ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঢাকা ডায়েরি: পর্ব ১


    পিয়াস মজিদ (February 14, 2021)
     
    কাফকা, খোলা হাওয়া

    একুশে বইমেলার শেষে ফি-বছর ঘুরতে যাই ঢাকার বাইরে; হয় কলকাতায়, নয় কক্সবাজারে। ২০২০-এর ৮ মার্চ কক্সবাজারে যাওয়ার তোড়জোড়ের মধ্যেই খবর এল— বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী। সব জায়গায় হুলস্থুল কাণ্ড। কাজ করি ঢাকার বাংলা একাডেমিতে। আমার প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বরেণ্য আনিসুজ্জামান। সেদিনই অফিসে একটি অনুষ্ঠানে এলেন তিনি। আর একটি টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কারণে, আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে হওয়া অনুষ্ঠানটিতে থাকা হল না আমার। তখন কি জানতাম, আর কখনওই আনিসুজ্জামানের কোনও কথা সামনাসামনি শুনতে পাব না! করোনার প্রকোপ বাড়লে অন্য অসুস্থতার সঙ্গে করোনা উপসর্গ নিয়ে ১৪ মে অনন্তবাসী হলেন তিনি। এর পর তাঁর সঙ্গে আলাপ চলবে কেবল বইয়ের সূত্রে— ‘স্বরূপের সন্ধানে’ থেকে ‘ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’ কিংবা ‘কাল নিরবধি’ থেকে ‘বিপুলা পৃথিবী’। শোকস্তব্ধ সবাই। 

    তবুও, ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাচ্ছি যখন বন্ধুদের সঙ্গে, তখনও তেমন করে আঁচ পাইনি, করোনা কতটা কামড় বসাতে চলেছে সুস্থ-স্বাভাবিক বর্তমানের বাহুতে! রাষ্ট্রীয় শঙ্কা কিছুটা অবশ্য অনুমান করা গেল, যখন বছরব্যাপী বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত ‘মুজিববর্ষ’-র উদ্বোধনী আয়োজনে কাটছাঁট এনে প্রায় স্থগিত করা হল। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে তবু পর্যটকের ভিড়। আর আমার মনে একবার গুঞ্জরিত হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ‘কক্সবাজারে সন্ধ্যা’, আর একবার অজানা আশঙ্কা জাগে। শেষে ভ্রমণ সংকুচিত করে, জন্মশহর চট্টগ্রাম হয়ে, ঢাকায় আবার।

    প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নেতিবাচক খবর আসে। মার্চের শেষাশেষি হঠাৎ একদিন অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসে। 

    বাজারে যাই জরুরি কেনাকাটা সারতে। ও মা, এ যেন যুদ্ধাবস্থা বা কারফিউ-কবলিত নগরীর চেহারা! যে যেভাবে পারছে আসন্ন আগামীকে নিজ পরিবারের জন্য সুসহ রাখতে, রীতিমতো মজুতদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ।

    আমি বাড়িতে ঢুকি। সবাই ঢুকে পড়ে। মুহূর্তে মনে পড়ে, বহুকাল আগে পড়া কাফকার ‘পেনাল কলোনি’র কথা। আমরা প্রত্যেকে যেন এক-একটা গ্রেগর সামসা, লোক মানে পোক। তখন কে জানত, শ্বাসচাপা সুদীর্ঘ সময়ের এ এক শুরুয়াৎ!

    বন্দিপ্রহরে অভিধান যেন আয়তন বাড়ায় তার। হ্যাঁ, আমাদের শব্দকোষে যোগ হওয়ার অপেক্ষায় উচ্চারিত হতে থাকে— ‘লকডাউন’, ‘কোয়ারেন্টাইন’, ‘সীমিত আকারে’, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ কিংবা ‘ওয়েবিনার’। টেলিভিশন হয়ে যায় স্বাস্থ্য-বুলেটিন প্রচারের মাধ্যম। 
    এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। প্রতিবেশী ভারতসহ সারা পৃথিবীর সঙ্গে আসা-যাওয়ার যোগাযোগ বন্ধ, সে-সব দেশেও একই অবস্থা। বিশ্বব্যাপী মেলা, সম্মেলন, পরীক্ষা স্থগিত বা বাতিলের মহড়া।

    স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দফায় দফায় বন্ধ হলে চালু হল ‘অনলাইন ক্লাস’ নামের নতুন শিক্ষা-বাস্তবতা। এ অবস্থা এখন অবধি চলছে। আরও কিছুকাল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ সংযোগবিহীন ক্লাসপরীক্ষা এক অশনি সংকেত হয়ে দেখা দেবে নিঃসন্দেহে। এখনই তো, অনেক শিশু-কিশোর পড়াশোনার জন্য ঘরের বাইরে পা ফেলার আগ্রহ হারাতে শুরু করেছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ফিরে আড্ডামুখর সময় কাটানোর জন্য হাঁসফাঁসও করছে বাংলাদেশের তারুণ্য।

    দেখতে দেখতে এতকালের চেনা পৃথিবী পাল্টে যাচ্ছে ভীষণ। কত মানুষ চাকরি হারালেন, কতজনের ব্যবসা লাটে উঠল। বাড়িতে পত্রিকা রাখা একটা বিলাসিতা বলে ঠেকল। মাসিক পত্রিকা দ্বিমাসিক হয়ে গেল। একগুচ্ছ পত্রিকার পরিকল্পিত ঈদসংখ্যার প্রকাশ বাতিল হল। প্রত্যক্ষ বই বিকিকিনির ঘাটতি অবশ্য মিটিয়ে দিল অনলাইনে বই বেচাকেনার নানা উদ্যোগ। অনেক প্রকাশক চিরাচরিত পেশা ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমালেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর একসঙ্গে এত লোক মনে হয় না কেন্দ্র ছেড়ে প্রান্তবাসী হয়েছেন। কেন্দ্র-প্রান্তের সম্মিলন ও সংঘর্ষ— উভয়ই সমান সত্য খবর হয়ে দেখা দিতে লাগল।

    মানুষ বড় কাঁদছে। কুকুরও বড় কাঁদছে। মানুষের পাশে দাঁড়ায় যে মানুষ, সে আবার কুকুরের পাশেও দাঁড়ায়। করোনায় সবকিছু বন্ধ হওয়ার বিরূপ পরিস্থিতিতে, হোটেল-রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়া কুকুরদের হঠাৎ খাদ্যহীন দুর্ঘটে, ঢাকার স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা বিশেষ ব্যবস্থায় রান্না করে কুকুরদের খাওয়ান। সে খবর প্রমাণ করে, যে ঢাকার রাজপথ ১৯৪২ সালে সোমেন চন্দের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, আজ এত বছর পর যেন সে রক্তের অক্ষর সহানুভূতির স্বর সঞ্চার করছে ঢাকাই তরুণদের মাঝে।

    অন্যদিকে রাজধানী থেকে কুকুর তাড়ানোর কর্পোরেশনীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিনেত্রী জয়া আহসান সহ সচেতন নাগরিকদের সোচ্চার অবস্থান, প্রচার, এমনকী মামলা প্রমাণ করে— এখনও জারি আছে আলোর ইশারা। করোনা কাবু করতে পারেনি জীবনের জারি থাকা।

    তবু জীবন থেকে মরণের ডাকে চলে গেলেন কত কে! ২০২০-এর ঢাকা মানে অবরুদ্ধ অশ্রুর উৎসব। আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, আশরাফ সিদ্দিকী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কামাল লোহানী, সাঈদা আহমদ, মনজুরে মওলা, আবুল হাসনাত, রাহাত খান, রশীদ হায়দার সহ সীমান্ত-পেরনো স্বজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, অরুণ সেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অমলাশঙ্কর, শম্ভু রক্ষিত থেকে শুরু করে ইরফান খান-সুশান্ত সিং রাজপুত বা একটু দূর-ভূগোলের কিন্তু চলচ্চিত্র-আত্মার নিকটস্বজন কিম কি দুক-এর চলে যাওয়া আমাদের বিদ্ধ করেছে ভীষণ। সবচেয়ে করুণ কথা হল, করোনার কারণে এঁদের অনেকের মৃত্যুর পর শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অতি স্বাভাবিক পর্বগুলোও সমাধা হতে পারেনি। গোরস্তানে-শ্মশানে নীরব মৃত্তিকালেপন আর অগ্নিসংযোগ যেন আমাদের গৃহবন্দি শোকের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

    তবু মানুষের বসতি আশায়। তাই জোর গতিতে ঢাকায় চলছে মেট্রোরেল স্থাপনের কাজ। একটু দূরে পদ্মানদীতে সেতু তৈরির কাজও সম্পন্নের পথে। প্রায় বছরকাল বহিঃযোগাযোগ-হ্রাসমান বাস্তবে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগশীলতার প্রয়োজনীয়তা যেন মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে ঢাকা ও বাংলাদেশ। তাই এসব নির্মাণ-প্রয়াস নিয়ে উৎসাহ অনন্ত। আর সকলেরই বিশেষ আগ্রহ ও অপেক্ষা এখন একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে। সবাই এখন চাইছে কাফকার গ্রেগর সামসার মতো গুমোট অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে, বসন্তের খোলা হাওয়া অনুভব করতে। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook