বঙ্কিমচন্দ্রের চাকরির ইন্টারভিউয়ে নাকি তাঁর কাছে ‘বিপদ’ ও ‘আপদ’ এই দুই বাংলা শব্দের পার্থক্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, নদীর বুকে নৌকাভ্রমণের সময়ে একবার ঝড় উঠেছিল, নৌকা ডোবে-ডোবে অবস্থা, প্রাণ যায়-যায় পরিস্থিতি— একে বলে বিপদ। আর বাঙালি হয়েও বঙ্কিমচন্দ্রকে, স্রেফ চাকরি পেতে, বিলিতি সাহেবের সামনে বাংলা ভাষার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে— একে বলা যায় আপদ। মুশকিল হল, ডাক্তারির ক্ষেত্রে এমার্জেন্সি বলতে যা বোঝায়, সেই চিকিৎসাকে যদিও বাংলা ভাষায় আপদকালীন চিকিৎসা বা আপদকালীন পরিষেবা বলা যায়— কিন্তু যদ্দূর মনে হয়, সেই ‘আপদকালীন’-এর সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র-কথিত ‘আপদ’ এক নয়; এবং আরও সন্দেহ, আমার কাছ থেকে কি ঠিক বঙ্কিমচন্দ্র-কথিত আপদ বিষয়ক লেখাই চাওয়া হয়েছে? অথচ মুশকিল, আমার মতো অলস, তাড়াহুড়োহীন, আজকের কাজ কালকে করুন-কালকের কাজ পরে কখনও আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের জীবনে তথাকথিত এমার্জেন্সি বলে কিছুই ঘটে না! আচমকা তেমন কিছু ঘটে গেলে সেই বিপদকে আপদ হিসেবে দেখার ফলে উৎকণ্ঠা-ছোটাছুটির সঙ্গে বিরক্তিই মুখ্য অনুভূতি হয়ে দাঁড়ায় এবং সেই বিরক্তিপূর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার কিছুই থাকে না— এই সরল সত্যিটুকু বাকিদের যে কেমন করে বোঝাই!
আরও পড়ুন: নসবন্দি যাদের সংকট, তাদের কি চেনে এমার্জেন্সি-পীড়িত মধ্যবিত্ত? লিখছেন অমিতাভ মালাকার…
ডাক্তারি করি, অথচ এমার্জেন্সি নিয়ে কোনও অভিজ্ঞতা নেই! এরকম আবার হয় না কি? ঠিকই। হয় না। অল্পবয়সে, মানে চিকিৎসক-জীবনের শুরুর দিকে তেমন অভিজ্ঞতা অবশ্যই ঘটেছে। কিন্তু আমি যে-অসুখের চিকিৎসক, অর্থাৎ ক্যান্সার, সেটি মূলত ক্রনিক অসুখ। এখানে রোগীর আচমকা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম। গুরুতর অসুস্থ হওয়াটা অনেকক্ষেত্রে প্রত্যাশিত এবং তা অনেক সময়েই ধাপে-ধাপে ঘটে। বিরল কিছু পরিস্থিতি, যাকে পরিভাষায় ‘অঙ্কোলজিকাল এমার্জেন্সি’ বলে, সেসব ক্ষেত্রেও চিকিৎসা যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হলেও ঠিক গল্প-সিনেমার মতো করে সাইরেন বাজিয়ে চিকিৎসক-টিমকে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না; কাজেই সেসবও ঠিক জমিয়ে গল্প করার মতো কিছু নয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, লিখবটা কী!
আসলে, ক্যানসার-চিকিৎসকের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো বাকি ডাক্তারদের থেকে আলাদা। এমার্জেন্সির মধ্যে যেমন একটা এখুনি-কিছু-করতে-হবে টাইপের চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কাজটা করে ফেলা থাকে, ঠিক তেমনই থাকে হাতেনাতে ফলাফল পাওয়ার আনন্দ (সাফল্যে) কিংবা হতাশা (চিকিৎসা ব্যর্থ হলে) থাকে। ক্যানসার-চিকিৎসকের লড়াই এর চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। যেখানে তথাকথিত সফল চিকিৎসা সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরেও রোগ ফিরে আসার ভয় থাকে, দীর্ঘ কয়েক বছর অব্দি কিছুদিন বা কয়েক মাস ছাড়া-ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফলো-আপের ব্যাপার থাকে, ফলো-আপে রোগী আসেন একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে, চিকিৎসকও রিপোর্টের পাতা খোলেন দুরুদুরু বক্ষে, কেননা ওই কাগজের লেখাটুকু এক লহমায় বদলে দিতে পারে একজন মানুষ তথা আস্ত একটি পরিবারের পৃথিবী— এর সঙ্গে সাইরেন বাজিয়ে চিকিৎসক-টিমের চটজলদি তৎপরতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রোগীকে ফিরিয়ে আনার যে-দুনিয়া, তার আশমান-জমিন ফারাক।
আমাদের চ্যালেঞ্জগুলোও তো আলাদা। রাজনৈতিক ‘জরুরি অবস্থা’-র সময়ে, শুনেছি, লেখক তথা সাংবাদিকদের খুব সাবধানে লেখালিখি করতে হত; বিষয়-নির্বাচনের ক্ষেত্রে তো বটেই, শব্দচয়নে সামান্য অসাবধানতার কারণেও লেখা ছাপা হত না, সঙ্গে কপালে হয়রানিও জুটত। একটা বোকা-বোকা তুলনা করি? কারোর ক্যানসার হয়েছে, অসুখ এমন পর্যায়ে, যেখানে সেরে ওঠার সম্ভাবনা পঞ্চাশ-পঞ্চাশ, অসুস্থ মানুষটি তথা পরিজনের কাছে এই কথাটা ঠিক এমন ভাষায় বলতে হবে যাতে তিনি/তাঁরা পরিস্থিতির গুরুত্ব তথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারেন; আবার ব্যাখ্যা করতে হবে এমন ভাষায়, যাতে অত্যধিক উৎকণ্ঠায় বিহ্বল হয়ে তিনি/তাঁরা একেবারে ভেঙে না পড়েন। শব্দচয়নের ক্ষেত্রে এই সচেতনতা কি খুব সহজ কাজ? দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চলতে-চলতে, আশানুরূপ ফল না পেতে-পেতে, হতাশ যে-রোগী তাঁর মনে আশার আলো জাগিয়ে রাখা অথচ রোগী-পরিজন যেন অলীক আশায় ভুগতে শুরু না করেন (যেখানে আশাভঙ্গের তীব্র বেদনা অনিবার্য) একইসঙ্গে সেটুকু নিশ্চিত করা— কথা ও দেহভাষার মধ্যে দিয়ে সেই ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারা কি কিছু কম কঠিন? অথচ, দেখুন, ভয়ানক ও দুরারোগ্য একটি অসুখের বিপদের মুহূর্তে এই কাজগুলো নিরন্তর করে চলতে পারাকে কিছুতেই ‘আপদকালীন চিকিৎসা’ বা ‘আপদকালীন পরিষেবা’-র আওতায় ফেলা যায় না (যদিও রোগী ও পরিজন সত্যিই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছেন), তাই না?
কঠিন কাজ হল, তারপরও, প্রতিদিন ওই মানুষগুলোর মুখোমুখি হওয়া। তারপরও প্রতিদিন চিকিৎসা ও শুশ্রূষা চালিয়ে যাওয়া। মৃত্যুর পরোয়ানা শুনিয়ে দেবার পরেও কি কিছু বলার থাকে? তবু কথোপকথন চালিয়ে যেতে হয়, যেতেই হয়। চিকিৎসকের সেই শিরশিরে অস্বস্তি, সেই উৎকণ্ঠা… প্রতিটি শব্দ নিক্তিতে মেপে উচ্চারণ করা, অথচ শব্দগুলো এমনভাবে বলতে হয় যেন একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত! মৃত্যুপথযাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে রোজ এই একই অভিনয় চালিয়ে যাওয়া, এ-ও কি একপ্রকার ‘জরুরি অবস্থা’ নয়?
আচমকা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া রোগী হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিভাগে হাজির হন, চিকিৎসক-টিম ছোটাছুটি করে তাঁকে আইসিইউ/ওটি-তে নিয়ে যান আর হাজার চেষ্টার পরেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না হলে ডাক্তারবাবু বাইরে এসে গম্ভীর মুখে গলা খাদে নামিয়ে পরিজনকে জানান, ‘সরি, পারলাম না!’ আরেকদিকে আমরা? দীর্ঘ কয়েক মাস বা বৎসরাধিক কালের চিকিৎসার পর যখন বুঝতে পারি, নাহ!, অসুখ এমনই যে এঁর ক্ষেত্রে কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না— কোনও এক অজানা বোধে, বা সহজাত প্রবৃত্তিতেই সম্ভবত, রোগীও জেনে যান সেই সত্য, তারপরও রোগী সত্যটা যাচাই করে নিতে চান তাঁর চিকিৎসকের মুখ থেকে আর চিকিৎসক কিছুতেই কথাটা বলে উঠতে পারেন না। রোগীর উৎকণ্ঠিত চোখ ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে আর চিকিৎসক প্রাণপণে এড়িয়ে থাকতে চান সেই দৃষ্টি; শেষমেশ চিকিৎসক চেষ্টা করতে থাকেন রোগীটিকেই যেন এড়িয়ে যেতে, অথচ রোগীর সেই দৃষ্টির সঙ্গে চোখ না মেলালেও সে-দৃষ্টি চিকিৎসককে অনুসরণ করতে থাকে অনুক্ষণ, এ-ও কি কিছু কম বড় চ্যালেঞ্জ?
লোকটিকে প্রায় রোজই দেখতাম। একটু বোকাসোকা। খানিকটা হাবাগোবা গোত্রের৷ কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে যায়। আসত ছেলের চিকিৎসা করাতে। বাবা ওরকম হলেও ছেলে তাগড়া জোয়ান কিন্তু ক্যানসার ধরা পড়েছে সেই কুড়ি-একুশ বছর বয়সেই। অসুখ যে-পর্যায়ে, তাতে সারার আশা একেবারেই নেই। তবু চেষ্টা চলছে। আস্তে-আস্তে সেই চেষ্টাও শেষের মুখে। ছেলেটির মুখে আশাহীনতার ছায়া ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। লোকটিকে কী বলব? ছেলের আয়ু যে আর মাত্র মাসকয়েক, তা বাবাকে জানাব? লোকটি রোজই আসেন, কিন্তু আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। একদিন ডাকলাম। বসিয়ে কথা বলতে চাইলাম। লোকটির কিছুই যেন বলার নেই। জিজ্ঞেসও করার নেই। অগত্যা নিজেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলের অসুখ কোন পর্যায়ে সেটা আপনি জানেন?’ না, উনি জানেন না। সবদিক বাঁচিয়েই আরেকটু বিশদে বলার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম, বোঝা তো দূর, লোকটি কিছুই শুনছেন না। অগত্যা, রূঢ় বাস্তবটা এক ঝটকায় বলে বসলাম, ‘আপনি কি জানেন যে ছেলের এই অসুখটা সারবে না? জানেন, অসুখটা খুব খারাপ পর্যায়ে ধরা পড়েছিল, আর উত্তরোত্তর আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে?’
লেখাটা এমার্জেন্সি নিয়ে হওয়ার কথা ছিল। যতদূর মনে হয়, এমার্জেন্সি কোনও সুখকর অভিজ্ঞতা নয়, কারও পক্ষেই। এমার্জেন্সির পর কেউ স্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফেরেন, আর কেউ হতাশ হয়ে— কিন্তু সেটা পরের ব্যাপার, আগের অংশটুকু নিখাদ উৎকণ্ঠার এবং অ-সুখের। না, এমার্জেন্সি নিয়ে আমার কাজ নয়। কিন্তু লোকটির সঙ্গে বাক্যালাপের পর তাঁর চোখের সেই আহত শূন্যতা আজও আমায় তাড়া করে। বছর তিরিশেকের সেই তরুণী, যার মেয়েটি তখন মাত্রই বছরসাতেকের, সেই তরুণীকে যখন জানাতে হয় যে হাজার চিকিৎসার পরেও তার স্তনের ক্যানসার শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে আর সে মেয়ের হাতটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে— ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত তরুণ যখন নিজেই গুগল করে জানতে পারে যে পায়ের পাতা থেকে তার অসুখটা সটান মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়েছে, সম্ভাব্য আয়ু মাত্র কয়েক মাস এবং সত্যরক্ষার খাতিরে আমাকে যখন সেই কথাটা ঠারেঠোরে স্বীকার করতে হয়— বিশ্বাস করুন, কাজটা সহজ নয়। কিন্তু কাজটা তত কঠিনও কি?
আসল কঠিন কাজ হল, তারপরও, প্রতিদিন ওই মানুষগুলোর মুখোমুখি হওয়া। তারপরও প্রতিদিন চিকিৎসা ও শুশ্রূষা চালিয়ে যাওয়া। মৃত্যুর পরোয়ানা শুনিয়ে দেবার পরেও কি কিছু বলার থাকে? তবু কথোপকথন চালিয়ে যেতে হয়, যেতেই হয়। চিকিৎসকের সেই শিরশিরে অস্বস্তি, সেই উৎকণ্ঠা… প্রতিটি শব্দ নিক্তিতে মেপে উচ্চারণ করা, অথচ শব্দগুলো এমনভাবে বলতে হয় যেন একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত! মৃত্যুপথযাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে রোজ এই একই অভিনয় চালিয়ে যাওয়া, এ-ও কি একপ্রকার ‘জরুরি অবস্থা’ নয়? একে কি আমি এক অর্থে ‘এমার্জেন্সি’ বলতে পারি?