কমিক্সের রান্নাঘর

Glimpse of Comics Exhibition

ভারতে কমিক্স-এর ইতিহাস নিয়ে যদি চর্চা করতে বসতে হয়, তাতে পিছিয়ে যেতে হবে শতাধিক বছর। সেই নিয়ে নানা গবেষণা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, তথ্য যাচাই বা বিরল কমিক্স সংগ্রহের কাজ চলছে বেশ কিছু বছর ধরে। ভবিষ্যতেও এই নিয়ে আরও নতুন তথ্য ও আলোচনার বিষয় বেরিয়ে আসবে বলেই মনে করা যায়। তবে বিড়লা একাডেমি ও ফাইন আর্টস-এ এই মুহূর্তে কমিক্স বিষয়ক যে প্রদর্শনীটি চলছে, তার অভিমুখ বেশ খানিকটা আলাদা। বলা যেতে পারে, তা কমিক্স তৈরির পদ্ধতিকে খানিক খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা। 


তত্ত্বাবধায়ক পিনাকী দে, এবং সুজান মুখোপাধ্যায়ের (সিনিয়র কিউরেটর, বিড়লা একাডেমি অফ ফাইন আর্টস) মতে, ‘ইতিহাস তো থাকবেই, সেই সঙ্গে থাকবে প্রতিটি শিল্পীর জীবনে তার চারিপাশের সমাজ ও সাময়িক রাজনীতির ছাপ। তবে সেই সঙ্গে, এই যে তাঁদের শিল্পকলা, তার পিছনে কাজ করছে একেকজনের এক-এক রকমের পদ্ধতি। সেটাকেই মুলত প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে।’

প্রদর্শনীর নাম ‘ক্রাফট অফ কমিক্স’। ভারত জুড়ে, সমসাময়িক কমিক্স শিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টি ও ভাবনা তুলে ধরার জন্য কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করছেন বা কীভাবে নিজেদের দর্শকের কাছে পৌঁছতে পারছেন, সেটাই দেখার চেষ্টা। অর্থাৎ, এই প্রদর্শনীতে দর্শকরা শুধু বিভিন্ন সমসাময়িক শিল্পীর কাজ দেখতে পারবেন, তা-ই নয়— তাঁদের সৃজনশীল প্রক্রিয়াটাও নিজেদের মতো করে বুঝে নিতে পারবেন। আর সেখানেই এই প্রদর্শনীর বিশেষত্ব। যাঁদের কাজ এখানে প্রদর্শিত, তাঁরা হলেন— আপ্পুপেন, আম্রুতা পাটিল, অর্ঘ্য মান্না, চিত্রা গণেশ, প্রিয়া কুরিয়ান, অরিজিত সেন, ইক্রুপ সান্ধু, জোশি বেনেডিক্ট, ইটা মেরহোত্রা, শঙ্খ ব্যানার্জি, সর্বজিৎ সেন, সারনাথ ব্যানার্জি এবং বিশ্বজ্যোতি ঘোষ। 

আরও পড়ুন: লিথোগ্রাফের এক অন্য ইতিহাস ধরা পড়ে সঞ্জীত চৌধুরীর প্রদর্শনীতে!
লিখছেন অর্পণ ঘোষ…

লক্ষ করলে দেখা যাবে, এদের প্রত্যেকের শিল্প যেমন স্বতন্ত্র, তেমনই তাঁদের সৃজনশীল প্রক্রিয়াগুলোও অনন্য। সেই প্রক্রিয়াগুলোর প্রতিই বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছে এই প্রদর্শনীতে। 

‘ফিউগ স্টেট ড্রিমস’ (২০২৪)। শিল্পী: চিত্রা গণেশ

ব্রুকলিনে জন্ম এবং বড় হওয়া চিত্রা গণেশের কাজে অঙ্কন-ভিত্তিক অনুশীলনের ছাপ পাওয়া যায়। পুরাণকথা বা বহু-প্রচলিত কাহিনিগুলোকে পুনর্কল্পনা করার একটা চেষ্টা। এর মূল উদাহরণ, তাঁর প্রথমদিকের কাজ ‘টেলস অফ অ্যামনেশিয়া’। ‘অমর চিত্রকথা’-র পুরুষ যোদ্ধাদের এখানে শিল্পী বদলে দিয়েছেন মহিলায়। দেখার চেষ্টা করেছেন নারীর চোখ দিয়ে। এই প্রদর্শনীতে রাখা রয়েছে, ‘ফিউগ স্টেট ড্রিমস’ (২০২৪)— মোট ন’টি ছবির একটি সিরিজ। এই প্রত্যেকটি ছবি যেমন একটি সিরিজের অংশ হিসেবে দেখা যায়, তেমনই দেখা যায়, এক-একটি স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবেও। ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং বেন-ডে ডট-এর মিশেলে চিত্রা তাঁর শিল্পকে রূপ দেন। 

অন্যদিকে প্রিয়া কুরিয়ান তাঁর কাজের মাধ্যমে একধরনের গল্প বলার চেষ্টা করে থাকেন। ফলে শুধু আঁকা নয়, স্পিচ বাবল-এর উপস্থিতি এবং ধারাবাহিকতা তাঁর শিল্প-পদ্ধতির এক বিশেষ অঙ্গ হয়ে ওঠে। 

‘ল্যান্ডস্কেপস ইন দ্য মিস্ট’। শিল্পী: সর্বজিত সেন

কমিক্স এবং গ্রাফিক শিল্পী হিসেবে সর্বজিত সেনের নাম বহু পরিচিত। ১৯৯৪ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ‘পেইন্টিং ইন টাইম’ তথ্যচিত্রর পরিচালক হিসেবে। এই প্রদর্শনীতে দেখতে পাওয়া যাবে তাঁর ‘ফেমিন টেলস’ (২০২৩)-এর অংশ ‘ল্যান্ডস্কেপস ইন দ্য মিস্ট’-এর কাজগুলি। অতিমারী চলাকালীন এই কাজটি করছিলেন তিনি। রঞ্জক পদার্থের অভাবে, সেপিয়া টোন তৈরি করার চেষ্টায় তাই ব্যবহার করেছেন ‘খয়ের’ (যা দিয়ে পান সাজা হয়)। 

শঙ্খ ব্যানার্জি-র মূল কাজ ‘মহাভারত’ নিয়ে। তিনি বহু বছর ধরে এই নিয়ে পড়াশোনা এবং গবেষণা করছেন, যা তাঁর কাজের পদ্ধতিতে স্পষ্ট। তাঁর মতে, ‘শিল্পীর একটা বেড়ে ওঠা থাকে। তাঁর চিন্তা প্রক্রিয়ারও একটা যাত্রা আছে, যেটা কাজের মাধ্যমে স্পষ্টতা পায়। অর্থাৎ, কমিক্স যদি একটি ভাষা হয়ে থাকে, তাহলে তাকে কীভাবে পড়া যায় বা দেখা যায়।’ এই প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের মধ্যে রয়েছে একটি ইনস্টলেশনও। শঙ্খ ও তাঁর ছাত্র সর্বেশ শ্রীবাস্তব— দু’জনে মিলে দেওয়ালে অভিক্ষেপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন হস্তিনাপুর খননের মানচিত্র। প্রদর্শিত ‘পাঞ্চালী: দ্য গেম অফ ডাইস’-এর অংশে দেখা যায় কীভাবে ফন্টকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।

‘পাঞ্চালী: দ্য গেম অফ ডাইস’। শঙ্খ ব্যানার্জির কাজের প্রদর্শনী

গ্রাফিক নভেলিস্ট ইটা মেহরোত্রার ‘শাহিন বাগ— আ গ্রাফিক রিকালেকশন’-এর কাজের মাধ্যমে দেখা যায় আন্দোলনে নারীদের জোরালো অবস্থান এবং নারীদের কীভাবে দেখা উচিত— সেই বিষয়ে চর্চা। 

গ্রাফিক শিল্পী হিসেবে অরিজিত সেনের দাপুটে উপস্থিতি তো আছেই। তিনি বরাবরই তাঁর কাজকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিসেবে দর্শকের সামনে উপস্থিত করতে চান। তাই ‘দ্য এমারেল্ড অপ্সরা’-র অংশ প্রায় ৬-ফুট মানুষের সমান প্যানেল করে রাখা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে প্রেম মুখার্জির তৈরি ‘এলএমএম ভেস্পা’-র ইনস্টলেশন।

সাধারণ মানুষের কাছে মুহূর্ত ক্ষণস্থায়ী মাত্র। তবে শিল্পীর চোখে নয়। একটি শিশিরবিন্দু পাতায় পড়ে সেখান থেকে কীভাবে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে, বা ঘুম থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসার যে প্রক্রিয়া— তা ধাপে-ধাপে প্যানেলের মাধ্যমে ফুটে ওঠে শিল্পী জোশুয়া বেনেডিক্টের কাজে। 

অর্ঘ্য মান্না-র কাজের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আঁকার টেবিলটিও রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। সঙ্গে তাঁর ছেলের বিভিন্ন ছবি ডেস্কের ওপরের দেওয়ালে সাঁটা। কারণ, শিল্পী হিসেবে এটাই তাঁর কাজের পদ্ধতির অঙ্গ। 

তেমনই ইকরূপ সান্ধু প্রথাগত প্যানেল তৈরিতে বিশ্বাসী নন। তাঁর শিল্পে গভীর আখ্যানকাঠামো-র ছাপ পাওয়া যায়। 

বিশ্বজ্যোতি ঘোষের কাজে মূলত দেশভাগের প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘লাহোর রিপোর্টিং’-এ শিল্পীর লাহোর ভ্রমণ এবং তাঁর শহর দিল্লির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়ার গল্প পাতায় পাতায় ছড়িয়ে। 

মহাকাব্যকে নতুন আঙ্গিকে শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখা— আম্রুতা পাটিলের কাজের পদ্ধতির মূল অংশ। জল-রং, অ্যাক্রেলিক ও চারকোলের ব্যবহার পাওয়া যায় তাঁর কাজে। সারনাথ ব্যানার্জি নিজেকে ‘ফ্ল্যানিউর’ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালবাসেন। তাঁর শিল্পমাধ্যমে তিনি চেষ্টা করেন শহর ও সমাজের ক্রমাগত বদলে যাওয়াকে তুলে ধরতে। এই প্রদর্শনীর বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শিল্পী জানালেন, ‘কমিক্স মাধ্যমের হাইব্রিড চরিত্রকে তুলে ধরতে আগে বিশেষ দেখা যায়নি। কমিক্সকে শুধুমাত্র চিত্রণ হিসেবে অজ্ঞতার চোখে না দেখে, তার শিল্পকে দেখা জরুরি।’ 

‘দ্য ড্রিম মেশিন’। শিল্পী: আপ্পুপেন

জর্জ মাথেন বা আপ্পুপেনের সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় মূলত প্রাধান্য পায় গল্প-বলা। তাঁর দু’টি গ্রাফিক নভেলের অংশবিশেষ প্রদর্শিত এখানে— ‘দ্য ড্রিম মেশিন’ এবং ‘দ্য স্নেক অ্যান্ড দ্য লোটাস’। উডকাটের আদলে পেন দিয়ে তাঁর শিল্প ও গল্পকে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। তাঁর মতে, ‘কমিক্স যে শুধুমাত্র ছোটদের বিনোদনের জন্য নয়, সেটা বুঝতে হবে ভারতের বেশিরভাগ মানুষকে। তাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে পাঠ করা যায়। এক-একটা পাতা মানে এক-একটা সৃষ্টি— যার জন্য পরিশ্রম আর গবেষণা লাগে। তাই সৃজনশীল প্রক্রিয়াগুলির ওপর আলোকপাত করা জরুরি।’

এই মুহূর্তে ভারতে সমসাময়িক তো বটেই, কমিক্সের ইতিহাস নিয়েও যথেষ্ট চর্চা এবং সংরক্ষণের কাজ চলছে। পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার ও শিক্ষক পিনাকী দে-র মতে, এই ন্যারেটিভ নিয়ে কাজ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, বাংলা কমিক্সের ইতিহাসের দিকে তাকালে এই বছরই শতবর্ষে পা রেখেছেন নারায়ণ দেবনাথ ও ময়ূখ চৌধুরী। গল্প ও বিনোদনের মাধ্যম তো বটেই, কমিক্সকে একরকমের ভাষা হিসেবে পড়ার চেষ্টা চলছে। এর থেকেই শিল্পীরা নতুন প্রথা ও প্রক্রিয়া দর্শকের সামনে নিয়ে আসবেন বলেই আশা করা হচ্ছে।

‘ক্রাফট অফ কমিক্স’ প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত, ‘বিড়লা অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্য়ান্ড কালচার’-এ।