চির-তরুণ

Tarun Kumar

তরুণকুমার সম্পর্কে ভাবতে বসলে যেটা প্রথমেই মাথায় আসে, সেটা একটা বিস্ময়। সেই বিস্ময়টা কেমন? আমি ভাবি, যখন এইসব মেথড অ্যাকটিং আসেনি, তখন তরুণকুমার-সহ অন্যান্যরা কী করে এইসব আবিষ্কার করছেন! উত্তমকুমারের চেয়ে বড় সার্টিফিকেট ওঁকে আর কে দিতে পেরেছেন! খোদ মহানায়ক নাকি বলছেন, তরুণকুমার এক শটে থাকলে তাঁর নার্ভাস লাগে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটা সময়ে বলতেন, ‘আমাদের আগে একটা উষ্মা ছিল যে, তরুণকুমার উত্তমকুমারের ভাই বলে পার্ট পায়। পরে দেখলাম, বুড়োদা এমন একজন অভিনেতা, যাঁর থেকে আমাকেও শিখতে হচ্ছে।’ তরুণবাবুর থেকে কত কী যে শেখার আছে, নিজে একজন অভিনেতা হয়ে বুঝতে পারি। আবার এ-কথাও ঠিক, সব কিছু ওঁর থেকে শেখা যাবে না। সম্ভব নয় সেটা। এমন একটা ম্যাজিক ছিল ওঁর মধ্যে, যা অননুকরণীয়।

সিনেমা তো বটেই, আমি তরুণকুমারকে বোর্ড থিয়েটারেও দেখেছি। কী সাবলীল অভিনয়! মনে রাখতে হবে, একজন অভিনেতাকে কিন্তু ন্যাচারাল হ্যাবিটাটে দেখলেই সবচেয়ে ভাল বোঝা যায়! সিনেমায় হিরো এন্ট্রি নিলে যেরকম হাততালি পড়ে, উইংস থেকে তরুণবাবুর গলা শোনা গেলেই সেরকম হাততালি পড়ত। এবং সেটা একদম শেষ রো পর্যন্ত। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (বড়) এবং তরুণকুমার ঠিক ততটাই ‘স্টার’ ছিলেন সেই সময়ে মঞ্চে। যাঁরা দেখেননি, তাঁদেরকে এটা লিখে বা বলে বোঝানো যাবে না। খুব জোর দিয়েই একটা কথা আমি বলতে চাই, তরুণকুমারের কোনও পূর্বসূরি যেমন ছিল না, উত্তরসূরিও তেমন নেই। কোনওদিন হবে বলে মনেও হয় না।

‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির একটা দৃশ্য যতবার দেখি, অবাক হয়ে যাই। ওই ছবিতে তরুণকুমার বয়স্ক এক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবিতে যখন ঘটকরা আসা শুরু করল তরুণকুমারের কাছে, প্রথমে দেখা যাবে, প্রথম ঘটককে খুব ধৈর্য ধরে বলছেন, ‘ওই তো ওইদিকে বসন্ত বিলাপ’, কিন্তু একদম শেষের জনকে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘আমার বুকের ওপর দিয়ে যাবে গো! আমার বুকের ওপর দিয়ে যাবে!’ মানে নিজে হোমিওপ্যাথি চেম্বারে বসে ঘটকের জ্বালায় তিষ্ঠতে পারছেন না, তা পাঁচটা শটের মধ্যে দিয়ে পার্থক্যটা বুঝিয়েছেন।

আরও পড়ুন : কেবলই অভিনয় নয়, ছোটগল্পের জন্যও স্মৃতিধার্য তৃপ্তি মিত্র!
লিখছেন আশিস পাঠক…

‘চুপি চুপি আসে’ বা ‘সোনার হরিণ’-এ ধূসর চরিত্রে ছিলেন তরুণকুমার। আবার ‘অবাক পৃথিবী’-তে ফাদারের চরিত্র, যা ওঁকে বিএফজেএ পুরস্কার এনে দিল, সেই চরিত্রে একেবারে অন্য তারের অভিনয়। নায়কের বন্ধুর চরিত্র তো চিরকালই বাংলা ছবিতে আছে, সময়ানুযায়ী কেবল বদলে গিয়েছে তার ধরন। কিন্তু তরুণকুমার যখন নায়কের বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন তা জীবনের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসে। ‘ছদ্মবেশী’-তে যখন এসে মাধবী মুখোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করেন তরুণকুমার, তাঁর বন্ধু, অর্থাৎ এই ছবিতে যিনি ছদ্মবেশী চালক, যে ভূমিকায় অভিনয় করছেন উত্তমকুমার, সেই বন্ধু কখন আসবেন, মনে হয়, এ যেন আমার বন্ধুর খোঁজ আমি নিচ্ছি! ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল এই অভিব্যক্তির স্বাভাবিকত্ব। তরুণকুমার এমনই, যখন তিনি দাদা, বন্ধু, তখনও তিনি যতটা সাবলীল, রাশভারী চরিত্রেও ততটা।

আটের দশকে গোটা ভারতীয় সিনেমারই একটা পতন হয়। এক তো উত্তমবাবু চলে গেলেন, তারপর ‘শত্রু’-র পর থেকে যে-ধরনের সিনেমা তৈরি হতে লাগল সেখানে আর স্বাভাবিক অভিনয়ের জায়গা রইল না। যাঁরা ভাল অভিনেতা ছিলেন, তাঁদেরকেও ভাঁড়ামো করতে দেখা যেত বড় পর্দায়। তাঁদেরকে ওইভাবেই তৈরি করতেন পরিচালকেরা। রবি ঘোষকেও সবুজ জামা, মেরুন প্যান্ট পরতে হয়েছে। অনুপকুমারকেও অতিনাটকীয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হল। সব মিলিয়ে, খুব একটা গর্ব করার মতো কিছু নেই। এই পরিস্থিতিতে তরুণকুমার যে আড়ালে চলে যাবেন, এতে আমি আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই দেখি না।