ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • নীল আকাশের নীচে

    শ্রীজাত (March 14, 2025)
     

    ছবিটা প্রথম দেখেছিলাম মামার বাড়িতে, যখন আমার বয়স বছর দশেক। তখন গড়িয়াহাটের ফুটপাথের বইয়ের দোকানগুলোয় নানা ধরনের বইয়ের সমাহার থাকত। তার মধ্যে বিদেশি বইও কিছু কম ছিল না। একটু পুরনো হলে বেশ মনমতো দামে কেনা যেত সেসব। মামার অভ্যেস ছিল নিয়মিত বই কেনা এবং সেসব বইয়ের বিষয় ছিল বিবিধ। তবে একটি বিষয়ের বই কিনে আনতে কখনও ভুল হত না, তা হল ছবি আঁকা। নিজের সারা সময়ের গানবাজনার পাশাপাশি ছবি আর ভাস্কর্যে অনেকখানি মন দিতেন মামা, আর সেসব বিষয়ে নানা ধরনের বই জোগাড় করায় তাঁর জুড়ি ছিল না।

    তখন ‘The Great Artists’ নামের একখানা সিরিজ বেরোত, বিদেশেরই কোনও এক প্রকাশনা থেকে। বহরে পাতলা হলেও, সে-বইয়ের ছাপা ছিল দেখবার মতোই। পাতারা ছিল বেশ মোটা আর রীতিমতো চকচকে, সেইসঙ্গে নামী শিল্পীদের বিখ্যাত সব আঁকায় ভর্তি। সেসব ছবি ছাপা হত সম্পূর্ণ রঙিন এবং অবিকৃত অবস্থায়। এক-একটি বইয়ে এক-একজন শিল্পীর কাহিনি। একদিকে তাঁর জীবন, আঁকার শৈলী, এসব নিয়ে মনোজ্ঞ লেখা— অন্যদিকে পাতায়-পাতায় তাঁরই আঁকা সব ছবি। বিশেষ-বিশেষ ছবির ক্ষেত্রে কখনও পাতাজোড়া জায়গা, কখনও পাশাপাশি দু’পাতা জোড়া, যাকে আমরা ইংরেজিতে বলি ডাবল স্প্রেড। সেসব ছবি দেখে মাথা ঘুরে যেত আমার। এক-একটি বই থেকে যেন আবিষ্কার করতাম এক-একজন শিল্পীকে। কারও নাম মাতিস, কারও নাম দালি, আবার কারও নাম মোনে। এভাবেই সম্পূর্ণ অচেনা নামের একজন শিল্পী ওই বইয়ের লেখা আর ছবিদের মধ্য দিয়ে চেনা হয়ে উঠতেন আমার।

    The great artists
    ‘The Great Artists’ সিরিজের ভ্যান গঘ

    মামার বাড়িতে অনেকখানি সময় কাটত তখন। তবে একেবারে আমার নিজস্ব সময় ছিল দুপুরবেলাটা। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে ‘ভাতঘুম’ নামের একখানা মিঠে ব্যাপার তখনও চালু ছিল। সেইসব ঘুঘুডাকা নির্জন দুপুরে আমার কাজ ছিল বইয়ের তাক থেকে একের পর এক এই সিরিজের বইগুলো নামিয়ে এনে মেঝেয় ছড়িয়ে বসা। এরই মধ্যে একদিন দেখলাম, একটা বই নতুন। তাকে আগে দেখিনি। মলাটে একখানা ছবি, অয়েল পেইন্টিং, তাতে উত্তাল সমুদ্রে পালতোলা জাহাজ ভেসে চলেছে। দেখেই চোখ আটকে গেল। এতদিন ধরে এত শিল্পীর কাজ দেখছি, এরকম জ্যান্ত মনে হয়নি কারও ছবিকে। নীচে বড়-বড় রোমান হরফে শিল্পীর নাম লেখা, Vincent Van Gogh। মানুষের জীবন কত অপ্রত্যাশিত বাঁক নেয়, তখন বুঝিনি। বইয়ের মলাট সরিয়ে যখন ঢুকছি ভিতরে, বুঝিনি, একদিন এই শিল্পীর একের পর এক ক্যানভাস দেখার জন্য নানা দেশের নানা জাদুঘরে ছুটে বেড়াব, আর তাতেও শান্তি হবে না। এঁর গ্রাম, এঁর আস্তানা, এমনকী এঁর কবরের সামনে দাঁড়ানোর জন্য সুদূরের পাড়ি জমাব একাধিক বার। আর এই মানুষটিকে নিয়ে, এই আশ্চর্য শিল্পীকে নিয়ে লিখে ফেলব গোটা একটা উপন্যাস। তখন বুঝিনি, ওই চকচকে কাগজের মলাট আসলে বইয়েরই নয় কেবল, আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য পরিচ্ছেদেরও মলাট সে।

    বইয়ের ভেতর ঢুকলাম যখন, এক লহমায় বুঝতে পারলাম, এতদিন যত শিল্পীর আঁকা ছবি দেখেছি, এঁর কাজ তাঁদের সক্কলের চেয়ে অনেক-অনেক আলাদা। কেন যে আলাদা, তা কি আর তখন সেভাবে বুঝতে পেরেছি? হয়তো আজও পারিনি। কিন্তু রঙের ব্যবহার, দৃশ্যকে দেখার ও পরিবেশন করার দৃষ্টিভঙ্গি, তুলির বেপরোয়া এলোমেলো আঁচড়, শান্তির মধ্যেও এক সমাহিত অস্থিরতা, এই সব মিলিয়ে একেবারে অন্যরকমের এক ঘরানা। এগোতে-এগোতে একেবারে মাঝের দু’খানা পাতায় গিয়ে থমকে গেলাম। ডাবল স্প্রেড। তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা একটাই ছবি ছাপা। ‘The Starry Night’। প্রথমবার দেখছি আমি ছবিটা। তখনও জানি না, এ-ছবি পৃথিবীর জনপ্রিয়তম ক্যানভাসের একখানা, জানি না, অ্যাসাইলামে থাকাকালীন রাতের জানলায় চোখ রেখে এ-ছবি এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট, জানি না, এ-ছবি কোথায় টাঙানো আছে আর তাকে একবারটি দেখার জন্য কত কোটি মানুষ জমা হন এক বছরে, জানি না, এই ছবি নিয়ে কত কত গবেষণা আর গান তৈরি হয়েছে, এমনকী এও জানি না, জীবদ্দশায় নামমাত্র দামেও এর কোনও খদ্দের জোটেনি।

    আত্মপ্রতিকৃতিতে ভিনসেন্ট

    তখন কেবল অবাক হয়ে দেখছি ঘন নীল রাতের আকাশ। দেশি-বিদেশি আঁকিয়েদের ছবিতে আকাশ তো কম দেখিনি! কিন্তু আকাশের এইরকম চেহারা বা বর্ণনা পাইনি কোথাও। এক হল তার রং, আর দুই হল তার চলমানতা বা বহমানতা। নীল অনেক রকমের হয়। কিন্তু নীলের মধ্যে এত রকমের অন্য রঙের সমাহারও যে তাকে নীলই করে তুলতে পারে, তা আমার কল্পনায় ছিল না। আর সে তো কেবল মেঘের পরতে ঢাকা সামান্য বা সাধারণ বা স্বাভাবিক আকাশ নয়। ওই ঘুমন্ত গ্রামের ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকা আকাশের গায়ে চুমকি আর নকশার মতো ফুটে উঠেছে অজস্র নক্ষত্র ও তারা। আকারে ও উজ্জ্বলতায় একটির সঙ্গে অপরটির মিল না থাকলেও, বোঝাই যাচ্ছে, এ হল সেই আকাশ, যা সতত বিদ্যমান, অথচ খালি চোখে যাকে দেখা যায় না। বহু পরে যখন জীবনানন্দের লেখায় পাই, ‘আকাশের ওপারে আকাশ’, তখন এই ছবি দিয়ে সেই কবিতার কাছে পৌঁছতে পেরেছিলাম।

    The Starry night
    ‘দ্য স্টারি নাইট’

    আর হ্যাঁ, তার ওই ঘুরতে-ঘুরতে বয়ে চলা। এ-জিনিসও যে তুলি দিয়ে ক্যানভাসে এঁকে ফেলা যায়, তা জানতাম না। ঘুমে বিভোর হয়ে থাকা এক আবাদের উপর দিয়ে নিস্তব্ধতা নিয়ে ভেসে চলেছে, বয়ে চলেছে, ঘুরে চলেছে নক্ষত্রখচিত এক বিশালাকার আকাশ, তার সমস্ত রকম জাগরণ, রহস্য আর মহাজাগতিকতা নিয়ে। ওই ঘুম আর ওই ঘূর্ণনের মিশ্রণে যে-বৈপরীত্য, ওই পার্থিব আর অপার্থিবের মেলবন্ধনে যে-বিস্ময়, তার কোনও তুলনা নেই। এ-ছবির বর্ণনা করতে যাব যত বেশি, ততই ব্যর্থ হবে শব্দেরা। কেবল বলি, ওই দুপুরে, আমার অজান্তেই, এই ছবি আমার দেখার চোখ বদলে দিয়েছিল। আমার আকাশ দেখার চোখ। আমার নীল দেখার চোখ। আমার সবটুকুই হয়তো।

    অনেক পরে, ২০০৬ সালে যখন সত্যিই নিউ ইয়র্ক শহরে এই ক্যানভাসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন বুঝেছিলাম কীভাবে রঙের পর রঙের পরত দিয়ে নিজের মধ্যেকার তুমুল অস্থিরতাকে আকাশে অনুবাদ করেছিলেন তিনি। স্যাঁ রেমি দ্য প্রভেঁস-এর অ্যাসাইলামের পুবদিকের জানলা থেকে এক রাতে তাঁর ক্যানভাসে জেগে উঠেছিল এই দৃশ্য। জেগে উঠেছিল এই সভ্যতার শৈল্পিক পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত দিগন্ত, অদেখা আকাশ। সে-সময়ে যা-ই আঁকছিলেন, বিশেষ ভাল লাগছিল না তাঁর। কেবল এই ছবিটি যে তাঁর বাকি সমস্ত ছবির চেয়ে আলাদা, ভাই থিও-কে সে-কথা তিনি লিখেছিলেন চিঠিতে। তারপর শতাব্দীরও বেশি সময় বুকে নিয়ে আকাশ ঘুরে গেছে এই গ্রহের উপর দিয়ে। জেগে আছেন ভিনসেন্ট। তাঁর কল্পনাতীত নীল রঙের রাত্রি নিয়ে। যার কোনও শেষ নেই।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook