‘ডায়োসিস’ বা ‘ধর্মপ্রদেশ’ ছিল না, যার মাধ্যমে বাংলার ক্যাথলিক গির্জাগুলি পরিচালিত হতে পারে। সুদূর তামিলনাডুর মায়লাপুর ধর্মপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল অবিভক্ত বাংলার সকল ক্যাথলিক গির্জা। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ডায়োসিস বা ধর্মপ্রদেশ হিসেবে পোপ ষষ্ঠদশ গ্রেগরি স্বীকৃতি দেন কলকাতাকে, আর ১৮৮৬ সালে পোপ ত্রয়োদশ লিওর সময়ে কলকাতা হয়ে ওঠে ‘আর্চডায়োসিস’ বা ‘মহাধর্মপ্রদেশ’। অর্থাৎ, আশেপাশের বিস্তৃত ভৌগোলিক সীমা জুড়ে ক্যাথলিক সমাজের কেন্দ্রবিন্দু রূপে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভারপ্রাপ্ত হচ্ছে কলকাতা।

কলকাতা শহরের প্রথম তিনটি ক্যাথলিক গির্জা পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত। তাদের খড়ে ছাওয়া মাটির তৈরি প্রথম উপাসনাস্থলটিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা ঠাট্টা করে বলতেন ‘মাসহাউস’। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমিশারি জেনারেল এবং চিফ গভর্নর জন গোল্ডসবরো পর্তুগিজদের গির্জাটি ভেঙে দিলে তারা বাধ্য হয়ে মুরগিহাটায় সরে যায় এবং ১৭০০ সালে গড়ে তোলে ইটের চ্যাপেল। যার বর্তমান রূপ ‘ক্যাথিড্রাল অফ দ্য মোস্ট হোলি রোজারি’, প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৯৯ সালে। পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত দ্বিতীয় গির্জাটি অবস্থিত বৈঠকখানা বাজারে, এই গির্জার নাম ‘চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ ডলার্স’— প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১০ সালে আর ধর্মতলায় অবস্থিত তৃতীয় গির্জা ‘চার্চ অফ সেক্রেড হার্ট অফ জিসাস’-এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৩৪ সাল। এই তৃতীয় গির্জাটি গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে অদ্ভুত এক ঘটনা। লুইস ডি’সুজা নামে জনৈক ব্যক্তি কোনও এক রাতে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে চৌরঙ্গি থিয়েটার থেকে ফেরার পথে জোসেফ গনসালভেস নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করেন এবং মামলায় অভিযুক্ত হন। পরে মুক্তি পেলে তাঁর মা পাসকোয়া ব্যারেটো ডি’সুজা ঈশ্বরের কাছে মানত অনুযায়ী নিজের জমিতে গির্জা নির্মাণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে এই গির্জাটি সম্ভবত একমাত্র গির্জা, যেখানে ক্যাথলিক গির্জার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ক্রুশের পথের চতুর্দশ দৃশ্যাবলি খোদিত রয়েছে ইউরোপ থেকে আনা  মার্বেল পাথরে। সেক্রেড হার্ট গির্জাটির মতো বাকি দু’টি গির্জা তৈরির ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবদান ও পৃষ্ঠপোষকতা সবচেয়ে বেশি ছিল নারীদের। প্রথমটির ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছিলেন মার্গারেট টেঞ্চ এবং সেবাস্টিয়ান শ, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে গ্রেস এলিজাবেথ নামে এক ভারতীয় খ্রিস্টান নারী।

কলকাতা-সহ বৃহৎ বঙ্গে পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত গির্জাগুলির নাম খেয়াল করলে এক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে— গির্জাগুলির অধিকাংশই কুমারী মারিয়ার দৈবী রূপগুলির নামে উৎসর্গীকৃত। ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্বে কুমারী মারিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আমরা জানি। কিন্তু এ-সকল উৎসর্গ কি নিছক কুমারী মারিয়ার প্রতি ভক্তির প্রকাশ? না কি বঙ্গের চিরাচরিত মাতৃ-উপাসনার সমান্তরালে মাতৃরূপী কুমারী মারিয়াকে পরিচয় করানোর মাধ্যমে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস প্রচারের পথ সুগম করার পন্থা?

কলকাতায় পর্তুগিজরা তাদের অধীনস্থ গির্জাগুলির মধ্যে ‘ক্যাথিড্রাল অফ দ্য মোস্ট হোলি রোজারি’ এবং ‘চার্চ অফ দ্য সেক্রেড হার্ট অফ জিসাস’-এর নিয়ন্ত্রণ হারায় ১৮৩৪ সালে,‌ এটি ঘটছে ঠিক কলকাতা‌ শহর ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশ রূপে মর্যাদা লাভের বছরেই। এটির কারণ অনুসন্ধান করার জন্য আমাদের আরেকটু পিছিয়ে যাওয়া দরকার। ১৬২২ সালে পোপ পঞ্চদশ গ্রেগরি শুধু পর্তুগিজদের ধর্মপ্রচারের বিশাল দায়িত্ব বহনের উপযোগী বলে আর মনে করছেন না, তিনি গঠন করছেন ধর্মপ্রচারের জন্য  বিশেষ কংগ্রেগেশন, যাকে বলা হচ্ছে ‘দে প্রোপাগান্ডা ফিদে’। পোপের এই পদক্ষেপ গ্রহণের পর থেকে পর্তুগিজদের ওপর নির্ভরতা কমে আসার সূচনা হয়। ভারতের ক্যাথলিক গির্জার ইতিহাসে এ এক বড়সড় বাঁকবদল। মিশনারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার কাজে এর পর থেকে নির্বাচিত হন সরাসরি ভ্যাটিকান-অনুমোদিত অ্যাপস্টলিক ভিকার পদের প্রতিনিধিরা। যা পর্তুগিজদের মনে ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা তৈরি করে ও পরবর্তীকালে পাদ্রোয়াদো-ক্ষমতাভোগী পর্তুগিজ বনাম ভ্যাটিকানের ভিকার প্রতিনিধিরা বিভিন্ন‌ পর্যায়ে সংঘর্ষের মুখোমুখি হন। কার্যত গোটা ভারতের ক্যাথলিক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যান পর্তুগাল সমর্থক ও ভ্যাটিকান সমর্থক হিসেবে‌। এই সমস্যার আঁচ কলকাতার গায়েও এসে পড়েছিল। ১৮৩৪ সালে ধর্মপ্রদেশ কলকাতায় এসে পৌঁছন পোপের প্রতিনিধি ভিকার অ্যাপস্টলিক রবার্ট শাঁলেজি, একজন আইরিশ জেসুইট। কলকাতার ক্যাথলিক সমাজের বেশিরভাগ তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নিলেও  বৈঠকখানায় অবস্থিত ‘চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ ডলার্স’ গির্জার গোয়ানিজ পুরোহিতদের পক্ষ নিয়েছিলেন কিছুজন। শাঁলেজি এ-গির্জাকে নিষিদ্ধ করেন, ১৯৩০ সালের আগে পর্যন্ত ভ্যাটিকানের কর্তৃত্বের বাইরে টিকে ছিল শহর কলকাতার একমাত্র পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রিত এই গির্জা।

দ্বিতীয় পর্বের গির্জাগুলি গড়ে ওঠার সূচনা তৎকালীন ভিকার অ্যাপস্টলিক প্যাট্রিক জোসেফ কেরুর সময়ে। ১৮৪২ সালে মিডলটন রো-তে তাঁর উদ্যোগে তৈরি হয় সেন্ট থমাস চার্চ। পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে মাদার তেরেসার দেহ  শায়িত ছিল এই গির্জায় এক সপ্তাহ ধরে। ক্যাথলিক হেরাল্ডের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, রোম থেকে প্রথম ভারতের এই গির্জায় মার্বেলের অল্টার উপহার আসে। পোপ ষষ্ঠদশ গ্রেগরি এই গির্জাকে উপহার দেন ঘণ্টা। বউবাজার এলাকায় উপাসনার সুবিধার্থে ১৮৪৪ সালে কেরু নির্মাণ করেছিলেন আরও এক চ্যাপেল, ১৮৯৭-এ চ্যাপেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরে আর্চবিশপ পল গথেলের উদ্যোগে এটি পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়‌ এবং ১৯০৩ সালে, চ্যাপেল থেকে গির্জা হয়ে ওঠে এই স্থাপত্য। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রীটে কেরুর স্মৃতিবিজড়িত চ্যাপেলটির জায়গায় যে গির্জাটি আজ দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম “সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার’স চার্চ”।

বড়বাজারে অবস্থিত ক্যাথিড্রালের ভেতরে ঢুকলে কারুকার্য করা স্মৃতিফলকের ওপরে পাথরে খোদিত ভিকার অ্যাপস্টলিক অগস্ত ভ্যান হিউলের মুখাবয়বটি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য, কলকাতার ক্যাথলিক সমাজে তাঁর বিশেষ‌ গঠনমূলক অবদান ছিল, তাঁর সময়েই সেন্ট প্যাট্রিক’স চার্চ হয়ে ওঠে একটি স্বাধীন ‘ইক্লিসিয়াস্টিকাল ইউনিট’, অর্থাৎ, খ্রিস্টীয় প্রতিষ্ঠান। ১৮৫৯ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়েছিল এই গির্জার। রোমান ক্যাথলিকদের এই উপাসনালয়টি এখনও বর্তমান, তবে ফোর্ট উইলিয়ামের অভ্যন্তরে সেন্ট পিটার’স নামে আরও একটি গির্জা ছিল, যেটি সেনাদের লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হয়েছে। 

এই শহরে রোমান ক্যাথলিকদের নিজস্ব সেন্ট আছেন, ২০১৬ সালে পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক সাধ্বী-রূপে স্বীকৃতি পান মাদার তেরেসা। ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক সমাজের কাছে এরপর থেকে তাঁর পরিচয়— ‘সেন্ট তেরেসা অফ ক্যালকাটা’। ‌

তবে এ-শহর বহন করে চলেছে আরও এক সেন্টের স্মৃতি। বেলজিয়ান জেসুইট। মিশনারিদের রেকর্ড থেকে জানা যায়, জীবিকার প্রয়োজনে একসময় কলকাতায় এসেছিলেন দশহাজার তামিল, ফাদার জশন নামে জনৈক পাদ্রীর প্রচেষ্টায় এদের মধ্যে মোটামুটি ন’শো জন ধর্মান্তরিত হন। ভিকার অ্যাপস্টলিক কেরুর সময়ে এদের জন্য ফাদার এডওয়ার্ড নামে এক পাদ্রী অনুদান সংগ্রহ করে মার্কেট স্ট্রিটে গড়ে তোলেন “সেন্ট জোসেফ’স চ্যাপেল” (১৮৬৫)। এই চ্যাপেলটি বর্তমানে “সেন্ট অ্যান্থনি’স শ্রাইন” নামেও পরিচিত, কারণ দ্বাদশ শতাব্দীতে ইতালির পাদুয়া শহরে জন্মগ্রহণ করা সাধু আন্তনির রেলিক সংরক্ষিত রয়েছে এখানে।

আর্চবিশপ পল ফ্রঁসোয়া মারি গথেলের সময়ে তৈরি হয় “সেন্ট তেরেসা অফ আভিলা’স চ্যাপেল” (১৮৮৯)। মৌলালিতে অবস্থিত লাল রঙের এই গির্জাটি দ্বিতলবিশিষ্ট “সেন্ট তেরেসা’স চার্চ” হয়ে ওঠে ১৯৯৭ সালে।

সেন্ট তেরেসাস চার্চ

ধর্মে খ্রিস্টান হলেও ঔপনিবেশিক আমলে ক্যাথলিকরা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, এর কারণ বোধহয় তারা শাসকশ্রেণির খ্রিস্টীয় শাখার অনুসারী ছিলেন না।

শুরুর দিকে ইংরেজ বণিকরা স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাথলিক মহিলাদের বিবাহ করতে আরম্ভ করে এবং তারা অগাস্টিনিয়ান সন্ন্যাসীদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এই ভেবে, জন গোল্ডসবরো ক্যাথলিকদের নির্মিত প্রথম গির্জাটি ভেঙে দেন। পলাশির যুদ্ধ ও ক্ষমতা‌ দখলের পর ইংরেজরা নিজেদের উপাসনালয়ের অভাবে পর্তুগিজদের মুরগিহাটার গির্জাটি দখল করে নিজেদের উপাসনার জন্য ব্যবহার করেছিলেন বেশ কিছুদিন। ওল্ড মিশন চার্চের প্রতিষ্ঠাতা জন জ্যাকারায়া কিয়েরন্যান্ডার-ও তাঁর সময়কালে বেশ কিছু ক্যাথলিককে প্রোটেস্ট্যান্টে রূপান্তরিত করেন। 

কলকাতার ক্যাথলিক সমাজের নিজস্ব সংকট ছিল, তবু সেসব কাটিয়ে তারা আজও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে, বাঙালি ক্যাথলিকদের অনেকে এখনও খ্রিস্টযাগকে (Mass) পর্তুগিজদের মতো ‘মিশা’ বলেন। বুঝি এভাবেই শতাব্দীপ্রাচীন গির্জাগুলির অল্টারের নকশার মতো আমাদের শব্দভাণ্ডারেও আটকে পড়েছে পর্তুগিজদের অমলিন স্মৃতি।