আমাদের অল্প বয়সের সাদাকালো টিভিতে রবিবার-রবিবারে হিন্দি সিনেমা দেখানো হত। হিন্দি সিনেমা আমার কাছে প্রিয় ছিল যতটা-না সিনেমার জন্য, তার চাইতে বেশি গানের জন্য। এবং সে-গান যদি গাইতেন কিশোরকুমার, তাহলে তো কথাই নেই! যেন হাজার বালবের আলো জ্বলে উঠত। তবে গান তো ক্যাসেট চালালেই শোনা যায়। আমার ক্যাসেটের সংগ্রহও ছিল বিপুল সংখ্যক। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার একদিন খেয়াল করলাম সিনেমা দেখতে-দেখতে। কী সেই ব্যাপার? ধরা যাক, কিশোর কুমার গাইছেন ‘ও শাম কুছ আজিব থি, ইয়ে শাম ভি আজিব হ্যায়। / ও কাল ভি পাস পাস থি, ও আজ ভি করিব হ্যায়।’ রাগ ইমনের ওপর এই গানের সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত কুমার। এর অন্তরার এক জায়গায় ক্যাসেটের কিশোর কী গাইছেন? গাইছেন, ‘ম্যায় জানতা হু মেরা নাম গুনগুনা রহি হ্যায় ও… এ হি খ্যয়াল হায় মুঝে কে পাস আ রহি হ্যায় ও।’ কিন্তু এই একই গান সিনেমার জন্য যখন গাইছেন, তখন কী করছেন কিশোর? তিনি তখন ‘মেরা নাম গুনগুনা রহি হ্যায় ও’ এই লাইনটির পরেই ‘এ হি খ্যয়াল হ্যায় মুঝে কে পাস আ রহি হ্যায় ও…’ না গেয়ে, প্রথম লাইনটি অর্থাৎ ‘ম্যায় জানতা হু মেরা নাম গুনগুনা রহি হ্যায় ও’-এর এই ‘ও’-তে এসে ‘ও’-এর সুরটির ওপর একটা ঝোঁক দিয়ে, আবার ফিরে যাচ্ছেন ‘ম্যায় জানতা হু’-তেই পুনরায়। ক্যাসেটের গানে তো তেমন নেই! সেখানে প্রথম লাইনটির রিপিটেশন নেই। সেখানে ‘গুনগুনা রহি হ্যায় ও’-এর পর শ্বাস নিয়ে সরাসরি পরের লাইনে চলে গেছেন। কিন্তু সিনেমায় কিশোর ‘গুনগুনা রহি হ্যায় ও’-র পর শ্বাস নিচ্ছেন না। নিচ্ছেন কোথায়? নিচ্ছেন ‘ম্যায় জানতা হু মেরা নাম গুনগুনা রহি হ্যায় ও… ম্যায়…’ তারপর। শ্বাস নিচ্ছেন এবং আবার গাইছেন, ‘জানতা হু মেরা নাম গুনগুনা রহি হ্যায় ও।’ পরে আসছেন ‘এ হি খ্যয়াল হ্যায় মুঝে কে পাস পাস আ রহি হ্যায় ও’ এই লাইনটিতে। নেশা চেপে গেল আমার। তাহলে কি একটা গান সিনেমার জন্য একরকম আর ক্যাসেটের জন্য আরেকভাবে গাইছেন গায়ক?

