সম্পর্কের আজ-কাল

Representative Image

সম্পর্কে বিশ্বাস, অবিশ্বাস, সুখ, দুঃখ হতাশা চিরকাল ছিল, আছে এবং থাকবে। সবটাই তো সম্পর্কজাত। কিন্তু আধুনিক দুনিয়ার আতসকাচে সম্পর্কের মানে ভিন্ন। প্রতিটা পদক্ষেপের একটা নতুন নাম। নবপ্রজন্মের ভাষায় বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের সংজ্ঞা। চটজলদি ভেঙে যাচ্ছে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ঘটছে বিবাহবিচ্ছেদ। কিন্তু কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন সম্পর্কে ‘অ্যামবিভ্যালেন্স’-এর ঘটনা বেশি ঘটছে, সেই জন্যই দূরত্ব বাড়ছে।


বিজ্ঞাপন

কিন্তু অ্যামবিভ্যালেন্স মানে কি? অ্যামবিভ্যালেন্স হল এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি একইসঙ্গে বিপরীতমুখী অনুভূতি বা চিন্তা অনুভব করে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর অর্থ দাঁড়ায় একদিকে সঙ্গীর প্রতি ভালবাসা, আকর্ষণ, ঘনিষ্ঠতার ইচ্ছা থাকে আবার একই সময়ে সন্দেহ, ভয়, বিরক্তি বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। এই দ্বৈত অনুভূতি মানুষের মনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে, আচরণে অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং সম্পর্কের গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ অ্যামবিভ্যালেন্স হল হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে চলা এক অদৃশ্য টানাপোড়েন, যেখানে ভালবাসা থাকলেও অনিশ্চয়তা ও দ্বিধা স্থির হতে দেয় না।

‘অ্যামবিভ্যালেন্স’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে ‘অ্যাম্বি’ অর্থাৎ দুই দিক বা উভয়পক্ষ আর ‘ভ্যালেনটিয়া’ অর্থাৎ শক্তি বা মানসিক প্রবণতা। এই দু’টি অংশ মিলিয়ে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘দুই বিপরীত শক্তির সহাবস্থান’।

১৯১০ সালে শব্দটির প্রচলন ঘটিয়েছিলেন সুইস মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ইউজেন ব্লয়লার। তিনি প্রথম এই ধারণাটি ব্যবহার করেন স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীদের আবেগগত আচরণ ব্যাখ্যা করতে। ব্লয়লার লক্ষ করেন, অনেক সময় একজন মানুষ একই ব্যক্তি বা পরিস্থিতির প্রতি ভালবাসা ও ঘৃণা দু’টি বিপরীত অনুভূতি একসঙ্গে অনুভব করেন। এই জটিল মানসিক অবস্থাকেই তিনি নাম দেন ‘Ambivalenz’, যা পরে ইংরেজিতে ‘Ambivalence’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, এমনকী সাহিত্যেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যখন মানুষ বা চরিত্রের মধ্যে টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব বা দ্বৈত অনুভূতি প্রকাশ পায়। আজকের দিনে সম্পর্ক, সিদ্ধান্ত বা নৈতিক দ্বিধা বোঝাতে, ‘অ্যামবিভ্যালেন্স’ একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন: যৌনতার ফ্যান্টাসির সঙ্গে কি হিংসা জড়িয়ে গেছে? লিখছেন আদিত্য ঘোষ…

আপনার বিপরীতে থাকা মানুষটিকে আপনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছেন দীর্ঘ বছর। বিবাহিত জীবনও বেশ সুখের। কিন্তু হঠাৎ আপনার মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্ভব হতে শুরু করল। আপনার বিপরীতে থাকা মানুষটিকে আতসকাচের তলায় রেখে, যাচাই করতে শুরু করলেন। সর্বক্ষণ চোখে-চোখে রাখার উপায় আঁটলেন। ঠিক একই সময়ে আবার ভাবলেন, এই মানুষটিকেই তো দীর্ঘ বছর ভালবেসে যাপন করেছেন। তাহলে কেন তাঁকে সন্দেহ করছেন? মনের ভেতরে তৈরি হল দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের বশবর্তী হয়েই, আপনার সম্পর্কে জন্ম নিল ‘অ্যামবিভ্যালেন্স’। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে দায়ী কতগুলো বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। অতীতে ভেঙে যাওয়া কোনও সম্পর্ক হঠাৎ আপনার মনকে অস্থির করে তুলতে পারে। কোনও সময়ে কেউ আপনাকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল বা কোনও বিশেষ কারণে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণ আপনাকে ব্যাকুল করে তুলল। যার ফলে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসে পড়ল বর্তমান সম্পর্কে। তৈরি হল দ্বন্দ্ব।

এছাড়া, শৈশবে যদি সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী যত্ন বা সঙ্গ না দেওয়া হয়, তবে তার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ভয় জন্ম নেয়, যা পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রতি আস্থাহীনতা এবং দ্বিধার জন্ম দেবে। এছাড়া সম্পর্কের মানসিক গঠনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি একটি দ্বৈত অনুভূতি, যেখানে একই সঙ্গে আকর্ষণ, ভালবাসা ও নিরাপত্তার ইচ্ছা কাজ করে কিন্তু ভয়, সন্দেহ বা আত্মপরিচয়ের ক্ষয় ব্যক্তিকে দ্বিধাগ্রস্ত করে। সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবও অ্যামবিভ্যালেন্সকে তীব্র করে।

আধুনিক যুগে সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের সম্পর্কের মানকে প্রভাবিত করছে। বন্ধুবান্ধবী বা পরিচিতদের সম্পর্ক দেখে তুলনা ও অতিরিক্ত তথ্য প্রবাহ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং নিজের সম্পর্ককে অনির্দিষ্ট বা অসুখী মনে করায়। সম্পর্কের মানসিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য।

অ্যামবিভ্যালেন্সের কারণে ব্যক্তি সম্পর্কের প্রতি আকৃষ্ট থাকলেও, সম্পর্ককে ধরে রাখার ভয় ও অনিশ্চয়তা তার আচরণে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যার ফলে সম্পর্কের গুণগত মান প্রভাবিত হয়। সব মিলিয়ে, অ্যামবিভ্যালেন্স সম্পর্কের ভিতরে ভালবাসা ও দ্বিধার সূক্ষ্ম মিশ্রণ, যা মানবিক এবং মানসিকভাবে জটিল হলেও স্বাভাবিক। এই অবস্থার মোকাবিলা করতে হলে, অতীতের অভিজ্ঞতা ও বর্তমান সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। সম্পর্কের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করলে দ্বৈত অনুভূতির প্রভাব কমানো সম্ভব এবং সম্পর্কের গভীরতা ও স্থায়িত্ব বজায় রাখা যায়।

বিশ্বব্যাপী সম্পর্কের অ্যামবিভ্যালেন্স অর্থাৎ একদিকে ভালবাসা এবং অন্যদিকে দ্বিধা বা অনিশ্চয়তা ডিভোর্সের হার বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গড়ে প্রতি ১,০০০ জনের মধ্যে প্রায় ১.৮ জনের ডিভোর্স হয়েছে যা ২০২২ সালের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মলদ্বীপে প্রতি ১,০০০ জনে ৫ জনের ডিভোর্স হয়েছে, যেখানে সম্পর্কের দ্বিধা, মানসিক চাপ এবং সামাজিক ও আর্থিক অনিশ্চয়তা আরও তীব্র। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সম্পর্কের অ্যামবিভ্যালেন্স দীর্ঘমেয়াদে বিচ্ছেদের সম্ভাবনা বাড়ায়। কারণ যখন একজন ব্যক্তি একদিকে ঘনিষ্ঠতা ও ভালবাসা অনুভব করে, আবার একই সময়ে অনিশ্চয়তা, ভয় বা আত্মপরিচয়ের ক্ষয় অনুভব করে, তখন সম্পর্কের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া দুর্বল হয়। এই ধারা শুধু পশ্চিম দেশে বা শহুরে সমাজে নয়, ভারত ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও লক্ষ করা যাচ্ছে, যেখানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্কের প্রত্যাশা, সামাজিক মিডিয়ার প্রভাব এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সম্পর্কের অ্যামবিভ্যালেন্স বিশ্বব্যাপী সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও মানের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে এবং এটি ডিভোর্সের হার বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের মোট ডিভোর্স রেট প্রায় ১% হলেও শহরাঞ্চল এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই হার ৩০-৪০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আধুনিক সম্পর্কের জটিলতা ও মানসিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। হায়দ্রাবাদে সম্প্রতি ডিভোর্স ফাইলিং ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সম্পর্কের প্রত্যাশার পরিবর্তন, সামাজিক মিডিয়ার প্রভাব, আর্থিক স্বাধীনতা এবং মানসিক চাপের কারণে ঘটছে।

শৈশবে যদি সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী যত্ন বা সঙ্গ না দেওয়া হয়, তবে তার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ভয় জন্ম নেয়, যা পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রতি আস্থাহীনতা এবং দ্বিধার জন্ম দেবে। এছাড়া সম্পর্কের মানসিক গঠনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি একটি দ্বৈত অনুভূতি, যেখানে একই সঙ্গে আকর্ষণ, ভালবাসা ও নিরাপত্তার ইচ্ছা কাজ করে কিন্তু ভয়, সন্দেহ বা আত্মপরিচয়ের ক্ষয় ব্যক্তিকে দ্বিধাগ্রস্ত করে।

মনে রাখতে হবে, ‘অ্যামবিভ্যালেন্স’ আসলে কোনও মানসিক রোগ নয়, বরং মানুষের মনের একেবারে স্বাভাবিক অবস্থা। শব্দটির অর্থই হল, একই সময়ে বিপরীত দুটি অনুভূতির সহাবস্থান যেমন কাউকে ভালও লাগে, আবার তার কিছু আচরণে বিরক্তিও লাগে। জীবনের নানা সিদ্ধান্তে, সম্পর্কের জটিলতায় বা নিজের অনুভূতির টানাপোড়েনে আমরা সবাই কোনও-না-কোনও সময়ে অ্যামবিভ্যালেন্ট হই। আর এই অবস্থা শুধু সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, যে-কোনও অবস্থায় হতে পারে।

কোনও জিনিস কেনার আগে, চাকরি পরিবর্তনের সময়ে, কোনও বন্ধুকে কোনও কথা বলার আগে, কোনও সিনেমা বা গল্পের বই নির্বাচনের সময়ে। তবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অ্যামবিভালেন্স একটি সম্পর্কে নিমেষে শেষ করে দিতে পারে। আগেও সম্পর্কে সমস্যা হত, দ্বন্দ্ব আসত। কিন্তু সেখানে ফেরার তাগিদ ছিল। বর্তমানে ফেরার তাগিদ কম। সেই সঙ্গে সমাজমাধ্যমের বিরূপ প্রভাব আমাদের ঘেঁটে দিচ্ছে। আমরা অন্যদের সম্পর্ককে দেখে নিজেদের তুলনা করছি। আদর্শ প্রেমিক, প্রেমিকা হতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না, দিনশেষে খুঁত রয়েই যাচ্ছে। আমাদের গ্রাস করছে হতাশা। সাধারণ জীবনে অ্যামবিভ্যালেন্স মানে অসুস্থতা নয়, বরং মনের একটি সংকেত তুমি নিজের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনুভব করছ, এবং সেই দ্বন্দ্ব তোমাকে কিছু ভাবতে, বুঝতে ও নির্বাচন করতে শেখাচ্ছে।

অ্যামবিভিলেন্স বা সম্পর্কের দ্বিধা সমাধানের ক্ষেত্রে— মূলত মানসিক, আচরণগত এবং যোগাযোগমূলক উপায়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে নিজেকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আমি কি সত্যিই এই সম্পর্ক চাই, নাকি আমার ভেতরের ভয় বা অতীত ট্রমা আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত করছে। নিজের অনুভূতি স্বীকার করা দ্বিধা কমাতে সহায়ক। এরপর খোলামেলা আলোচনা খুবই প্রয়োজন। সঙ্গীর সঙ্গে নিজের আশঙ্কা, আশা এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি দূর হয় এবং সমঝোতার পথ খোলা যায়। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। থেরাপি বা কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে নিজস্ব অ্যাটাচমেন্ট প্যাটার্ন বা অতীত অভিজ্ঞতা বোঝা যায়, আর মাইন্ডফুলনেস, মেডিটেশন বা জার্নালিং-এর মাধ্যমে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দ্বিধা থাকলেও তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে ধীরে-ধীরে সম্পর্ক বোঝা উচিত। ছোট-ছোট পদক্ষেপ, যেমন একসঙ্গে সময় কাটানো, ভ্রমণ বা দায়িত্ব ভাগাভাগি সম্পর্কের বাস্তবতা বোঝার সুযোগ দেয়। এছাড়াও সম্পর্কের মধ্যে নিজের সীমা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখলে, নির্ভরতার চাপ কমে এবং দ্বিধা হ্রাস পায়। সর্বশেষে, দ্বিধা মেনে নেওয়াও জরুরি—এটি কোনও দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং সম্পর্ককে গভীরভাবে বোঝার একটি প্রক্রিয়া। পারস্পরিক সমঝোতা, সচেতনতা এবং ধৈর্য সহকারে এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করলে অ্যামবিভিলেন্স মোকাবিলা করা সহজ হয় এবং সম্পর্কের মান স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পায়।

  তথ্য এবং বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মানি দাস