যাদু-ওস্তাদের কাহিনি

Representative Image

অজিতকৃষ্ণ বসু ওরফে অ.কৃ.ব. আসলে এমন এক বিশেষ ধরনের দ্বিগু সমাস, যার ব্যাসবাক্য হবে, দু’টি অ.কৃ.ব.-র সমাহার। এক অ.কৃ.ব. লিখতেন কৌতুকরসের কবিতা-গল্প-উপন্যাস, করতেন অনুবাদ; আর একজন, সম্পূর্ণ আলাদা অ.কৃ.ব. ছিলেন, তিনি লিখতেন মাত্র দু’টি বিষয়ের কিস্সা‌। প্রথম অ.কৃ.ব. রসসাহিত্যে সিদ্ধহস্ত; তাঁকে পাওয়া যায়, ‘পাগলা গারদের কবিতা’-য়, ‘এক নদী বহু তরঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থে, কিংবা ‘বিধাতা’, ‘চন্দনপুরের কাহিনী’, ‘ম্যারিনা’, ‘ক্যান্টিন’, ‘নন্দিনী সোম’, ‘শেষ বসন্ত’, ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’, ‘শকুন্তলা স্যানাটরিয়াম’ উপন্যাসে৷ ইংরেজি কৌতুক কবিতা লিখেছেন ‘শঙ্করস উইকলি’-তেও। আর দ্বিতীয় অ.কৃ.ব. ডুবে থাকেন জাদু আর সংগীতে। তখন তাঁর মেজাজ আলাদা, প্রাচীন দুই শিল্পের মধ্য দিয়ে চলে তাঁর স্মৃতি, আবার স্মৃতির ভেতর পাকা খেলোয়াড়ের মতো জায়গা পরিবর্তন করে চলে এই দুই শিল্প।  

আরও পড়ুন: প্রফেসর বোসের সার্কাস প্রভাব ফেলেছিল স্বামী বিবেকান্দের জীবনেও! লিখছেন সৌরপ্রভ চ্যাটার্জি

জাদু আর সংগীত নিয়ে তাঁর জোড়া কাহিনি— ‘যাদু-কাহিনী’ আর ‘ওস্তাদ কাহিনী’ প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় একই সময়ে, ১৯৬০ সাল নাগাদ। এই দুই বিষয়ের মধ্যে যোজন-বিস্তৃত দূরত্ব থাকলেও, অ.কৃ.ব.-র কাছে তা নেহাতই আপাত। এই কথা সত্যি যে, সংগীত বা জাদু, দুটোই পারফর্মেন্সভিত্তিক, সামনে বসে দেখা বা নিদেনপক্ষে শোনা না গেলে, রসের যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটে। ‘যাদু-কাহিনী’-র প্রস্তাবনা অংশে এমন কথাই বলছেন তিনি, “ঠাণ্ডা ছাপার হরফে রাগ-রাগিণীর রূপবর্ণনা পড়ে তারপর গুণী সংগীতশিল্পীর কণ্ঠে তাদের সুন্দর রূপায়ণ শুনলে যেমন হয় ‘গ্যাম্যাজিক’ পড়ার পর ছাপার হরফে বর্ণিত একাধিক যাদুর খেলাকে গুণী যাদুকর ‘রয় দি মিষ্টিক’-এর হাতে বাস্তব রূপ নিতে দেখে আমার তেমনি অবস্থা হল।”

বলা বাহুল্য যে, লন্ডনের বিখ্যাত গ্যামাজ কোম্পানির ম্যাজিক বিভাগের ক্যাটালগ, গ্যামাজ আর ম্যাজিক শব্দ দু’টি জুড়ে যার নাম দাঁড়ায় ‘গ্যাম্যাজিক’। কিন্তু লক্ষণীয় যে, প্রস্তাবনা থেকেই সংগীত এবং জাদুর প্রসঙ্গ একে অন্যের বিশেষণ-রূপে একযোগে উচ্চারিত হতে থেকেছে। 

অ.কৃ.ব.-র ছোটবেলা কেটেছে ঢাকার গ্যান্ডেরিয়ায়, বুড়িগঙ্গার ধারে। মাঝে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এলেও , মন পড়ে থাকত সেই বুড়িগঙ্গার ধারেই। এদিকে তখন ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিমণ্ডল। সেখানে এসে হাজির হয়েছেন শিবসেবক মিশ্র, পশুপতিসেবক মিশ্র এবং ওস্তাদ গুল মহম্মদ খাঁ। কিছুদিন বাদে শিবসেবক আর পশুপতিসেবক মিশ্র চলে গেলেও, থেকে গেলেন ওস্তাদ খাঁ সাহেব; তাঁর কাছেই রীতিমতো নাড়া বেঁধে সংগীতচর্চা শুরু করলেন অজিতকৃষ্ণ। এর আগে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র, তাঁর কাছেও শিখেছেন অল্পদিন। তবে ঢাকাতে গুল মহম্মদের কাছেই, তাঁর দস্তুরমতো তালিম নেওয়া। পরে শিখেছেন সংগীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে। কিন্তু ম্যাজিক শেখার ক্ষেত্রে এমন কোনও গুরুসঙ্গ তাঁর করা হয়নি। ছোটবেলায় ঢাকা শহরেই দেখেছিলেন ‘রয় দ্য মিষ্টিক’-এর জাদু প্রদর্শন (১৯২৬ সাল)। সেই সন্ধের কথা সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি। আর বাড়ির পুরনো কাগজপত্রের ভেতর হঠাৎই পেয়েছিলেন, ‘গ্যাম্যাজিক’ ক্যাটালগ। সেখানে দেখা মিলল ডেভিড ডেভান্ট আর হ্যারি হুডিনিদের। ম্যাজিকের নেশা পেয়ে বসল তাঁকে, ‘ডাকযোগে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত হলাম পূর্বোল্লিখিত গ্যামাজ কোম্পানির যাদুবিভাগের সঙ্গে এবং পরে লন্ডনের আরো দু’টি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে— হ্যামলি ব্রাদার্স এবং ড্যাভেনপোর্ট লিমিটেড— যাদের ছিল শুধু যাদু নিয়েই কারবার । যাদু-সাহিত্যে এবং যাদু-সংক্রান্ত অনেক কিছুতে আমার পড়ার ঘর ভরে উঠতে লাগলে!’

সুতরাং, ম্যাজিক বিষয়ে তাঁকে কিছুটা স্বশিক্ষিতই বলা চলে। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে লাগল এই দুই শিল্পের চর্চা। দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন প্রকাশিত হয় জাদুবিষয়ক প্রথম রচনা। বছরচারেক যেতে-না-যেতে, লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ‘দ্য ম্যাজিসিয়ান মান্থলি’ পত্রিকায় লিখলেন জাদু নিয়ে মৌলিক প্রবন্ধ। সেই লেখা পৃথিবীর জাদুমহলের অনেকেরই চোখে পড়ে।

আসলে রেওয়াজ, তালিম, কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠার পথ ধরে যুগপৎ চলতে থাকল সংগীত আর ম্যাজিকের চর্চা। তাঁর ‘যাদু-কাহিনী’ আর ‘ওস্তাদ কাহিনী’-র মধ্যে এই সাদৃশ্যের জায়গা যেন বারবার সামনে চলে আসে, অনেক ক্ষেত্রে ‘যাদু-কাহিনী’ পড়তে-পড়তে মনে হয়, বুঝি পড়ছি ‘ওস্তাদ কাহিনী’। যেমন ধরুন, অজিতকৃষ্ণকে একটি আলাপচারিতায় ‘রয় দ্য মিষ্টিক’ বলেছিলেন একটি গল্প— “ইংল্যাণ্ডের অদ্বিতীয় যাদুকর ডেভিড ডেভাণ্ট-এর কাছে একজন শৌখিন যাদুকর গিয়েছিলেন তালিম নিতে। ডেভাণ্ট তাঁকে প্রশ্ন করলেন ‘আপনি ক’টা খেলা জানেন?’ ভাবী শিষ্য জবাব দিলেন ‘শ তিনেক।’ ডেভাণ্ট চোখ কপালে তুলে, মহাবিস্ময়ের ভান করে বললেন, ‘সর্বনাশ!!! বলেন কি? আমি তো জানি মাত্র ডজন খানেক।’ বুঝলেন তো কথাটার মানে?”

অলৌকিক রহস্যময় শক্তিকে জাদু হিসেবে দেখা থেকে, ক্রমেই জাদুকে লৌকিক মনোরঞ্জনের এলাকায় নিয়ে আসা— এই বিবর্তনই হল জাদুর আধুনিক ইতিহাস। আর ঠিক এই কাজটিই করেছেন অ.কৃ.ব. তাঁর বইয়ে। বাংলা ভাষায় এমন বই তখনও লেখা হয়নি। সারা পৃথিবীর লৌকিক জাদুকরদের অলৌকিক দক্ষতার কথা তিনি বলে গেছেন বই জুড়ে।

এর পাশে রাখতে চাই, ‘ওস্তাদ কাহিনী’ থেকে গুল মহম্মদ খাঁ-র বলা একটি অ্যানেকডোট। তানসেন তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু তিনি শুনতে পান আর এক অতুলনীয় গায়ক বৈজু-র কথা। তিনি থাকেন নিভৃতে, জঙ্গলের ভেতর। তানসেন চাইলেন নিজের কানে বৈজু-র গান শুনতে এবং বুঝে নিতে যে বৈজু কি তাঁর চেয়েও বড় গায়ক! জঙ্গলে গিয়ে দেখেন, এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে বৈজু শুধু গান্ধারে সুর লাগিয়েই চলেছেন। তারপর যে-কথাটা বৈজু বললেন, তাঁর সঙ্গে অনায়াসে মিলিয়ে নেওয়া যায় ডেভিড ডেভান্টের কথাগুলো। তানসেনকে বৈজু বললেন যে, তিনি ছত্রিশ বছর ধরে শুধু গান্ধারেই সুর লাগিয়ে চলেছেন কিন্তু এখনও সে-সুর তাঁর রপ্ত হল না। অর্থাৎ, সাত সুরের তৃতীয় সুরেই তিনি আটকে আছেন।

আব্দুল করিম খাঁ

অলৌকিক রহস্যময় শক্তিকে জাদু হিসেবে দেখা থেকে, ক্রমেই জাদুকে লৌকিক মনোরঞ্জনের এলাকায় নিয়ে আসা— এই বিবর্তনই হল জাদুর আধুনিক ইতিহাস। আর ঠিক এই কাজটিই করেছেন অ.কৃ.ব. তাঁর বইয়ে। বাংলা ভাষায় এমন বই তখনও লেখা হয়নি। সারা পৃথিবীর লৌকিক জাদুকরদের অলৌকিক দক্ষতার কথা তিনি বলে গেছেন বইজুড়ে। সেখানে যেমন আছে ডেভিড ডেভান্ট, হ্যারি হুডিনি, ফরাসি জাদুকর উদ্যাঁ কিংবা চিনের চুং লিং সু, তেমনই আছেন, ‘রয় দ্য মিষ্টিক’ রাজা বোস (আসল নাম রিপেন বোস), গণপতি চক্রবর্তী, সিনিয়র পি সি সরকার। পাশ্চাত্যের কথা যখন বলছেন, তখন তার মূল সুর হল জাদুর অভিনবত্ব, অভাবনীয় সব কৌশল আর চোখধাঁধানো পরিবেশন; কিন্তু যখন তিনি বলেন দেশীয় জাদুকরদের কথা, তখন তাঁর লেখায় এসে লাগে দর্শনের ছোঁয়াচ, বিশ্বের দরবারে নিজেদের মেলে ধরার কাহিনি।

‘ওস্তাদ কাহিনী’-র একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তাঁর ছেলেবেলার ঢাকা, তাঁর গুরু গুল মহম্মদ খাঁ-র স্মৃতি। এই স্মৃতি ধরে একে-একে আসতে থাকেন ফৈয়াজ খাঁ, আবদুল করিম খাঁ থেকে কেসরবাই কেরকর, হীরাবাই বরোদেকর, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, জ্ঞান গোঁসাই, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। মোটামুটি ঢাকা থেকে কলকাতার মধ্যেই তাঁর ঘোরাফেরা। ম্যাজিকের কথায় যিনি ঘুরে আসেন সারা পৃথিবী; সংগীতের কথায় তিনি একেবারেই ডানা মুড়ে বসে থাকেন, বুড়িগঙ্গা আর কলকাতার গঙ্গার ধারে।

দু’টি বইয়ে এত চমকপ্রদ সব কাহিনি ছড়িয়ে আছে যে, এই ছোট পরিসরে তা বলা অসম্ভব, এমনকী, উল্লেখটুকুও সম্ভব নয়। এমন মজলিশি মেজাজ তাঁর গদ্যে, সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না এই অ.কৃ.ব.-র হাত থেকে। ‘যাদু-কাহিনী’ কিংবা ‘ওস্তাদ কাহিনী’-র মতো লেখা তখন বিরল। একদিকে যেমন আছে হুডিনির অহংকার ঝেড়ে ফেলে ‘মিল্ক ক্যান এসকেপ’-এর মতো ম্যাজিক উদ্ভাবন করে ফিরে আসার বর্ণনা, তেমনই আছে কলকাতায় মৌজুদ্দিন খাঁ-র ঠুংরি শুনে যুবক ফৈয়াজ খাঁ-র গর্ব নিমেষে মাটিতে মিশে যাওয়ার প্রসঙ্গ— ‘গান গেয়ে অনেক চমক লাগিয়েছি, অনেক বাহবা, তারিফ, হাততালি পেয়েছি, কিন্তু গান শুনিয়ে এমন করে তো কখনো কোনো শ্রোতার চোখে আঁসু বহাতে পারিনি।’

অ.কৃ.ব.-র এই জোড়া কাহিনি যেন মৌজুদ্দিন খাঁ-র ঠুংরি, অনেক ক্ষেত্রে আবেগ সংবরণ করা মুশকিল হয়ে যায় পাঠকের পক্ষে। খুব ইচ্ছে করে, এই বইদুটোর নাম ঈষৎ বদলে দিতে, সামান্য অদলবদল করে নাম দেওয়া যায় ‘ওস্তাদের যাদুকাহিনী’ আর ‘যাদু-ওস্তাদের কাহিনী’, আসলে জাদু হোক বা সংগীত— এই জোড়া বইয়ের আসল ওস্তাদ, জাদুকর অজিতকৃষ্ণ বসু ওরফে অ.কৃ.ব.।