হবে তা প্রায় বারো-তেরো বছর, বড়ো খারাপ সময়টা যাচ্ছে কাল্লা ভিলের। শিকার আর পশুপালন— এই মাত্র তাদের বংশগত জীবিকা, কৃষিকাজ তেমন জানেই না। শিকার থেকে আসে আহার্য, আর পশুপালন থেকে আসে বস্ত্র ও বাসস্থান। যদিও বস্ত্র বা বাসস্থান নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি রকমের চাহিদা নেই ওদের, কেননা সামান্য পরিধেয়েই আবৃত থাকে ভিলদের পাথরসম শরীর আর বসতি অরণ্যে পাতার কুটিরে বা পাহাড়ের গুহায়, তবু স্বাচ্ছন্দ্যের একটা ব্যাপার তো আছেই! আজ আট-দশ বছর কুঠিয়া ছাইতে পারেনি, বস্ত্রাদিও ছিন্নভিন্ন; হাটে গিয়ে নতুন কাপড় কেনারও সামর্থ্য নেই। এ অবস্থা শুধু তার একারই নয়, মেবার রাজ্যের সমস্ত ভিল প্রজার। যখন তখন যুদ্ধবিবাদ লেগেই আছে রাজায়-রাজায়, তার উপর আবার যেখানে-সেখানে বনভূমি ধ্বংস করে টিলাপাহাড় সমান করে কেল্লা আর দুর্গ বানানোর ঢং লেগেই রয়েছে। বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে, তাই শিকারের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে প্রতিদিন। অন্যদিকে যেসব জমিতে পশুচারণ করত কাল্লারা, সেসব জমিতে বেঁধে যাচ্ছে যুদ্ধ। মাসের পর মাস যুদ্ধ। যুদ্ধ বাঁধলে একটাই শুধু লাভ কাল্লাদের, সৈন্যবাহিনীকে ঘোড়া বা হাতি জোগান দিয়ে দু-পয়সা উপার্জনের সুযোগ। কিন্তু জংলি ঘোড়া বা হাতি ধরে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তবেই না সেসব বেচবার সুযোগ আসবে? তা এ রাজ্যে বনভূমিই তো চলে যেতে বসেছে রাজপুতদের উৎপাতে। জংলি জানোয়ার সমস্ত পালিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত পেরিয়ে। কী যে একটা কঠিন সময় এল!
আরও পড়ুন: সুমন সরকারের গল্প ‘ভ্রমর সেনের সন্দেহ’
কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়! উলুখাগড়া নাই হোক, ভিলদের যে প্রাণ যায়ই, তাতে সন্দেহ নেই। শেষ কবে যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল কাল্লা, তা এখন আর ঠিকঠাক মনেই করতে পারে না। বোধ হয়, মহারাণা সংগ্রামসিংহের আমলে। রাণা সঙ্গের অবসান থেকেই একের-পর-এক সব বুজুমভোম্বল রাজা; একেকজনের শাসনকাল অল্পস্বল্প ক-টা করে বছরের, বাচ্চা হাতির কানের মতন অতি চঞ্চল টলমল একেকজনের আমল। রাজা আসে, রাজা যায়। এই রাণা রতন সিং রাজা হল তো এই রাণা রতন সিং-এর গদি চলে গেল। রতন সিং গেলেন তো বিক্রম সিং এলেন। সেই বিক্রম সিং-কে মেরে কেটে গদিতে বসেছে এখন বনবীর সিং। অরাজকতা আর কাকে বলে? রাজ্যশাসনে মন নেই; খালি মদ, গানাবাজানা আর মেয়েমানুষের নেশা। কুমার পৃথ্বীরাজের অসংযমের ফসল এই বনবীর, তাঁরই রক্ষিতার কুপুত্তুর। খালি বিক্রম সিং-কে মেরেই ওর শান্তি হয়নি। আগে শোনা যাচ্ছিল, রাণা সংগ্রামের শিশুপুত্র উদয়কেও নাকি হত্যা করেছিল বনবীর বিক্রম সিং-এরই সঙ্গে। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, আগের খবর ভুল, উদয়সিংহ নাকি দিব্বি বেঁচেবর্তে আছেন। শুধু বেঁচেবর্তে আছেনই নয়, মাসখানেক আগে জানতে পেরেছে কাল্লা, আশেপাশের বেশ ক’জন সর্দার সঙ্গে জুটিয়ে উদয়সিংহ মাহোলি আক্রমণ করে নাকি তার দখল নিয়ে নিয়েছেন। এখন আসতেছেন তিনি টানা-র দিকে। টানা আর মাহোলি বনবীরের পক্ষপাতী কি না, কাজে-কাজেই উদয়সিংহের বিরোধী। কাল্লা ভিল সেই কোন ছোট্টোবেলায় শুনেছিল তার বাপের কাছে, বনের সাপটাকে মারতে হলে আগে তার দুটো বিষদাঁত ভাঙতে হয়!
এদের এই সব রাজাগজাদের খবর কানে এসে ঢুকলেও ওসবে তেমন আগ্রহ বোধ করে না কাল্লা। সমস্যা এই যে, আগ্রহ বোধ না করলেও না শুনে কি তার উপায় আছে? তাদের ভিলেদের সমাজ আর রাজপুতদের সমাজ আলাদা হলেও একান্ত বিচ্ছিন্ন নয়। ভিলেরা থাকে বনে পাহাড়ে, রাজপুতদের কেল্লা থেকে বহু দূরে স্বতন্ত্র তল্লাটে। ভিলেদের আলাদা সর্দার আছে, নিজস্ব প্রথাপদ্ধতি, ধ্যানধারণা, নিয়মটিয়ম আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কোন মান্ধাতার আমল থেকে ভিলেরা জড়িয়ে গেছে রাজপুতদের সঙ্গে। সেসব কোন আদ্যিকালের রাজা শিলাদিত্য, রাজা গোহ— সেই তেনাদের সময় থেকেই ভিলেরা জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে রাজপুতদের ঝামেলায়— ওসব গল্প কম কিছু তো শোনেনি কাল্লা তার দাদা, ঠাকমার মুখে। ভিলেদের সঙ্গে বাপ্পা রাওলের ভাব-ভালবাসা ওঠাবসা থাকলে কী হবে, তেনার বাপ নাগাদিত্যের ভীষণ অত্যাচারটাও কিন্তু মুখ বুজে সইতে হয়েছিল ভিল প্রজাদের। যখনই যুদ্ধ বাঁধে, তখনই ভিলদের প্রতি রাজপুতদের পিরিত একেবারে উছলে ওঠে। কেননা ভিলেরা যুদ্ধের যে-সব কেরামতি জানে, কোনো রাজপুত তার আদ্ধেকের আদ্ধেকও জানে না। এদিকে এই সব খুচখাচ যুদ্ধের প্রভাবে হাটবাজার যে আগুন-গরম, তার কী নিদান? একদিকে বনভূমির অভাবে উপার্জন যাচ্ছে কমে, অন্যদিকে জিনিসপত্তরের দাম জহরের জ্বালার মতো— না, না, না, কাল্লা আর এ অবস্থা কিছুতেই সামলাতে পারছে না।
এসব কথাই ভাবতে-ভাবতে, মনে-মনে গজর-গজর করতে করতে কাল্লা ফিরছিল আজ হাট থেকে বৈকালবেলায়। সারাটা দিন কুটোটি পর্যন্ত দাঁতে কাটেনি। দুটো খরগোশ আর একটা বেজি নিয়ে সে গেছল আজ হাটে। সারাদিন মাছি তাড়িয়ে একেবারে শেষ বেলায় এক বুড়ি রাজপুতানিকে পাতিয়ে-তুতিয়ে জানোয়ারগুলো কোনোমতে নামমাত্র মূল্যে বেচতে পেরেছে। মানুষের পেটে যখন টান পড়ে তখন এসব শখের জানোয়ার পুষবার সাধ হয় কি? যা অর্থ পেয়েছে, ও দিয়ে তিনদিনও কাল্লার চলবে কি না, কে জানে! মুদ্রা ক-টা কোচড়ের কাপড়ে বেঁধে ঘরে ফিরছে সে, মেজাজ হয়ে রয়েছে সেই পরিমাণেই খাট্টা। আসতে-আসতে বেলা পড়ে গেল, বিকেল গড়িয়ে সাঁঝ লেগে যাবে এবার। এখান থেকে আরও পাঁচ কোশ গেলে তবে কাল্লাদের গাঁ। আরও কিছুক্ষণ হাঁটবার পর একটা ঘন বনভূমি পড়ল। আসতে-আসতে রাত হয়ে গেল। গাঁ এখনও কোশ দেড়েকের মামলা। মনে-মনে বলল কাল্লা, ‘দূর দূর, আজকে আর ফিরবই না গাঁয়ে আমি।’ আন্ধারে না চলছে চোখ, পথশ্রমে না চলছে দু’খানা পা। এই বনেই রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে গাঁয়ে ফিরবে মনস্থ করে কাল্লা একটা পাতাঢাকা বড়ো গাছে চড়ে বসল। গামছা দিয়ে গাছের একটা মোটা ডালের সঙ্গে নিজেকে কষে বেঁধে ঘুমোনোর চেষ্টা দেখতে লাগল কাল্লা ভিল।
ভিলেদের পক্ষে এমন আচরণ মোটেই অস্বাভাবিক নয়; অরণ্যই তাদের ঘর, তাদের সুখশয্যা, তাদের মা-বাপ সব কিছু। এমন কত রাত কাল্লা জঙ্গলের গাছে চড়ে কাটিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে কাজল-কালো অন্ধকার, তার মধ্যে সবুজাভ জোনাকিদের দপদপানি আর অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির ডাক। কাল্লা চোখ বুজে ভাবছিল তার বউয়ের কথা। কষ্ট করে হেঁটে গেলেই সে বউটাকে আজ রাতে পেত। কিন্তু এখন সেই সত্যিকারের রক্তমাংসের বউটাকে পাওয়ার চেয়ে মনে মনে বউটার কথা ভাবতেই তার বেশি ভাল লাগছে। বিচিত্র বিরোধাভাসে পরিপূর্ণ মানুষের মন!
মনে-মনে বউকে আদরসোহাগ করতে-করতে কখন যেন সরল শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল কাল্লা। হঠাৎ কাদের কথাবার্তার শব্দে ঘুম চটে গেল। তারই সঙ্গে কাঠকুটো পোড়ার কট্-কট্ শব্দ। ব্যাপারখানা কী?
নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল কাল্লা। গাছের নীচে আগুন জ্বলছে। আর আগুনের এপাশে-ওপাশে বসে আছে দুটো লোক। চোর-ডাকাত নয় তো?
কিন্তু কান পেতে তাদের কথাবার্তা শুনে সে-ভুল ভাঙল। চোরছ্যাঁচোড় নয়। এরা যদ্দূর সম্ভব, রাজপুত মজুর। টানা থেকে আসছে। ঘরে ফেরার পথ এখনও বহু দূর বিস্তৃত, তাই আপাতত এ-রাতটা ওরা কাল্লার মতন জঙ্গলেই কাটানোর মতলব করেছে।
কান খাড়া করে কথাগুলো শুনতে লাগল কাল্লা। প্রথমজন বলে উঠল, ‘ওরে ভাই কেতু! সাতদিন ধরে গাধার মতো খাটিয়ে নিয়ে শেষে কি না এইটুকুনি মজুরি? সে-কথা খন্দকার সর্দারকে বলতেই আমাকে একেবারে দূদ্দুর করে তাড়িয়ে দিলে?’
কেতু-নামের লোকটা লম্বা দু’খানা ভুট্টা মনোযোগ সহকারে আগুনে ঝলসাচ্ছিল। আগুনের দিকেই চোখ রেখে সে শুধু বলল, ‘কী করবি বল? ছোটো মন! রাজাগজা বড়লোক হলেই কি আর মনটা বড়ো হয় রে, ইষু? একবারও চিন্তা করল না ব্যাটারা, আমরা হঠাৎ গিয়ে টানায় হাজির না হলে, ওই সুড়ঙ্গ কাটতে ওদের তিন মাস লেগে যেত, হ্যাঁ!’
প্রথম লোকটি অর্থাৎ ইষু সেই কথায় সায় দিয়ে আগুনের কাছাকাছি সরে এসে বলল, ‘যা বলেছিস, ভাই! ওই পাকশালার উনুনের পেছনে পাথরের গাদ উলটে মাটি খুঁড়ে অত বড়ো সুড়ঙ্গ বের করা কোনো বাগাডুম সেপাইয়েরও কম্মো ছিল না। এ বিদ্যে আমাদের বাপ-পিতেমোর বিদ্যে, তাই জলদি জলদি হল। তবে মজুরি যা দিল, তাতে ঘরে ফিরতে ফিরতেই সব ফুরুৎ!’
ঝলসানো ভুট্টা-দুটোর গায়ে সৈন্ধব লবণ আর পাহাড়ি নেবু ঘষতে-ঘষতে বিরস স্বরে বলল কেতু, ‘এখন আর ওসব ভেবে কী হবে? এখন এই ভুট্টা পুড়িয়েছি, খা। আর আগুনের ধারে পেটে কিল মেরে শুয়ে থাক। কপাল!’
‘জন্তু-জানোয়ার নেই তো রে?’ ভুট্টাপোড়া খেতে-খেতে চোখ গোল-গোল করে প্রশ্ন করল ইষু-নামের লোকটি।
‘জানোয়ার? আছে না কি আর জানোয়ার তোর এ-তল্লাটে? শুনছিস না, জানোয়ারগুলো সীমানা পেরিয়ে পালাচ্ছে রোজ? আর কিছুদিন পরেই টানা-রাজ্য জানোয়ারশূন্য হল বলে, দেখে নিস!… তবে আমি ভাবছি অন্য একটা কথা!’ কেতুর গলার স্বর এবার বেশ নীচের গ্রামে নেমে এল।
খাওয়া থেমে গেল ইষুর। চোখ সরু-সরু করে কেতুর দিকে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল।
সেই অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসারই যেন উত্তর দিল কেতু। বলল, ‘আমি ভাবছি, হঠাৎ করে দুর্গের পাকশালা থেকে পশ্চিমদিকে যাওয়ার সুড়ঙ্গ বানানোর মতলবটাই বা কেন রে?’
কীর্ণ চক্ষু প্রসারিত হল ইষুর। হাসতে-হাসতে বলে উঠল, ‘এটা আর বুঝতে পারিসনি তুই? এ তো একদম সোজা মামলা। টানার কিলেদার শঙ্খালা মালোজি বেজায় ভয় পেয়ে গেছে। হেঃ!’ কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই ভুট্টার দানার উপর কামড় দিতে লাগল ইষু।
এতক্ষণে ব্যাপারটা আত্মস্থ করতে পেরে হৃষ্ট হয়ে উঠল কেতু। বলল, ‘ও! তার মানে মাহোলির সর্দার সোলোঙ্কি মেডা যেই না রাণা উদয়সিং-এর হাতে কচুকাটা হয়েছে, অমনি টানা-র সর্দার শঙ্খালা মালোজির কলজেটা ভয়ে একেবারে তুপ্-তুপ্, তুপ্-তুপ্…’ হাতের আঙুলগুলো সঙ্কুচিত-প্রসারিত করে মালোজির ফুসফুসের হ্রাসবৃদ্ধির কম্পন দেখাতে দেখাতে ঠা-ঠা করে হেসে উঠল কেতু।
‘তা ভয় পাবে না রে? মাহোলির সোলাঙ্কি মেডা-কে সাহায্য করতে বনবীরসিং তোমর কানোয়ারসিং-এর মতন ঝানু যুদ্ধবাজকে পাঠিয়েছিল। তা সেই তোমর ব্যাটারও প্রাণ উদয়সিং-এর হাতে ভোমর হয়ে উড়ে গেছে! ভয় পাওয়ারই কথা,’ গম্ভীর স্বরে বলল ইষু। তারপর যোগ করল, ‘ওই জন্যেই টানা-সর্দার শঙ্খালা মালোজি সুড়ঙ্গ কেটে রাখছে আগেভাগেই। পাকশালা থেকে সোজা দুর্গের পশ্চিমদিকে। উদয়সিংহের সেনাবাহিনী এসে টানা দুর্গ সামনে থেকে অবরোধ করলেই পেছনের সুড়ঙ্গ পথ ধরে সুড়ুৎ করে পালাবে শঙ্খালা বাবাজি। বুঝলি?’
‘বুঝলাম, ভাই। এই সব রাজাগজাদের জীবনটাই ভয় দিয়ে ঘেরা। যেমন ভোগ করে, তেমনি ভয় করে। এর থেকে আমাদের এই ভুট্টাপোড়া জীবনই ভাল। খেতে পাই না পাই, এমন ভয়ে-ভয়ে কাল তো কাটাতে হয় না। অনেক হয়েছে, ছাড় তো! চল, ঘুমিয়ে পড়ি। কাল আবার সক্কাল-সক্কাল বেরিয়ে পড়তে হবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই কথাবার্তা থেমে গিয়ে কেতু ও ইষুর বিকট নাসিকাগর্জন শোনা যেতে লাগল।
কিন্তু গাছের উপর বসে ওদের এসব কথা আড়ি পেতে শুনে সারাটা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না কাল্লা ভিল। একেবারে ভোরের দিকে ঘুম এসেছিল কখন যেন। সেই ঘুম যখন ভাঙল, তখন দিনের আলো করমচা ফলের মতো বেশ ভালরকমই ফুটে উঠেছে। আড়মোড়া ভেঙে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল কাল্লা। গাছের নীচে কেউ নেই। শুধু পড়ে আছে কাঠকুটো-পোড়া একগাদা ছাই।
গাছ থেকে নামল কাল্লা সাবধানে। তার কপালে সুগভীর চিন্তার ছাপ। যা করবার, এই বেলাই করতে হবে। কী করতে হবে, সে-কথা সে সারারাত ধরে বেশ ভাল করেই ভেবে রেখেছে। এখন আর ঘরে না-ফিরে সোজা যেতে হবে মাহোলিতে। মহারাণা উদয়সিংহের ছাউনিতে যেভাবেই হোক ঢুকতে হবে তাকে। সুড়ঙ্গের খবরটা মহারাণাকে দিতে পারলে আগামী দশ বছর তাদের আর গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা করতে হবে না। আর বিলম্ব না করে মাহোলির উদ্দেশে পা বাড়াল কাল্লা।
পশুপালক সরল বনবাসী ভিল কাল্লা কখন যে রাজারাজড়ার গুপ্তচরবৃত্তির মতন ক্রূরকর্মে নিয়োজিত হল, সেই কথা সে জানতেও পারল না!
মাহোলি পৌঁছে প্রথমেই সবজি-মাণ্ডিতে গিয়ে ঢুকল কাল্লা। দাতাগণপৎ বাজারের বড় আড়তদার। কাল্লার বাপের সঙ্গে দাতাগণপৎ-এর এক সময় ছিল মাখোমাখো সম্বন্ধ। এতদিন পর কাল্লাকে দেখতে পেয়ে দাতাগণপৎ তো বেজায় খুশি। সবটা মতলব ভেঙে বলল না কাল্লা তবু। শুধু বলল, একটা মোষে টানা গাড়ি চাই। আর চাই, একগাড়ি নানারকম তরিতরকারি। পরে সুদে আসলে সব শোধ দিয়ে দেবে। সেই মোষের গাড়িতে সবজি-ব্যবসায়ীর মতো সেজেগুজে হুর্ হুর্ হ্যাট্-হ্যাট্ করতে-করতে মাহোলিতে রাণা উদয়সিংহের ছাউনির দিকে সত্বর যাত্রা করল কাল্লা ভিল।
বিস্তৃত জায়গা জুড়ে সেনাছাউনি বসেছে। কাছে যেতেই সেপাই-সান্ত্রী কাল্লাকে আগাপাশতালা তল্লাস করেও সন্দেহজনক কিছুই পেল না। নিতান্তই নিরীহ সবজি-ব্যাপারি ভেবে সৈনিকেরা ওকে সেনা-অবরোধের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিল। প্রবল সোল্লাসে মোষের লেজ মুচড়িয়ে হ্যাট্-হ্যাট্ হুর্-হুর্ শব্দে কাল্লা চলে গেল ভেতরে। অস্থায়ী পাকশালার মাতব্বরদের কাছে শাকসবজি বেচে ভালই দু-পয়সা জুটিয়ে যেন সে ফেরার পথ ধরল।
‘যেন’ ফেরার পথ ধরল। সত্যি-সত্যি ফেরা নয়। খানিক দূর গিয়েই মোষদুটোকে গাড়ি থেকে খুলে খড় খেতে দিল। যতক্ষণে মোষদুটো খড় চিবুচ্ছে, ততক্ষণে চুপিসাড়ে এদিক-ওদিক দেখে রাণা উদয়সিংহের তাঁবু খুঁজতে লাগল কাল্লা।
সারি-সারি কানাতের মাঝখানে একটা বেশ বড়োসড়ো রঙচঙে তাঁবু। এটাতেই নিশ্চয়ই রাণা উদয়সিংহ আছেন, ভাবল কাল্লা। যাবে নাকি সাঁ-করে সেঁধিয়ে সে ভিতরবাগে?
এই সব ভাবনাকুটকুটুনিতে কাল্লার মন যখন এপাশ-ওপাশ দুলছে, ঠিক তখনই দু’জন মুশকোগোছের সেপাই এসে কাল্লাকে দু-পাশ থেকে ধরল। কাল্লার গতিবিধি বেশ আপত্তিকর; সৈনিকদের মনে সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক। কাল্লাকে ধরে ওকে মারতে-মারতে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল সৈনিকেরা। যতই মারে, কাল্লা ততই চেঁচায়, ‘আমাকে রাণাজীর কাছে নে চলো, আমাকে রাণাজীর কাছে নে চলো!’
শেষে সেপাইদের সর্দার হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। চল এটাকে মহারাণার তাঁবুতে নিয়ে গিয়ে ফেলি। তবে সাবধান, ভাইসব। ব্যাটার গায়ে অসুরের মতো জোর!’
কাল্লা অবাক হয়ে দেখল, একটা অত্যন্ত সাধারণ তাঁবুর দিকে রাজপুত সৈন্যরা ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে ওই সাদামাটা তাঁবুতেই তখন মহারাণা থাকেন। বড়োসড়ো রঙচঙে তাঁবুটা শুধুই বহিরাগতদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য বানানো হয়েছিল। ওই বড়ো তাঁবুতে কেউই থাকত না।
সৈনিকদের দ্বারা সমানীত কাল্লা ভিল পিঠমোড়া অবস্থায় মহারাণার তাঁবুর ভেতর ঢুকে দেখল, মাঝখানে রাজকীয় আসনে যিনি বসে আছেন, তাঁর বয়েস মাত্তর এই আঠারো-উনিশ হবে। কাল্লার ছেলে এক্কার চেয়ে বছর দু’য়েকের বেশি যদি হয় কোনওমতে। ইনিই কি মহারাণা উদয়সিংহ? আশ্চর্য!
আশেপাশে আরও গোটা পাঁচেক উচ্চাসনে গদিয়ান হয়ে বসে আছে মাঝবয়েসি সব সর্দারেরা। কী ঝলমলে সব পোশাক! ওদের তুলনায় রাণা উদয়সিংহেরই বেশবাস বরং সাদামাটা! সাদামাটা মানে এক্কেবারে সাদামাটা—সর্বশুক্ল। মাথায় শুধু একটা বাসন্তী রঙের পাগড়ি।
একজন সৈনিক মহারাণাকে সামনে ঝুঁকে অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠল, ‘হুকুম! এ লোকটা ছাউনিতে সবজি বেচতে এসে সন্দেহজনকভাবে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল। আমরা ওকে ধরে মারতেই বলতে লেগেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
কী একটু চিন্তা করে নিয়ে উদয়সিংহ বললেন, ‘আপাতত ওর বাঁধন খুলে দেওয়া হোক— না কি?’ এই বলেই তিনি একবার পার্শ্ববর্তী সর্দারদের অনুমোদনের জন্যে যেন চাইলেন।
অন্যরাও সকলে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই হোক, লোকটা তো নিরস্ত্র। দিক, ওর বাঁধন খুলে দিক। ক্ষতি নেই।’
কাল্লার বন্ধনমুক্তির পর একজন বয়স্ক সর্দার গলা তুলে কাল্লাকে বললেন, ‘বলো হে, তোমার কী পরিচয়? হুকুমের কাছে আসতে চাইছিলে কেন?’
এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কাল্লা বলে উঠল, ‘খম্মা গণি, হুকুম! আমার নাম কাল্লা ভিল। আমি টানা দুর্গের থেকে সামান্য দূরে বনপাহাড়ে ভিলটোলায় থাকি। আপনাকে দুটো গুহ্য কথা জানানোর জন্যেই সবজি-ব্যাপারি সেজে আজ এখেনে এসেচি!’
উদয়সিংহ ও অন্যান্য সর্দারেরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে যে যার আসনে সোজা হয়ে বসলেন। রাণাজী বললেন, ‘বেশ। কী বলবে, নির্ভয়ে বলো!’
তখন কাল্লা আনুপূর্বিক কাল রাত থেকে যা দেখেছে, যা শুনেছে, সমস্তই অবিকল নিবেদন করতে লাগল। কথা শেষ করল এই বলে, ‘হুকুম! এ এক্কেবারে পাক্কা খবর। টানা-সর্দার শঙ্খালা মালোজি দুর্গের পাকশালা থেকে পশ্চিমদিকে বেরোনোর জন্যে সুড়ঙ্গপথ বানিয়েছেন। এ কথাটা জানতে পেরে ভাবলাম, আপনাকে এসে বলি, যদি আপনার কোনো কাজে লাগে…!’
একজন সৈনিক মহারাণাকে সামনে ঝুঁকে অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠল, ‘হুকুম! এ লোকটা ছাউনিতে সবজি বেচতে এসে সন্দেহজনকভাবে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল। আমরা ওকে ধরে মারতেই বলতে লেগেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
কাল্লার কথা শেষ হল কি হল না, তার আগেই রাণা উদয়সিংহ ও তাঁর সহচর সর্দারেরা গম্ভীর মুখে এক এক করে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁবুর একদিকে একটা বিস্তৃত সমুচ্চ বেদির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওদিকে এতক্ষণ কাল্লার নজর পড়েনি। এখন সে ওদিকে অবাক হয়ে চেয়ে দেখল, বেদির উপরে রাখা অবিকল টানা-দুর্গের একটা অনুকৃতি—ঠিক যেন মাটির তৈরি নকল খেলনা টানাদুর্গ একটা!
একটা দীর্ঘ লৌহশলাকার ছুঁচালো প্রান্ত দিয়ে সেই খেলনা-দুর্গ বা দুর্গ-নমুনার একটি বিশেষ স্থান দেখিয়ে জনৈক মধ্যবয়স্ক সর্দার চিন্তান্বিত স্বরে বললেন, ‘এই হচ্ছে টানাদুর্গের পশ্চিমদিক। তা এ-জায়গাটি তো বেশ প্রস্তরকঙ্করময়। এখানে সুড়ঙ্গের নিষ্ক্রমণপথ খোদাই করল কীভাবে? অসম্ভব!’
আরেকজন বললেন, ‘যদি সুড়ঙ্গটা আরও দীর্ঘ হয়… অদূরে বনভূমি… যদি বনভূমির মধ্যে গিয়ে সুড়ঙ্গের মুখ খোলে…’
সকলেই চুপ করে নমুনার দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিক চিন্তান্বিত দৃষ্টি মেলে। সহসা নীরবতা ভঙ্গ করে রাণা উদয়সিংহ বলে উঠলেন, ‘দুর্গের এই পশ্চিমদিকে এ-বস্তুটি কী?’
মধ্যবয়স্ক সর্দার বললেন, ‘এটি একটি কূপ। পাথর দিয়ে পাড় বাঁধানো।’
উদয়সিংহ বললেন, ‘তাহলে আমার মনে হয়… এই কূপটার তলদেশেই সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে। অর্থাৎ এই কূপটিই হচ্ছে সুড়ঙ্গ হতে নিষ্ক্রমণের মুখ। আপনার কী মনে হচ্ছে, ইদর-সর্দার?’ কথাটা বলেই তিনি পার্শ্ববর্তী সেই ব্যক্তির দিকে চাইলেন।
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি উত্তর দিলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে সহমত, রাণাজী। এ ছাড়া অন্য নিষ্ক্রমণপথ অসম্ভব। অন্যরা কী বলেন?’
অবশিষ্ট সকলেই রাণাজী ও ইদর-সর্দারের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করলেন। ইদর-সর্দার বললেন, ‘তাহলে এখন কর্তব্য কী, হুকুম?’
কিন্তু তাঁর প্রশ্নের উত্তর তখনই না দিয়ে রাণা উদয়সিংহ বেদির সামনে থেকে সরে এসে নিজের আসনে উপবেশন করলেন। অগত্যা অন্যরাও স্ব-স্ব আসনে ফিরে এলেন।
এতক্ষণ কাল্লা ভিলের উপস্থিতির কথাও যেন এঁরা ভুলে গেছলেন। এখন আসনে ফিরে এসে রাণা উদয়সিংহ কাল্লার দিকে চেয়ে বললেন, ‘আশা করি, তোমার দেওয়া তথ্য নির্ভুল, ভিল! এ তথ্য আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।’
এই পর্যন্ত বলে ডান হাত শূন্যে তুলে বাম করপুট দিয়ে উত্থিত হস্তের করপুটে মৃদু আঘাত করে সাংকেতিক করতালি বাদন করলেন উদয়সিংহ। তখনই জনৈক রাজকর্মচারী তাঁবুতে প্রবেশ করল। অপেক্ষাকৃত অনুচ্চ স্বরে সেই কর্মচারীকে কিছু যেন নির্দেশ দিলেন রাণাজী। তারপর কাল্লার দিকে চেয়ে বললেন, ‘তুমি এর সঙ্গে যাও। পারিতোষিক গ্রহণ কোরো। আর শোনো, আমাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রেখো। তোমার দেওয়া তথ্য যদি নির্ভুল হয়, তাহলে আবার আমি তোমাকে ডেকে নেব।’
তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে অবশ্য কী হবে, সেকথা রাণাজী বললেন না। তবে তা অনুমান করে নিতে বিশেষ অসুবিধা হল না কাল্লার। যাই হোক, সে সকলকে পুনরভিবাদন জানিয়ে রাজকর্মচারীর সঙ্গে তাঁবুর থেকে বেরিয়ে গেল।
এইবার ইদর-সর্দারের পূর্বোত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিলেন রাণা উদয়সিংহ। বললেন, ‘আমরা সৈন্যবাহিনীকে প্রথমে দুই ভাগে ভাগ করব। বড়ো টুকরি আর ছোটো টুকরি। বড়ো টুকরিটি শিরোহি-সর্দারের নেতৃত্বে টানার দিকে অগ্রসর হয়ে দুর্গ ঘিরে বসে থাকুক। দুর্গের পশ্চিমভাগে কূপের চারিপাশে কতিপয় সৈন্য যেন লুক্কায়িত অবস্থায় দিবারাত্রি অবস্থান করে। তবে আমার ধারণা, শঙ্খালা মালোজি পালাবার চেষ্টা করবে মধ্যরাত্রে। সকলেই যেন সজাগ থাকে।’
শিরোহি-সর্দার পাগড়িসুদ্ধু মাথা নেড়ে উদয়সিংহের কথায় সম্মতি-জ্ঞাপন করলেন।
ইদর-সর্দার প্রশ্ন করলেন, ‘আর সৈন্যবাহিনীর ছোট অংশ? তার কাজ কী হবে, তা তো বললেন না!’
উদয়সিংহ বললেন, ‘জনা-পঞ্চাশ সৈন্য হলেই চলবে। এই ছোট টুকরির মধ্যে আমরা বাকিরাও থাকব। ছোট টুকরি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব চিত্তোরদুর্গের দিকে।’
কথাটা শুনে সকলেই হতবাক হয়ে পড়ল। বুন্দি-সর্দার বললেন, ‘এত অল্প লোক নিয়ে চিত্তোরদুর্গ? ওই দুর্গ তো এমনিতেই দুর্ভেদ্য। দুর্গে আমরা এই ক-টা লোক প্রবেশ করব কীভাবে? প্রাকাররক্ষক সৈন্যরা প্রবেশদ্বারেই আমাদের শরাঘাতে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে!’
উদয়সিংহ মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘কেন, কাল্লা ভিল কি আজ আমাদের পথ দেখায়নি? ও যেভাবে আমাদের ছাউনিতে আজ প্রবেশ করেছে, সেভাবেই আমরাও চিত্তোরদুর্গে প্রবেশ করতে পারব। কেউ সন্দেহ করার সুযোগও পাবে না।’
ইদর-সর্দার সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘অর্থাৎ সবজি-ব্যাপারির ছদ্মবেশে?’
উদয়সিংহ কোনো উত্তর দিলেন না। সর্দারদের দিকে চেয়ে কেবল রহস্যময় হাসি হাসতে লাগলেন। উপস্থিত সকলেই বিস্ময়াহত দৃষ্টি মেলে অষ্টাদশবর্ষীয় রাণা উদয়সিংহের দিকে চেয়ে রইল।
…কাল্লা ভিলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাণা উদয়সিংহ কালক্রমে তাঁর অপহৃত সাম্রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তিতে নিবেশিত কাল্লা ভিল এর পর আর কোনওভাবেই তার সেই ফেলে আসা সরল সহজ ভিল-জীবনের অনাবিল সাম্রাজ্যে ফিরে যেতে পারেনি।