চেহারা
নীলাব্জ: এত সকালে হন্তদন্ত হয়ে চললে কোথায়?
নীলা: উফ! আবার কোথা থেকে উদয় হলে?
নীলাব্জ: পিঠে ওটা কীসের ব্যাগ?
নীলা: তোমার কী? যাও না নিজের কাজে।
নীলাব্জ: আজকে সন্ধে অব্ধি কাজ নেই, ভাবলাম একটু ঘুরে বেড়াই।
নীলা: আর জায়গা নেই ঘোরার এত বড় শহরে?
নীলাব্জ: আহ্, রাগ করছ কেন? জিমে যাচ্ছ নাকি?
নীলা: হ্যাঁ যাচ্ছি! শান্তি? এবার বিদেয় হও তো!
নীলাব্জ: বাহ্! জিমে যাওয়া তো খুব ভাল, তাই না?
সিনেমায় কি শেষ কথা বলবে বক্স অফিস নম্বরই? পড়ুন ‘নীলা-নীলাব্জ’-র আগের পর্ব…
নীলা: জানোই যখন, তাহলে প্রশ্ন করছ কেন?
নীলাব্জ: না, মানে তুমি জিমে কেন যাচ্ছ?
নীলা দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘জিমে মানুষ কেন যায়? আড্ডা মারতে? না চ্যাংড়ামি করতে?’
নীলাব্জ একটু নরম হয়ে, ‘না, সে আমি জানি। আমি বলছিলাম যে তুমি তো বেশ ফিটফাটই আছ, তোমার আবার জিমের…’
নীলা: সুস্থ থাকতে গেলে শরীরের দিকে নজর দেওয়াটা দরকার।
নীলাব্জ: অবশ্যই, অবশ্যই! তুমি তো বেশ সুস্থ জীবনযাপনই করো, ভাল খাবারদাবার খাও।
নীলা: কিন্তু তাও পেটে চর্বি জমছে…
নীলাব্জ: সে মানুষের পেটে একটু মেদ তো থাকবেই…
নীলা: না, থাকবে কেন? দেখতে বিচ্ছিরি যাতে লাগে?
নীলাব্জ: মেদওয়ালা মানুষ কুৎসিত আর মেদহীন মানুষ সুন্দর? এই বলতে চাইছ তুমি?
নীলা: অবশ্যই। আদর্শ চেহারা মেদহীন হওয়া উচিত। নায়ক-নায়িকাদের দেখো, গণেশ ছাড়া বাকি দেব-দেবীদের দেখো, যিশুকে দেখো, আদম-ইভকে দেখো। সুন্দরকে কল্পনা করলে মানুষ মোটা কল্পনা করে না।
নীলাব্জ: অর্থাৎ তুমি জিমে আরও সুন্দর হতে যাচ্ছ!
নীলা: স্বাস্থ্য ভাল রাখতে এবং তার সঙ্গে অবশ্যই নিজেকে সুন্দর রাখতে যাচ্ছি। হ্যাপি? এবার তুমি জাহান্নমে যাও আর আমাকে বিরক্ত করো না।
নীলাব্জ: না, নীলা এক সেকেন্ড। একটা জিনিস তুমি বললে, যেটা আমাকে হঠাৎ একটু ভাবাচ্ছে। তুমি সুন্দর কেন হতে চাও?
নীলা: এটা কী ধরনের বাজে প্রশ্ন? কে চায় না সুন্দর হতে? তুমি নিজে চাও না?
নীলাব্জ: চাওয়ার আগে প্রশ্ন করতে চাই, কেন সুন্দর হব?
নীলা: কারণ এই পৃথিবীতে হাজার-হাজার সাধারণ চেহারার মাঝে আমি হারিয়ে যেতে চাই না। যাতে লোকের চোখে পড়ি।
নীলাব্জ: তার মানে তুমি বলতে চাইছ পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই অসুন্দর। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে তুমি এলে কোন ভিত্তিতে?
নীলা: অসুন্দর শব্দটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল, তুমি অ্যাভারেজ বা সাধারণ বলতে পারো। কথায় আছে, পেহলে দর্শনধারি ফির গুণ বিচারি। আমাকে নিজেকে ফিটফাট, ঝাঁ-চকচকে করে রাখতে হবেই।
নীলাব্জ: বুঝলাম, কিন্তু আমি জানতে চাইছি ভিত্তিটা কী? কী দিয়ে বিচার করছ সৌন্দর্য? চোখ, নাক, উচ্চতা, ওজন, গায়ের রং?
নীলা: গ্রিক দেবতাদের ছবি দিয়ে।
নীলাব্জ: কিন্তু তারা তো কাল্পনিক দেবতা। মানুষ তো নয়!
নীলা: কিন্তু দেবতার কল্পনা তো মানুষই করেছে, নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে। এটাই হতে চায় মানুষ।
নীলাব্জ: কিন্তু গ্রিক মানে তো সাদা চামড়া, লম্বা, টিকালো নাক আর তুমি পাঁচ ফুটের রোদে পোড়া, বোঁচা নাক, খসখসে চামড়ার বাঙালি হয়ে এসব কী করে করবে?
নীলা: এই নিয়েই যতদূর যাওয়া যায়। তাতেও তো বুক, কোমর, পশ্চাৎদেশ কারেক্ট মাপের হলে তোমরাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। কী? তাকিয়ে থাকবে না?
নীলাব্জ হেসে ফেলে, ‘কিন্তু আমার তাকানোতে তোমার কী?’
নীলা: ওমা! তোমার তাকানোতেই তো সব। কলেজে ভাইভার দিন আয়নাতে একটু নিজেকে দেখে যেতাম। স্যারেদের সঙ্গে একটু নরম ভাবে কথা বললেই, ঢেলে নম্বর দিত। এখনও অফিসের মিটিং-এ সুবিধে হয়। মেয়েদের প্রোমোশন হলে এমনিতেও সবাই বলে রূপ দেখিয়ে প্রোমোশন হয়েছে, কাজের কথা কেউ বলে না। তাই যদি তোরা বলবি, তাহলে দেখ! তোরা রূপ-ই দেখ।
নীলাব্জ: তার মানে তোমার যুক্তি হল সৌন্দর্য তোমাকে কর্মজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবন, দুই জায়গাতেই ফায়দা এনে দিচ্ছে তাই তুমি দিন-দিন আরও সুন্দর হতে চাইবে।
নীলা: আমাদের ইঁদুরদৌড়ে একটু এগিয়ে থাকার জন্য জিমে-টিমে যেতে হবে বইকি।
নীলাব্জ: তোমার কথা অনুযায়ী রোনালডিনহো খারাপ দেখতে, ওর কিছুই হওয়ার নয় জীবনে।
নীলা: বোকার মতো কথা বোলো না তো! রোনালডিনহো একজন ফুটবলার এবং অস্বাভাবিক ট্যালেন্টেড। ওর চেহারা যথেষ্ট অ্যাথলেটিক। তাছাড়া মানুষ ওর খেলা দেখে ওকে সম্মান করে। তুমি কি বলছ মেসি খারাপ দেখতে হলে কিছু হত না ওর?
নীলাব্জ: এই তো, এবার পথে এসো। তার মানে আসল হলো মেধা। রূপ তার অনেক পরে আসে। ঠিক কি না? তোমার জীবনে সাফল্য চাইলে নিজের মেধার উপর জোর না দিয়ে বাইরে সৌন্দর্যর দিকে কেন ঝুঁকছ?
নীলা: আরে বাবা, ওই ট্যালেন্টের সঙ্গে আমাদের তুলনা? আমি সাধারণ, আমি অত ট্যালেন্ট নিয়ে জন্মাইনি। সারা জীবন ঘষলেও আমার ওরকম কিছু হবে না।
নীলাব্জ: হাল-ই ছেড়ে দিলে?
নীলা: হাল ছাড়ার ব্যাপার নয় নীলাব্জ, তুমি এঁড়ে তর্ক করছ। সবাই জানে নাসিরুদ্দিন শাহ্ দারুণ অভিনেতা, তাহলে নায়কের রোলে কেউ নেয় না কেন? তার জায়গায় একটু খারাপ অভিনয় করে কিন্তু দেখতে ভাল, তাকে কেন নেওয়া হয়?
নীলাব্জ: সে তো পাবলিক ক্যাবলা, নকল হিরোগিরি দেখতে চায় বলে। পাবলিক কি এত অভিনয় বা কোনও সূক্ষ্ম জিনিসের তফাত বুঝতে পারে?
নীলা: হ্যাঁ, মানুষ সুন্দর মুখের খারাপ অভিনয় সহ্য করবে কিন্তু সাধারণ মুখের ভাল অভিনয় দেখতে চাইবে না। পরিষ্কার?
নীলাব্জ: তার মানে দুনিয়ার শো বিজনেসে তুমিও ঢুকে পড়েছ। পুরোটাই লোক দেখানো। মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য আমি হতে পারলাম, এটার প্রতিযোগিতা?
নীলা: আমাদের ইঁদুরদৌড়ে একটু এগিয়ে থাকার জন্য জিমে-টিমে যেতে হবে বইকি।
নীলাব্জ: তোমার কথা অনুযায়ী রোনালডিনহো খারাপ দেখতে, ওর কিছুই হওয়ার নয় জীবনে।
নীলা: বোকার মতো কথা বোলো না তো! রোনালডিনহো একজন ফুটবলার এবং অস্বাভাবিক ট্যালেন্টেড। ওর চেহারা যথেষ্ট অ্যাথলেটিক। তাছাড়া মানুষ ওর খেলা দেখে ওকে সম্মান করে। তুমি কি বলছ মেসি খারাপ দেখতে হলে কিছু হত না ওর?
নীলা: এত জটিল কোরো না, আমি শুধু আমার চলার পথটাকে আর একটু সহজ করতে চাই। দুটো মানুষ আমার দিকে ঘুরে তাকালে, আমার ভালই লাগে। কনফিডেন্স পাই। আর শুধু মুখটুকু দিয়ে নয়, পুরো শরীর এবং নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়েই প্রকাশ পায় মানুষের সৌন্দর্য।
নীলাব্জ: দেখো, মানুষের বাইরের সৌন্দর্য এক রকম আর ভেতরটা কিন্তু আলাদা। একটা দারুণ দেখতে মানুষের কুৎসিত মন তো হতেই পারে, তাই না? তাহলে কোন জিমে গেলে সে তার ভেতরটাও সুন্দর করতে পারবে?
নীলা: লাইব্রেরি বা ধ্যানের আশ্রম টাইপের কোথাও। কিংবা মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে, কত জায়গা আছে। আমি এত জানি না।
নীলাব্জ: তোমার নিজের ইচ্ছে করে না তোমার ভেতরটা সুন্দর করতে?
নীলা: ন্যাকা-ন্যাকা কথা বোলো না তো! কে তুমি হরিদাস পাল? আমার বিবেক?
নীলাব্জ: নিজের কাছে নিজে সুন্দর, সেটার কি কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই?
নীলা: শোনো, মানুষের ভিখিরিকে পয়সা দিতে ভাল লাগে কিন্তু সেটা ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করতে আরও ভাল লাগে। আমি দশটা খুন করে এসেও যদি আদালতে বেকসুর খালাস হই আর পাবলিক মনে করে আমি খুনগুলো করিনি, তবে সেটাই সত্যি। সুতরাং আমার পথ ছাড়ো, আমাকে জিমে যেতে দাও।
নীলাব্জ: না নীলা, মানুষ অন্যায় করলে একদিন সে নিজে ঠিক বুঝতে পারে। সারাজীবন যন্ত্রণায় ছটফট করে। কাউকে একটা বলে হালকা হতে চায়। পালাতে পারে না সেই অপরাধবোধ থেকে। কেউ ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে, কেউ আত্মঘাতী হয়, আবার কেউ উন্মাদ হয়ে যায়।
নীলা: কিছু মানুষের ক্ষেত্রে হয়তো সত্যি কিন্তু পৃথিবীর রাষ্ট্রনেতাদের দেখে তো আমার তা মনে হয় না। নিজের প্রয়োজনে যা খুশি তাই করো আর সব সাক্ষী মুছে দাও। অপরাধ যদি প্রমাণই না করা যায়, তাহলে সেটা কীসের অপরাধ? অর্থাৎ পাবলিকের চোখের সামনে আমি পরিষ্কার। অন্য মানুষ বা জনগণের আদালত কী মনে করল, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।
নীলাব্জ: কিন্তু সার্ত্র যে বলে গেছেন, ‘হেল ইজ আদার পিপল!’
নীলা: সকাল-সকাল সার্ত্র-মাত্র সব শুরু কোরো না তো, আমাকে যেতে দাও।
নীলাব্জ সামনে থেকে সরে যায়। নীলা হনহন করে জিমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী