সাল ১৯৫৬। ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে ন’বছর আগে। স্বাধীন ভারতে ভারতীয় গননাট্য সংঘের লখনঔ শাখা, প্রেমচন্দের ‘ঈদগা’ গল্পের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করে। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের অনুমতি নেওয়া ছিল না। লখনঔ পুলিশ এই নাটকের অভিনয় বন্ধ দেয় এবং চারজন কর্মী-অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করে— ব্রিটিশ ভারতের এক আইনকে হাতিয়ার করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিচারপতি কিদোয়াই এবং ডব্লিউ এন মুল্লাকের ডিভিশন বেঞ্চ, উল্লেখিত আইনকে বিধিবহির্ভূত বলে ঘোষনা করে। ব্রিটিশ ভারতের সেই বিতর্কিত আইনটি হল ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ‘ড্রামাটিক পারফরমেন্সেস কন্ট্রোল অ্যাক্ট’ (‘নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন’)। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর এই আইন লাগু হয়। আজ আমরা এসে দাঁড়িয়েছি সেই বিতর্কিত আইন প্রণয়নের সার্ধশতবর্ষের দোরগোড়ায়।
কেন হঠাৎ ব্রিটিশ সরকার এরকম একটা আইন প্রণয়ন করতে চাইল? ঠিক কী-কী ঘটেছিল সেই সময়ে? ঘটনাগুলি ফিরে দেখা যাক। ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যাশনাল থিয়েটার বা জাতীয় রঙ্গালয়, জাতীয় রঙ্গালয়ের উদ্বোধন ঘটে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের হাত ধরে। ‘নীলদর্পণ’-এর ইতিহাস আর নতুন করে বলার কিছু নেই, এই নাটক মঞ্চায়নের পর থেকেই ইংরেজ সরকার সিঁদুরে মেঘ দেখতে শের করে। থিয়েটার যে-কোনও মুহূর্তে সমাজের দর্পন হয়ে, সম্পূর্ণ সমাজকেই পালটে দিতে পারে এই আশঙ্কা ইংরেজ সরকারের ছিলই। তবে সবকিছু শুরু হওয়ার আগেই ক্ষয়ে যেতে থাকে, ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙে যায়।
আগামী ৩ বছর ন্যাশনাল, হিন্দু ন্যাশনাল, গ্রেট ন্যাশনাল, এমনই বিভিন্ন ভাঙাগড়া হতে থাকে। ১৮৭৬ সালের শুরু থেকে বেঙ্গল ও গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নিয়মিত অভিনয় শুরু করে। মধুসূদন ও রামনারায়ণের নাটক অভিনয়ের সময়ে আসতে থকে কালচারাল হেজিমনির চাপ ও কণ্ঠরোধের চেষ্টা। অন্যদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’, কিরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারতে যবন’, হরলাল রায়ের ‘বঙ্গের সুখাবসান’, ‘হেমলতা’, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গুইকোয়ার’, অমৃতলালের ‘হীরকচূর্ণ’, উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎসরোজিনী’ অভিনয় হয়ে চলেছে। বিভিন্ন নাটকে ইংরেজ সাহেবদের খল চরিত্রে দেখা যেতে থাকে। ইংরেজরা তলে-তলে প্রস্তুত হয় কিছু একটা করার জন্য, হয় জোর করে পেশিশক্তি দিয়ে, নতুবা আইনবলে। দ্বিতীয় পথটাই বেছে নেয় তারা। তবে প্রয়োজন ছিল নির্দিষ্ট একটি উপলক্ষের।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় আসেন প্রিন্স অফ ওয়েলস (মহারানী ভিক্টোরিয়ার পুত্র, পরবর্তীতে সপ্তম এডওয়ার্ড)। প্রিন্সের শখ জাগে— বাঙালি অভিজাত ঘরের অন্দরমহলের নারীদের দেখার। সে-সময়ের প্রেক্ষিতে এটি বিদঘুটে প্রস্তাব হলেও, রানীর ছেলের শখ বলে কথা! না পূরণ করলে হয়? শখ পূরণে এগিয়ে এলেন ভবানীপুরের জগদানন্দ উকিল। জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির স্ত্রীলোকগণ যুবরাজকে উলু দিয়ে বরণ করলেন। এই ঘটনা কলকাতায় শোরগোল ফেলে দিল। সংবাদপত্রে প্রচুর লেখালিখি হয়, বাঁধা হয় গান।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাট্যরচনা করেন উপেন্দ্রনাথ দাস। নাটকের নাম ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি এই নাটক অভিনীত হয় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে। ব্রিটিশ সরকার নাটকটির অভিনয় বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়— এই নাটকে রাজভক্ত সম্ভ্রান্ত প্রজাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে এই অভিযোগে। গ্রেট ন্যাশনাল কিন্তু এখানেই দমে গিয়ে মঞ্চায়ন থামিয়ে দেয়নি, খেলা গড়ায় বহুদূর। তারা মূল নাট্য-আখ্যান এক রেখে, নাটকটির নাম পরিবর্তন করে— ‘হনুমান চরিত্র’ নামে আবার অভিনয় করে। যথারীতি ‘হনুমান চরিত্র’ও নিষিদ্ধ হয়। তখন তারা অভিনয় শুরু করে ‘দি পুলিশ অফ পীগ অ্যান্ড শীপ’ নাটকের। তখনকার পুলিশ সুপার মিস্টার ল্যাম্ব এবং পুলিশ কমিশনার মিস্টার স্টুয়ার্ট হগ-এর নামকে ব্যঙ্গ করে এইরূপ নামকরণ করা হয় নাটকের।
বিভিন্ন নাটকে ইংরেজ সাহেবদের খল চরিত্রে দেখা যেতে থাকে। ইংরেজরা তলে-তলে প্রস্তুত হয় কিছু একটা করার জন্য, হয় জোর করে পেশিশক্তি দিয়ে, নতুবা আইনবলে। দ্বিতীয় পথটাই বেছে নেয় তারা। তবে প্রয়োজন ছিল নির্দিষ্ট একটি উপলক্ষের।
উপেন্দ্রনাথের ‘শরৎ-সরোজিনী’ এবং ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ নাটক নিয়ে আগে থেকেই সমস্যা ও ইংরেজ সরকারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল, এই নাটকগুলি অভিনয়ের পর সরকারও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। ৪ মার্চ, ১৮৭৬। ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ নাটক অভিনয়ের সময়ে পুলিশ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ঘিরে ফেলে এবং নাটক ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ অশ্লীল ও এরা সকলে তার সঙ্গে যুক্ত, এই অপরাধে উপেন্দ্রনাথ দাস, অমৃতলাল বসু, মতিলাল সুর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, রামতারণ সান্যাল, মহেন্দ্রলাল বসু, শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গোপাল দাস এবং ভুবনমোহন নিয়োগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারের পর বাকিরা ছাড়া পেলেও, উপেন্দ্রনাথ এবং অমৃতলালের একমাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়।
কিন্তু শুধু কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে ইংরেজ সরকার বিষয়টিকে ছেড়ে দেয়নি। মার্চ মাসেই ‘ড্রামাটিক পারফরমেন্সেস কন্ট্রোল বিল’ নির্মাণ করা হয়। এই বিল বাইরে অশ্লীলতার কথা বললেও, ভেতরে-ভেতরে সরকার বিরোধীতার ভয়টিই ছিল প্রবল। স্বভাবতই এই বিল পাশ হওয়ার পরে বেশ কিছু বিরোধীতা হতে থাকে, কিন্তু বিলটিকে আইনে পরিণত করার ব্যাপারে ইংরেজ সরকার ছিল অপ্রতিরোদ্ধ। ১৮৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই বিলটি আইন হিসাবে স্বীকৃতি পায়। রাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাহাদুর সিলেক্ট কমিটিতে ভারতীয় সদস্য হিসাবে এই বিলটি সমর্থন করেন। এই আইনের বলে, গিরিশচন্দ্রের ‘সিরাজদৌল্লা’, ‘ছত্রপতি শিবাজী’, ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’, ‘বাঙ্গলার মসনদ’, মনোমোহন গোস্বামীর ‘কর্মফল’, ‘শিবাজী’ নাটক থেকে শুরু করে মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’, শচীন সেনগুপ্তর ‘নরদেবতা’-র মতো নাটক নিষিদ্ধ হয়।
স্বাধীন ভারতেও সলিল চৌধুরীর ‘সংকেত’, তুলসী লাহিড়ীর ‘বাংলার মাটি’, জোছন দস্তিদারের ‘অমর ভিয়েতনাম’ নাটক এই আইনের বলেই নিষিদ্ধ করা হয়। যাত্রাকেও এই আইনের অন্তর্গত করা হয় এবং প্রচুর পালা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
ইংরেজ শাসিত ভারতে তো বটেই, স্বাধীন ভারতে একদম হাল আমল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাটককে এই আইনের বলে আংশিক অথবা নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়েছে। রাষ্ট্রশক্তি সবসময় সৎ শিল্পকে ভয় পায়। কেন পায়? কারণ সে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় বলে। কিন্তু যে-দেশে শিল্পীরাই বিকিয়ে যেতে থাকে প্রতিদিন ক্ষমতার কাছে, অর্থের কাছে, সেই দেশে কি আদৌ এইরকম কোনও আইনের প্রয়োজন আছে? আছে, কারণ কেই-বা হলফ করে বলতে পারে যে— আর কোনওদিন কোনও বেণীমাধব হঠাৎ করে টিনের তলোয়ার হাতে নিয়ে বলতে শুরু করবেন না তিতুমীর নাটকের সংলাপ?



