রাষ্ট্রদ্রোহী?

Sonam Wangchuk

সোনম ওয়াংচুক একজন ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট। অর্থ হয়, এই গ্রহের কথা ভেবে যে উদ্বিগ্ন! প্রথমেই বলা প্রয়োজন, এহেন অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে রাষ্ট্র কী আচরণ করে। সুমুদ ফ্লোটিলা জাহাজ থেকে ইজরায়েলি নৌসেনার হাতে যখন গ্রেপ্তার হলেন গ্রেটা থুনবার্গ— বাইশ বছর— ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার— হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা; চোখ বেঁধে দেওয়া হল। হাতকড়া। পিছমোড়া করে বেঁধে। আশরীর ঢেকেছে ইজরায়েলি পতাকায়। এরপর সে মানুষ থাকে না আর। সভ্যতার সামনে সাজিয়ে রাখা এক জড়, একজন নিস্পন্দ। একটা ট্রফি। যেমন, সোনম ওয়াংচুক যোধপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। তফাৎ আছে কি আদৌ?

বলিউড আমাদের প্রথম চিনিয়েছিল, কে সোনম ওয়াংচুক! রাজকুমার হিরানির ছবি ‘থ্রি ইডিয়েটস’ নিশ্চয়ই মনে আছে? সেই যে আমাদের ব়্যাঞ্চো। ফুকসুক ওয়াংড়ু। হইহল্লায় আলুথালু একটা জীবন! ড্রোন নিয়ে ছেলেখেলা করছে। বলছে, অল ইজ ওয়েল। প্রশ্ন করছে, পেনসিল কেন ব্যবহার করা হল না স্পেসে? কেন ফাউন্টেন পেন? এমনতর প্রশ্নে রাষ্ট্র হাততালি দেয় প্রবল। যতখানি আঁচড় কাটে মেধায়, ততখানি গভীরে পৌঁছয় না একটা সময়গ্রন্থির। তাই বলিউডের জাদুকাঠিতে, ক্রমে ক্রমে আমাদের, যারা সেইসব দিনগুলোয় বারো থেকে আঠেরো— প্রায় সকলের হিরো ব়্যাঞ্চো। বেহেতি হাওয়া, তবু এখন মনে হয় বাঁধাগত। রাষ্ট্রের ব্যকরণ মেনে চলেছে। বোধ করি সে কারণেই, রাজু রাস্তোগি যখন আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুশয্যায়, অচেতন, তখন আমাদের হিরো, এক আদর্শ বন্ধু হিসেবে স্ব-কর্তব্য পালন করছিল। মরিয়া হয়ে যাচ্ছে, রাজু যেন কথা বলে একবার! অথচ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্নও সে রাখে না। আমাদের গড়পড়তা চেতনায় হিরোর ধারণা এটুকুই। তাই ‘থ্রি ইডিয়টস’ ব্লকবাস্টার। সোনম ওয়াংচুক যুগ যুগ জিও।

আরও পড়ুন : তুমুল অর্থাভাবেও ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র স্বত্ব বিক্রি করতে চাননি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়!
লিখছেন আশিস পাঠক…

সে-ছবি মুক্তির প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে। আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? লাদাখের নির্জন কোনও পাহাড়ের কোলে, কাঁচা রোদের আলো মেখে,অমানুষিক শীতে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তামাটে মুখ, খারদুংলা পাস— সোনম ওয়াংচুক অনশন করছেন। ২১ দিন। ‘ক্লাইমেট ফাস্ট’। আমাদের ছোটবেলার হিরো, ন্যাশনাল হিরো, জলবায়ুর জন্য অনশনে বসেছেন!

নিউজফিডে দু’-একটি রিল ভেসে ওঠে। শুনি লেহ, লাদাখ এবং পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের পাহাড়, বনভূমি কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দিচ্ছে ভারত সরকার। প্রকৃতির কোল, পাহাড়ি ঝরনা অথবা নৈসর্গিক সুন্দর বলে কিছু হয় না। একবিংশ শতাব্দীতে ভোগবাদ একমাত্র সত্য। সোনম ওয়াংচুক বলেন, লাদাখে গণতন্ত্র নেই। এভাবেই লাদাখ একদিন মরে যাবে। সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলে অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রয়োজন। এখনই।

অদ্যাবধি আপনি ক্লাইমেট চেঞ্জ বলতে ভেবেছেন, দুর্গাপুজোর চারদিন মুষলধারে বৃষ্টি। ভেবেছেন, উত্তরবঙ্গ আসলে পৃথক একটি রাজ্য। অথবা, লাদাখে কয়লাখনি হবে তো আমার কী? এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আরও একটি মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, এ-মাটি আমার, বেচতে দেব কেন?

এইবার সোনম ওয়াংচুক রাষ্ট্রের চৌখুপি ভেঙে ফেলছেন। লাদাখ থেকে ‘দিল্লি চলো পদযাত্রা’ ভেস্তে দিচ্ছে পুলিশ। তারপর সোনম ওয়াংচুক গ্রেপ্তার। সমগ্র দেশের সামনে, পলকে-পলকে বদলে যাচ্ছে হিরোর যাবতীয় খোলনলচে। মনে পড়ছে, ২০১৯ সাল। অমিত শাহ ঘোষণা করলেন, জম্মু এবং কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত। লাদাখও পরিণত হল একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। অথচ থাকবে না কোনওরূপ বিধানসভা। সোনম ওয়াংচুক লিখছেন, থ্যাঙ্ক ইউ প্রাইম মিনিস্টার। ততক্ষণ সে সুন্দর। ততক্ষণ সে মেধা আর জ্ঞানের কান্ডারী। এখন? এই মুহূর্তে? সে একজন ভিলেন। বিশ্বাসঘাতক। দেশদ্রোহী।

তবু আমাদের ফিরতেই হবে একজন ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্টের উদার চিন্তনে। যে কোনও প্রথম বিশ্বের দেশে, নিশ্চিন্তে ও নির্ঝঞ্জাটে, আপন গবেষণায় মগ্ন থাকতে পারতেন সোনম ওয়াংচুক। তবু আঁকড়ে রইলেন নিজের মাটি। নিজের পাহাড়। নিজের আকাশটুকু। হিরোর মতো। এই আদিম অধিকারবোধ, ভয় দেখায় প্রতিনিয়ত। পুঁজিবাদ। রাষ্ট্র। উভয়কেই। যেমন গ্রেটা থুনবার্গের শাণিত দৃষ্টি! যেমন কার্ল মার্কসের লেখায় পেয়েছিলাম, প্রকৃতি দখলের হিংসাত্মক খেলার চক্করে, কেমন বেমালুম ভুলে গিয়েছি, আমরা সকলেই প্রকৃতিজাত। এই পরিবেশ, আসলে মানুষের দুই হাতের মতো। তা এত চমৎকার কথা লিখলেও, সবশেষে পড়ে থাকে একটা ভয়েডনেস। সেই ভয়েডনেস থেকেই আসলে হিরো জন্ম নেয়। সেই ভয়েডনেসের ভেতরে দাঁড়িয়ে সে যখন বলে, এ-গ্রহ বসবাসের উপযুক্ত নেই, দায়ী করে রাষ্ট্রনেতাদের, তখনই সে ভিলেন। কারাগারে বন্দি। আমি দেখি, যমুনা নদীর জলস্তর বেড়ে যায় হু হু। হু হু করে ধ্বস নামে দার্জিলিং-এর রাস্তায়। উত্তরকাশীতে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে হারিয়ে যায় কতশত ঘরের মানুষ।

রাষ্ট্রনির্মিত যে ন্যারেটিভ, সেখানে সোনম ওয়াংচুক ভারত সরকার উৎখাতে উদ্যত। উদগ্র। কিন্তু তিনি যে নিরন্তর আস্থা রেখেছিলেন বিজেপি সরকারের প্রতি! সময়ে বলেছিলেন, চিনা দ্রব্য বর্জনের কথা। অসময়ে বিজেপি-শাসিত বেশ কয়েকটি রাজ্যের শিক্ষা উপদেষ্টা পদেও আসীন ছিলেন। অর্থাৎ কিনা, রাষ্ট্রের চোখে সুবোধ। রাষ্ট্রকে চটায় না কখনওই। আমরণ অনশনে বসেও যিনি বলছেন, ভালবাসাই একমাত্র ভাষা! সরকার এবং ভারতের প্রতিটি মানুষ—উভয়ের কাছেই সবিনয় বলতে চেয়েছেন, লাদাখবাসীর দাবি ও প্রত্যাশা। কেন ৩৮৮ একর বনাঞ্চল ধ্বংস করা লাদাখের পক্ষে সর্বনাশা, বহু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তা-ও। এত স্থিতধী একজন মানুষ, নৈরাজ্যবাদী হয়ে উঠলেন বেমক্কা? এ কেমন ডাবল ট্রুথের দুনিয়া? যেন সোনম ওয়াংচুক শুধু লাদাখের হিরো। অবশিষ্ট ভারতে, সে ভিলেন। একই শরীরে। তবে কি সরকারই আখেরে বলতে চাইছে, লাদাখ পৃথক কোনও স্থান? এই দেশ, এই জলবায়ু, এই গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগহীন? রাষ্ট্র বলে, অল ইজ ওয়েল! যেহেতু রাষ্ট্রই হিরো। ঈশ্বর। অথবা ঈশ্বরের বরপুত্র। আপনিও বলুন! অল ইজ ওয়েল?