ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • নিজস্ব ‘পেরিস্তান’

    সৌকর্য ঘোষাল (February 26, 2025)
     

    আত্মজীবনী লেখা কঠিন কাজ। তাই লীলা মজুমদারকে নিয়ে কিছু লেখা একইরকম কঠিন। কারণ, লীলা মজুমদার বহুকাল আগেই আমার জীবনে ঢুকে পড়েছেন। ওঁর লেখা গল্পগুলো, মানুষগুলো, জায়গাগুলো, ম্যাজিকগুলো, সবগুলো আমার দৈনন্দিন রুটিনে উঁকি দেয়। এ এক খেলাচ্ছল! পান থেকে চুন খসুক না খসুক, ওরা বলে যায় অনর্গল টুকি। আমি বলে যাই নিরন্তর ধাপ্পা। এই যেমন বাজার থেকে আসা ডিমগুলোর মধ্যে কয়েকটা কদাচিৎ নরম নীলাভ যখন দেখায়, আমি জানলার বাইরে তাকাই অভ্যেসে। বাস্তব পাশে এসে দাঁড়ায়, বলে ‘বয়সের গাছপাথর নেই কো, এখনও এমন শিশুপারা হয়ে থাকতে আঁতে লাগে না? ফ্রিজ থেকে ডিম নিতে এসে যদি এতক্ষণ ধরে ফ্যান্টাসি বেরয়, তাহলে বাপু তুমি জীবন-দৌড়ে তো ডাহা ফেল। ওগুলো কাগ নয় কো, হাঁসেরই ডিম বটে। ফোটাও-ফাটাও, যেভাবে খুশি খাও, ভুলে যাও।’ আমি কিন্তু কস্মিনকালে বাস্তবকে যেচেপড়ে বলতে যাইনি এসব। আর বলে হবেই বা কী, সে তো আর লীলা মজুমদারের দুনিয়ায় ভিসা পাবে না। ইঁদুর দৌড়, পিছনে কাঠি, পরশ্রীকাতরতা— এসব বোধহয় বাস্তবটা আর ত্যাগ করতে পারবে না এ-জীবনে। ওগুলো আবার লীলা মজুমদারের দুনিয়ায় প্রাইমারি রেড ফ্ল্যাগ। 

    এই তো সেদিন আমার পাঁচ বছরের বন্ধুঝি ‘রাজন’-কে ‘ইয়াজন’ বলেছে বলে প্রথমে সকলে খুব খানিকটা হেসে নিল, তারপর তার মা তাকে কোলে নিয়ে মুখ হাঁ করে দাঁতের ডগায় জিভ ছুঁইয়ে বলল, ‘রাজন। বল, রাজন।’ সে আবার বলল, ‘ইয়াজন’। আবার তার মা অমনই মুখ হাঁ করে জিভের ভেলকিতে বলল, ‘রা রা রা রা রা রা রা।’ ভাইঝি বলল, ‘ইয়া, ইয়া, ইয়াইয়াইয়া!’ শেষটায় আমি বেচারিকে বাস্তবের রিয়েলিটি শো থেকে ছুটি দেওয়ার জন্য বললাম, ‘কী আছে বলুক না, নরবুও তো লামা কে ইয়ামা বলে।’ বন্ধু বলল, নরবুটা কে? আমি সবে বাতাসবাড়ির অবতারণা করতে যাব, ওমনি খেয়াল হল, ও তো ওখানে ভিসা পাবে না, বলে কী লাভ, বুঝবেই না। ও টাকা ছাড়া কিছু বোঝেই না। ও আমায় শিখিয়েছে, রোজগারপাতি হিসেব করে বলতে হলে একসঙ্গে সারা বছরের বলতে হয়। মাসমাইনের কথা বলা ব্যাস্তব পরিস্থিতিতে ব্যাকডেটেড। শুধু তাই নয়, আমাকে বোকা ভেবে একবার ও আমায় বোঝাতে এসেছিল শিল্পকর্ম, লেখাপত্তর সব টাকা দিয়ে মাপতে। মানে, ফেলো কড়ি মাখো তেল টাইপ। আমি ওকে আর ভেঙে বলিনি, বড় লামা বিনাপয়সায় সোলার এনার্জির চাষ করে গেল ভাবীকালের কচিকাঁচাদের জন্য আর আমি কিনা চাড্ডি পয়সার জন্য লেখা বন্ধ করে দেব, কত বড় কিশোরকুমার আমি? এই যে ভূতেরা আজ পর্যন্ত আমাদের এত মনোরঞ্জন করে করে চলেছে, এর জন্য ওরা যদি ফস্ করে টাকা চেয়ে বসে, পেমেন্টটা কোথায় করব!

    আরও পড়ুন : স্নো হোয়াইট থেকেই কি ডানা মেলে অ্যানিমেশনের পক্ষীরাজ?
    লিখছেন সৌকর্য ঘোষাল…

    বাস্তবটা আবার তক্ষুনি পাশে এসে ফিসফিস শুরু করে দিল, ‘ভূতফুত কিচ্ছু হয় না।’

    হয় না? আমার মাথায় রাগ চাপলে আমি ছেড়ে কথা বলি না কাউকে। বললাম,  ‘কে বলল তোকে, হয় না?’ বাস্তব মুখ টিপে হেসে নিল খানিক, তারপর দালাল স্ট্রিটের চোস্ত সেলসম্যানের মতো বলল, ‘হোয়ার ইজ দা প্রুফ বাডি? তুই দেখেছিস ভূত?’

    এই হচ্ছে ওর সমস্যা! বাস্তব-জ্ঞান এত বেশি যে, ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে ছাড়ে না। কিন্তু ভূতের কাণ্ডজ্ঞান নেই। বললাম, ‘ব্ল্যাক হোল দেখেছিস তুই?’ ও বলল, অঙ্ক দিয়ে দেখিয়ে দেবে, কোথায় আছে ব্ল্যাক হোল। আমার বলতে ইচ্ছে করছিল. ‘যা না, ঘুরে আয় না তাহলে ব্ল্যাক হোল থেকে! বুঝবি কত ধানে কত চাল। ওটাই ভূতের আখড়া, ইন্টারস্টেলারে দেখিয়েছে!’

    আমার স্ত্রী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল— ‘আবার তুমি তুমি একা একা কথা বলছ?’

    অযোধ্যা পাহাড় যাওয়ার পথে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বাঁদিকে নিলে বাঁকুড়া যাওয়ার যে রাস্তাটা? সেটার প্রায় মাঝামাঝি, একটা রাস্তার ধারের দোকান আছে। চা, অমলেট, টোস্ট পাওয়া যায়। ইন্দুরানি বলে একটা পরির মতো মেয়ে দোকানটায় থাকে। ও স্কুলে যায় সকালে। দুপুরে চান-খাওয়া করে বইপত্তর নিয়ে চলে আসে দোকান সামলাতে, সকালে আর রাতে কাকা বসে ওর। বাবা-মা নেই। কিন্তু ফুলের মতো হাসে। যত বারই গেছি, ওই দোকানে ইন্দুরানি ঝলমল হাসে, অমলেট বানায়, চা বানায়, সাধলেও খায় না আর খালি মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যায়। দোকানটা নাকি কাকা বন্ধক রেখেছে, ধার না মিটলে মহাজন দোকান নিয়ে নেবে।

    একবার স্ত্রী বলল, যাওয়ার পথে ইন্দুকে একটা সাহায্য দিয়ে, যাবে অযোধ্যা। আমরা গিয়ে দেখলাম, দোকান পাল্টে গেছে। নতুন চাকর, নতুন মালিক। বুঝলাম, দেরি হয়ে গেছে আমাদের। নতুন মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, ইন্দুদের বাড়ি কোন দিকে। উনি বললেন, ‘কে ইন্দু?’ আমরা বললাম, এর আগে দোকানটা যার ছিল, তার ভাইঝি। মালিক অবাক হয়ে বলল, ‘এ দোকানের আমিই মালিক। দোকানটা আমার বাবার!’ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, আমি জীবনে প্রথম নিজেকে চিমটি কাটলাম। ভাবলাম, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? ‘লাল টিনের ছাদের বাড়ি’ তো বহুকাল আগে পড়েছি। সেই যেবার আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার পেলাম বইটা। ক্লাস সেভেনে। তাহলে এখন কুসুমকুমারীর ঘটনা জীবনে কী করে দেখছি? স্ত্রী-কে বললাম গল্পটার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই লাল টিনের ছাদের বাড়ি, অপূর্ব ব্রহ্মপুত্রের ধারে এক গোপন আস্তানা। সৈন্যরা গা ঢাকা দিতে গেছিল। কুসুমকুমরী অমনই ঝলমল হেসে, রেঁধে-বেড়ে, দেশি মুরগির ঝোলভাত খাইয়েছে তাদের। শেষটায় জানা যায়, ওই বাড়িটিতে পঞ্চাশ বছর কেউ থাকে না। কিন্তু হঠাৎ বিপদে পড়ে এর আগেও যে যতবার আশ্রয় নিয়েছে, লাল টিনের ছাদের বাড়ি থেকে খালি পেটে কেউ ফেরেনি। গল্পটা শুনে আমার স্ত্রী ইমোশনাল হয়ে পড়ল। আমি বললাম, এটা কষ্টের না ভয়ের ব্যাপার। ইন্দুরানি কুসুমকুমারী নয় তো? ও বলল, ধুর! নতুন দোকানদার মিথ্যে বলছে, অন্যায়ভাবে দোকানটা ইন্দুদের থেকে নিয়েছে বলে শেয়ার করল না। বললাম, আর যদি সত্যি সত্যি কুসুমকুমারীর মতো কেস হয়?’ এর জবাবে বলল, ‘তাহলে তো সবেতেই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এই যে আকছার ডেলিভারি এজেন্টরা বাড়ি আসছে! হেসে পার্সেল দিচ্ছে, তারপর চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে তো কতজনকে আর দেখিও না, তার মানে কি তারা সবাই ভূত?’

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই লাল টিনের ছাদের বাড়ি, অপূর্ব ব্রহ্মপুত্রের ধারে এক গোপন আস্তানা। সৈন্যরা গা ঢাকা দিতে গেছিল। কুসুমকুমরী অমনই ঝলমল হেসে, রেঁধে-বেড়ে, দেশি মুরগির ঝোলভাত খাইয়েছে তাদের। শেষটায় জানা যায়, ওই বাড়িটিতে পঞ্চাশ বছর কেউ থাকে না।

    প্রশ্নটা শুনে মহিলা সমিতির সেজপিসিমার কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটার নাম, ‘সন্ধ্যা হল’। পিসিমার বক্তব্য, ‘ভূতে বিশ্বাস করি কি করি না, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কারণ বললেই তো ভূত কেন হতে পারে না, তোরা তার একশরকম প্রমাণ এনে দিবি। কিন্তু পথে ঘাটে ট্রামে বাসে এই যে হাজার হাজার মানুষ দেখিস এরা সবাই জ্যান্ত মানুষ বলতে চাস নাকি? তবেই তো হয়েছিল! যেটুকু চাল ডাল পাওয়া যাচ্ছে তাও উঠে যেত।’

    তাই তারপর থেকেই যতবার মোবাইল টুং করে বেজে বলেছে, ‘ইওর ডেলিভারি পার্টনার ইজ অ্যাট ইওর ডোরস্টেপ’,  ততবার ভয় না লাগলেও, সন্দেহ তো হয়েছেই।

    পেরিস্তানটা যেমন আমার ছিল। মিথ্যে বলে লাভ নেই, একটু অন্যরকম, কিন্তু ছিল। তখনও ‘টংলিং’ পড়িইনি। তেতলার চিলেকোঠা যেখানটায় একদম বেঁটে হয়ে গেছে। ক্লাস ফোরের আমিও মাথায় সিলিং ছুঁই ছুঁই দাঁড়াতে পারি না, সেখানটায়। ওখানে একটা শতরঞ্চি চার ভাগ করে পাততে পারা যেত। ওখানে ঘুড়ি-লাটাই থাকত, গল্পের বই থাকত আর থাকত বাবুলগামের র‍্যাপার জমিয়ে পাওয়া ক্রিকেটারদের কার্ড। এর মধ্যমণি ছিল একটা বড় সাইজের কার্ড। শচিনের ‘গাটস অ্যান্ড গ্লোরি’। ওটা র‍্যাপার জমিয়ে পাওয়া দশখানা কার্ডের বিনিময়ে অর্জন করে এনেছিলাম। যখন ‘টংলিং’ পড়লাম, প্রথমেই মনে হয়েছিল আমার চিলেকোঠার বেঁটে জানলা দিয়ে, দ হয়ে শুয়ে শুয়ে আমিও তো দেখেছি কত বিকেল-পাখির ঘর ফেরা। বাতাসে ভেসে ভেসে কখনও ওরা নোঙর ফেলত দূরের কোনও ট্যাঙ্কির পাইপে। আকাশে এরোপ্লেন যেত রেলগাড়ির বদলে, তাই তারা টংলিং শব্দটুকু খালি করত না। কিন্তু আমারও মনে হত, দূরে কোথাও চলে যাই। গল্পের বই আর ‘গাটস অ্যান্ড গ্লোরি’-কে সঙ্গে নিয়ে।

    অনেক ভাবীকালে, যখন অগমেন্টেড রিয়েলিটির দুনিয়া হয়তো তৈরি হয়ে গেছে। যখন হয়তো ওয়েব সিরিজের মতো মানুষ এআর-এ আমোদিত হচ্ছে, তখন হয়তো কেউ পেরিস্তানের গল্প পড়ে আর শুধু ভাববে না ছেলেবেলার কথা, সটান অগমেন্টেড পরিস্তানে গিয়ে জিরিয়ে নেবে দু’দণ্ড। হয়তো বাতাসবাড়ি ঘুরতে গিয়ে কেউ খুঁজে পাবে দুলের নোটবই। চোখ ছলছল করবে তাও পড়বে—

    ‘পৃথিবীতে যখন মানুষ থাকবার জায়গা কুলোবে না, কয়লা ফুরুবে, তেল ফুরুবে, তখনও যেন কেউ ভয় না পায়। এই আমি রেখে গেলাম আরও ভালো বাতাস বাড়ির নকশা; এই রইল সূর্য-কলের নিয়মকানুন; খিদের বড়ির রন্ধনপ্রণালী; যে কাপড় ছেঁড়ে না বা পোড়ে না, গায়ের সঙ্গে বাড়ে-কমে, রোজ যার রং বদলায়, তার গোপন তথ্য।

    পৃথিবীর দুঃখ ঘুচে যাক, সবাই সুখী হোক।’

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook