রাজছত্র ভেঙে পড়ে৷ রণডঙ্কা শব্দ করে না। দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের অতিকায় মূর্তির মাথা গড়ায় রাজপথে৷ ‘জাতির পিতা’, অমিত-শক্তিশালী একনায়ক বা দুর্ধর্ষ সম্রাটের ভাস্কর্য গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়৷ সময়ের চাকতির খেল এমনই। আজকের মহানায়কের গলা কাটা পড়ে আগামিকালের গিলোটিনে৷ নির্বিচারে প্রাণ যায় অজস্র নিরপরাধ জনতার। পলাতক বা পরাজিত শাসকের প্রাসাদে লুটপাট হয়। নির্বিচারে আগুন দেওয়া হয় বিগত আমলের অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যে। হেলিকপ্টারে ঝুলতে ঝুলতে দিগন্তের দিকে উড়ে যান পরাজিত শাসকের ‘আইকন’— যিনি নিজে হয়তো ছিলেন এক মরমী স্বপ্নদ্রষ্টা, কিন্তু স্বৈরাচারী উত্তরসূরিরা যাঁকে টেনে নামিয়েছে গণঘৃণার পাঁকে।
এক চিনা ‘বিপ্লবী’ বলেছিলেন, বিপ্লব সূচিকর্ম বা ভোজসভা নয়৷ কথাটা সত্যি, তবে প্রতিবিপ্লবও ঠিক তাই। বড়সড় গণঅভ্যুত্থানের পর সমাজে আলো ও অন্ধকারের শক্তিরা নেমে পড়ে জমি দখলের যুদ্ধে৷ কখনও আলোর পক্ষ জয়ী হয়, কখনও অন্ধকারের। ঘোলাটে সময় জুড়ে চলে মৃত্যুর মিছিল, রক্তের হোলিখেলা।
আরও পড়ুন : ডিপসিক ও ওপেনএআই কি মানুষেরই মেধা চুরি করছে? লিখছেন শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য…
১৭৮৯ সালে বাস্তিলের পতনে তাই ফরাসি বিপ্লব শেষ হয় না৷ সবে হাঁটি হাঁটি পায়ে এগতে থাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে৷ সম্রাটের মাথা কাটা পড়ে কয়েক বছর পর। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সমাজের পায়ের তলায় থাকে পাথরকুচি, টুকরো কাচ ও পেরেক। সামনে অনন্ত গিলোটিন৷ বিপ্লবের এমনই নিয়তি৷ এই পথেই তাকে হাঁটতে হয় চিরকাল৷ ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ বিপ্লব তাই শেষ হয় না, এমনকী, নভেম্বরেও না৷ দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত, পিচ্ছিল পথ পেরতে হয় তাকে৷ ‘ইস্পাত’-এর পাভেল কোরচাগিনদের মরতে এবং মারতে হয় বছরের পর বছর৷ লড়াই চলে বিপ্লবীদের নিজেদের মধ্যে৷ লড়াই চলে বিপ্লব-বিরোধীদের সঙ্গেও। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, নৈরাজ্য পেরিয়ে হাঁটতে হয় বিপ্লবকে। বড় কোনও গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পরেই স্বপ্নের নন্দনকানন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন অনেকে। এই কুৎসিত পৃথিবীতে অমন অনিন্দ্যসুন্দর স্বপ্ন ইউটোপিয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম বলেছিলেন, ‘In times of revolution nothing is more powerful than the fall of symbols.’ বিগত জমানার ‘প্রতীক’গুলির ওপর আছড়ে পড়ে গণঘৃণা৷ এ বড় সুখের সময় নয়৷ এই সময় দানব ও দেবদূতদের। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুরে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের দায় আছে। এই বাড়ি রক্ষা করতে না-পারা অপরাধ। কিন্তু যুগে যুগে বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পরে গণঘৃণার এমন চিৎকৃত, উৎকট প্রকাশের সাক্ষী থেকেছে ইতিহাস। রাশিয়া, আমেরিকা, জার্মানি, চিন, ইরান, ব্রিটেন— সর্বত্র ঘটেছে এমন৷
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব৷ তিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি৷ যে ন’মাস মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই সময়কালে তিনি বন্দি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে৷ ইতিহাসের এমনই পরিহাস, শেখ মুজিবের নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, অথচ তিনিই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি নেতা, যিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি৷ অতি-বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী, মুজিবনগর সরকারের প্রধান তাজউদ্দিন আহমেদ, কমিউনিস্ট বিপ্লবী সিরাজ শিকদার, মণি সিং— সকলেই হাতে-কলমে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন৷ কেউ দেশান্তরী হয়েছেন, কেউ দেশের মধ্যে আত্মগোপন করে গড়ে তুলেছেন সংগ্রাম। স্বাধীনতার পরে যাঁরা জাতীয় ‘সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ) গড়ে মুজিব সরকারের বিরোধিতা করবেন, সেই সিরাজুল আলম খানরা মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে ছিলেন ‘মুজিব বাহিনী’ নামে।
ছিলেন না শুধু একজন, যাঁর নামে মুক্তিযুদ্ধ, সেই শেখ মুজিব।
ন’মাস রক্তের বন্যায় স্নান করে, লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করল বাংলাদেশ। জেল থেকে ছাড়া পেলেন শেখ মুজিব। লন্ডন, দিল্লি হয়ে এলেন ঢাকায়। তাঁকে স্বাগত জানালেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তিনি তখন গণনায়ক, ভগবানের মতো তাঁর ইমেজ৷ তাঁকে ঘিরে আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা। কিন্তু গত ন’মাসে বাংলাদেশ ভেতরে ভেতরে বদলে গিয়েছে। এত রক্ত, এত প্রাণহানি, এত নির্যাতন ও প্রতিরোধ একটি জাতিকে বদলে দেয় অন্তর থেকে। জেলে আটক শেখ মুজিব সেই বদলের প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারেননি৷ তিনি পারতেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব পক্ষকে নিয়ে জাতীয় সরকার তৈরি করতে৷ তিনি তা করলেন না। তিনি তৈরি করলেন আওয়ামী লীগের সরকার, নিজে হলেন সরকারের প্রধান। ধীরে ধীরে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লেন এমনকী, তাজউদ্দিন আহমেদের মতো নেতাও।
সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশ দেখল তার স্বপ্নের নায়কের দানবিক স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা। প্রিয় ‘বঙ্গবন্ধু’, প্রিয় ‘মুজিবভাই’ যাবতীয় বিরোধী স্বর দমন করলেন নিষ্ঠুর হাতে৷ তৈরি করলেন রক্ষীবাহিনী৷ তাদের নির্মম নির্যাতনের কাহিনি ফিরল মুখে মুখে। রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হল মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধীদের। দেশজুড়ে নৈরাজ্য। হাজার হাজার প্রাণ গেল৷ সিরাজ শিকদার খুন হলেন। মুজিব হুংকার দিলেন, ‘কেথায় আজ সিরাজ শিকদার?’
১৯৭৩ সালে নির্লজ্জের মতো ভোট লুট করল আওয়ামী লীগ। মুজিব হত্যার পর যে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসবেন, তাঁকে জেতাতে হেলিকপ্টারে করে ব্যালট চুরি হল৷ ইতিহাস বোধহয় তখনই মুচকি হেসেছিল৷ ’৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হল৷ ’৭৫-এ শেখ মুজিব তৈরি করলেন গণতন্ত্র-হত্যাকারী একদলীয় শাসন— বাকশাল।
দেশজোড়া নৈরাজ্য। গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে মুজিব পরিণত হলেন খলনায়কে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবার নৃশংস, বর্বরোচিতভাবে হত্যা করল ঘাতকের দল। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা মুজিবের স্বাভাবিক বিচার হল না। তিনি চিরতরে রয়ে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে, ‘শহিদ’ হয়ে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধী খুনের পরে উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, তিন বছর আগে যে মুজিবকে বরণ করতে জনস্রোতে ভেসে গিয়েছিল ঢাকা শহর, তাঁর মৃত্যুর পর কোনও শোক মিছিল হল না ঢাকা শহরে, কেউ পথে নামলেন না। দীর্ঘ কয়েক মাস পরে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল করলেন ছাত্ররা।
সেই বাকশালের স্মৃতি এখনও জেগে আছে বাংলাদেশে৷ ঢাকার রাজপথে ‘মোদি-হাসিনা’-র বিরুদ্ধে যেমন দেওয়াল লেখা, তেমনই ‘বাকশাল ২.০’-বিরোধী গ্রাফিতিও অজস্র। শেখ হাসিনা গত তিনটি নির্বাচনে ভোট লুট করেছেন। নির্বাচন বলেই কিছু হয়নি৷ যাবতীয় বিরোধী কণ্ঠ দমন করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁর শাসন উৎখাত করেছে বাংলাদেশ। সেই সূত্রে টান পড়েছে ইতিহাসের শিকড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবের অতিকায় গ্রাফিতির অর্ধেক ঢেকে আঁকা হয়েছে কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ শিকদারের ছবি। সঙ্গে ক্যাপশন, ‘লাল ঘোড়ার প্রত্যাবর্তন’। এই সিরাজ শিকদারকেই হত্যার অভিযোগ উঠেছিল মুজিবের বিরুদ্ধে। অর্ধশতক পরে লাল ঘোড়া ফিরে এল নৈরাজ্যের আগুনে জ্বলতে থাকা, মুজিবের বাড়ি ও মূর্তি ভাঙা অশান্ত ঢাকায়।
এমনই হয়। চিরকাল এমনই হয়েছে দেশে দেশে।
১৭৭৬-এর জুলাই মাসে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার পর নিউ ইয়র্কে তৃতীয় জর্জের চার হাজার পাউন্ড ওজনের মূর্তি ভাঙচুর করেছিল উৎফুল্ল জনতা। ফরাসি বিপ্লবের সময় বাস্তিলের পতনের কথা তো বহুচর্চিত। সেই কালপর্বেই একের পর এক পঞ্চদশ লুই, ষোড়শ লুই, ষষ্ঠ হেনরির মূর্তি-সহ সাম্রাজ্যের বহু স্থাপত্যচিহ্ন ভেঙে ফেলে বিপ্লবী জনতা।
মার্টিন লুথার কিং জাগিয়ে তুললেন ইউরোপের বিরাট অংশের জনতাকে৷ সেই জাগরণের অভিঘাতে ক্যাথলিকদের বহু মূর্তি ও অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস হয় প্রোটেস্ট্যান্টদের হাতে। গির্জার ভেতর ঢুকে সন্তদের মূর্তির শিরশ্ছেদ করে জনতা। কোথাও লুট হয়ে যায় বহুমূল্য ধাতু। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে পার্লামেন্ট মূর্তিপূজা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে শপথ নেওয়ার পর এই ধরনের নৈরাজ্য আরও তীব্র হয়। ক্রমওয়েলের বিপ্লবে শিরশ্ছেদ হয়েছিল কিং চার্লসের।
একে যদি ‘বিপ্লবী’ নৈরাজ্য বলি, তাহলে ‘প্রতিবিপ্লবী’ নৈরাজ্যও হয়েছে অনেক। মৃত্যুর কয়েক বছর পরে ক্রমওয়েলের কবর থেকে লাশ তুলে তাঁর মুণ্ডচ্ছেদেরও ইতিহাস আছে। সেই কাটা মাথা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল প্রাসাদগাত্রে। ফরাসি বিপ্লবী রোবসপিয়ারকেও কাটা পড়তে হয়েছিল তাঁর ‘বিপ্লবী কর্তৃত্ব’-র হাতিয়ার গিলোটিনেই৷
১৭৭৬-এর জুলাই মাসে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার পর নিউ ইয়র্কে তৃতীয় জর্জের চার হাজার পাউন্ড ওজনের মূর্তি ভাঙচুর করেছিল উৎফুল্ল জনতা। ফরাসি বিপ্লবের সময় বাস্তিলের পতনের কথা তো বহুচর্চিত। সেই কালপর্বেই একের পর এক পঞ্চদশ লুই, ষোড়শ লুই, ষষ্ঠ হেনরির মূর্তি-সহ সাম্রাজ্যের বহু স্থাপত্যচিহ্ন ভেঙে ফেলে বিপ্লবী জনতা। ধাতব মূর্তি গলিয়ে কামান তৈরির কাজে লাগানো হয়। চতুর্দশ লুই-এর সমাধি যেখানে ছিল, সেই জায়গায় নেপোলিয়ন নির্মাণ করেন ভেনডম কলাম। কিন্তু সেটিও চিরস্থায়ী হয়নি। ১৮৭১ সালে ক্ষমতা দখলের পর প্যারিস কমিউনের ‘বিপ্লবী কমিউনার্ড’-রা সেই কলাম ভেঙে ফেলেন।
যুগে যুগে বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর এমন শিউরে ওঠার মতো নৈরাজ্যের সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী। বলশেভিকদের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবের পর কেবল ১৯১৮ সালেই, জারের আমলের অন্তত ৫০০টি স্থাপত্য ধ্বংস হয়। পরে সেই জায়গায় বসানো হয় কমিউনিস্ট নেতাদের মূর্তি৷ সপরিবার হত্যা করা হয় জার-কে। উইন্টার প্যালেসে বলশেভিক ভ্যান্ডালিজম নামে একটা আঁকা ছবিও আছে৷ বিপ্লব বলতে অনেকের চোখেই যে রোম্যান্টিক দৃশ্য ভাসে, আদতে বিষয়টি একেবারেই তেমন নয়। বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ক্ষুব্ধ জনতার হিংসাত্মক ও সরব আত্মঘোষণা৷ সেই গণরোষের চোখে মায়া নেই, আছে কূলপ্লাবী নির্মমতা। সব রঙের বিপ্লবই এমন৷ সব যুগেই।
শুধু বিপ্লব বা অভ্যুত্থান কেন, বড় গণআন্দোলনের সময়ও এমন হয়৷ ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সময় সোভিয়েত শাসনের চিহ্নগুলি জনতার ভাঙচুরের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বুদাপেস্টে স্তালিনের একটি বিশাল মূর্তি ভেঙে ফেলে জনতা। রাস্তা দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে সেই ধাতব মূর্তির শিরশ্ছেদ করে৷ মূর্তির গায়ে থুতু দেওয়া হয়, প্রস্রাব করা হয়৷ পড়ে থাকে শুধু মূর্তির বুটজোড়া। সরিয়ে ফেলা হয় সোভিয়েতের লাল তারা, গো ব্যাক স্লোগান দিয়ে ভাঙচুর করা হয় রাশিয়ানদের দোকানপাট। বার্লিন ওয়ালের পতনের পর ভ্লাদিভস্তক থেকে ভিলনিয়াস অবধি বিস্তীর্ণ এলাকায় সমাজতন্ত্রের অসংখ্য স্থাপত্য ভেঙে ফেলা হয়। খোদ রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের পরে মস্কোয় কেজিবির হেডকোয়ার্টারের বাইরে আয়রন ফেলিক্সের মূর্তি সরিয়ে গুলাগে মৃতদের উদ্দেশ্যে নতুন মনুমেন্ট বসানো হয়। মস্কো, লিথুয়ানিয়া, বুদাপেস্টে বড় বড় পার্কে নিক্ষিপ্ত হয় শয়ে শয়ে সোভিয়েত আমলের মূর্তি।
ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিনিধিস্বরূপ মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে দেশে দেশে। বহু রাস্তার নাম বদলে ফেলা হয়েছে৷ কলকাতাতেই যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ব্রিটিশ রাজপুরুষদের মূর্তি। ভারতের অন্যত্রও এমন ঘটনার নজির আছে অনেক৷ বেশ কিছু অপসৃত মূর্তি আছে দিল্লির করোনেশন পার্কে।
ফিলিপাইনের দশম রাষ্ট্রপতি ফার্দিনান্দ মার্কোসের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী রাজত্ব কায়েম, গণতন্ত্র হত্যা এবং বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ ছিল। ১৯৮৬ সালে তিনি গদিচ্যুত হন। মার্কোস নিজের একটি মস্ত আবক্ষ মূর্তি বানিয়েছিলেন। এই মূর্তি স্থাপনের জন্য ইবালোই জনজাতির মানুষদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল৷ ইবালোইরা এই মূর্তিকে তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে দেখতেন। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে ফিলিপিন্সের কমিউনিস্ট পার্টির নিউ পিপলস্ আর্মি মূর্তিটি ভেঙে ফেলে৷
ইতিহাস ফিরে ফিরে আসা। তবে সেই প্রত্যাবর্তনে নান্দনিকতা নেই। আছে ঘৃণা, ক্রোধ, হিংসা। চিনের বহু-আলোচিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় সাম্রাজ্যের প্রতীক বহু স্থাপত্য, প্রাসাদ, মূর্তি ধ্বংস করা হয়। যেমন বেইজিংয়ের প্যালেস। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকার বহু জায়গায় ওয়ার মেমোরিয়ালগুলোর ওপর ক্ষোভ উগরে দেয় জনতা। মূর্তি ও প্রাসাদের গায়ে গ্রাফিতি আঁকা হয়। মেমোরিয়ালগুলির দেওয়ালে অশ্লীল গালি লিখে দেওয়া হয়৷
কেপটাউনের ‘রোডস্ মাস্ট ফল’ মুভমেন্টের কথাই ধরা যাক। সিসিল রোডস্ ছিলেন ডি বিয়ার্স হিরের কোম্পানির মালিক এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ কেপ কলোনির প্রধানমন্ত্রী। ঔপনিবেশিক আমলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি প্রণয়নের পিছনে তাঁর ভূমিকা ছিল বিরাট। ১৯১২ সালের তৈরি গ্রানাইট ও ব্রোঞ্জের রোডস্ মেমোরিয়ালের গায়ে ২০১৫ সালে লেখা হয় ‘বর্ণবাদী, চোর ও খুনি’। রোডসের মূর্তির নাক কেটে নেওয়া হয়। পরে, ২০২০ সালে মূর্তিটির মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। ঘৃণা মোছে না। রয়ে যায় দশকের পর দশক।
এই ভাঙচুর, নৈরাজ্য, হানাহানি, রক্তপাতের অনন্ত নরকের পথেই মানবসভ্যতার হাঁটা। এই পথে ফুলের গন্ধ নেই, আছে শুধু লাশ আর লাশ। এই নির্মমতাকে মহিমান্বিত করার সুযোগ নেই, ঘৃণার মাথায় বীরত্বের মুকুট পরানো অসম্ভব৷ শুধু নির্মম বাস্তবটুকু মেনে নেওয়া ভাল৷
এই পথে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে? বিশ্বাস হয় না, প্রতিদিন গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হয় সংশয়।