ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল : পর্ব ৪১

    শ্রীজাত (February 15, 2025)
     

    নিরঞ্জনের গল্প

    নিরঞ্জন পাগলা-র একমাত্র অস্ত্র ছিল বিড়ি। কেউ তার পিছনে লাগলে বা কাউকে তার পছন্দ না হলে সে কানের গোঁজ বা ছেঁড়া বুকপকেট থেকে বিড়ি বের করে এনে তাক করে ছুড়ে মারত। ছোড়ার ভঙ্গিটা যদিও অবিকল হাতবোমা বা পেটো ছোড়ার মতোই, মুখের আক্রোশটাও যুদ্ধরত সৈনিকের মতো, কিন্তু অস্ত্রটি নেহাত নিরীহ একখানি বিড়ি। এমন নয় যে, হাতের কাছে ইট পাটকেল বা ডালপালা পেত না সে, কিন্তু সেসব কুড়িয়ে লোকের গায়ে ছুড়ে মারার প্রবণতা কখনও তার মধ্যে ছিল না। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! রাগ তার নিখাদ, কিন্তু আক্রমণের সময়ে সে জুতসই অস্ত্র একেবারেই ব্যবহার করত না, যা গায়ে লাগলে লোকে আঘাত পায়। বিড়ি ছুড়ে মারার মধ্য দিয়ে তার অপছন্দ বা অভিযোগ প্রকাশিত হল, এতেই সে খুশি। কারণ আর কিছুই নয়, তার পিছনে লাগা লোকজন তো সবই পাড়ার ছেলেছোকরা, যাদের সঙ্গে মিলেমিশে সে বড় হয়েছে। তাদের ভালমন্দর একটা আবছা খেয়াল তার নিজের মনের মধ্যেও ঘুরপাক খেত নিশ্চয়ই, তাই এই প্রতীকী আক্রমণ। রাগ দেখানোও হল, আবার অনাঘাতীও থাকা গেল। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। 

    মজা শুধু সেইখানেই নয়, মহামূল্যবান অস্ত্রটি ছুড়ে মারার পর নিরঞ্জন আবার সেটি ফেরত চাওয়ার জন্য ধেয়ে যেত। এ-কথা সকলেরই জানা ছিল। তাই নিরঞ্জন পাগলা বিড়ি ছুড়ে মারলে ক্রিকেটের লোপ্পা ক্যাচের মতো লুফে নেওয়াই ছিল পাড়ার ছেলেদের দস্তুর। তারপর চলত চোর-পুলিশ খেলা। ‘অ্যাই, আমার বিড়ি ফেরত দে! দে বলছি!’ এই বাক্য আওড়াতে আওড়াতে নিরঞ্জন পাগলা ছেলেদের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে, আর ছেলেরাও, ‘নাহলে কী করবি? আরেকটা বিড়ি ছুঁড়ে মারবি?’ বলতে বলতে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছে পাড়াময়, এ-দৃশ্য ছিল রোজকার।

    আরও পড়ুন : জগজিৎ সিংয়ের নরম ও বিষণ্ণ সুরে মজেছিল দেশ! লিখছেন শ্রীজাত…

    পাড়ায় সকলের নির্দিষ্ট পদবি ছিল। কেউ ঘোষ, কেউ চট্টোপাধ্যায়, কেউ হালদার। কেবল নিরঞ্জনের পদবি ছিল পাগলা। নিরঞ্জন পাগলা। এই ছিল তার নাম। ছোটবেলা ইস্তক এ-নামেই তাকে সম্বোধন করতে শুনে আসছি সকলকে। কানাকে কানা বলতে নেই, খোঁড়াকে খোঁড়া বলতে নেই, এসব শিক্ষা বই অবধি চলত তখন। বাকিদের চেয়ে যার মন বা মস্তিষ্ক অন্যভাবে কাজ করে, তাকে যে অনায়াসেই পাগল ব’লে দাগিয়ে দেওয়া যায়, এবং নির্দ্বিধায় ‘পাগলা’ বলে ডাকাও চলে, সেই নির্মমতা আমাদের কাছে বাগানের ফুলের মতোই স্বাভাবিক ও নিরপরাধ ছিল। নিরঞ্জনও কেবল নাম ধরে ডাক শুনলে একটু হকচকিয়েই যেত। বরং ‘কী রে পাগলা’ বলে ডাক দিলে স্বস্তি পেত বেশি। ওইটাই তার পরিচিতি, আইডেন্টিটি। পাড়ার একমাত্র ঘোষিত পাগল। সে-শিরোপা সে খামকা ছেড়ে দিতে যাবেই বা কেন? 

    পদবি অবশ্য ছিল একখানা তার। তার মানে, তার পরিবারের। রায়চৌধুরী। অতএব, নিরঞ্জনের আসল পুরো নাম ছিল নিরঞ্জন রায়চৌধুরী। কিন্তু সে-পদবির গৌরব সে কবেই কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল। গৌরব বলছি এই কারণে, তাদের পরিবার ছিল আমাদের ছোট পাড়ায় এবং কলকাতার বড় সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাবা ছিলেন নামজাদা উকিল, মা এক স্কুলের হেড দিদিমণি। নিরঞ্জনরা ছিল তিন ভাই, নিরঞ্জন মেজ। তার দাদাও বাবা-র মতোই উকিল হয়েছে ততদিনে, ছোটখাট একটা চেম্বারও খুলে ফেলেছে হাই কোর্ট চত্বরে। ছোট ভাইটি কলেজ শেষ করে বিলেতে যাওয়ার পরীক্ষা দিচ্ছে। এহেন পরিবারের মধ্যমণি নিরঞ্জনকে তার পরিবারও খুব একটা আন্তরিক চোখে দেখত না যে, তা আমরা টের পেতাম। তার বাবা-মা, বাকি দু’ভাই, সকলেই পাড়ার মধ্য দিয়ে দ্রুত ও চোখ নামিয়ে যাতায়াত করতেন। যেন নিরঞ্জনের বাড়ির লোক হওয়ার লজ্জা ও অপরাধ, দুই-ই বয়ে বেড়াচ্ছেন।

    বাকিদের চেয়ে যার মন বা মস্তিষ্ক অন্যভাবে কাজ করে, তাকে যে অনায়াসেই পাগল ব’লে দাগিয়ে দেওয়া যায়, এবং নির্দ্বিধায় ‘পাগলা’ বলে ডাকাও চলে, সেই নির্মমতা আমাদের কাছে বাগানের ফুলের মতোই স্বাভাবিক ও নিরপরাধ ছিল। নিরঞ্জনও কেবল নাম ধরে ডাক শুনলে একটু হকচকিয়েই যেত।

    শুনেছিলাম, ডাক্তার দেখিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল। ভর্তিও রাখা হয়েছিল তাকে কিছুদিন, মনের হাসপাতালে। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। তাই বাড়ির সকলে হাল এবং নিরঞ্জন, এই দুই-ই প্রায় ত্যাগ করেছেন। নিরঞ্জন সকালে সেই যে বাড়ি থেকে বেরত, ফিরত অনেক রাতে। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তটুকু তার পরিবার কেড়ে নেয়নি, এই যা। কিন্তু মেলামেশা, ঝামেলা খুনসুটি, সবই তার ছিল পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে, বিশেষ করে তার বয়সি যুবকদের সঙ্গে। সত্যি বলতে কী, নিরঞ্জনকে একরকম ভালই বাসত সকলে। বা, ‘ভালবাসা’ না ব’লে একে খানিক করুণামিশ্রিত মায়া বললেও হয়তো ভুল হবে না। 

    এও ঠিক, পাড়ার সব কিছুতে সে হাজির। তাকে ডাকা মোটেই হত না, কিন্তু সে ঠিক থাকত। পার্টির মিটিং থেকে রবীন্দ্রজয়ন্তী’র প্রস্তুতি, আন্ডার এইট্টিন ক্রিকেট প্রতিযোগিতা থেকে দুর্গাপুজোর আয়োজন, নিরঞ্জন সবার আগে হাজির। তাকে কেউ কোনও কাজ টাজ দিত না, সে চাইতও না কাজ করতে। কিন্তু হাজির থেকে সবটা শোনা ও দেখা তার চাই। ওইসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময়ে নিরঞ্জন সকলের চোখে কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যেত। একখানা আস্ত মানুষ যে দাঁড়িয়ে আছে পাশেই, সে-খেয়াল আর কারও থাকত না। এক-এক সময়ে ভাবতাম, এরকমটা হলে কিন্তু বেশ হত। আছি, অথচ নেই। এর চেয়ে ভাল আর কী-বা হতে পারে?

    এহেন নিরঞ্জন একদিন সত্যি সত্যি ‘নেই’ হয়ে গেল। চিরতরে। খালের ধারে তাকে পাওয়া গেল ভোরবেলা, কাত হয়ে পড়ে আছে, মুখে গ্যাঁজলা। পল্টু সবার আগে দেখেছে, ফুল তুলতে বেরিয়ে। বাকিদের সে-ই ডেকে এনে জড়ো করেছে। নিরঞ্জনের বাড়ির সকলেও হাজির। দুঃখ, আক্ষেপ আর স্বস্তি-মেশানো অভিব্যক্তি কেমন হয়, সেটা সেদিন তার বাবা-মা’র চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। নিরঞ্জন চলে গিয়ে তাঁদের যে একরকম মুক্তিই দিয়ে গেল, সে-কথা আর বলে দিতে হয় না। ডাক্তার এলেন, জানা গেল, বিষক্রিয়া। কিছু একটা খেয়েছিল কোথাও, তাতেই সব শেষ। কানে তখনও বিড়ি গোঁজা নিরঞ্জনের, কেবল সেটা কারও দিকে তাক ক’রে ছুড়ে মারার শক্তি আর তার নেই। 

    খুব মনখারাপ হয়েছিল সকলের। যে-মানুষটা পাশে থাকলে ‘নেই’ বলে মনে হত, সেই জলজ্যান্ত মানুষটা ‘নেই’ হয়ে কেমন যেন আমাদেরই মধ্যে থেকে গেল। এও এক ম্যাজিক।

    শ্মশানে গোটা পাড়া উপচে পড়েছিল। সকলে চুপ। ওই দু’-একটা কেজো কথা ছাড়া কেমন যেন নৈঃশব্দ্যের কুয়াশায় মোড়া একখানা ছবি। তখন আমি ক্লাস ফাইভ। সব কিছু মিটে যাওয়ার পর পায়ে পায়ে যখন পাড়ায় ফিরছি দাদা-দিদিদের সঙ্গে, খেয়াল হল, আরে, এতদিনের চেনা, অথচ আমি এখনও ‘নিরঞ্জন’ শব্দের মানেটাই জানি না। বৈশাখীদি, পার্ট টু দিল সেবার বাংলায়, আমার ঠিক পাশটায় হাঁটছিল। চুপিচুপি তাকে জিজ্ঞেস করায় সে আমার দিকে অদ্ভুত এক চাহনি নিয়ে তাকিয়েছিল, মনে আছে। তারপর বলেছিল, ‘তুই জানিস না? নিরঞ্জন মানে বিসর্জন। ভাসান।’

    আর কক্ষনও ভুলিনি মানেটা!

    ছবি : শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook