ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ

    হিয়া মুখোপাধ্যায় (February 21, 2025)
     

    ক্লাস সেভেনে অর্ণব খচ করে রেগে গিয়ে বলে দিল ‘দুর শালা!’ রাগে, অপমানে, লজ্জায় আমার দু’কান লাল হয়ে উঠল।

    তখন ‘শালা’ উচ্চারণ দুঃস্বপ্নের অতীত। রেগে গেলে বন্ধুদের গাধা, ছাগল বা খুব বেশি হলে প্যাঁচা বলার নিয়ম। বাবার বন্ধুদের আড্ডায় দু’-একবার খুব আবছা-আবছা অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ দূর থেকে শুনেছি বটে। কিন্তু সেসব আলোচনা শুরু হলেই মা, ‘এই বাচ্চারা যাও পাশের ঘরে গিয়ে খেলো, কেমন? এখানে বড়রা কথা বলবে।’ বলে আমাদের বিদেয় করে দিত। পাশের ঘর থেকে উচ্চকিত হাসির আওয়াজ শুনে বুঝতাম, কোনও একটা বিশাল রসের আলোচনা চলছে। কিন্তু সেই আলোচনায় আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। ‘শালা’ শব্দটাও প্রথম কোনও এক কাকুর মুখেই শুনেছিলাম মনে আছে। পাপুন খুব গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘ওগুলো গুন্ডাদের খারাপ কথা।’ গুন্ডারা খুব খারাপ। তারা সারারাত ধরে টিভি দেখা আর রাস্তায় যখন তখন তেলেভাজা খাওয়ার মতো নিষিদ্ধ কাজকর্ম করে থাকে।

    আর অর্ণব কিনা আমায় গুন্ডাদের ভাষায় গালাগালি দিল! চ্যাঁ চ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে সোজা অনুভাদির কাছে গিয়ে নালিশ ঠুকে দিই। অনুভাদি যথেষ্ট সহানুভূতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বলেছে ও তোমায়?’

    আরও পড়ুন : সাতের দশক থেকেই বদলে যেতে শুরু করল গ্যালারির ভাষা!
    লিখছেন জয়ন্ত চক্রবর্তী…

    আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। বলি, ‘বলতে পারব না আন্টি। খুব খারাপ কথা।’

    অনুভাদির মুখ-চোখ গম্ভীর হয়ে ওঠে।

    — আচ্ছা কোন অক্ষর দিয়ে শুরু বলতে পারবে?

    আমি অনেক ভেবেচিন্তে বললাম, ‘দ।’

    অনুভাদির ভুরু-টুরু রীতিমতো জিজ্ঞাসাচিহ্ন। অনেকক্ষণ ‘দ’ দিয়ে কোন গালাগালি শুরু ভেবে বের করতে না পেরে সোজা অর্ণবের কান ধরে টেনে আনলেন, ‘ছি ছি ছি! দ দিয়ে কী এমন বলেছিস ওকে যে মেয়েটা লজ্জায় বলতে অবধি পারছে না!’ এবং তার সাথে উত্তম-মধ্যম।

    এই ঘটনার বছরচারেক পর আমার ডানা ও ল্যাজ গজায়। ব্যাকবেঞ্চার ক্লাবের মেম্বার হওয়ার স্বরূপ দু’অক্ষর, চার অক্ষর, আট অক্ষর ও জিপি সিরিজে ক্রমবর্ধমান অক্ষরের ওপর ছোটখাট মৌলিক গবেষণা করে ফেলেছি প্রায়। হাই বেঞ্চের ওপরে বসে বেশ সমাজবিরোধী-সুলভ ভঙ্গিমায় জনৈক সহপাঠী সম্পর্কে বাছা বাছা গবেষণালব্ধ বিশেষণ প্রয়োগ করে চলি। সরলমতি সহপাঠিনীরা আতঙ্কিত হয়ে চারপাশে ছিটকে যায়। বাঘা বাঘা সহপাঠীরা অবধি, ‘বাপ রে বাপ, মুখ না জাঙ্গিয়া!’ বলে কানে আঙুল দেয়। সদ্য বুঝেছি, নিষিদ্ধ বোমার মতো এই শব্দগুলো নিতান্ত সরল মুহূর্তে বিনা প্ররোচনায় কোনও অসতর্ক হিরোশিমা বা নাগাসাকিতে উৎক্ষেপ করলে দারুণ সব বিস্ফোরণ দেখা যায়। ভাষাতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্বর জটিল মারপ্যাঁচ মাথায় ঢোকেনি তখন। শুধু জানি, যা যা লোকে ‘খারাপ’ বলে, তাই তাই হুবহু করে ফেলার মধ্যে একটা রবিনহুডীয় বাহাদুরি আছে!

    বাদবাকি আর দশটা ভাল-ভাল জিনিসের মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খিস্তির মালিকানাও হাতবদল হয়ে গিয়ে পুরুষের ‘বাপের সম্পত্তি’-তে পরিণত হয়েছে। মূলধারার ভাষাশিক্ষা, ভাষাচর্চা, এমনকী, নিজের শরীরের ওপরও হক না-থাকা মেয়েদের হাতে পড়ে থেকেছে পেনসিল।

    কিন্তু মুশকিলটা বাধল অন্যত্র গিয়ে। ‘যা যা মেয়েদের করতে নেই’— এই হিসেবে কোথা হতে নারীবাদের পাঠও ঢুকে আসে। আর দেখা যায়, চালু খিস্তিখেউড়ের ম্যাপের সঙ্গে নারীবাদী ভাবনাচিন্তার ম্যাপ প্রায় মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ। এহেন স্ববিরোধী ভেন ডায়াগ্রামের সামনে দাঁড়িয়ে বোম্বাচাক লেগে যায়। কারণ প্রতিটি ‘স্ল্যাং’ তথা নিষিদ্ধ শব্দ অমন আপাত সাদাসিধে মুখ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে যা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, তাকে নারী ক্ষমতায়ন ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে? অন্তত সে মুহূর্তগুলোয় এক আশ্চর্য নাশকতামূলক ক্ষমতায় ভর করে নিজেকে যে হালকা ওয়ান্ডার ওম্যান-সুলভ সুপার হিরোইন বোধ হয়নি— তা বললে মিথ্যে বলা হবে! অথচ অধিকাংশ খিস্তির অরিজিন স্টোরিতেই যে ভয়ানকভাবে নারীবিদ্বেষের ছিটছিটে দাগ লেগে আছে!

    কালীঘাট পটচিত্র

    কাজেই সমস্যাটা আখেরে ‘মেয়েলি’। একজন সংবেদনশীল মহিলা কোন আক্কেলে কাউকে মাতৃসংগমকারী বা ভগিনীসংগমকারী হিসেবে গাল পাড়তে পারেন? যার গভীরে ঢুকলে দেখা যায়, শুধু রাগ নয়, মহিলাদের বিরূদ্ধে যৌন হিংসে থেকে পরিবারের মহিলাকে পুরুষ্যেতর কোনও জড় পদার্থ হিসেবে গণ্য করা— এবং সেই জড় পদার্থের প্রকৃত মালিকানা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ—খিস্তিখেউড়ের ইতিহাস প্রকৃত প্রস্তাবেই রক্তাক্ত।

    কারণটা স্বাভাবিক। বাদবাকি আর দশটা ভাল-ভাল জিনিসের মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খিস্তির মালিকানাও হাতবদল হয়ে গিয়ে পুরুষের ‘বাপের সম্পত্তি’-তে পরিণত হয়েছে। মূলধারার ভাষাশিক্ষা, ভাষাচর্চা, এমনকী, নিজের শরীরের ওপরও হক না-থাকা মেয়েদের হাতে পড়ে থেকেছে পেনসিল। আর পুরুষ তার নিজের প্রয়োজনে, নিজের জবানে খিস্তির চরিত্র বদলেছে। যে কারণে খিস্তিতে পুরুষাঙ্গের বর্ণনা থাকলে, তা রাখা হয় যন্ত্রটি ঠিকঠাক কাজ করে না— এরূপ খোঁচা থেকে (কোনও এক আদিম কারণে পুরুষ-মাত্রেই এতে ভয়ানক চটে যান), আর মেয়েদের জননাঙ্গের বর্ণনাসুলভ স্ল্যাংগুলো আখেরে মেয়েদের স্রেফ যৌন সামগ্রী হিসেবে সংকুচিত করার কারণে। এমনকী, বিকল পুরুষাঙ্গের উপস্থিতিতে কোনও পুরুষ ‘নিষ্ক্রিয়’ মাংসের তালের মতো একটি যোনিতে পরিণত হয়েছেন—এমন ইঙ্গিতবাহী খিস্তির সংখ্যাও কম নয়। 

    এই অবধি পড়ে সুধী পাঠক প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘ওসব খারাপ কথা বলারই দরকার কী? না বললেই তো মিটে যায়!’ কিন্তু মিটে যায় না এই কারণেই যে, স্ল্যাং যে কোনও ভাষারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার জন্ম প্রয়োজনের তাগিদেই। খিস্তি অপরিহার্য, কারণ তাকে অন্য কোনও শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার মানে খানিকটা ‘আপেল’-কে আপেলের বদলে ফুলকপি নামে ডাকার মতো। তাছাড়া বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এও আবিষ্কার করেছেন যে, শরীরে ভালরকম ব্যথা পাওয়ার মুহূর্তে চেঁচিয়ে একটি মোক্ষম খিস্তি মেরে উঠতে পারলে ব্যথা-বেদনার অনুভূতি প্রায় ৩৩ শতাংশ অবধি কমে যেতে পারে! কাজেই ‘ওসব না বললেই হয়’, অনেকটা অসুখে মেয়েদের পেনিসিলিন বা প্যারাসিটামল না খেলেই হয় বলার মতো যুক্তি।

    পাশ্চাত্যে নারীবাদীরা অবশ্য অনেকেই অনেকদিন ধরেই এই সমস্যার সমাধান বের করার চেষ্টা করে চলেছেন। ‘বিচ’ বা ‘কান্ট’-এর মতো শব্দগুলোকে মেয়েরা নিজেদের মতো করে রিক্লেইম করে নেবে— এমন কল্পনায় বইয়ের পর বই লেখা হয়েছে। কারণ ইতিহাস অংশত অভ্যেস। আর অভ্যেস বদলানো সম্ভব।

    অথচ, এ-কথাও সত্যি অভ্যেস বদলাতে, ক্লাস সেভেনের বাংলা প্রশ্নপত্রের ব্যাকরণের লিঙ্গ পরিবর্তনের উত্তরের মতো মাতৃসংগমকারীকে ‘পিতৃসংগমকারিনী’ বললেই নারী ও পুরুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টি সার্বিকভাবে বদলে যায় না। ‘টিট ফর ট্যাট’ না-হয় হইল, কিন্তু কিক আসিল কি? আরোপিত পরিচয়ের মতোই এসব খিস্তিও ব্যবহারিক রেসে মুখ থুবড়ে পড়ে।

    জুলিয়া ক্রিস্তেভা

    জুলিয়া ক্রিস্টেভার মতো ফরাসি নারীবাদীরা অবশ্য মনে করেন, ‘পুরুষ’ আর ‘নারী’ মৌলিকভাবে আলাদা। আর যে নারী পুরুষের ভাষায় কথা বলে, সে আখেরে নিজেরই অজান্তে পুরুষের পোশাক নিজের শরীরে গলিয়ে নেয়! (এদিকে মাত্র কয়েক দশক আগেই জুলিয়ার দেশেই সিম্যন দ্য বোভেয়া মুখে রক্ত তুলে বলে গিয়েছিলেন, এই ‘আলাদা’ হওয়ার গল্পটা আখেরে পিতৃতান্ত্রিক ধাপ্পাবাজি! অবিশ্যি প্যারিসে সবই সম্ভব।) তাছাড়া ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’

    কিন্তু রেগে গিয়েও পুরুষের ভাষা ব্যবহার করার বদলে মাইম করার প্রস্তাবটি মনে ধরে না। কাজেই খোঁজ। মেয়েদের নিজস্ব খেউড়ের খোঁজ। এককালে নিশ্চয়ই ছিল। যখন সমাজে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা ছিল না। যখন মেয়েরা অন্দরমহলে নিজেদের মতো নিজেদের একটা জগৎ গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিল। হয়তো সে জগতে নিজস্ব দেখার চোখ, নিজস্ব ভাষার সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব খিস্তির ভাঁড়ারও মজুত ছিল!

    কিন্তু রান্নাঘরের ভাষার হিসেব কোনও অ্যাকাডেমি রাখেনি, আর পৃথিবীতে রোজ কত ভাষাই তো এভাবে মরে যায়, দু-একটা অধঃক্ষেপ শুধু পড়ে থাকে যৌথ অবচেতনে। আর একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে নিজেকে নারীবাদী ভেবে শ্লাঘা বোধ করা আমি টের পাই, কাউকে ‘মিনসে’ বললে আখেরে তেমন কিছুই মিন করা হচ্ছে না! মোদ্দা কথা, ঝাঁঝটাই উধাও।

    এমত সময়ে আশ্চর্যভাবে এক স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে দেখি এক শীর্ণকায় যুবা বলছে, এসব দিকে দিয়ে বাংলা ভাষা খুব ভালো। কারণ হিন্দি, মৈথিলি, পাঞ্জাবি বা ভোজপুরির মতো গড় বাঙালি শ্রোতার মা-বোন তুলে অপমান করে না, সে সরাসরি তার বৌদ্ধিক পরিধিকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করায়। সে শ্রোতার বুদ্ধিকে আক্রমণ করে। আর সে পবিত্র চার-অক্ষর দেশ, কাল, জাতি এবং হ্যাঁ লিঙ্গনিরপেক্ষ! উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই দরজার পাল্লায় কড়ে আঙ্গুল চেপটে যাওয়ার ব্যথা ৩৩ শতাংশ কমে যাচ্ছে, আমি টের পাই! কী আরামের, কী নরম কাঁথার মতো, মায়ের আদরের মতো মাতৃভাষার সেই উচ্চারণ!

    আমি মনে মনে বাংলা ভাষাকে আরও একবার নতুন করে ভালবেসে ফেলি। তারপর মনে মনেই আলতো হেসে ক্লাস সেভেনের অর্ণবের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলি— ‘সরি রে বোকা…’!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook