সোমনাথদা যখন প্রথম কলাভবনে এলেন (১৯৬৭ সালে), গ্রাফিক্স-এর কাজে একটা অন্য স্তর যুক্ত হল। আমরা ততদিন পর্যন্ত যা গ্রাফিক্স করতাম তা নেহাতই এর অল্প একটা অংশ, কিন্তু সোমনাথদা গ্রাফিক্স-এ নিয়ে এলেন একটা অন্য ভাবনাচিন্তার পরিধি, আরও বিশাল অর্থে আমাদের দেখালেন তার সম্ভাবনা। এবং এর ভিতরে যেসব কারুকাজ, যা উনি নিজে যেটা সম্পূর্ণ করতে পারতেন, ছাত্রদের কাছে সেটাই ইন্ট্রোডিউস করতেন। কখনও ছাত্রদের না নিয়ে কোনও কাজ করতেন না। উনি বলতেন, ‘আমার ভাবনাটা আমি ট্রান্সফার করছি। ওরা যদি এটা নিয়ে এগোতে চায়, ওরা এগোবে’। সৎ কর্মী ছিলেন। কিঙ্করদাকে (রামকিঙ্কর বেজ) ভীষণ মান্য করতেন।
অনেকে বলত সোমনাথদা কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক চেতনা ছাড়াও, উনি খুব স্বাধীনচেতা ছিলেন, এবং শান্তিনিকেতন ওঁকে আরও জানালা খুলে দেয়।
দুই ক্ষেত্রেই উনি চমৎকার। আমাদের শিক্ষকতার জীবনে ইদানীং দেখি প্রায় ক্ষেত্রেই শিক্ষক কিছু করেন না। শুধু বলে যান। সোমনাথদা সেরকম শিক্ষক ছিলেন না, একেবারে হাতেনাতে শিখিয়ে দিতেন। আর কী করে কম খরচে একটা শিল্পকর্মকে দাঁড় করানো যায়, এটা উনি খুব ভাল করে বোঝাতেন। মোমের কাঠির ছাঁচ তৈরি করতেন পেঁপে পাতার ফাঁপা ডালের ভিতর মোম গলিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে। সেই দিয়ে জুড়ে-জুড়ে ছবি তৈরি করে, ঢালাই করে কাজ করতেন। এটা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতেন বলে ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষ ভাবে উপকৃত হত। আমাদের অনেক শিক্ষকের ভিতরে এটা আজ আর নেই। এটা মাস্টারমশাইয়ের (নন্দলাল বসু) ভিতরে ছিল, কিঙ্করদার ভিতরেও ছিল। যাঁরা ভাল শিক্ষক হন, তাঁরা তো ট্রান্সফার করতে চান। এটাই বড় কথা।
আমার সঙ্গে সোমনাথদার প্রথম দেখা এবং আলাপ কলাভবনে। আমার তখন ছাত্রাবস্থা শেষ, আমি এক্সটেনশনে কাজ করছি। সুতরাং শিল্পী হিসেবে আমার প্রভাবিত হওয়ার বয়স চলে গিয়েছিল, কিন্তু সোমনাথদা আমাদের দেখতে শিখিয়েছিলেন। সব থেকে বড় ইন্সপিরেশন ছিল, খুব কথা কম বলতেন, আর কাজে ডুবে থাকতেন। ওঁর মেয়েও (চন্দনা হোর) কাজ করত।
সোমনাথদার কর্ম এবং জীবন আলাদা করা যায় না। খুব সিম্পল থাকতেন, অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাত্রা ছিল। ভাবাই যায় না যে একটা মানুষ এত সহজে থাকতে পারে! এই সহজে থাকার জন্য উনি খালের ধারের গ্রামে একটা মাটির বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেখান থেকে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে কলাভবনে যাতায়াত করতেন। ভিড়ের মধ্যে সবসময় কাজ হয় না। গ্রামের লোকেরাও ওঁকে নিজেদের মনে করত। পাখিরা যেমন সহজে উড়ে বেড়াতে পারে, সেই স্বাধীনতা সোমনাথদা পেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে।
শান্তিনিকেতন ছাড়ার পর আমি পুরুলিয়া চলে যাই, এবং পরে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনে বহুদিন শিক্ষকতা করি। যোগাযোগ কমে যায়, কিন্তু আমি সোমনাথদার প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছি কিছু বার, ওঁর সঙ্গে কয়েকবার দেখাও হয়েছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে মেশা ইত্যাদি ওঁর ছিল না, ওই এক্সপোজারটা উনি এড়িয়ে চলতেন। হয়তো নিজের কাজের ক্ষেত্রে আর্ট মার্কেটের প্রভাব দূরে রাখার জন্যই ওই সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রদের সঙ্গে থাকাটা মাস্ট ছিল, ছাত্ররা সব সময়েই জানত সোমনাথদা পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ এচিং-এর হুইলটা টানতে পারছে না, উনি পিছন থেকে ধরে টেনে দিতেন। গুরুর হাতও ছাড়তে হয়, কিন্তু আমার মনে হয়, শিক্ষক হিসাবে সোমনাথদার মতো এত বড় প্রভাব আর কেউ ফেলে যেতে পারেনি।
ষাটের দশকটা বাংলার স্বর্ণযুগ। সংস্কৃতির একটা সার্বিক, অসামান্য সময়। আমরা খুবই ভাগ্যবান, ওই সময়ে একসঙ্গে দেখেছি, কাজ করেছি, শিক্ষা পেয়েছি কিঙ্করদা, সোমনাথদা, মানিদার— যাকে বলে একেবারে ‘বিগ বস’, এঁদের। আড্ডা হচ্ছে তিনজনের, বিষয় পিকাসো, কলাভবনের সামনেই কিছু বনপুলক গাছের ঝাড় ছিল, সেখানে চা খেতে-খেতে। কিঙ্করদা বলে উঠলেন, ‘পিকাসো ভাব, পিকাসো হোয়ো না!’
সব জিনিসেরই একটা ক্ষয় আছে। শান্তিনিকেতনে মাস্টারমশাই (নন্দলাল বসু) যা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তারও ক্ষয় হয়, এবং এই ক্ষয়িষ্ণু মুহূর্তে এঁরা এলেন। কিঙ্করদা বাটিকের ওপর প্রাধান্য দিতেন। বাটিকের ছড়িয়ে পড়ার যে অসাধারণত্ব, তা অন্য কিছুর ভিতরে নেই, তাই বাটিক করা খুব পছন্দ করতেন। অনেক সময় আমরা বাটিক করে যখন মোম তুলছি, তখন এসে দেখতেনও যে, কীরকম হচ্ছে। শিক্ষকরা আমাদের সঙ্গে বসে কাজ করতেন, শুধু ‘করে যাও, করে যাও’ বলতেন না। ব্রাশ কী করে ধরতে হবে— এর একটা ধরন আছে, একটা গোল পাথর হাতে নিয়ে তারপর তুলি ধরা হয়, তবে লাইন সোজা হয়। এই ধরনের টেকনিক সব সময় চর্চা না হলে ভোঁতা হয়ে যায়— তা দেখানো থেকে শুরু করে কাজের শেষ মুহূর্ত অবধি শিক্ষকেরা আমাদের সঙ্গে থাকতেন।
একটা কথা এখানে বলব। আমরা কিঙ্করদা আর বিনোদদাকে (বিনোদবিহারী) নিয়ে এত উচ্ছসিত ছিলাম যে গৌরীদি (গৌরী ভঞ্জ) নিভৃতে থেকে গেলেন। গৌরীদি সমতুল্য ছিলেন, তাঁর কাছে কিছু নিয়ে গিয়ে ধরলেই সেটা শিল্পবৎ হয়ে ফিরে আসত। কিন্তু গৌরীদি অদেখা রয়ে গেলেন, সেই দেখাটা হল যখন আমি শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়ে গেলাম, দূর থেকে দেখলাম এবং উপলব্ধি করলাম যে উনি কী অসাধারণ শিক্ষিকা এবং শিল্পী ছিলেন। আমার যত বয়স কমে আসছে তত বুঝছি গৌরীদির অবদান। ওঁর আলপনার কাজ আন্তর্জাতিক স্তরের শিল্পকর্ম ছিল, ওঁর চলে যাওয়ার পর সেটা কলাভবনে খুব একটা আর চর্চাও হয়নি।
কলাভবনে সোমনাথদাকে নিয়ে আসেন দিনকর কৌশিক। শান্তিনিকেতনে যাদের একদম গোঁড়া মনোভাব ছিল, তারা প্রথমদিকে সোমনাথদাকে মেনে নিতে পারেনি। উনি ‘মেনে নাও’-ও বলেননি। কিন্তু ধীরে-ধীরে, ফুল ফুটলে যেমন গন্ধ মানুষকে আকৃষ্ট করে, কর্মদক্ষতার গুণে সোমনাথদা আর শান্তিনিকেতন এক হয়ে গিয়েছিল। স্বভাবটা খুব ভালো ছিল, রেগে যেতেন না। এটা খুব বড় কোয়ালিটি, অসন্তুষ্ট না হওয়া।
আমাকে সোমনাথদা প্রায়ই বলতেন, ‘আপনি একটা বড় মানুষের কাছে আসা-যাওয়া করেন,’ যেহেতু আমি নন্দলালের কাছে আসা-যাওয়া করতাম। সোমনাথদার সাথে ভাবের আদান-প্রদান হত। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগত ওঁর কাজের নিপুণতা দেখে। এর কোনও তুলনা ছিল না। উনি যে গ্রাফিক্সে কতগুলো জিনিস একেবারে নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছিলেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মেটালে কীভাবে দাগ দেবে, কীভাবে পোড়ানো যাবে, কোনটা চাপে নেওয়া যাবে বা যাবে না, কাগজ কতটা ভিজবে, কাগজ না ভিজিয়ে কতটা কাজটা করা যায়, তারপর পেপার-পাল্প প্রিন্টের কাজ, ‘উন্ড’-এর কাজগুলো— এই সব পদ্ধতিতে সোমনাথদা অসামান্য নিপুণতায় কাজ করতেন, এবং সর্বসমক্ষে কাজ করতেন। পেপার-পাল্প প্রিন্টের কাজ খুব কষ্টসাধ্য ছিল, কিন্তু পুরোটা নিজে করতেন।
ওঁর পেন্টিং-এরও একটা নিজস্বতা ছিল, খুব সুন্দর কাজ করতেন, প্রধানত জলরং-এ। কখনও ওপেক ওয়াটারকালার-ও করতেন, কিছু তেলরং-এর কাজও করতেন। পেন্টিং-এ কোনও ইতস্তত ভাব ছিল না। কিন্তু একটা মজার কথা বলি— কলাভবনে সোমনাথদা আসাতে ছবি আঁকা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, সবাই গ্রাফিক্স করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমিও করেছি, রেগুলার করেছি।
সরকারি আর্ট কলেজের থেকে শান্তিনিকেতনে তখন একটা সজীবতা এসেছিল। স্টুডিওতে আলো নিভত না, সবসময় দরজা খোলা, সারাক্ষণ কাজ হচ্ছে— এটা একটা শিল্প পরিবেশের পক্ষে মস্ত পাওয়া। এবং সেটা সোমনাথদার মতন শিক্ষকেরা ছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল। একটা ইমোশনের গল্প বলি— কিঙ্করদা একটা মূর্তি গড়ছেন এবং হাতের কাছে স্প্রে করার বোতলটা খুঁজে পাচ্ছেন না। তখন মুখে জল ভরে কুলকুচি করে স্প্রে করে দিলেন। এই আর্জেন্সিটা, এই ইমোশন, এত বেশি ইনভল্ভ হয়ে পড়েছেন যে এটাই সহজ, স্বাভাবিক হয়ে পড়ল— এটাই ছিল আমাদের শান্তিনিকেতন। কাজটা পাথরে যাবে, না মেটালে যাবে— এটা কিঙ্করদার মতো বুঝতেন খুব কম শিল্পীই। পাথর বাছতে-বাছতেই তো দিন কাবার কিঙ্করদার। আমরা খুবই ভাগ্যবান, এঁদের শিক্ষক হিসাবে পেয়েছি।
হতশ্রী সমাজকে সামনে তুলে ধরার একটা বড় দিক সোমনাথদার কাজে ছিল। ওঁদের একটা গ্রুপ ছিল, যেখানে এই ধরনের কাজের খুবই প্রচলন ছিল। সোমনাথদার বিরাট পরিবর্তন হল শান্তিনিকেতনে আসার পর, উনি আরও কিছু দেখতে শুরু করলেন, অনেক জানলা খুলে গেল। এবং সোমনাথদাকে দেখে গ্রাফিক্স-এর একটা আলাদা স্তর তৈরি হল কলাভবনে। ছেলেরা এমন একজন মাস্টারমশাইকে পেল যে সারাক্ষণ কাজ করছে— এই লিথো করছে, এই এচিং করছে, এই পেপার-পাল্পের কাজ করছে, পেন্টিং-ও করছে। সবচেয়ে ভাল লাগত একজন শিক্ষককে দেখতে পেয়ে যিনি নিজে কাজ করে উদ্বুদ্ধ করছেন। সোমনাথদা মিতভাষী ছিলেন, কিন্তু কাজ করতেন সারাক্ষণ, রাত-দিন, ২৪ ঘণ্টা। যার জন্য পরে ওঁর শরীর ভেঙেও গেছিল।
পরে ছোট-ছোট করে ভাস্কর্য শুরু করেছিলেন, এবং সেখানেও বাংলার দুর্ভিক্ষ সামনে উঠে আসে। এই বিষয় থেকে বেরিয়ে খুব সুকোমল কাজ করেছেন, এরকম আমি দেখিনি। পুরনোপন্থী শান্তিনিকেতনের অনেকেই এই গতের কাজ পছন্দ করতেন না, কিন্তু তাতে ওঁর কাজের শিল্পগুণ কোনওভাবেই কম হয়ে যায় না। নন্দলালের হরিপুরা কংগ্রেসের ড্রয়িং-এর লাইন ভাবাই যায় না, কিন্তু শিল্পগুণে তা অসাধারণ। দুঃখের বিষয়, গ্রাফিক্স-এ সোমনাথদার পরম্পরা রয়েছে, কিন্তু ভাস্কর্যে নয়।
সোমনাথদার সম্বন্ধে কথা বলার একটা সুবিধা আছে: উনি সুবিধাবাদী ছিলেন না। শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাস নয়, মানুষটাই ওই রকম ছিলেন। মনোগত যে অনুভূতি, সেটার সঙ্গে উনি যুক্ত ছিলেন। বলতেন, ‘আমি কাজ করে যাচ্ছি, কেউ যদি এ থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই হবে আমার প্রাপ্য’।
শতবর্ষে সোমনাথ হোর, ভেবে অবাক লাগছে। শিল্পী এবং শিল্পশিক্ষক হিসাবে তাঁর যে মর্যাদা প্রাপ্য, উনি যেন সেটা পান, এটাই কাম্য।