আমি যে-সময়ের কথা বলছি, তখন ইন্টারনেট এত সহজলভ্য নয়। ক্যাসেট কোম্পানিগুলো কিশোরকুমারের শ’দুয়েক গানকেই ঘুরিয়েফিরিয়ে নানা নামে বাজারে বেচত। তার বাইরের গান শুনতে পাওয়ার সহজ সুযোগ ছিল না তেমন। সেই সময়ে আমি কিছু আশ্চর্য লোকজনের খোঁজ পেলাম। কারা তাঁরা? তাঁরা ‘গানচোর’। কিশোর একটা অনুষ্ঠানে তাঁর প্রিয় শচীন কর্তার গাওয়া একটা ভজন গেয়েছিলেন একবার। ‘পি লে পি লে পি লে রে তু হরি নাম কা পেয়ালা।’ শচীন দেব বর্মণের গলায় এই রেকর্ড কিংবা ক্যাসেট তো পাওয়া যায় কিন্তু কবে কোন অনুষ্ঠানে কিশোর তাঁর অন্যতম গুরু শচীন দেব বর্মণকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই গান গেয়েছিলেন, সেইটি পাব কোথায়! এই কলকাতা শহরের একজন-দু’জন রাখেন সেই খবর। মাতাল যেমন মাঝরাতে কোথায় মদ পাওয়া যায় ঠিক জেনে যান, আমিও তেমন সেই সব ‘গানচোর’দের ঠিকানা পেয়ে গেলাম।

ঠিকানা তো পেলাম, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে দেখা করে বুঝলাম, গান তাঁরা সহজে দেবেন না আমায়। কারণ যে-গান আর প্রায় কারওর কাছেই নেই, সেই গান তাঁদের কাছেই আছে— এই অহংকার যে সে অহংকার নয়। সুতরাং, একটা দুর্লভ গানের জন্য তখনকার সময়ে দাম হাঁকলেন তিন হাজার টাকা। একটা ক্যাসেটে প্রায় আট-দশটা গানের দাম যেখানে পঁয়ত্রিশ টাকা, সেখানে ‘পি লে পি লে পি লে রে তু হরি নাম কা পেয়ালা’র একার দাম তিন হাজার। গানটা শোনার সৌভাগ্য হল বটে, কিন্তু সংগ্রহ করা হয়ে উঠল না আর। তবে ধীরে-ধীরে আশ্চর্য সব না-জানা গানের খোঁজ পেতে থাকলাম। জানতে পারলাম, কিশোরকুমারের বাংলায় গাওয়া ‘হাওয়া মেঘ সরায়ে ফুল ঝরায়ে’র হিন্দি ভার্সন আছে একটা। কিশোরকুমারের সুর করা এই বাংলা গানটা রেকর্ড করার বহু বছর আগে এর হিন্দি ভার্সনটি রেকর্ড হয়েছিল। সেক্ষেত্রে শুধু সুর নয়, লিরিকও ছিল কিশোরেরই। কিশোরের লেখা ‘পবন গুনগুনায়ে গুল খিলায়ে’ থেকেই শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা করেছিলেন ‘হাওয়া মেঘ সরায়ে ফুল ঝরায়ে ঝিরিঝিরি এলে বহিয়া।’ কিশোরকুমারের সুরে একটা অসাধারণ গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ‘প্রিয়তমা, কী লিখি তোমায়… তুমি ছাড়া কিছু ভাল লাগে না আমার।’ এই গানটিও লতাকে দিয়ে বাংলায় গাওয়ানোর অনেক আগে কিশোর নিজেই গেয়েছিলেন হিন্দিতে। কিন্তু এইসব গান কোনও-না-কোনও কারণে আর রিলিজ হয়নি কখনও, কোনওদিন। তাহলে কি এই গানগুলি সব না শোনা থেকে যাবে আমার? আমি তখন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে চাকরিসূত্রে যুক্ত। কর্তৃপক্ষকে গিয়ে বললাম আমি বম্বে যেতে চাই।
২
কিশোরকুমারের অজানা গান আমি সব থেকে বেশি শুনেছিলাম অমিতকুমারের কাছ থেকেই। আমার মনে আছে, অমিতদার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ওঁদের কার্টার রোডের বাড়িতে। সেই বাড়িতে লীনা চন্দ্রপ্রভাকর আর সুমিতও থাকতেন। অমিতদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। অমিতদা বললেন ‘আরে, এ কী করছ?’ আমি বললাম, ‘আপনার বাবাকে তো দেখিনি, ছুঁইনি, আপনাকে ছুঁলাম।’ অমিতদা তাঁর দুটো হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘এই হাতটা ধরো, এই হাত দিয়ে বাবাকে ছুঁয়েছি কতবার। বাবার ছোঁয়া লেগে আছে আজও এই হাতে।’ মনে আছে, কেঁদে ফেলেছিলাম। এরপর অমিতদার সঙ্গে দেখা করলাম ওঁর পালি হিলের বাড়িতে। কিন্তু তখনও কিশোরকুমারের বাড়ি যাওয়া বাকি। কোথায় সেই বাড়ি? জুহুতে। রাস্তার নাম কলাকার কিশোরকুমার মার্গ। আমাকে নিয়ে গেলেন অমিত কুমার। বাড়ি নয়, বাংলো। দরজায় লেখা ‘গৌরীকুঞ্জ’। কিশোরকুমারের মা গৌরী দেবী আর বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলির নাম মিলিয়ে বাংলোর নাম।
বাড়ির ভেতরে প্রথমেই একটা অতিকায় অয়েল পেইন্টিং। কে এল সায়গলের। কিশোর আজীবন গুরু মেনে এসেছেন যাঁকে। যাঁকে অনুকরণ করে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন। তারপর দ্বিতীয় ছবিটি মহম্মদ রফির সঙ্গে কিশোরকুমারের। একটা পিয়ানো রাখা আছে। কিশোর বাজাতেন। একটা হারমোনিয়াম। অমিতদা বললেন, ‘সলিল চৌধুরীর হারমোনিয়াম, বাবা নিয়ে এসেছিলেন। মান্নাবাবু এলে এই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন। বাংলায় একটা গান ছিল ‘চলো যাই চলে যাই দূর বহুদূর, গায়ে মেখে জড়ি বোনা সোনা রোদ্দুর’; এর হিন্দিটা কিশোরকুমারের সঙ্গে মান্না দে-ও গেয়েছিলেন। হিন্দি লিরিক কিশোরকুমারেরই, ‘চলাচল চলাচল হ্যাঁয় মেরা দিল’; কিন্তু রিলিজ হয়নি আজও। এইখানে বসে বাবা গানটা খালি গলায় গাইছেন। মান্না দে সেটা শুনতে-শুনতে এই হারমোনিয়ামে তুলে নিচ্ছেন। কত স্মৃতি! লতা বাঈ, আশা বাঈ, বিলায়েৎ খাঁ সাহেব, সত্যজিৎ রায়, শচীন কর্তা, কে না এসেছেন এই বাড়িতে!’
সেই বাড়িতে একটা রাত থেকেছিলাম আমি। ঘুমাতে পারিনি। বহু বছর চুপ করে থাকা পিয়ানোটা বেজে উঠল কি হঠাৎ! রাজ কাপুর একটা জোকারের পুতুল নিয়ে অভিনয় করেছিলেন ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমায়। সেই পুতুলটি রাজ কাপুর কিশোরকুমারকে উপহার দিয়েছিলেন। সাজানো রয়েছে টেবিলে। সেটা নড়ে উঠল বলে মনে হল কেন আমার? ভয় নয়, আনন্দে-উত্তেজনায় ঘুমাতে পারিনি। কিশোরকুমার নেই, কিন্তু তিনি কী ভীষণভাবে আছেন এই বাড়িতেই! আমাকে একদিন কবি জয় গোস্বামী বলেছিলেন, ‘ভাবো তো, একজন মানুষ ১৯৮৭ সালের পর একটা গানও আর রেকর্ড করেননি। একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি কোনওদিন তার পর থেকে। অথচ এই ভয়ংকর দীর্ঘ নীরবতা তাঁকে মুছে ফেলতে পারেনি। একটি নতুন গান না গেয়েও তিনি গেয়ে চলেছেন প্রতিদিন।’


৩
‘সুহানা গীত’ নামে একটা সিনেমা শুরু করেছিলেন কিশোর। লীনাজি নায়িকা। সেই সিনেমার জন্য তেরোটা গান রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু সিনেমা শেষপর্যন্ত শেষ হয়নি। গানগুলোর অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। সেই গানগুলোর কয়েকটা শুনেছিলাম অমিতদার গলায় আর কিছু অংশ কিশোরকুমারের প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া স্পুল থেকে, ওই বাড়িতে বসেই। এছাড়া আরও কত যে ‘কিশোর প্রোডাকশন’-এর অপ্রকাশিত গান! ‘ব্যান্ড মাস্টার বামচিক’, ‘যমুনা কি তীর’, ‘প্যায়ার আজনাবি হ্যায়’ এরকম বেশ কয়েকটি সিনেমার জন্য গান রেকর্ড হলেও সিনেমাগুলো হয়নি। শেষোক্ত সিনেমায় একটি অসাধারণ গান ছিল, ‘হমারি জিদ হ্যায় কে দিওয়ানগি না ছোড়েংগে’। বাংলায় কিশোরকুমারের সুরারোপিত ‘আমার দীপ নেভানো রাত’-এর ধাঁচে তৈরি। রাগ পুরিয়া ধানেশ্রী। একটা ব্যাপার খুবই আশ্চর্যের যে, কিশোরকুমারের সুর করা অধিকাংশ গানের কাঠামোই রাগ-রাগিনীনির্ভর। ‘বেকারার দিল আরে তু গায়ে যা’, ‘আমার মনের এই ময়ূর মহলে’, ‘নয়ন সরসী কেন’— এরকম একের পর এক উদাহরণ দেওয়া যায়।
অমিতদা বললেন, ‘সলিল চৌধুরীর হারমোনিয়াম, বাবা নিয়ে এসেছিলেন। মান্নাবাবু এলে এই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন। বাংলায় একটা গান ছিল ‘চলো যাই চলে যাই দূর বহুদূর, গায়ে মেখে জড়ি বোনা সোনা রোদ্দুর’; এর হিন্দিটা কিশোরকুমারের সঙ্গে মান্না দে-ও গেয়েছিলেন।
প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া কীভাবে রাগনির্ভর সুর দিচ্ছেন কিশোর? এই প্রশ্ন করেছিলাম স্বয়ং আশা ভোঁসলেকে। আশাজি বলেছিলেন, ‘আসলে সুরের সঙ্গে কিশোরদার একটা নিজস্ব বোঝাপড়া ছিল। মাঝে-মাঝে গৌরীকুঞ্জে আসতেন বিলায়েৎ খাঁ সাহেব, আলি আকবর খাঁ সাহেবের মতো সংগীতজ্ঞরা। ওঁদের বাজনা শুনে শিশুর মতো কাঁদতেন কিশোর। রাগ না জানলেও, মূল সুরটা মনে থেকে যেত। কিশোরকুমার কী করে কী পারেন, এর ব্যাখ্যা করতে যাওয়াই উচিত হবে না আমাদের।’ এই একই প্রশ্ন আমি করেছিলাম মান্না দে-কেও। মান্না দে বললেন, ‘আশা, রফি, আমি, এমনকী লতাকে নিয়ে পর্যন্ত আলোচনা করা যায় যুক্তিটুক্তি দিয়ে, কিন্তু কিশোর এইসব যুক্তিতর্কর বাইরে। যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকে-টাকে, তবে তিনি আমাদের সবার মাথায় একবার হাত রেখেছেন বলে আমরা গানবাজনাটা করি। কিন্তু ব্যাপার হল, তিনি কিশোরের মাথায় দু’বার হাত রেখেছেন, যা খুশি করতে পারত ও।’

অমিতকুমার আমাকে একটা মূল্যবান চিঠি দেখিয়েছিলেন সেবার। কার চিঠি? কিশোরকুমারকে লিখেছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গ কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান। কণিকা লিখছেন, ‘Just to listen to these songs is a motivation to live longer.’ কিশোরকুমারও চেয়েছিলেন আর একটা অন্তত রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করে রেখে যাবেন। ঠিক হয়ে গিয়েছিল সেই রেকর্ডের সমস্ত গানে পিয়ানো বাজাবেন সত্যজিৎ রায়; যেরকম বাজিয়েছিলেন ‘চারুলতা’য় ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানে। এই গানটিরও একটা অন্য ভার্সন আমাকে শুনিয়েছিলেন কমল ঘোষ। কমলবাবু ছিলেন মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার। কিশোর এইচ এম ভি-র বাইরে একমাত্র কমল ঘোষের কোম্পানি থেকে রেকর্ড করেছিলেন, কারণ কমল ঘোষকে খুব পছন্দ করতেন কিশোর। দু’জনের দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনি’ সত্যজিৎ রায় রেকর্ড করেছিলেন বম্বে গিয়ে। কিন্তু সত্যজিৎ কলকাতা ফেরার পর থেকে কিশোরকুমারের মনে হতে থাকে যে, গানটা যতটা ভাল গাওয়া যেত তিনি তত ভাল সম্ভবত গাইতে পারেননি। তখন তিনি সেই গান আবার রেকর্ড করে কলকাতা পাঠান। সত্যজিৎ অবশ্য প্রথম রেকর্ডিংটিই সিনেমায় রাখেন।

প্যায়ারেলাল থেকে বাপ্পি লাহিড়ী কিংবা রবীন্দ্র জৈন— যেসব সুরকার কিশোরকুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই কিছু-না-কিছু এমন গান রয়ে গেছে কিশোরের, যেগুলো আনরিলিজড। তেমনই একটা গান শুনিয়েছিলেন আমাকে রবীন্দ্র জৈন, তাঁর সুরে। ‘মন বানজারা রে ও মন বানজারা’। রবীন্দ্র জৈন বললেন, ‘যিনি প্রোডিউসার ছিলেন, খুব উৎসাহ নিয়ে সিনেমার কাজ শুরু তো করেছিলেন। দুটো গানও রেকর্ড করিয়েছিলেন কিন্তু আর শ্যুটিং শুরু করতে পারেননি।’
৪
কিশোরকুমার— এই একটা নাম, একটা মন্ত্রের জোরে বম্বেতে আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম লতা মঙ্গেশকর থেকে অমিতাভ বচ্চন সবার কাছে। কুমার শানু, শান, অভিজিৎ, বাবুল সুপ্রিয়, অনুপ জলোটা, সুদেশ ভোঁসলে, জলি মুখার্জি, অলকা ইয়াগনিক, মধুশ্রী, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি— আমাকে ফিরিয়ে দেননি কেউই। কিশোরকুমারকে নিয়ে কথা বলতে-বলতে রাত ভোর হয়ে গেছে আমাদের। কিশোর-বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস নেরুরকর কিশোরের গান সংক্রান্ত একটা বিরাট ভল্যুমের বই লিখেছিলেন। তাঁর কাছে প্রথম জানতে পারি, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের সুরে কিশোরকুমার দুটো গান গেয়েছিলেন যা বহুল প্রচলিত নয়। তিনিই আমাকে শোনান বিশিষ্ট বংশীবাদক পান্নালাল ঘোষের সুরে, বিশিষ্ট তারসানাইবাদক দক্ষিণারঞ্জন ঠাকুরের সুরে কিশোরকুমারের না-শোনা সব গান। তবে এখনও কিশোরকুমারের সব থেকে বেশি অপ্রকাশিত গান রয়ে গেছে রাহুল দেব বর্মণের সুরেই। সেই আনরিলিজড গানের সংখ্যা প্রায় নব্বইটির মতো। মাত্র কিছুদিন আগে এই নব্বইটি গানের মধ্যে থেকে একটা গান রিলিজড হল। গুলজারের লেখা, রাহুল দেব বর্মণের সুরে সেই গানের কথা ‘মুঝকো ইউ হি উদাস রহে নে দো।’ এইসব অপ্রচলিত এবং অপ্রকাশিত গানের কয়েকটি ইদানীং পাওয়া যায়। যেমন পাওয়া যায় ‘শোলে’র একটি কাওয়ালি। কিশোর, মান্না এবং আরও অনেক সহশিল্পীর সঙ্গে গাওয়া সেই গান রেকর্ড হলেও ‘শোলে’ সিনেমাটি এত দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল যে সেই গানটি আর সিনেমায় রাখা সম্ভব হয়নি। ‘চাঁদ সা কই চেহেরা না পহেলু মে হো’ গানটির আনকাট ভার্সন আমাকে ওই সময় শুনিয়েছিলেন মুম্বইয়ের এক ‘গানচোর’। যেখানে রাহুল দেব বর্মণ গান শুরুর আগে কিশোরকুমার আর মান্না দে-কে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তোমরা রেডি? টেক-এ যাব?’ উত্তরে কিশোর বলছেন, ‘তুমি টেকে যাও, আমি কেটে যাই। মান্নাদা একা গান করুক।’ তারপর হাসাহাসির শব্দ।
৫
এই লেখা বম্বের সেই ‘গানচোর’কে দিয়েই শেষ করি। কারণ ‘চোর’ শব্দটা এখানে সম্মানসূচক। বড় আদরের। এঁরা কেউই খুব যে আর্থিকভাবে সচ্ছল, তেমন কিন্তু নয়। কিশোরকুমারের একটা না পাওয়া গান পাওয়ার জন্য এঁদের যে পাগলামি আমি দেখেছি, তা তুলনাহীন। বম্বের সেই ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন কলমিস্ত্রি, কিন্তু গান সংগ্রহের জন্য টাকা খরচ করতে কখনও কার্পণ্য করেননি। প্রতি বছর ৪ অগাস্ট আর এই ১৩ অক্টোবর বাড়িতে প্যান্ডেল হয় তাঁর। প্রায় শ’দুয়েক লোককে পোলাও খাওয়ান তিনি। কারণ একটা তাঁর প্রিয় শিল্পীর জন্মদিন, অন্যটা মৃত্যুর। এরকম মানুষ আমি কলকাতা, হাওড়া, আরও অনেক জায়গায় দেখেছি। এঁরা ছিলেন, আছেন বলেই তো কিশোরকুমার ‘১৯৮৭ সালের পর একটা গানও আর রেকর্ড করেননি। একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি কোনওদিন তার পর থেকে। অথচ এই ভয়ংকর দীর্ঘ নীরবতা তাঁকে মুছে ফেলতে পারেনি। একটি নতুন গান না গেয়েও তিনি গেয়ে চলেছেন প্রতিদিন…’