ব্যাকুল বাঁশুরিয়ার স্বর

Hariprasad Chaurasia_Featured Image

ছেলের বয়স যখন ১৫ বছর, স্বাধীন ভারত তখন সবে ছয়। মোটামুটি বয়স হয়েই গেছে আখড়া ছেড়ে জাতীয়, আন্তর্জাতিক কম্পিটিশনে নামার। হাইট তো ঠিকই ছিল, এতদিনে ছোলার ছাতু পেটে ফেলে, রোজ ভোরে দৌড়; তারপর মাটি মেখে কুস্তি, আর শেষে পবিত্র গঙ্গায় দশবার এপার-ওপার সেরে দম আর ওজন মোটামুটি চলে এসছে লক্ষ্যমাত্রায়। সদ্য-স্বাধীন দেশের নাম উজ্জ্বল করবে ছেলে, কুস্তি লড়ে বড়-বড় দেশের পেহেলওয়ানদের পটকে ফেলে আসবে, এলাহাবাদের পুস্তেনি কুস্তিগীর খানদানের সম্ভবত সবচেয়ে প্রখ্যাত ছেদি পেহেলওয়ান স্বপ্ন দেখছেন, তাঁকে ছাপিয়ে যাবে তাঁর সেই ইকলতা, হরি। কিন্তু তিনি তো জানেন না, বাংলার তরজমা— রাখে হরি, মারে কে… সেই ছেলে যত ভোরে ওঠার কথা, তার চেয়েও আগে উঠে কুস্তির পাট চুকিয়ে, নদীর এপার-ওপার কিছু কমিয়ে কোনওদিন শুধুই মাথা ডুবিয়ে কাদা ধুয়ে এসে বসছে গঙ্গার পাড়ে, আর ভিখিরির থেকে চুরি করা সরু ফিনিফিনে বাঁশিটি ধুতির কোঁচড় থেকে বের করে ফুঁ দিচ্ছে অন্য এক স্বপ্নের বাতাসে; যে-স্বপ্ন তার বাপের স্বপ্ন থেকে অন্যতর পারে নিশ্বাস ছাড়ছে। বয়স যতই কম হোক, শেষমেশ তো পালোয়ানি কসরত-করা হাত। মোটা আঙুল সেই বাঁশির ছিদ্রে খাপ খাচ্ছে না। মন বলছে, এই জীবনের চেয়ে বড় স্বপ্ন, এই কিঞ্চিৎ বাঁশের গভীরে ঘাপটি মেরে থাকা বাতাসকে আন্দোলিত করার জন্য চাই আরও বড় কোনও বাঁশির আশ্রয়। জানা গিয়েছে, বাংলার একজন কে এক পান্নালাল ঘোষ নাম্নী বংশীবাদক নাকি তেমনই এক-দেড় হাত লম্বা বাঁশি বানিয়ে ফেলেছেন।

কিন্তু, হায় রে হরি! কোথায় পালোয়ানের আখড়া আর কোথায় সংগীতের আসর— পান্নালালের কাছে কি আর পৌঁছনো যাবে? অগত্যা, সংগীতের তাগিদে, আপাতত গান শেখা দিয়েই হাত পাতা যাক। বাপকে লুকিয়ে, নিজের শ্রম-অধ্যবসায়ে মাত্র চার বছরে, ১৯৫৭ সালে, ওড়িশার অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-য় কম্পোজার ও পারফর্মারের চাকরি। না, পালোয়ান তাঁকে হতে হয়নি। বাঁশি তাঁর স্বপ্নকে বাতাস দিয়ে, দিয়েছে প্রশ্রয়, অধ্যাত্ম আশ্বাস। সেই তথাগত পালোয়ান ও ব্যাকুল বাঁশুরিয়া এক শরীরে ৮৭ বছর ধরে ঝাপট মেরে চলেছে। যদিও, তাদের মধ্যেকার বোঝাপড়া কীভাবে শরীরকে মোচড়ায়, দোমড়ায়, আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব কি না ভেবে কাজ নেই।

আরও পড়ুন: মুষ্টিযুদ্ধ শেখাতে-শেখাতেই সংগীতশিক্ষালাভের দিকে ঝুঁকেছিলেন পান্নালাল ঘোষ! আমরা কি তাঁকে যথার্থ মর্যাদা দিয়েছি? লিখছেন কবীর সুমন…

বরং এখন, অর্থাৎ, ওইসব সারেগামা পেরিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে দু-দণ্ড বসা যাক। কারণ, আদালত ননস্টপ চলছে। আর, নেপাল, গোপাল, ট্রাম্প, মেট্রো, কোহলি, অ্যালকোহলিক, সিরিয়া, গাজা, পাহাড়তলি, রাশিয়া নিয়ে যাবতীয় মামলা-মোকদ্দমার সারিতে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে সেই অশীতিপর বাঁশুরিয়াকে— সেই বাঁশিবাদক, প্রায় সাত দশক দীর্ঘ যাঁর বংশী-কেরিয়ারের কাছে ভারতের ঋণের শেষ নেই। যাঁর নিশ্বাসে বয়েছে গঙ্গা, প্রতিধ্বনিত হয়েছে হিমালয়, আর নিবেদিত হয়ে আছে ভারতীয় রাগ সংগীতধারার আধেক অহংকার। কিন্তু, তাঁর দোষ— তাঁর দুঃসাহস। শরীরে পারকিনসনস বাসা বেঁধেছে, ফুঁ দেওয়ার দম নেই, বাঁশির ছিদ্রে হরির আঙুল থরহরি কম্প, কিন্তু শখ ষোলো আনা— স্টেজে উঠেছে! দু’একটা করুণ সুর, এবং সিংহভাগ নীরবতা ছাড়া কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা যাঁর আর নেই, তাঁর এই দুঃসাহস হয় কী করে! তা সে যতই হোক না সাত দশকের কেরিয়ার, ‘কল অফ দ্য ভ্যালি’, ‘সিলসিলা’, বিটলস, সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি, পদ্মবিভূষণ!

মামলা শুরু হয়ে গেছে। বাদী পক্ষ যা বলার বলে দিয়েছে। অভিযুক্ত একইরকম নীরব। কিন্তু হঠাৎ বিবাদী পক্ষের হয়ে কালো কোট চাপিয়ে ঢুকে পড়েছে এক পাগলা উকিল। তার নাম নাকি বিবেক। মাঝেসাঝে তাকে আদালত চত্বরে দেখা যায়, বেশির ভাগ সময়েই ঘুমিয়ে থাকে। আর সে প্রবেশমাত্র প্রশ্ন তুলেছে, সাত দশক বাদ দিন। গত দশ বছর মানে এক দশকে, বাদীপক্ষের হাবভাবে একটু তাকাই, একটু সালতামামি হোক। অভিযোগ তো গ্রহণ করলাম, কিন্তু তার আগে দশ বছরের হিসাব, মাই লর্ড, কারণবশতই বলছি। ক্রমশ প্রকাশ্য!

Hariprasad Chaurasia_3

তা বিগত দশ বছরে কী কী ঘটেছে? কম কথায় সারব জনাব! নবকলেবরে প্যারিস চুক্তি কার্বন এমিশন কমানোর প্রয়াস, যদিও তাতে শতাব্দীর উষ্ণতম দশকের রেকর্ড রোখা যায়নি, এল নিনোর প্রভাবে এই উত্তাপ, এই বাঁধ-ভাঙা বৃষ্টি। জনজীবনে ব্যাঘাত তো সূক্ষ্ম, মৃত্যু ঘটেছে বহু, আর পাহাড় ছাপিয়ে বন্যা, পাহাড়ের ধস। স্পেন-পর্তুগালে বীভৎস দাবানল, যার ফলে উষ্ণায়নের আরও বৃদ্ধি। আছে কোভিড প্যানডেমিক, এখনও অবধি তথ্য বলছে প্রায় এক কোটি মানুষের বেমক্কা মৃত্যু। যদিও এসবে মানুষের রোখ কমছে না, উপরি যুদ্ধ চাই। তাই রাশিয়া-ইউক্রেন, ওদিকে ইজরায়েলের একতরফা অ্যাটাক প্যালেস্টাইনে, লক্ষ-লক্ষ শিশুর লাশ। ভারতে এসবের প্রভাব নতুন করে আর বলছি না। বরং ৩৭০ ধারা লোপ মনে করে নেওয়া যাক। মনে করে নেওয়া যাক, উন্নাও-হাথরাস— আর জি কর বলব নতুন করে? বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে ভোট চুরির তাগড়া প্রমাণ, দশ ফুট বাই আট ফুটের একটা ঘরে ৭০ জনের বসবাস মনে করাব? আর বাবরি মসজিদ-রামমন্দির কিস্‌সা, থাক।

এসবই প্রায় আপনারা কমবেশি জানেন, তর্ক জুড়েছেন, বলা বাহুল্য, সুবিধেমতো এড়িয়েও গিয়েছেন। কিন্তু হায়, হরিজিকে নিয়ে সালিশি বসানোর আগে খবরই রাখেননি, দশ বছর হতে চলল, তাঁর পারকিনসনস ধরা পড়েছে। আপনারা ধরতেও পারেননি। এই দশ বছরে নাই-নাই করে দশটারও বেশি বড়-বড় আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যাল, সোলো টুর, কনসার্টে গিয়ে রাগের ভিতর নীরবতা ঢেলে এলেন; গুরুকুল বৃন্দাবন, নিজের সংগীত প্রতিষ্ঠানে ছয় থেকে ষাট বছর বয়সি শিষ্যদের তালিম দিয়ে গেলেন নিরবচ্ছিন্নভাবে; এত পালটে যাওয়া সময়-পরিবেশ-মৃত্যুভোগের মাঝে প্রিয়জন প্রিয় সংগীতসঙ্গীদের চলে যাওয়ায় আরও বিপন্ন হলেন, কিন্তু তিনি শেষ শ্বাস পর্যন্ত কেবলমাত্র থামতে চাইলেন না। এটাই অপরাধ? তিনি যে নিজেই নিজের অক্ষমতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন সেই ২০২০-তে একটি কনসার্টের মাঝে যখন অতিরিক্ত হাত কেঁপে যাওয়ার ফলে সুর নড়ে গেল, তাল কেটে গেল, সেই খেয়াল তো আপনারা রাখেননি! তখন পারকিনসনস-এর উল্লেখ করে নিজের ব্যর্থতা প্রকাশের পরক্ষণে গোটা শ্রোতাকুল হাততালি দিয়ে তাঁকে উৎসাহ জানিয়েছিল যে, তা আপনাদের বেখেয়ালে চোখ এড়িয়ে গেছে। তিনি তখন স্মিত হেসে মাথা নত করে বলেছিলেন, আপনাদের আদর-সাহসেই আমি এখনও টিকে আছি। আর আপনারা কী করলেন? তাঁর নীরবতা, অপারগতার শ্বাসাঘাতে রাগ খুঁজে সুর খুঁজে শেষমেশ কেউ অস্থির হলেন, চুকচুক করলেন, কেউ উঠে চলে গেলেন মেজাজ দেখিয়ে মাথা নেড়ে, কেউ ফিসফিস করলেন— এ কে রে হরি, একে বাজাতে দেওয়া হল কেন? টাকার দরকার ছিল নাকি? অনেকে আবার চুপচাপ বসে রইলেন, এই মুহূর্তকে ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে রগড় করবেন, সহানুভূতির ফোয়ারা ছোটাবেন বলে! মাননীয়, আপনারা অর্থনীতির অঙ্কে সব মাপতে শিখে গেছেন দেখছি? কত টাকা দিয়েছিলেন জন্মানোর জন্য? আপনাদের অর্থচিন্তায় অর্থহীনতার দীর্ঘশ্বাস টের পাচ্ছি।

কী জানেন তো, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার আদপে আর কিছু প্রমাণ করার নেই। আমরা মনে হয় ভুলে যাচ্ছি, তিনি অন্নপূর্ণা দেবীর শিষ্য। সেই অন্নপূর্ণা দেবী, যিনি পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর সর্বসমক্ষে কোনওদিনও সুরবাহার বাজাননি; অভিমানে-ক্ষোভে চিরকাল থেকে গেলেন আড়ালে, মুখ দেখালেন না, শিষ্যদের শেখাতে বসালেন মাঝরাতে যখন আর কিছু দেখা যায় না তেমন নিকষ অন্ধকারে কেবল গুরুকে আবছা পাওয়া যায়। স্বয়ং হরিজিকেই তিনি তিন মাস ঘুরিয়েছেন, শেখাবেন না বলে; শেখাতে যদিও-বা বসেন সামনে আসবেন না, অবশেষে হরিকে সন্তানের মতো ভালবেসে ফেলবেন আলগোছে। সেই সন্তানসম শিষ্য গুরুমা-র অভিমানের বিপরীতে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ স্টেজের প্রত্যয় নেবেন যে, তা কি আমরা বুঝতে পারব? আমরা এই পাকেচক্রে হয়তো ভুলে যাচ্ছি, তাঁর বাঁশি কেবলই বাদ্যযন্ত্র নয়, দেশের সুর হয়ে ইতিহাস ও মিথের মাঝে নদী হয়ে বয়ে চলেছে, অবিরাম। অথচ বয়সের সামান্য এক হোঁচটেই আমরা তাঁকে ‘করুণ দৃশ্য’ বানিয়ে ফেললাম। কী উদারতা আমাদের! আপনারা আবার যুক্তি খাড়া করেছেন, সব কিছুরই শেষ আছে, থেমে যাওয়াটাও শিল্প!

এই যুক্তি মানলে তো বেটোভেন বধির হওয়ার দিনই সোনাটা কম্পোজিশন বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি সাহস করে লিখলেন নাইন্থ সিম্ফনি— ওড টু জয়, যাদের উৎসার ওই নিস্তব্ধতার ভেতর থেকে। আপনাদের যুক্তি অনুযায়ী, স্টিফেন হকিংয়ের একদমই উচিত হয়নি হুইলচেয়ারে বসে ব্ল্যাক হোলের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা! নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকতেন, আকাশ-বাতাস মাপতেন, আমরা ‘আহা রে স্টিফেন’ বলে চামচে করে জুস খাইয়ে দিতাম বড়জোর। পালোয়ানের কথা হচ্ছে যখন মহম্মদ আলি-কেই বা ভুলি কী করে, তাঁরও তো পারকিনসনস হয়েছিল, মনে পড়ে? কিছু কি মিল পাচ্ছেন এবার? সেক্ষেত্রে মুঠি কাঁপিয়ে, অলিম্পিকে মশাল জ্বালানো তো অপরাধের কাজ— অথচ সেই কাঁপা হাতে মশালের স্থির জ্বলে ওঠার ম্যাজিক দৃশ্য কি আপনাদের খেয়াল হবে? যান, দেখুন, ওই মুহূর্ত আপনাদের মুখে ঘুসির থেকেও বড়।

আপনারা বলছেন বটে সময় বুঝে থেমে যাওয়ার কথা। সেটাও তো করতে চেয়েছিলেন অনেকে। মনে পড়ছে না? সুচিত্রা সেন। স্বেচ্ছা নির্বাসন নিলেন, কী কারণে আমাদের তো ভেবে কাজ নেই, তাঁর মর্জি। কিন্তু, আপনারা কী করলেন? পেপারে ব্লার ছবি ছাপিয়ে একদিনের বিক্রি বাড়ালেন, সামনে ব্যক্তি-স্বাধীনতার গান গাইলেন আর আড়ালে ঘনিষ্ঠ সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন, রমাদির কী হয়েছে? দিলীপ কুমারের শারীরিক দুর্বলতাকে শ্রদ্ধার চোখে দূর, মিম বানিয়ে ছাড়লেন। উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ শ্বাস ফুরোনো পর্যন্ত বাজিয়ে গেলেন, অথচ আমরা তাঁর সংগীতের থেকে বেশি আলোচনা করলাম তাঁর অর্থকষ্ট। গিরিজা দেবী আশির কোঠায় পৌঁছে ঠুমরি গাইছেন, আর আপনারা রেকর্ড ঢুঁড়ে দেখাতে উদ্যোগী কখন তাঁর গলায় ফেটে গেল। আপনাদের মাথায় কেবল ঘুরে বেড়িয়েছে হেডলাইন, ফোটো ক্যাপশন ‘এক যুগের অবসান’, আর পরবর্তী রিয়্যাক্টের উৎরোল।

কিংবদন্তিদের মাঝে আপনারাও কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন, তবে হ্যাঁ ভণ্ডামিতে। এদিকে নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শুনে অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চার পেগ বেশি গিলে ফেলেন, বয়স্ক মানুষের বাঁচার অধিকার ভাল থাকার অধিকার নিয়ে দর্শন কপচান, কিন্তু ভেতর-ভেতর নুয়ে পড়াকে ছুড়ে ফেলার হাত নিশপিশে আপনারা রেকর্ড করবেন। রতন টাটার প্রজ্ঞা আমাদের প্রাণিত করল, কিন্তু জ্বরাগ্রস্ত পা-টলমল ভিডিয়ো ভাইরাল করেছি চুকচুক স্বরে, যেন বার্ধক্য একটা কেলেঙ্কারি একটা দুর্নীতি। অর্থচিন্তা ও ভার্চুয়াল চিরন্তনীর কুহুকে আপনারা ভুলে গেছেন— অমরত্বের প্রত্যাশায় কোনও ম্যানিফেস্টেশন নেই।

চৌরাসিয়ার মঞ্চে ওঠা কোনও ট্র্যাজেডি, কোনও কালের ক্ষয় তো নয়ই, বরং এই ঘটনা অনেক বেশি পরিস্থিতিকে আলিঙ্গন, সত্যকে গ্রহণের স্বরূপ। একজন অশীতিপর পারকিনসনস-গ্রস্ত বৃদ্ধ বার্ধক্য-ব্যাধীর চোখে চোখ রেখে বলছেন, আমি এখনও বাঁশি ধরব, সুর যদি আমায় ছেড়েও যায়। গত দশ বছর ধরে তিনি পারকিনসনস-কে হারিয়ে একটানা কনসার্ট করেছেন, বেশির ভাগ শ্রোতা বুঝতেও পারেনি, কিংবা বোঝা তো দূর, যখন চৌরাসিয়া ছিলেন চাঙ্গা, সুস্থ, তখনও কি তাঁর সুর প্রক্ষেপ, সুরের ভেতর গভীর অধ্যাত্মবোধ বুঝতে পেরেছে পুরোপুরি? আজ ব্যর্থতা বুঝতে পেরে নিজেদের কী প্রমাণ করলেন?

Hariprasad Chaurasia_2

ট্র্যাজেডি আসলে দর্শকরা, সোশ্যাল মিডিয়ার চুকচুকবৃন্দ। যাঁরা আসন ছেড়ে চলে গেলেন, যাঁরা ভিডিয়ো শেয়ার করে বয়সের মর্ম বোঝানোর চেষ্টা করলেন, একদিন সব ফুরিয়ে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন— আসলে, আপনাদের অস্বস্তির কারণ সুরের অভাব নয়, আপনাদের অস্বস্তি আসলে সত্যের উপস্থিতি নিয়ে। আপনাদের ভয় হয়েছে আদপে, এই দুঃসাহস হয়তো আপনাদের না-ও থাকতে পারে। এই বয়স অবধি বেঁচে থেকে এত প্রিয়জনের মৃত্যুযন্ত্রণা বইতেও পারবেন কি? আর যাঁরা ভিডিয়ো মুছে ফেলার দাবি তুললেন— তাঁদেরও বলিহারি, যেন মুছে দিলেই আবার চৌরাসিয়ার শ্বাস ফিরে আসবে, না কি আমাদের স্বস্তি? ভিডিয়ো মুছে ফেলা আদৌ সম্মান নয়; বরং করুণার মুখোশ পরে সেন্সরশিপ। মসৃণ, ফিল্টার লাগানো, অটো-টিউন করা সত্যকে চিনতে হবে তো!

চৌরাসিয়া যখন তাঁর শৈলীর মধ্যগগনে, আমরা কি সত্যিই তাঁকে শুনেছি? তাঁর নীরবতা বুঝতে পেরেছি? তাঁর হা-হুতাশ, অন্নপূর্ণা দেবীর চলে যাওয়া, জাকির হোসেন, শিবকুমার শর্মার মৃত্যু, সেই মাত্র ছ-বছর বয়সে মায়ের অকালপ্রয়াণ— বোঝার চেষ্টা করেছি তার রাগ বিস্তারে? কেবল ডিনার পার্টি, বিয়ের ভিডিয়ো, আর হোটেলের লবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া গভীরে কতটুকু ঢুকেছি? যার সরবতার মধ্যে নীরব অশ্রু বুঝিনি, তার বোবা হয়ে যাওয়া আমাদের ব্যর্থতা।

হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া তাঁর এই ভঙ্গুর পারফরম্যান্সে সবচেয়ে সাহসী পাঠটা দিয়েছেন: শিল্প মানেই নিখুঁত হওয়া নয়। শিল্প মানে উপস্থিতি। মানে এই ঘোষণা— আমি এখনও আছি। যদি তা না হয়, তাহলে যার পারকিনসনস আছে, যে সেরিব্রাল পালসি, যে অটিস্টিক, তার বুঝি যোগ্যতা নেই স্টেজে ওঠার? একান্ত যাপনের দর্শন দিয়ে তাকে আরও কোণঠাসা করার খেলা খেলছি না কি আমরা? পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির দমবন্ধ স্বর তাঁর সম্পর্কে যত-না, আমাদের সম্ভ্রমহীন অহেতুক বাচালতা সম্পর্কে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে গেল আরও বেশি।