দিনুর মন পাঁচশো টাকার জন্য বিগড়ে দিতে চাইছেন না রবীন্দ্রনাথ। দিনু, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি। সেই টাকাটা বিশ্বভারতী থেকে নয়, দিতে চাইছেন নিজের রয়্যালটি থেকে। লিখছেন, ‘গীতবিতান তৃতীয় ভাগের স্বরলিপিতে আমার নিজের যে সাড়ে বারো পার্সেন্ট প্রাপ্য থাকবে সেইটে আমি ত্যাগ করব, তার মূল্য পাঁচশো টাকার চেয়ে বেশি হবে বলে আশা করি অতএব ঐ টাকা দিলে তাতে বিশ্বভারতীর লোকসান হবে না।’
কথাগুলো ‘চারুবাবু’-কে বলার জন্য বলছেন ‘কিশোরী’-কে। ৭ মার্চ, ১৯৩৪-এ কিশোরীমোহন সাঁতরা যখন তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি পাচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স সবে চল্লিশ। চারুবাবু, অর্থাৎ, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য তখন বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের সচিব। এর কিছু পরে, ১৯৩৮-এর ২৯ মে রবীন্দ্রনাথ চারুচন্দ্রকে কালিম্পং থেকে লিখছেন, ‘শান্তিনিকেতনে আমার গ্রন্থ প্রকাশের যে ব্যবস্থা আছে আমার স্বভাবসিদ্ধ অসতর্কতা ও অক্ষমতাবশত তার কাজ অচল হয়ে উঠচে… রথীর শরীরও অসুস্থ… এই অবকাশের প্রশ্রয় পেয়ে গ্রন্থ প্রকাশের কাজে, শৈথিল্য, ত্রুটি ও অপব্যয় ঘটচে। যতদিন কিশোরীর উপর ভার ছিল ততদিন কর্মচারীরা যথাবিহিত কাজ করা সম্বন্ধে স্বেচ্ছাচারিতা করত না। তাঁকেই সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করবার জন্যে পত্র লিখেচি।’
বিশ্ব-কাঁপানো এক বাঙালি কবি ৭৮ বছর বয়সে পৌঁছে পঁয়তাল্লিশ বছরের তরুণ এক সম্পাদকের ওপর এতটাই ভরসা করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সব রচনা সংগ্রহ, বিন্যাস এবং সংশোধনের দায়িত্ব কিশোরীমোহনকে দিয়ে তাঁর অধীনে একটি নতুন দপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি ওই তরুণটিকেই এ কাজে ‘best fitted’ মনে করেছিলেন। Founder-President হিসেবে তাঁর ক্ষমতাবলে ১৫ নভেম্বর, ১৯৩৭ এই মর্মে লিখিত নির্দেশও দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : ভূমেন্দ্র গুহর আত্মজীবনীতে কীভাবে ধরা দিয়েছেন তিনি?
লিখছেন আশিস পাঠক…
রবীন্দ্রনাথ যে আমৃত্যু পরম-পাকা প্রবীণদের চেয়ে সবুজের অভিযানেই ভরসা করতেন বেশি— তার এক আশ্চর্য প্রকাশ হয়ে আছে কিশোরীমোহনকে লেখা তাঁর চিঠিগুলি। খোলামেলা সে-সব চিঠিতে রাগ করছেন রবীন্দ্রনাথ, আবার ঠান্ডাও হয়ে যাচ্ছেন। আর তার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে বই তৈরি নিয়ে তাঁর নানা সোজা ভাবনা। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ লিখছেন, ‘শুদ্ধিপত্রকে তোমরা ব্যর্থ করেছো নিজেদের লজ্জা গোপন করবার জন্যে। এ চলবে না। ও পত্রকে হয় বইয়ের আরম্ভেই, নয় সূচিপত্রের আরম্ভে দেওয়াই চাই, কিছুতেই যেন তার অন্যথা না হয়।’ ‘আমরা করি ভুল, ঝাঁপ দিয়ে যুঝিয়ে পাই কুল’ যিনি লেখেন, ভুল করে ভুল গোপন করার চেষ্টা তিনি সহ্য করবেন কেন! গানের আর রাখীর ফাইল পাচ্ছেন না বলে ক্ষুব্ধ হয়ে কিশোরীমোহনকে ৩ জানুয়ারি, ১৯২৯ লিখছেন, ‘শীঘ্রই বেরিয়ে পড়তে হবে এই জন্যেই তোমাদের তাড়া দিতে বাধ্য হলুম। গানের ও রাখীর ফাইল শীঘ্র পাওয়া দরকার নইলে এগুলো প্রেসে চড়াবার আগে বিলাত রওনা হব— বৎসর কেটে যাবে। দীর্ঘকাল বিলম্ব করাই বিশ্বভারতীর স্বধর্ম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিষ্ঠাতা আচার্য্যের সঙ্গে তার তাল মেলে না— আমার স্বভাবটা ত্বরপ্রবণ!’ আবার মাসখানেক পরে রাগ ঠান্ডা হয়ে গেলে লিখছেন, ‘আমাদের দেশে স্বভাবতই কর্মের রথ চলে মন্দ গমনে, নানা ছোটোখাটো বাধার ভিতর দিয়ে। আমরা যারা কাজের কেন্দ্রের ভিতর থাকি নে, আমরা সব সময়ে তার দুরূহতা ঠিক মতো বুঝি নে— হয়তো অসঙ্গতভাবে প্রত্যাশা করি। সে জন্যে তোমরা ক্ষুব্ধ হোয়ো না। আমরা স্বভাবতই অধৈর্য্য, কিন্তু বুঝিয়ে দিলেই একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে যাই। এটা আসলে সাইকোলজির মারপ্যাঁচ— বোধহয় গিরীন্দ্রশেখরকে আমাদের বোর্ডে নিযুক্ত করলে কাজ সহজ হতে পারে।’
রবীন্দ্রনাথের এই তরুণ সম্পাদক ও প্রকাশকের আদি বাড়ি বজবজের কাছে, নিশ্চিন্দিপুরে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিএ পরীক্ষায় বাংলায় প্রথম হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র পদক অর্জন করেছিলেন। ১৯২৩-এ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ প্রতিষ্ঠার কিছু পরেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তাঁকে গ্রন্থন বিভাগে নিয়ে আসেন। কিশোরীমোহনের স্বাস্থ্য কোনওদিনই ভাল ছিল না। সজনীকান্ত দাস তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’-তে লিখছেন, ‘বিশ্বভারতীর স্থানীয় কর্মাধ্যক্ষ কিশোরীমোহন সাঁতরা তখন নিদারুণ ফুসফুসের ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া দশ নম্বরেই শয্যাশায়ী ছিলেন, বিশ্বভারতীর কার্য পরিচালনা করিতেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ।… জীবনদা তখন ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে মাস্টারির সঙ্গে সঙ্গে কবিরাজী-হোমিওপ্যাথী-বায়োকেমিক-টোটকা চিকিৎসায় হাত পাকাইতেছিলেন। হোমিওপ্যাথী-বায়োকেমিকে তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের শিষ্য, রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি পুস্তকও তাঁহার অধিকারে আসিয়াছিল। কিশোরীমোহন সাঁতরাকে তখন প্রসিদ্ধ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকেরা জবাব দিয়াছিলেন। জীবনময় তাঁহাকে স্রেফ লাউয়ের রস খাওয়াইয়া সঞ্জীবিত করিবার শেষ চেষ্টা করিতেছিলেন। পালা করিয়া রোগীর সেবা চলিতেছিল, আমিও আসিয়া জুটিলাম।… একদিন রবীন্দ্রনাথ কিশোরীমোহনকে আশীর্বাদ করিতে আসিলেন, এখন-তখন অবস্থা। গুরু-শিষ্যের সেই মর্মান্তিক মিলন আমরা দেখিলাম, কিন্তু জীবনদার লাউ-রস অঘটন ঘটাইল। সাঁতরা মহাশয় সুস্থ সবল কর্মক্ষম হইয়া আবার বিশ্বভারতীর পরিচালনভার গ্রহণ করিয়াছিলেন; অনেক বৎসর পরে রক্তের চাপবৃদ্ধির ফলে তাঁহার মৃত্যু ঘটিয়াছিল।’
এই অনেক বছর, কুড়ি বছরও নয়। অথচ এর মধ্যেই নিজের প্রতিভায় রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশের কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন কিশোরীমোহন। ১৯২৫ থেকে ১৯৪০— এই দেড় দশকে শতাধিক চিঠি তাঁকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেসব চিঠিতে বইয়ের নাম থেকে ছাপার কালি, মলাট থেকে বাঁধাই, বানান থেকে ছবি— সব প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ অকপট তাঁর এই যুবক বন্ধুটির কাছে। দিনেন্দ্রনাথকে স্বরলিপির জন্য পাঁচশো টাকা দেওয়ার বিষয়টা যে কেবল লাভলোকসানের বিষয় নয়, সে-কথা বলে কিশোরীমোহনকেই তাঁর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের কথা লিখছেন—
‘জিনিষটা কেবলমাত্র লাভলোকসানের ব্যাপার নয়— এতে আমার নিজের ব্যক্তিগত দরদ আছে—আমার রচিত গানের সুরগুলি রক্ষা করবার যোগ্য বলেই আমি কল্পনা করি— আমার কাব্যের কোনো কালে অনাদর হতেও পারে কিন্তু বাংলাদেশের লোককে সুখে দুঃখে আমার গান গাইতেই হবে— সেই গানের সুরগুলি যদি বিকৃত বা লুপ্ত হয় তবে তাতে দেশের ক্ষতি এ আমি অহঙ্কার করেই বলতে পারি— অতএব স্বরলিপি থেকে আমি আর্থিক লাভ করতে চাই নে— যে মানুষ তাকে রক্ষা করবে তাকে আমি নিজেরই গরজে পারিশ্রমিকরূপে যদি পাঁচশো টাকা দিই তবে খুব কম দেওয়াই হবে।’
কুড়ি বছরও নয়। অথচ এর মধ্যেই নিজের প্রতিভায় রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশের কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন কিশোরীমোহন। ১৯২৫ থেকে ১৯৪০— এই দেড় দশকে শতাধিক চিঠি তাঁকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেসব চিঠিতে বইয়ের নাম থেকে ছাপার কালি, মলাট থেকে বাঁধাই, বানান থেকে ছবি— সব প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ অকপট তাঁর এই যুবক বন্ধুটির কাছে।
কিন্তু এই আশ্চর্য প্রতিভাবান সম্পাদকের মৃত্যু হয় রবীন্দ্রনাথের আগেই, ২০ অক্টোবর, ১৯৪০। রবীন্দ্রনাথ তখন গুরুতর অসুস্থ। তাঁর মৃত্যুর খবর গোপন করে রাখা হয় তাঁর কাছে। নির্মলকুমারী মহলানবিশ তাঁর ‘কবির সঙ্গে যুরোপে’-রভূমিকায় লিখেছেন, ‘এর বোধহয় মাসখানেক পরেই কিশোরীমোহন সাঁতরার মৃত্যু ঘটল। কবির স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। এই দারুণ অসুখের মধ্যে পাছে মনে বেশি আঘাত পান, তাই রবীন্দ্রনাথকে খবরটা জানানো হয়নি।…
কিন্তু আশ্চর্য তাঁর মন। সেই সময় দুদিন ধরে বারে বারে বলেছেন: কিশোরীকে একবার ডেকে দিও, তার সাথে আমার কথা আছে।
কিন্তু কিশোরী আসছেন না; সবাই একটা-না-একটা অজুহাত দেখাচ্ছেন তাঁর অনুপস্থিতির।
শেষে আমাকে একদিন বললেন, রানী, সত্যি করে বল তো, খবর দেওয়া সত্ত্বেও কিশোরী কেন আসছে না? সে কি তবে বেঁচে নেই?
আমি কী আর বলব? চুপ করে রইলাম, কিন্তু মিথ্যে কথা বলতে পারলাম না।
কবি বললেন, বুঝেছি। এই জন্যেই তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম। জানি, তুমি আমার কাছে মিথ্যে বলতে পারবে না।’
ঋণ: আকাদেমি পত্রিকা ৫।। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি