ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ইডেনের ঈশ্বরেরা


    বোরিয়া মজুমদার (Boria Majumder) (March 13, 2021)
     

    ভারতের ‘প্রধান জাতীয় প্যাশন’ তকমা বজায় রাখতে ২০০১-এ ক্রিকেটের নতুন অক্সিজেনের প্রয়োজন ছিল। ভারত যে ক্রিকেটে একটা গুরুত্বপূর্ণ শক্তি এবং দেশটা যে এই খেলার মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে চলেছে, ক্রিকেট-ভক্তদের মধ্যে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং নতুন ভক্ত তৈরি করা, দুটোই দরকার ছিল। ২০০১-এ ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ভারতীয় দলের কিছু অনবদ্য পারফর্ম্যান্সের দরুন, ঠিক তা-ই হয়। ক্রিকেট-জাতীয়তাবাদ তুঙ্গে ওঠে। এর পর থেকেই গোটা দেশে ক্রিকেট-জ্বর এক অন্য মাত্রা পায়, পৌঁছয় এমন এক জনপ্রিয়তায় যা এমনকী আই.পি.এল স্পট-ফিক্সিং কেচ্ছা ও পরবর্তী আদালতের হস্তক্ষেপও বিন্দুমাত্র দমিয়ে দিতে পারেনি।    

    যে অস্ট্রেলিয়া দল ২০০১-এ ভারত সফরে এল, তারা সেই মুহূর্তে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দলগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। টানা ১৫টা টেস্টে অপরাজিত থাকা এই অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিততেই এসেছিল। অধিনায়ক স্টিভ ওয়া ভারতের বিরুদ্ধে এই সিরিজের নাম দিয়েছিলেন ‘শেষ সীমানা’। ক্রিকেটের ইতিহাসে ওয়া-র দল সহজেই ‘শ্রেষ্ঠতম’ আখ্যা পেতে পারে, এবং সদ্য অধিনায়কপদে ভূষিত সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিঃসন্দেহে আন্ডারডগ ছিল।     

    মুম্বইয়ে প্রথম টেস্টেই বোঝা গিয়েছিল এই অস্ট্রেলিয়া দলটা ঠিক কতটা ভাল। ম্যাথিউ হেডেন এবং অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-এর দুটো সেঞ্চুরি এবং গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেসপি এবং শেন ওয়ার্নের অসামান্য বোলিং-এ ভর করে ওয়া-র অস্ট্রেলিয়া, তিন দিনে ভারতকে তুড়ি মেরে হারায় ও সিরিজে এগিয়ে যায়। ‘ওরা সত্যি খুবই ভাল একটা দল ছিল’, প্রতিপক্ষের ক্ষমতার কথা মনে করে বলেন সৌরভ গাঙ্গুলি, ‘আমরা ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না, কীভাবে এবং কী করলে ওদের মোকাবিলা করা যাবে। সত্যি বলতে, আমি উত্তর হাতড়াচ্ছিলাম। ওদের খেলায় প্রত্যেকটা দিকই এত শক্তিশালী ছিল যে জিততে হলে আমাদের একদম অন্যরকম কিছু  করার প্রয়োজন ছিল। সেভাবে দেখলে, কলকাতার টেস্ট জয় ছিল একেবারেই অদ্ভুত। দ্বিতীয় দিনে আমরা কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার ৪৪৫-এর জবাবে ১২৮/৮ থেকে ওই টেস্ট জিতেছিলাম, সেটা একটা অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে হয়। বলা যায়, ঈশ্বরের হস্তক্ষেপে তা হয়েছিল। ক্রিকেটে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল।’ 

    মুম্বই টেস্টের পর ভারতের সবচেয়ে গোঁড়া ভক্তও বোধহয় ভাবেনি, ভারতের জেতার আর কোনও সম্ভাবনা আছে। অস্ট্রেলিয়া নিজের প্রাধান্য দাপিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল, মনে হয়েছিল ভারত লড়তেই পারবে না। হ্যাঁ, হরভজন মুম্বইতে অসাধারণ বল করেছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটে ‘সর্বকালের সেরা’ তকমা পাওয়ার যোগ্য এই অস্ট্রেলিয়ার বিধ্বংসী ব্যাটিং লাইন-আপের টুঁটি বারবার টিপে ধরতে তাঁর মতো নবীন ক্রিকেটারের উপর ভরসা করে থাকাটা সম্ভব ছিল না।  

    ইডেন গার্ডেনস-এও খেলা অস্ট্রেলিয়ার আনুকূল্যে চিত্রনাট্য-মাফিক এগোচ্ছিল। প্রথম দিনে, চার উইকেটে ২৫২ রানে অস্ট্রেলিয়া বেশ বড় একটা টোটাল তৈরি করার দিকে এগোচ্ছিল। তারপর ঘটল প্রথম মিরাক্‌ল—হরভজনের হ্যাটট্রিক, সিরিজের প্রথম অলৌকিক ঘটনা। প্রথম ভারতীয় হিসাবে হরভজন এই হ্যাটট্রিক করা মাত্র কলকাতার বিশাল সংখ্যক দর্শক যেন হঠাৎ জেগে ওঠে। শান্ত ইডেনে সাড়া জাগতে শুরু করে, এবং হঠাৎই যেন খেলাটা একটা প্রতিযোগিতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ভারত প্রতি-আক্রমণ শুরু করায় এরকম মনে হতে থাকে, অস্ট্রেলিয়ার টেল এন্ড-কে জলদি শেষ করে দিলে, গাঙ্গুলির দল এখনও খেলার মোড় ঘোরাতে পারে। ভারতের দুর্ভাগ্য, এই ল্যাজও বেশ জোরে ‘দুলেছিল’, একটা অসামান্য সেঞ্চুরিসহ স্টিভ ওয়া নিজের দলকে নিপুণ ভাবে ৪৪৫-এ টেনে নিয়ে যান। প্রাণবন্ত অস্ট্রেলিয়ান বোলিং অ্যাটাকের মুখে ভারতের পক্ষে এই স্কোর ছাপিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের টপ অর্ডার যখন তৃতীয় বারের জন্যেও ভেঙে পড়ে, তখন মনে হয় ১৭-তম টেস্ট জয়— বিশ্ব ক্রিকেটে পৃথিবীতে কোনও দলের ক্ষেত্রে যা প্রথম— বোধহয় অস্ট্রেলিয়া খুব সহজেই করে ফেলবে। 

    তৃতীয় দিনের সকালে ভারত যথেষ্ট তৎপরতা দেখায়, অনেকটাই ভি ভি এস লক্ষ্মণের দৌলতে, যিনি দৃঢ়চরিত্র ৫৯ করেন এবং আউট হন সবার শেষে। ২৭৪ রানে এগিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়া ভারতকে ফলো-অনে বাধ্য করে। ‘ওই সিরিজে ততক্ষণে আমরা ভারতকে মেপে নিয়েছিলাম, এবং আমাদের বোলাররা আত্মবিশ্বাসী ছিল যে তারা আরও একবার জয় ছিনিয়ে আনবে। ভারতকে আবার ব্যাট করতে বলতে তাই আমার কোনও দ্বিধা হয়নি’, বলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্টিভ ওয়া।   

    এক উদ্বুদ্ধ সিদ্ধান্তে ভারত সেই দিন সকালে লক্ষ্মণকে তিন নম্বরে ব্যাট করায়— যে সিদ্ধান্ত ভারতীয় ক্রিকেটে আমূল রূপান্তর ঘটায়। ‘প্রথম ইনিংসে লক্ষ্মণ যেভাবে ব্যাট করে, আমরা মনে করি ওকে তিন নম্বরে খেলানোই আমাদের পক্ষে ঠিক হবে। রাহুল (দ্রাবিড়) ছ’নম্বরে ব্যাট করতে পারত; যা অস্ট্রেলিয়ানদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারত’, সেই দিনের কথা মনে করে হেসে বলেন গাঙ্গুলি, ‘কিন্তু এর পরে যা ঘটে তা কেউ অনুমান করতে পারেনি। এমনকী, যখন আমি আউট হই এবং আমরা তৃতীয় দিন চার উইকেটে ২৫৪ করে শেষ করি, খেলাটা অস্ট্রেলিয়ারই ছিল। আমাকে বলতেই হবে, এর পরে যা ঘটে তা ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পার্টনারশিপের প্রদর্শন। চতুর্থ দিনে, একটা উইকেটও না হারিয়ে আমরা ৩৩৫ রান তুলি। দিনের শেষে, ওরা এত ফ্লুইড খুইয়েছিল যে রাহুল আর লক্ষ্মণ দুজনকেই ড্রেসিং রুমে ড্রিপ নিতে হয়। ক্লান্তি এবং ক্র্যাম্প সত্ত্বেও, ওরা একে অপরকে মনের জোর জুগিয়ে যায়। ঘটনাটা অস্ট্রেলিয়া বিশ্বাস করতে পারছিল না।’

    ৪২৫ বলে লক্ষ্মণের ২৮১— ২০০০ সালে সিডনিতে করা তাঁর ১৬৭ সত্ত্বেও— ক্রিকেটার হিসাবে তাঁর পূর্ণতাপ্রাপ্তির স্মারক। ‘আমি পুরো টেস্ট ম্যাচটায় ভাল ব্যাট করছিলাম। আমাকে যখন দ্বিতীয় ইনিংসে তিন নম্বরে ব্যাট করতে বলা হয়, বলতেই হয় যে আমার ভাল লেগেছিল। ভাল ফর্মটা কাজে লাগানোর এটা একটা দারুণ সুযোগ ছিল। রাহুলের সঙ্গে পার্টনারশিপ যত এগোয়, একসঙ্গে ১০০ রান করায় আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে আমরা এগোতে পারব। আমরা জানতাম যে নতুন বল এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেল খেলে ফেলতে পারলে অস্ট্রেলীয়রা চাপে পড়ে যাবে। আমাদের প্ল্যান কাজ করে। ক্লান্তি সত্ত্বেও আমরা একে অপরকে অনুপ্রাণিত করতে থাকি, কেননা এমন কিছু ঘটতে চলেছিল, যা সত্যিই অসাধারণ’, ইডেনে ঠিক ওই একই ড্রেসিং রুমের বাইরে বসে সেদিনের কথা মনে করে বলেন লক্ষ্মণ। 

    এই ইনিংস চলাকালীন ওয়ার্নের বলকে বেধড়ক মারা হয়েছিল। যতবার লক্ষ্মণ পিচে নৃত্যভঙ্গিমার মতো সাবলীল ভাবে এগিয়ে এসে টার্নের বিপরীতে অফসাইডে খেলছিলেন, ইডেন ততবার ফেটে পড়ছিল। গ্ল্যাডিয়েটর তাঁর দর্শক পেয়েছিলেন— একটা জনজোয়ার, যা হঠাৎ একটা অলৌকিক সম্ভাবনায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, আর রুদ্ধশ্বাসে ম্যাচটা দেখছিল। চতুর্থ দিনের শেষে অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়দের কাঁধ ঝুলে যায়, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভারত এই ইডেন টেস্ট হারবে না। হোম সাইডের পক্ষে এই একটা টেস্ট জেতার তাৎপর্য প্রবল এবং বহু স্তরে। এক, এটা শুধু অসীম শক্তিমান অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে কোনও একটা জয় নয়— এর মানে দাঁড়াবে অস্ট্রেলিয়ার অব্যাহত জয়ের ধারায় ছেদ টানা। কেউ কি ভাবতেও পেরেছিলেন যে তিন-ম্যাচের এই সিরিজ চেন্নাই-এ ডিসাইডার অবধি পৌঁছবে, ১-১ অবস্থায়? মনে হয় না। 

    লক্ষ্মণের ২৮১ এবং দ্রাবিড়ের ১৮০-র (তাঁর সব সমালোচকের প্রতি জবাব) দৌলতে গাঙ্গুলি পঞ্চম দিনের সকালে ডিক্লেয়ার করেন, অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে এমন একটা লক্ষ্য স্থির করে দিয়ে, যা ঘূর্ণি-পিচে বেশির ভাগ দলই তাড়া করতে চাইবে না। কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়া তো আর যে-কোনও দল ছিল না। তারা বিশ্বশ্রেষ্ঠ, এবং কোনও মোকাবিলা থেকে পিছপা হওয়ার দল নয়। হরভজন তাঁর কেরিয়ারের সেরা বোলিং করছিলেন। ইডেন গার্ডেনসে উপস্থিত প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর পক্ষে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

    লক্ষণ-দ্রাবিড় জুটি

    ইডেন গার্ডেনসের প্রেস বক্স— যেখানে আমি জীবনে এই প্রথম বসেছিলাম— আবেগে ভেসে যাচ্ছিল। অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকেরা যা দেখছিলেন তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এবং মনে করছিলেন যে ওয়া এবং তাঁর দল ঠিক খেলাটা ধরে নেবেন। অন্যদিকে, ভারতীয় সাংবাদিকেরা তাঁদের হারানো স্বর খুঁজে পেয়েছিলেন। দু’দিন ধরে চুপ করে থেকে, ব্যঙ্গ সহ্য করে, এখন প্রতিটি অস্ট্রেলীয় উইকেটপতন উচ্ছ্বাসিত হয়ে উদযাপন করছিলেন।  

    চায়ের বিরতির ঠিক আগে ওয়া-র ক্যাচ পড়ে যাওয়ায় মনে হয়, টেস্টটা ড্র হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। বিরতির সময় অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক অপরাজিত হয়ে ফেরেন, এবং তখনও সাত উইকেট তাদের হাতে থাকায়, মনে হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া কিছুতেই হারবে না, যদিও হরভজন একেবারে অবিশ্বাস্য বল করছিলেন। ‘দেবতারা অন্য রকম ভেবেছিলেন’, মুখের হাসি অটুট রেখে বলেন গাঙ্গুলি, ‘চায়ের বিরতির পর খেলা শুরু হওয়ার কিছু মুহূর্ত পরেই, স্টিভ ওয়া আমাদের আরও একটা সুযোগ দেয় এবং আমরা সেই সুযোগ হারাইনি। ওয়া আউট হওয়ার পর থেকেই আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে অসাধ্য সাধন করতে পারব। এবং এর পরও যখন কিছুক্ষণ কিছু হয় না, আমি শচীন তেন্ডুলকরের কাছে যাই, ওকে একটা বা দুটো ওভারে ব্যবহার করব বলে। প্ল্যানটা ছিল যে, এক দিকে টাইট বোলিং থাকবে, আর অন্যদিকে আমার আসল হাতিয়ার হরভজনকে দিয়ে উইকেট তুলব। শচীন, যে চিরকালই ভাল বল করত, সেদিন একটা মায়াবী পাঁচ ওভারের স্পেল বল করে তিন উইকেট নেয়; আমাদের জন্য গেম, সেট এবং ম্যাচ জিতে নেয়। শেন ওয়ার্নকে যে গুগলিতে ও আউট করে, পৃথিবীর যে কোনও ব্যাটসম্যান ওই বলে আউট হয়ে যেত।’ 

    ব্যাট নিয়ে বেশি কিছু করতে না পারা তেন্ডুলকর— দুই ইনিংসেই মাত্র দশ রান করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন যিনি— বল হাতে দলের খাতিরে এগিয়ে আসতে ছটফট করছিলেন। ‘আমি জানতাম কিছু করার জন্য আমার হাতে এক বা দু’ওভারই আছে। আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে হেডেন এবং গিলক্রিস্ট-এর ক্ষেত্রে আমি অনেক রকম মিলিয়ে-মিশিয়ে বল করব, কেননা গতানুগতিক বিচক্ষণতা বলে যে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে আমি শুধু অফস্পিন বল করব। এবং যখন হেডেন এবং গিলক্রিস্ট-কে আমি আউট করতে পারলাম, ওয়ার্ন পিচে আসা মাত্র আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে ওকে আমি একটা গুগলি দেব। এটা ওয়ার্ন একেবারেই অনুমান করেনি, এবং এটাই আমার তৃতীয় উইকেট তোলার সুযোগ ছিল। আমি যতটা চেয়েছিলাম, বলটা ততটা ভাল হয়নি, কিন্তু বলটা এমন ঘুরেছিল, ওয়ার্ন বুঝতে পারেনি। এবং যখন বলটা ক্রিজের মধ্যেই ওর গায়ে লাগল, আমি জানতাম যে ও প্লাম্ব এল বি ডাবলিউ ছিল,’ বলেন শচীন।      

    শেষ পর্যন্ত, হরভজন যখন ম্যাকগ্রাকে এল বি ডাবলিউ-র ফাঁদে ফেলেন— যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্রিকেটের ঘটনাপঞ্জিতে চিরকাল তর্ক লেগেই থাকবে— ইডেনের ১০০,০০ দর্শক সমবেত উল্লাসে ফেটে পড়েন। বধির করে দেওয়া শব্দ, সম্মোহনী উত্তেজনা। ম্যাচ ফিক্সিং যেন এক লহমায় অতীত। গাঙ্গুলির দল এমন এক কৃতিত্ব সম্পন্ন করেছিল, যা বিশ্ব ক্রিকেটে অন্য কোনও দল পারেনি। অস্ট্রেলীয়দের যে হারানো যায়, তা প্রমাণিত হল। গাঙ্গুলির কথায়, ভারত চেন্নাই ডিসাইডার খেলতে গেল এই বিশ্বাস নিয়ে যে, খেলার গতি এখন তাদের অনুকূলে।  

    ইডেন টেস্ট ম্যাচ যে সমাজের সব স্তরের মানুষের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল, তার উদাহরণ হিসাবে একটা ঘটনার কথা বলা যাক। শেষ উইকেট পড়ার সময় অবধি যিনি মাঠে ছিলেন, সেই আম্পায়ার এস কে বনশল হোটেলে ফেরার পথে, তাঁর ড্রাইভার ভুল বাঁক নিয়ে একটা ওয়ান-ওয়ে রাস্তায় ঢুকে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক কনস্টেবল তাকে থামান এবং লাইসেন্স চেয়ে বসেন। ভয় পেয়ে যাওয়া ড্রাইভার বেগতিক দেখে আম্পায়ার বনশলের শরণ নেন। গল্পটা এইরকম— বনশল গাড়ি থেকে নেমে পুলিশকর্মীর কাছে ড্রাইভারের হয়ে ক্ষমা চান এবং তাঁকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। ওঁকে দেখে কনস্টেবল কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞাসা করেন, সত্যিই কি উনি ‘সেই বনশল’, যিনি সেদিন গ্লেন ম্যাকগ্রা-কে আউট ঘোষণা করেছিলেন? তাঁর পরিচিতি সম্বন্ধে আশ্বস্ত হয়ে, কনস্টেবল ড্রাইভারকে ছেড়ে দেন, এই বলে যে, আম্পায়ার বনশলের জন্য সেই সন্ধ্যায় সব নিয়মে বদল সম্ভব! 

    পরের দিন সকালের সংবাদপত্রে ক্রিকেট আবার প্রথম পাতায় ফেরত আসে। হরভজন, দ্রাবিড় এবং লক্ষ্মণকে ‘জাতীয় ত্রাতা’ হিসাবে দেখা হতে থাকে, এবং ম্যাচ ফিক্সিং-এর প্রেতের ছায়া ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। ইডেন গার্ডেনস-এর টেস্টের মতো ম্যাচ ফিক্স করা সম্ভব নয়, ফিক্স করে ভারতীয় দলের মতো ব্যাট আর বল করা সম্ভব নয়। এখানে ক্রিকেট একেবারে অন্য স্তরে উঠে গিয়েছিল, এবং এই টেস্টের মতো খেলার চিত্রনাট্য আগে থেকে লিখে দেওয়া অসম্ভব। ওয়ার্নকে মিড-অন বা মিড-অফের উপরে তুলে মারার জন্য ক্রিজ ছেড়ে পিচে এগিয়ে আসা লক্ষ্মণ, হরভজনের স্বপ্নের স্পেল এবং শেষে দ্রাবিড়ের সঞ্জীবনী ব্যাটিং— এ-সবেরই দরকার ছিল ক্রিকেটের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য। ইডেনের অলৌকিক টেস্ট জয়ের কারণে, এই সবই হয়েছিল।   

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook