কোভিড অতিমারীর পাঁচ বছর পূর্ণ। শরীর-মনে এখনও এর প্রভাব বহন করে চলেছেন অনেকেই। ঠিক কীভাবে মনের ওপর এই অসুখের রেশ রয়ে গেল? কথাবার্তায় মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম। ডাকবাংলা.কম পত্রিকার তরফে কথা বললেন প্রিয়ক মিত্র।
পরিসংখ্যান বলছে, কোভিড-উত্তর সময়ে ভারতে অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ওষুধের বিক্রি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। এর নেপথ্যে কী সমীকরণ কাজ করছে বলে মনে হয়? কোভিড কি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রেখেছে?
এটা কিন্তু কেবল ভারতে নয়, আবিশ্ব ঘটেছে। কোভিডের সময়ে পরিস্থিতিটা এমনই ছিল, অনিশ্চয়তা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা, দীর্ঘ আইসোলেশন, প্রিয়জনের মৃত্যু— সব মিলিয়ে এমন একটা প্রভাব পড়েছিল মানুষের মনে যে, ডিপ্রেশন অবধারিত হয়ে পড়েছিল।
তবে অতিমারীর একটা ইতিবাচক দিকও রয়েছে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে ওই সময়েই। সেই সময়ে সারা পৃথিবীর মতো ভারতেও টেলিকনসাল্টেশন বেড়েছিল। প্রত্যন্ত গ্রামেও এই সুযোগ-সুবিধে পাওয়া গিয়েছিল।
এর ফলে কী হয়, অনেকেই তখন বুঝতে পারে, তার ভেতরে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন নানাভাবে বাসা বেঁধেই ছিল। তখন সেই চিকিৎসা শুরু হয়। এর ফলে অনেকেই এইসব ওষুধগুলো খেতে শুরু করেন তখন। সেই চিকিৎসার রেশ টেনেই হয়তো এখনও অনেকে ওষুধ খেয়ে চলেছেন।
এই যে সচেতনতা বাড়ার কথা বলছেন, এইটা তখন হল কী করে? অতিমারী তো শারীরিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভীতিটাই বাড়িয়েছিল। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এটা ঘটল কী করে?
মানুষ তখন এটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল। অনেকেরই সাব থ্রেশহোল্ড সমস্যা হয়তো ছিল। কোভিড সেটাকে তীব্র করে তুলল। আর স্বাস্থ্য নিয়ে, শরীর নিয়ে কথা হচ্ছিল তখন। কী কী করলে শরীর ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচবে, এই নিয়ে সবাই তখন ভাবছিল। একইভাবে, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, একেবারে একা হয়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কষ্টটাও তো পাশাপাশি ছিল। তাই মনখারাপও বাড়ছিল। এছাড়া যারা কোনও-না-কোনও নেশার দ্রব্য সেবন করে, তাদের অনেকেই তখন অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত হছিল, কারণ, তারা মদ হোক বা সিগারেট, পাচ্ছিল না। ফলে, চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হচ্ছিল। চিকিৎসক মাদকের জোগান দিতে পারবে না, কিন্তু অসুখের ওষুধ তো দিতে পারবে!
এই প্রভাবটা কাদের ওপর সবচেয়ে বেশি ছিল? তরুণদের ওপর?
না, এর কোনও বয়ঃসীমা ছিল না। সব বয়সের মানুষের ওপরেই এই প্রভাবটা পড়েছিল। বিশেষ করে বয়স্কদের ওপর। কারণ অসুখটা তাদেরই বেশি হচ্ছিল। তবে, কেউই নিরাপদ ছিল না এ-ব্যাপারে। স্কুল-কলেজপড়ুয়াদেরও ভয়াবহ অবসাদ হচ্ছিল। আর একজন ৩৫ বছর বয়সির কাছে দেড় বছর লকডাউনে থাকার যে-অভিঘাত, একজন ১৬ বছর বয়সির কাছে তো তা অন্যভাবে এসে পৌঁছবে!
একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। এক প্রৌঢ় ডাক্তার ওই কোভিডের সময়েই অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীও তাঁকে কাজ ছেড়ে দিতেই বলছিলেন। তাঁরা পুজোর সময়ে নিউজিল্যান্ডে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা পর্যন্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ভদ্রলোকের স্ত্রী কোভিড-আক্রান্ত হয়ে সে-সময়েই চলে গেলেন। এমন কত জীবন এদিক-ওদিক হয়ে গেল সে-সময়ে! এর প্রকোপ তো সর্বব্যাপী হবেই। কতজনের পড়াশোনা বা গবেষণার পরিকল্পনাও তো ভেস্তে গেল!
লকডাউনের শুরুতে আশ্চর্যভাবেই, অনেকেই বাড়িতে থাকাটা উপভোগ করছিলেন। রান্নাবান্না, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো নিয়ে অনেকেই খুশি ছিলেন। কর্পোরেট জীবনের যে-দ্রুতি, তাতে কি ওয়ার্ক ফ্রম হোমটা কোনওভাবে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল? না কি এর অন্য দিক রয়েছে?
সামগ্রিক ওয়ার্ক ফ্রম হোম খুব কম সংখ্যক মানুষকেই অ্যাপিল করে। হয়তো যারা একটু মুখচোরা, একটু ঘরকুনো, তাদের আকর্ষণ করতে পারে। কোভিডের সময়ে ওই বাড়িতে থাকাটা কিন্তু ওয়ার্কিং উইমেন, কর্মরত মহিলাদের জীবনে বেশ অভিশাপের মতোই নেমে এসেছিল। কারণ অফিসের কাজ সামলানোর পাশাপাশি শ্বশুর-শাশুড়ির যত্ন নেওয়া থেকে শুরু করে সন্তানের লেখাপড়া, সব কিছুই তাদের দেখভাল করতে হত তখন। তাদের দুর্ভোগ নিয়ে কম কথাই হয়েছে।
এখনও অনেকেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। কিন্তু বেশির ভাগই অফিসে সময় কাটাতে চায়। এর মূল কারণ, সামাজিক সংসর্গটা বজায় রাখা। ওটা অনেকের কাছেই প্রাণশক্তিও তো বটে।
এই যে অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ওষুধের বাড়বাড়ন্ত, এটা কতটা প্রেসক্রাইবড বলে মনে হয়?
বেশিরভাগটাই। ঘুমের ওষুধ নয়। কলকাতার একটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এখানে শীতলা ফার্মেসিরা এতই উদার, তারা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ঘুমের ওষুধ দিয়ে দেয়। কলকাতাই একমাত্র শহর, যেখানে এমন যথেচ্ছ ঘুমের ওষুধ পাওয়া যায়, এদেশের অন্যান্য শহরেও এমনটা হয় না। হয় কী, হয়তো একটা পুরনো প্রেসক্রিপশন আছে। এখন হয়তো সেই ওষুধের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা। ক্লোনাজেপাম আর অ্যালজোলাম বলে দুটো ওষুধ তখন বিক্রি হচ্ছিল, সেগুলো কিন্তু ডিপ্রেশনের ওষুধ নয়, ঘুমের ওষুধ। এখন আমার কাছে পরিসংখ্যান নেই, তাই বলতে পারব না, ওই পরিমাণেই ঘুমের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে কি না।
শেষ যে-প্রশ্নটা করব, কোভিডের পর থেকে ভাইরাসের ভয় একটা নতুন অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায়। এর মোকাবিলা কীভাবে সম্ভব?
ভাইরাসেও ভয়, ভ্যাকসিনেও ভয়। সব মিলিয়ে অসুখের ভয়টা বেড়েছে। শুচিবাই বেড়েছে। কোভিডের পর গুগল ঘাঁটাও অনেকের বেড়েছে। তারা এখন কোনও শারীরিক সমস্যা হলেই কোনও কঠিন অসুখের নাম খুঁজতে শুরু করে। অবসাদের এটাও একটা দিক। এটার মধ্যে কিছুটা ওসিডি, বা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারও রয়েছে। তারও একটা চিকিৎসা আছে। আসলে এই অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট ও মুড এলিভেটর ড্রাগের মধ্যে ওসিডির ওষুধও কিছু-কিছু আছে, কারণ অতিমারীর পর সেটাও ক্রমশ প্রকট হচ্ছে।