সংবাদ মূলত কাব‍্য: পর্ব ২৫

চম্বলের দিকে যাত্রা

নির্জন ও ছমছম রাতের মুরেনা রেলস্টেশনে আপাদমস্তক চাদরে-মোড়া লোকটি এবার টর্চের আলো আমাদের মুখে এক ঝলক ফেলেই শুধোল, ‘সাহাব, আপ লোক হোটেল মাংতা? সুযোগ পেয়ে গেল আমার আলোকচিত্রী সখা সৌগত, ‘হা হা, হোটেল চাহতা হামলোগ। হামলোগ পত্রকার। বাগী লোকজন কা মোলাকাত চাহতা। কহানি লিখেগা। ফটো ভি খিচেগা।’ লোকটি কী বুঝল কে জানে, ‘হা হা, আইয়ে আইয়ে’, বলে আমার হোল্ডঅলটি হাতে তুলে নিল; সৌগতর হোল্ডঅলটিতে ক‍্যামেরা, লেন্স ইত‍্যাদি ভরা আছে বলে সৌগত দিতে রাজি হল না। টাঙায় চড়িয়ে লোকটি আমাদের স্টেশনের অদূরে হোটেলে নিয়ে এল। ছোট্ট হোটেল। তবে সুব‍্যবস্থা ছিল।

আগের লেখায় বলতে ভুলে গিয়েছি, আগ্রায় পৌঁছে প্রথমেই আমরা গিয়েছিলাম আগ্রা থেকে বাসে জয়পুর। আমরা চম্বলে খবর করার কাজে সাহায‍্য পাব, এমনটি ভেবে ‘পরিবর্তন’-এর প্রধান সম্পাদক অশোক চৌধুরী আমাদের হাতে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু রাজস্থান সরকারের উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারকে। জয়পুরে আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাদের খুবই খাতির করেন। উত্তরপ্রদেশ ও মধ‍্যপ্রদেশের কয়েকজন পুলিশকর্তাকে চিঠি লিখে আমাদের হাতে দিয়েছিলেন। জয়পুরে দুপুরবেলা এসব কাজ সেরে বিকেলে আমরা টাঙা চড়ে গিয়েছিলাম ‘রাজস্থান’ পত্রিকার সম্পাদক কাপুর চন্দ্র কুলিশের (লোকে বলত, কাপুর চন্দ্র কৈলাস) বাসভবনে। রাজস্থানে ওই এক ঝলক সফরেই দেখেছিলাম জয়পুরে ইতিউতি ছোট-মাঝারি বেশ কিছু দুর্গ আছে, যেগুলি ব‍্যক্তিগত মালিকানায় চলে গিয়েছে। বা ভাড়াটে বসেছে। দেখলাম কাপুরচন্দ্র কুলিশ থাকেন ওইরকমই একটি ছোট লাল পাথরের দুর্গে। যখন পৌঁছই, কাপুরচন্দ্র বাড়িতে ছিলেন না। মস্ত বড় ঘোমটা টেনে তাঁর স্ত্রী উনুনে রুটি সেঁকছিলেন। উনুনের আগুনে আলোকিত হয়ে উঠেছিল সেখানটা। ওদিকে সূর্যাস্তের রং ছড়িয়ে গিয়েছিল দুর্গভবনটির গায়ে। বাসনের কোণে একটু আচার, বাটিতে রাজমার ঘন ডাল, তাওয়ায় রাখা গরম রুটিতে ঘি ছিটিয়ে অপেক্ষারত আমাদের দিয়েছিলেন ওই মধ‍্যবয়সিনি। আমি-সৌগত তাঁকে ‘ভাবীজি’ ডাকছিলাম। কেবলই আশ্বাস দিয়ে চলছিলেন তিনি, ‘এখনই এসে পড়বেন তিনি, এখনই এসে পড়বেন।

আরও পড়ুন: তারাপীঠের মহাশ্মশানে এক সাহেব সাধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেম, ‘আপনি বিজ্ঞান মানেন না?’ লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত…

সন্ধে যখন রাত ছুঁই-ছুঁই, দুর্গ-ফটকে গাড়ির আওয়াজ হল, এলেন কাপুর চন্দ্র কুলিশ। চম্বল নিয়ে আলোচনা হল আমাদের। সস্নেহে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনেক হদিশ, অনেক তথ‍্য। এই এখন, লিখতে-লিখতে মনে আসছে সুদূরকালের সেই ঘিয়ে ভেজা গরম রুটি আর রাজমার ঘ্রাণ। তখনই বিখ‍্যাত, এরপর ভারতজোড়া নামডাক হয়েছিল কাপুর চন্দ্র কুলিশের। ১৯৯১ সালে সর্বভারতীয় সম্পাদক সম্মেলনের সুবর্ণজয়ন্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর জাতীয় মূলধারার ওই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন‍্য তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়েছিলেন। কাপুরচন্দ্র কুলিশ প্রয়াত হন ২০০৬ সালে। ২০১২ সালে ডাকবিভাগ তাঁর একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।

জয়পুরে এক রাত্রি থেকে ভোরের বাসে আগ্রা ফিরে আসি এবং সারাদিন তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট দেখে, রাতের ট্রেনে ওই ঘুটঘুটে অন্ধকার মুরেনা স্টেশনে নামি। দেখি ওই আপাদমাথা চাদরে মুড়ি দেওয়া লোকটিকে। হোটেলে পৌঁছে আমি ও সৌগত ম‍্যানেজার ও অন‍্যান‍্যদের বার বার বললাম, আমরা কেন, কী উদ্দেশ্যে চম্বলে এসেছি। তরুণ ভাদুড়ীর বইয়ে ওইরকম বলা ছিল।

এখানে একটি কথা বলে নিই। ১৯৬০ সালে সর্বোদয়ী নেতা বিনোবা ভাবে চম্বলে এসে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলেন নিহত দস‍্যুনেতা মান সিংয়ের পুত্র তহশীলদার সিং, মান সিংয়ের অগ্রজ নবাব সিং-সহ ২০ জনকে। মৃত‍্যুদণ্ড থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাঁদের। শান্তির পথে ফিরিয়েছিলেন চম্বলের দস‍্যুদলগুলিকে। ওই আত্মসমর্পণের বিশাল জনসভায় আচার্য বিনোবা ভাবে ওঁদের দিয়েছিলেন ‘বাগী’র মর্যাদা। বলছিলেন, ‘দস‍্যু নয় ওরা, ওরা বাগী।’ ‘বাগী’ শব্দটির অর্থ— বিদ্রোহী। বস্তুত, চম্বলের হিংসার প্রধান কারণ, প্রতিহিংসা। এমনকী, পিতামহের অপমানে নাতির প্রতিশোধ, বোনের অসম্মানে ভাইয়ের প্রতিশোধ, চম্বলে এসব ঘটত। জানি না এখনও ঘটে কি না। ভিন্দ, মুরেনা, ইটাওয়া, ঢোলপুর, অম্বা— তখনই আটের দশকে এসব শহরে ব‍্যাঙ্কগুলির বহু শাখা খোলা হয়ে গিয়েছিল। এখন নিশ্চয় আরও বেড়েছে। চম্বলে ব‍্যাঙ্ক ডাকাতির একটিও খবর নেই। তবে ধনীর প্রাসাদ লুট করা, মুক্তিপণের জন‍্য অপহরণ, এসব ঘটে চলত।

এ-লেখায় আমি তাঁদের ‘বাগী’ই বলব। চম্বলে তা-ই বলেছি। তরুণ ভাদুড়ী তাঁর বইয়ে বলেছিলেন, দেখা করার সবচেয়ে ভাল উপায় হল সর্বত্র প্রচার করা, আমরা বাগীদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। সকালে মুরেনা থেকে অম্বা-র বাসে উঠেও আমরা দুজনে বলাবলি শুরু করে দিলাম, ‘হমলোগ বাগীলোককা সাথ সাক্ষাৎ করনে আয়া।’ কীভাবে তাঁরা, ওই যাঁদের সন্ধানে চলেছি, তাঁরা আমাদের কথা জানতে পারবেন? মুরেনার হোটেলের ম‍্যানেজার বলে দিয়েছিলেন, ‘ঠিক জেনে যাবেন। মুখবীররা খবর দিয়ে দেবে।’ ‘মুখবীর’ মানে কী? আগেই বলেছি, পুলিশের যেমন গোয়েন্দা বিভাগ আছে, তেমনই চম্বলের গ্রামে-গ্রামে, হাটে-বাজারে-জমায়েতে, চায়ের দুকানে ছড়ানো আছে ‘মুখবীর’; বাগী দলগুলির গুপ্তচর এরা।

মুরেনার বাসঘাঁটিতে অম্বা-র বাসে উঠে তো আমরা বসলাম, কিছুক্ষণের মধ‍্যে সে-বাসের সিটগুলি ভর্তি হয়ে গেল। দেখলাম, আমাদের বয়সি তরুণ কয়েজনের কাঁধে ঝুলছে বন্দুক। হাসাহাসি করছে তারা, ফুর্তিতে গড়িয়ে পড়ছে। আর বাসের ভেতরে সিটগুলির মাথায় হিন্দিতে লেখা রয়েছে, ‘ভরা বন্দুক লেকড় ন বৈঠ’। অর্থাৎ (গুলি) ভরা বন্দুক নিয়ে (বাসে) বসো না। কারণ যাত্রাপথে ঝাঁকুনিতে বন্দুকের গুলি ছিটকে বিপদ হতে পারে।

তরুণ যুবকেরা, বয়স্করাও বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে ঘুরছে, বাসে চড়ছে, এতে আমরা আদৌ ঘাবড়ে যাইনি। কারণ সকালেই মুরেনা শহরটিতে, এবং এই যে বাসে যেতে-যেতে, পুরুষ মানুষ অনেকেরই দেখছি কাঁধে বন্দুক! এই অঞ্চলে কৈশোর পেরোলেই স্বচ্ছল পরিবারগুলিতে বাবা বন্দুক কিনে দেন ছেলেকে। যেমনটি আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর বাবা আমাকে হাতঘড়ি কিনে দিয়েছিল। চম্বলে কাঁধে বন্দুক নেওয়াটা একটি নওল জওয়ান ছেলের পৌরুষজ্ঞাপনও। দস‍্যু-উপদ্রুত অঞ্চল বলেই গণনিরাপত্তায় তিন রাজ‍্যের চম্বল উপত‍্যকভুক্ত জেলাগুলিতে সরকারিভাবে তৎকালীন সময়ে দেদার লাইসেন্স দেওয়া হত। বেশির ভাগ সময়ে সেগুলি চলে যেত বাগী দলগুলির হাতে।

দুপুরে বাস আমাদের অম্বায় নিয়ে এল। বাসডিপোতেই খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা রছেড় গ্রামটিতে যাওয়ার জন‍্য আগ্রাগামী বাসে উঠে পড়লাম। খিদিরপুরের ওই ব‍্যবসায়ী, যার চিঠি নিয়ে এসেছি, তার গ্রামের বাড়ি এই রছেড়। মধ‍্যপ্রদেশ-উত্তরপ্রদেশ সীমান্তের এই গ্রামের বাড়িতেই ওই ব‍্যবসায়ীর ভাইয়েরা থাকে। এক ভাই মালখান সিংয়ের দলে। ভাইদের জন‍্যই আমাদের হাতে পাঠানো হয়েছে চিঠি। রছেড়, অম্বা এই গ্রামগুলি আমরা বেছে নিয়েছিলাম এই কারণেই, এই অঞ্চলটি উত্তরপ্রদেশ-মধ‍্যপ্রদেশ-রাজস্থানের একবারে সীমান্তবর্তী। এই অঞ্চলেই ইতিহাসের কাল থেকে নামডাকওয়ালা দস‍্যুনেতাদের উৎসস্থল, বাড়িঘরদোর। দস‍্যুদমনে কেন্দ্র ও রাজ‍্য সরকার এই অঞ্চলে অগণন হাইওয়ে, দীর্ঘ সড়ক গড়েছে পুলিশ অভিযানের জন‍্য। অম্বা থেকে চম্বল নদী পেরিয়ে আগ্রা যাওয়ার অমনই একটি হাইওয়ে ধরে চম্বল নদীঘাটের ঠিক আগে বিকেল-শুরুতে রছেড় গ্রামে বাসস্টপে নামিয়ে দিল বাস। আমরা দুজন হোল্ডঅল হাতে নেমে পড়লাম। ওই স্টপে আর কেউ নামল না।

মালখান সিং ও তাঁর দলবল

হাইওয়ের পর টানা বহুদূর বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। গম, জোয়ার, মকাই, জব, ভুট্টার। সারা চম্বল কৃষিসম্পদে ভরপুর। চম্বলের কৃষকেরা সম্পন্ন, স্বচ্ছল। তবে জাতপাত রয়েছে। দলিতেরা অবহেলিত, অত‍্যাচারিতও। তাঁদের ভেতর থেকেও এসেছেন অপমানিত সশস্ত বন্দুকধারী বাগীরা। ফুলন দেবী অন্ত‍্যজ মাল্লা শ্রেণির, মালখান সিং নিম্নবর্ণের মির্ধা। পাঁচের দশকে চম্বলে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিলেন যে মান সিং রাঠোর, তিনি ছিলেন উচ্চবর্ণের রাজপুত ঠাকুর, তবে সে-সংঘাতের উৎস ছিল ঠাকুর বনাম ব্রাহ্মণদের।

দিগন্তবিস্তারী ফসলের ক্ষেতের শেষে গ্রাম। গ্রামের শেষে ধু-ধু বেহড়। চম্বলে প্রায় প্রতিটি গ্রামবিন‍্যাস এইরকম। ফসলের খেত পেরিয়ে গ্রাম, তারপর প্রকৃতির দোমড়ানো-মোচড়ানো টিলা, খাদ, ফাটল, শুড়িপথের বেহড়। রছেড় গ্রামের বাসস্টপে দুপুরবেলা নেমে আমরা দুজনে দেখলাম কেউ কোত্থাও নেই। উৎপলকুমার বসুর কবিতার সেই ‘একা শুধু ময়ূর ঘুরছে’। বাসস্টপে সিগারেট ধরিয়ে আমরা ধু-ধু মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে যাওয়া পথটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, কাউকে যদি পাই। অনেকক্ষণ কাটল। খিদিরপুরের ব‍্যবসায়ী বলে দিয়েছিলেন, আগে গ্রামে চিঠি পাঠাবেন, তারপর গ্রামে ঢুকবেন।

ঘণ্টাখানেক পর হাইওয়ে দিয়ে আসা একটি ট্রাকটর থামল। লাফিয়ে নেমে একটি কিশোর রছেড় গ্রামের রাস্তা ধরতেই ‘ও ভাইয়া, ও ভাইয়া’ বলে তাকে থামালাম। একগাল হেসে সৌগত বলল, ‘হমলোগ পত্রকার… বাগীলোক কি কহানি লিখনে কে লিয়ে…।’ হান্টার বুটজোড়া খুলে আমি গ্রামের ওই ব‍্যবসায়ীর ভাইদের জন‍্য চিঠিপত্র কিশোরটির হাতে দিলাম। চিঠি নিয়ে দিগন্তের কিনারের গ্রামটির উদ্দেশে সে হনহন করে চলে গেল। মিলিয়েও গেল।

কেউ আর আসে না। কত সিগারেট ধ্বংস হল। সৌগত বিড়ি খেত। দূর গ্রামটির ঢেউখেলানো জমির দিকে তাকিয়ে এক সময়ে দেখলাম সূর্যাস্তে রং ছড়িয়ে পড়ছে চম্বলের বেহড়ে। তারও অনেকক্ষণ পর দেখলাম, ঢাল বেয়ে এগিয়ে আসছে লন্ঠন, লন্ঠনের পর লন্ঠন…