ধরে নিন, এই ঘটনার স্থান, কাল আর পাত্র সবই কাল্পনিক, শুধু ঘটনাটি ছাড়া। ঘটনাটি ঘটছে ঠিক সেই সময়ে, যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। ভারতের পশ্চিমদিকের কোনও এক রাজ্য। সেখানে এক ছোট্ট জনপদের পাশেই রয়েছে সেনাছাউনি। এই জনপদে বেশ কয়েক বছর ধরে রয়েছে এক যুবক, সাধারণ মানুষের বড় পছন্দের সে— বিনয়ী ব্যবহার, বন্ধুবৎসল, বিপদে-আপদে সহায়। তবে শুধু সেই এলাকার মানুষজনই নয়, সেনাছাউনিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গেও জমে গেছে তার বন্ধুত্ব। হঠাৎই খবর এল একদিন সেনাছাউনিতে, যুবকটি সম্ভবত রাশিয়ার গুপ্তচর, তার বাড়ি-ঘর তল্লাশি করে দেখতে হবে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কিনা! যুবকটির অপরাধ, সে রুশ ভাষা জানে এবং রুশ সাহিত্য থেকে অনুবাদও করে।
যাই হোক, আদেশ শিরোধার্য করে তল্লাশি চালাতে এলেন সেনাবাহিনীর তরফে বেশ কয়েকজন, যাঁদের সঙ্গে এতদিন খাতায়-কলমে অন্তত তার ‘মধুর’ সম্পর্কই ছিল, কিন্তু কর্তব্যে তাঁরা অবিচল। আর্মড এয়ারফোর্সের ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের কড়া ট্রেনিংয়ে এসব কাজে কোনও অস্বস্তির ঠাঁই ছিল না। বিয়ের ন’বছর পরে স্বামী গুপ্তচর জানতে পেরে কোথায় কোন মেয়ে তাকে রাতের অগোচরে চানঘরে বন্ধ করে রেখে সেনাদের তাঁবুতে এসে খবর দিয়েছে, এসব গল্প ভেসে বেড়াত গরবিনী হাওয়ায়।
আরও পড়ুন : ডিপসিক আর চ্যাটজিপিটি-র কাজ কি মানুষের মেধা চুরি করা? লিখছেন শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য…
যাই হোক, সারা ঘরে যখন তন্নতন্ন করে খোঁজ চালাচ্ছেন সেনাবাহিনীর লোকজন, মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে চুপ করে থাকে ছেলেটি। গোটা সময়টা জুড়ে নিজের পড়ার টেবিলের সামনে বসে থাকে, বোঝাই যায়, লেখালিখি করছিল একটু আগেই। হাতে একটা পেনসিল, তখনও। আনমনে অদ্ভুত, অজানা ভাষায় কবিতা আওড়াতে থাকে সে, বাকিদের বোঝানোর জন্য কবিতাটি অনুবাদও করে দেয় হিন্দিতে। সে কবিতার বিষয়বস্তু অনেকটা এইরকম— যাদের কবি একদিন অন্তরের প্রিয় মানুষ বলে মনে করেছিলেন, আজ তারাই কবিকে সন্দেহ করে, তারাই বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করে।
একদিকে এত খোঁজাখুঁজি করেও সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না, তায় আবার অমন কবিতা! এই তল্লাশির শ্রান্তি ততক্ষণে যৎপরোনাস্তি বিব্রত করছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদেরকেও, ধীরে ধীরে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন সবাই। যদিও এই ঘটনায় বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটল ভালই, যুবকটি আর খুব একটা মেশে না চারপাশে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই খবর এল, মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে ছেলেটির, উন্মাদপ্রায় অবস্থা তার, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে ভরতি হয়েছে সেনা-হসপিটালে। ব্যথায় প্রায় অচেতন সে, কিন্তু ওই অবস্থাতেও কী এক অজানা কারণে কিছুতেই মস্তিষ্কে স্ক্যান করতে দিতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু স্ক্যান করেই দেখা গেল, কানের ঠিক ওপরে, চামড়ার ভেতর সার্জারি করে বসানো আছে একটা ছোট্ট ধাতব টুকরো, সুদূর বিদেশ থেকে নানা আদেশ-নির্দেশ বাজতে থাকছে সেই সেখানে। আর সেদিনের হাতে যে পেনসিলটি ছিল তা এক বিশেষ ডিভাইস যা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যেত মাথার ভেতরের ধাতব টুকরোকে। নানা খবরাখবর পাচার করত সে, কিন্তু কোনও এক যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে এই ভয়ংকর মাথার যন্ত্রণা।
বোঝা গেল, সেনাবাহিনীর কাছে একদম ঠিক খবরই ছিল, সে আদতেই একজন রাশিয়ার গুপ্তচর। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সত্ত্বেও গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে মানুষের ওপরই আস্থা রাখতে পছন্দ করত রাশিয়ার ইনটেলিজেন্স, এমনকী, নয়ের দশকের গোড়াতেও।
এইবার পিছিয়ে যাওয়া যাক ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব জুড়ে শুরু হল ঠান্ডা লড়াই, প্রধান প্রতিপক্ষ সোভিয়েত রাশিয়া আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৭ সাল নাগাদ, যখন পুরোদমে চলছে এই ঠান্ডা লড়াই, ইয়ান ফ্লেমিং লিখলেন একটি স্পাই-নভেল, ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’, সেই নভেলের একটি অধ্যায় ‘Konspiratsia’-তে রাশিয়ার গুপ্তচরবৃত্তির জোরালো দিক এবং দুর্বলতাগুলির কথা বলতে বলতে আমেরিকার ইনটেলিজেন্সকে অত্যন্ত সক্রিয় এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে অসাধারণ বলে চিহ্নিত করেও লিখলেন যে, গুপ্তচর নিয়ে তাদের জ্ঞান বেশ সীমিত: ‘দ্য আমেরিকানস হ্যাভ দ্য বিগেস্ট অ্যান্ড রিচেস্ট সারভিস… টেকনিক্যালি… দে আর দ্য বেস্ট। বাট দে হ্যাভ নো আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফর দ্য ওয়ার্ক।’
অন্যদিকে, সোভিয়েত ব্লক আস্থা রেখেছিল রক্তমাংসের মানুষের ওপর, এবং সেটাই ছিল তাদের সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থাগুলি প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি করে যান্ত্রিক চোখ আর কান রেখেছিল আকাশে, স্থলে, পাতালে, জলের গভীরে— সারা পৃথিবী প্রায় চলে এসেছিল তাদের সামনে। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া আর তার অধীনে থাকা ইস্ট ব্লক দীর্ঘদিন ধরে ‘ক্লোজড সোসাইটি’-তে অভ্যস্ত হওয়ায় ভেতরের খবর খুব একটা বাইরে আসত না। আমেরিকা স্বভাবগতভাবে ছিল ‘ওপেন সোসাইটি’, ফলে গুপ্তচরদের আনাগোনার ক্ষেত্রে তা তুলনায় সহজ ছিল। বেশ কিছু গুপ্তচরের খবর বিভিন্ন সময়ে শিরোনামে উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে এইরকমই দুই বন্ধুর কথা এখানে বলি।
ক্রিস্টোফার বয়েস আর অ্যান্ড্রু ডালটন লি, ক্যালিফোর্নিয়ায় একসঙ্গে বড় হওয়া দুই বন্ধু। সচ্ছল পরিবারের সন্তান ক্রিস্টোফারের বাবা ছিলেন ম্যাকডনেল ডগলাস এয়ারক্র্যাফট কর্পোরেশনের ডিরেক্টর অফ সিকিউরিটি। আর পেশায় চিকিৎসক ড. ডালটন লি-র পালিত পুত্র হল অ্যান্ড্রু। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ক্রিস্টোফার চাকরি নেন ক্যালিফোর্নিয়ার এরোস্পেস তৈরির সংস্থা TRW-তে। কয়েক মাসের মধ্যে পদোন্নতির ফলে এই কোম্পানির খুব গোপনীয় একটি বিভাগ, ক্লাসিফায়েড কমিউনিকেশন সেন্টারের (যার কোডনেম ছিল ‘ব্ল্যাক ভল্ট’) দায়িত্ব পান। অন্যদিকে স্কুলে পড়াকালীনই অ্যান্ড্রু-র ঝোঁক যায় মাদক ব্যাবসার দিকে। সেখানে পসার এতটাই জমে ওঠে যে, মাদক-চক্রের লোকজন তাঁকে ‘দ্য স্নোম্যান’ বলে এককথায় চিনত। তবু মন ভরে না অ্যান্ড্রুর। আরও দামি দামি ড্রাগসের জন্য টাকা বিনিয়োগ করতে চায় তাঁর মন, আর তার জন্য চাই প্রচুর টাকা। এই সূত্রেই তাঁর সহায় হয় বন্ধু ক্রিস্টোফার।
সোভিয়েত ব্লক আস্থা রেখেছিল রক্তমাংসের মানুষের ওপর, এবং সেটাই ছিল তাদের সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থাগুলি প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি করে যান্ত্রিক চোখ আর কান রেখেছিল আকাশে, স্থলে, পাতালে, জলের গভীরে— সারা পৃথিবী প্রায় চলে এসেছিল তাদের সামনে। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া আর তার অধীনে থাকা ইস্ট ব্লক দীর্ঘদিন ধরে ‘ক্লোজড সোসাইটি’-তে অভ্যস্ত হওয়ায় ভেতরের খবর খুব একটা বাইরে আসত না।
ক্রিস্টোফার যখন TRW-তে কাজ করছেন, তখন কেবল্-বিভ্রাটের ফলে শুনতে পেয়ে যান CIA-র কথাবার্তা। আমেরিকা গোপনে চক্রান্ত করছে সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে গদিচ্যুত করতে। কারণ অস্ট্রেলিয়া বেঁকে বসেছে, তারা আর আমেরিকার সঙ্গে চলতে চাইছে না। অস্ট্রেলিয়ায় তিনি আমেরিকার মিলিটারি বেস বন্ধ করে দিতে চাইছেন, এমনকী, চালু রাখতে চাইছেন না ‘পাইন গ্যাপ’ (এটি একটি অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকার যৌথ স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন বেস যার মাধ্যমে নজরদারি চালানো হত।) এছাড়াও ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে নিতে চাইছেন তাঁদের সেনাবাহিনী। এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর-জেনারেল জন কের। নিষিদ্ধ এক কৌতূহল পেয়ে বসল ক্রিস্টোফারকে, কেবল্ কানেকশনের মাধ্যমে ক্রিস্টোফার জানতে পারলেন, CIA এই ধরনের গোপন চক্রান্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গেও করে চলেছে। এইসব খবরাখবর আর অন্যান্য নথিপত্র হাতিয়ে জোট বাঁধলেন পুরনো বন্ধু অ্যান্ড্রু-র সঙ্গে। অ্যান্ড্রু ড্রাগ বিক্রির অছিলায় পাড়ি দিল মেক্সিকো— প্রচুর টাকার বিনিময় চুরি করা সমস্ত তথ্য বিক্রি করে দিলেন মেক্সিকো সিটিতে সোভিয়েত এমব্যাসির অফিসারদের কাছে। মাঝে-মাঝেই চলতে থাকল অ্যান্ড্রু-র এই অভিযান, আসতে থাকল প্রচুর টাকাও।
১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে সোভিয়েত এমব্যাসির সামনে টপ সিক্রেট মাইক্রোফিলম নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলেন অ্যান্ড্রু। পুলিশি অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজেকে রাশিয়ান স্পাই বলে স্বীকার করে নিলেন, বলে দিলেন গুপ্তচরবৃত্তির কথা, স্বাভাবিকভাবেই উঠে এল ক্রিস্টোফারের নামও। এই ঘটনার দশ দিনের মাথায়, ১৬ জানুয়ারি রিভারসাইড ক্যালিফোর্নিয়া থেকে FBI ধরে ফেলল ক্রিস্টোফারকেও। বিচারে চল্লিশ বছরের জন্য কারাবাস ধার্য হল। কিন্তু ক্রিস্টোফার অত সহজে হাল ছাড়ার লোক ছিলেন না। তিন বছরের মাথায় জেল থেকে পালালেন তিনি। এই অবস্থায় আমেরিকায় থাকাটা একেবারেই নিরাপদ ছিল না তাঁর পক্ষে, ঠিক করলেন পালিয়ে যাবেন রাশিয়ায়। আর এর জন্য প্রয়োজন অনেক টাকার। ইডাহো আর ওয়াশিংটন মিলিয়ে মোট ১৭টি ব্যাঙ্কে ডাকাতি করলেন। পালটে ফেললেন নাম, নতুন নাম হল অ্যান্টনি এডওয়ার্ড লেস্টার। ইতিমধ্যে শিখে নিয়েছেন বিমান চালানো। দেশ ছাড়ার আগে গোপনে দেখা করলেন বন্ধু অ্যান্ড্রু-র সঙ্গে, চাইলেন দু’জনে মিলে পালাতে। অ্যান্ড্রু কিন্তু এবার ফিরিয়ে দিলেন বন্ধুকে। তিনি বললেন, ‘জেলের সামনের দরজা দিয়ে যখন ঢুকেছি, তখন সেই দরজা দিয়েই বেরব।’ অগত্যা ক্রিস্টোফার একাই চললেন রাশিয়ার পথে।
তখনও ওয়াশিংটন থেকে বেরতে পারেননি তিনি। সামান্য খাবার কিনে খাচ্ছিলেন তাঁর গাড়ির মধ্যে বসে। ঠিক সেই সময় তাঁর গাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ, এবার আর পারলেন না পালাতে। জেল পালানো, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, ষড়যন্ত্র আর অস্ত্র আইনভঙ্গের জন্য ৬৮ বছরের সাজা হল তাঁর। যদিও ২৫ বছর জেল খেটে প্যারোলে মুক্তি পেলেন ২০০২ সালে। জীবনের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন ‘আমেরিকা সন্স: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ দ্য ফ্যালকন অ্যান্ড দ্য স্নোম্যান’ বইয়ে। এর কিছু বছর আগে, ১৯৯৮ সালে একইভাবে প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন অ্যান্ড্রুও। সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ এই দু’জন আজও আছেন আমাদের পৃথিবীতে, একই সঙ্গে বইয়ের পাতায় এবং সেলুলয়েডে।
কিন্তু একজনের কথা সামান্য উল্লেখ না করে এই লেখা শেষ করা যায় না। তিনি হলেন উইলিয়ম ক্যাম্পাইলস। এই দুই বন্ধুর সমবয়সি তিনি। তিনি কিন্তু ছিলেন সরাসরি CIA-র চাকুরে। যে বছর ধরা পড়েছিলেন দুই বন্ধু, সেই বছরেই উইলিয়ম যোগ দিয়েছিলেন CIA-তে। এক বছরের মধ্যেই তিনি হেড-কোয়ার্টার থেকে হাতিয়ে নিলেন KH-11 Spy Satellite-এর ম্যানুয়াল। পরের বছর জানুয়ারিতে গেলেন গ্রিসে— এইরকম ভরা শীতে সচরাচর কেউ গ্রিসে যায় না। যাই হোক, তিনি এথেন্সে সোভিয়েত এমব্যাসির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং KGB-র এজেন্টের হাতে মোটা টাকার বিনিময় তুলেও দিলেন ম্যানুয়ালটি। কিন্তু তাঁর মনে হল, জীবনে রোমাঞ্চ বড় কম পড়িয়াছে! মনে হল, তিনি ডাবল এজেন্টের মতো কাজ করবেন আর ক্ষীর খাবেন দু’দিকেরই। খুব বেশিদিন চালাতে পারেননি এমন সাংঘাতিক খেলা, একসময় ধরা পড়ে গেলেন তিনি।
আপাতত উইলিয়ম ক্যাম্পাইলস নিয়ে এইটুকুই এখানে থাক, পরে কখনও আবার বলা যাবে তাঁর বা তাঁদের মতো এমন সব গুপ্তচরের গল্প। আজ যেন রূপকথা হয়ে গেছেন তাঁরা।