নাম বলছেন কেন, বদনাম বলুন!
কেন কে-জানে, পাশ্চাত্যে বড় বদনাম এই রঙের। সবুজ। শেক্সপিয়রের নাটকে ঈর্ষাকে বর্ণনা করা আছে এক সবুজ চোখের দৈত্য হিসেবে। প্রাচীন গ্রিসেও এই ধারণা ছিল যে, ঈর্ষাকাতর মানুষের চামড়ার রং ধীরে ধীরে সবুজাভ হয়ে যেতে থাকে। প্রবল ঈর্ষায় নাকি মানুষের শরীর থেকে পিত্তরস বেশি বেশি করে নির্গত হয়, তারই পরিণামে অমন সবুজপানা চেহারা দাঁড়ায়। ঈর্ষার রং তাই সবুজ।
অবশ্য, এই-যে বললুম পাশ্চাত্যের কথা, এটা পুরোপুরি সত্যি নয়। সে বদনামের ঢেউ সাগর পেরিয়ে এদেশের তটে এসেও লাগে। বাঙালি কথাসাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এক সুখপাঠ্য গোয়েন্দা কাহিনির কথা মনে পড়বে কারও কারও। তার নাম ‘ঈর্ষার সবুজ চোখ’। আপাতত শুধু এইটুকু খেয়াল করার যে, সেই কাহিনি শেষ হয় অব্যর্থভাবে ঈর্ষাজর্জর ওথেলোর উদ্দেশে বলা ইয়াগোর সেই সংলাপটিকে উদ্ধৃত করেই, ‘O, beware, my lord, of jealousy; it is the green-eyed monster which doth mock the meat it feeds on…’।
আরও পড়ুন : বাঙালির নিজস্ব হিংসের রং কি সবুজ? ‘এবড়োখেবড়ো রং’-এ লিখলেন চন্দ্রিল ভট্টাচাৰ্য…
তবে কিনা এই নদীবিধৌত বঙ্গদেশে এই বদনামটুকুর জিতে যাওয়া খুব শক্ত, মহামতি শেক্সপিয়রের সার্টিফিকেট সত্ত্বেও, শক্ত। বাংলা ভাষার যিনি মহত্তম কবি তিনি লিখে রাখেন, ‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে!/ হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে।’ আমরা এক সবুজ-রঙা দেশের বাসিন্দা, সবুজ রং তাই আমার অস্তিত্বেরই অংশ।
রবীন্দ্রনাথের কথায় মনে পড়ল অন্য এক প্রসঙ্গ। ১৯১৪ সাল নাগাদ নতুন এক পত্রিকা বেরনোর তোড়জোড় চলছে। কী নাম দেওয়া যায় সেই আসন্ন-প্রকাশ পত্রিকার? রবীন্দ্রনাথই প্রস্তাব করলেন, নাম দাও ‘কনিষ্ঠ’। অবশ্য অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদল হল। ১৯১৪ সালের ৫ মার্চ পত্রিকা-সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘সবুজপত্র উদ্গমের সময় হয়েছে— বসন্তের হাওয়ায় সে কথা চাপা রইল না…।’
কিন্তু কেন সে-পত্রিকার নামে জুড়ে গেল সবুজ রং? প্রথম সংখ্যায় তার বিস্তারিত কৈফিয়ত দিলেন সম্পাদক নিজে। সেইখানে নানা বিষয়ের মধ্যে দুটো চমৎকার কথা খেয়াল করিয়ে দিলেন তিনি। প্রথমত তিনি বললেন, আমাদের দেশে বর্ণবৈচিত্রের কোনও অভাব নেই বটে, কিন্তু সবুজ তার মধ্যমণি। সবুজ শুধু বাংলার দেশজোড়া রং নয়, বারোমেসে রং। ‘মাধব হতে মধু পর্যন্ত ওই সবুজের টানা সুর চলে’, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সুরের যে-টুকু বদল ঘটে, সে শুধু কড়ি আর কোমলের বদল। অখণ্ড হরিৎ ভাবটিই এ-দেশের স্থায়ীভাব। আর, দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে, সাদা রং প্রিজমের মধ্যে দিয়ে গিয়ে যখন নানা বর্ণালিতে ভেঙে যায়, তার ঠিক মধ্যিখানের রং-টাকে খেয়াল করে দেখুন: সবুজ! যেমনটি হয় রামধনুতে। এই দেখাটাকে ধরিয়ে দিয়ে দুটো আশ্চর্য বাক্য লিখলেন প্রমথ চৌধুরী, ‘তার দক্ষিণে নীল আর বামে পীত, তার পূর্ব্ব সীমায় বেগুনী আর পশ্চিম সীমায় লাল। অনন্ত ও অন্তের মধ্যে, পূর্ব্ব ও পশ্চিমের মধ্যে, স্মৃতি ও আশার মধ্যে মধ্যস্থতা করাই হচ্ছে সবুজের, অর্থাৎ সরস প্রাণের স্বধর্ম্ম।’
এই এক গুরুত্বপূর্ণ কথায় এসে পৌঁছলাম আমরা অবশেষে। সরস প্রাণ। যে প্রাণের ভেতর রসের প্রবর্তনা ফুরিয়ে যায়নি তারই রং সবুজ।
কী বৈশিষ্ট্য সেই সরস প্রাণের? তাকে চিনব কেমন করে? তার উত্তর আছে ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বেরনো রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতায়, ‘সবুজের অভিযান’। সবুজের বৈশিষ্ট্য এই যে, সে ভুল করতে ভয় পায় না। সে প্রচণ্ড, প্রমত্ত, প্রমুক্ত। যারা এই মুক্তিকে ভয় পায়, আলোকে ভয় পায় তারা সবুজকেও সহ্য করতে পারে না। চিরকালের লড়াই তাই সবুজে আর সবুজহীনতায়। ‘সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে/ শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে/ সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে/ লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।’
আজও কি চারপাশে তাকালেই টের পাওয়া যায় না যে, তেমনই লড়াই চলছে আসলে নিরন্তর?
কেমন হত যদি আমরা সবাই সবুজ মানুষ হতাম। আকাশে প্রত্যহ জেগে থাকা সূর্য নামের ওই চিরন্তন শক্তি-উৎস থেকেই আমাদের সব প্রয়োজন মিটে যেত? ‘কোই মিল গ্যায়া’ নামের হিন্দি ছবিটির ‘জাদু’-কে মনে আছে? তার গায়ের রং অবশ্য ঠিক সবুজই ছিল তা নয়।
২
জড়তার উল্টোদিকে দাঁড়ানো প্রাণস্পন্দনের রং সবুজ। এইটাই নিশ্চয় সবচেয়ে জরুরি কথা। কিন্তু তারপরে একটা-দুটো কথা রয়েই যায়। সাহিত্যের পাঠক হিসেবে বারবার নজরে আসে, কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিতে ভিনগ্রহের প্রাণীকে বারবার আঁকা হয়েছে ‘সবুজ মানুষ’ হিসেবে। সে হতে পারে ম্যাক রেনল্ডের লেখা ‘দ্য কেস অফ লিটল গ্রিন মেন’ কিংবা লুইস জারেমের ‘দ্য গ্রিন মেন ফ্রম স্পেস’। অথবা আমাদের ঘরের মানুষ, চারজন লেখক— যথাক্রমে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী এবং সত্যজিৎ রায়— একসঙ্গে লেখা একটি গল্প, তারও নাম হয়ে ওঠে, অনিবার্যভাবেই যেন, ‘সবুজ মানুষ’।
কেন এমন হল?
এর একটা স্থির উত্তর দেওয়া কঠিন। সকলেই যে ঠিক একইরকম করে ভেবেছেন, তা তো আর নয়। তাছাড়া, প্রথম কিছু উদাহরণের পর বিষয়টা খানিক রীতি বা প্রথা হিসেবে চলে গেছে, এমনটাও হওয়া অসম্ভব নয়। তবু এ-প্রসঙ্গে একটা বিশেষ উত্তরের দিকে এগিয়ে যেতে ভাল লাগে। আমাদের এই পৃথিবীর ইতিহাসে যে এত লড়াই, এত বিদ্বেষ, রাষ্ট্র আর জাতির মধ্যে এত সংঘাত, তার অন্যতম এক মূল কারণ এনার্জি (শক্তি)-র উৎসগুলির দখলদারিত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় হিটলার বলেছিল, বাকুর তৈলখনির দখল যদি না নিতে পারি, তাহলে এই যুদ্ধ আমাকে থামিয়ে দিতে হবে। এই সেদিনের উপসাগরীয় যুদ্ধের কথাও আমাদের মনে পড়বে। আসলে আদিম যুগ থেকেই কথাটা একইরকম রয়ে গেছে। আমরা নিজেরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় এনার্জি তৈরি করতে পারি না। গাছপালা থেকে কিংবা অন্য প্রাণীকে মেরে সেই এনার্জির সরবরাহ বজায় রাখতে হয়। ফলে, আমাদের সব হিংসার আদত কেন্দ্রে রয়েছে জমি, ক্ষেত, নদী, জঙ্গল, সমুদ্র অধিকারের প্রকাশ্য বা সংগুপ্ত আকাঙ্ক্ষা। জীবনানন্দের এক আশ্চর্য কবিতায় যেমন বলা ছিল: ‘মাঠের ফসলগুলো বার-বার ঘরে/ তোলা হ’তে গিয়ে তবু সমুদ্রের পারের বন্দরে/ পরিচ্ছন্নভাবে চ’লে গেছে।’ সমস্ত সাম্রাজ্যশক্তির ইতিহাসই কি এই তিনটে অমোঘ লাইনে ধরা পড়ে যায়নি?
কথাটা হল, কেমন হত যদি আমরা সবাই সবুজ মানুষ হতাম। আকাশে প্রত্যহ জেগে থাকা সূর্য নামের ওই চিরন্তন শক্তি-উৎস থেকেই আমাদের সব প্রয়োজন মিটে যেত? ‘কোই মিল গ্যায়া’ নামের হিন্দি ছবিটির ‘জাদু’-কে মনে আছে? তার গায়ের রং অবশ্য ঠিক সবুজই ছিল তা নয়। কিন্তু তার টিকে থাকা এবং তার যাবতীয় ক্রিয়ার সংগঠনের জন্য সূর্যের আলো ভিন্ন অন্য কিছুরই প্রয়োজন পড়ত না। ভাবতে ভাল লাগে, জাদুর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যশক্তির হুঙ্কার অনেক কম শোনা যায় হয়তো। কেমন হত, এই পৃথিবীর মানুষরাও, আমরা, তেমনই হতাম যদি? ক্লোরোফিল মানুষ। গায়ের রং সবুজ। সেই সবুজে আলো এসে পড়ে। সেই আলো মুছে দেয় অনেকখানি হিংসা, দ্বেষ, লোভ। অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়ার বর্বরতা।
আমরা সবুজ মানুষ নই। তাই ছিনিয়ে খেতে হয় আমাদের, অন্যকে মেরে খেতে হয়। কিন্তু কারও কারও বুকের ভিতর সবুজ বাঁচে। যেমন, ধরা যাক, শাহজাহান-দুহিতা জাহানারা। দিল্লিতে তাঁর ছিমছাম কবরটার পাশে গিয়ে যদি দাঁড়ান কেউ, আজও দেখতে পাবেন, সেখানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁরই লেখা একটা কবিতার কয়েকটা লাইন। সরল বাংলা গদ্যে যার মানে দাঁড়ায় এরকম: ‘আমার কবরে খানিক নরম ঘাসের আবরণ ছাড়া আর কোনও আচ্ছাদনের প্রয়োজন নেই। আমার মতো এক দরিদ্র ফকিরের কবর ঢাকা দেওয়ার জন্য ওই তৃণদলই যথেষ্ট।’
ঘাসের আচ্ছাদন খুব ঠান্ডা। সেখানে কোনও ভয় নেই, দ্বেষ নেই, ঘৃণা নেই। নিজেকে জগৎ-সংসারের প্রভু ভাবার অশ্লীলতা নেই। আকাশ আমাদের উদার হতে শেখায়, অন্তত শেখানোর কথা। ঘাসও আমাদের উদার হতে শেখায়। কিন্তু শেষ কবে আকাশের দিকে তাকিয়েছি? শেষ কবে খালি পায়ে হেঁটেছি সবুজ ঘাসের বুকে? রবীন্দ্রনাথের এক কবিতার সেই আর্তি মনে পড়ে, ‘চাহি সেই দিগন্তের পানে/ শ্যামশ্রী মূর্ছিত হয়ে নীলিমায় মরিছে যেখানে।’
আমাদের জীবনে সকল রং জেগে থাকুক, আর তার কেন্দ্রে থাকুক ওই শ্যামশ্রী। যেমন থাকে রামধনুতে।