ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • কিসমাত কানেকশন : পর্ব ২

    সৌগত রায়বর্মন (January 31, 2025)
     

    সরকারি জুয়া ও ৪২০ নম্বর

    হাকিম সাহেব নতুন এসেছেন। খুব কড়া এবং সৎ। তাঁকে ঘুষ খাইয়ে বশে আনা যাবে না। উৎকোচ দিতে গেলে তিনি উৎকৃষ্ট থেকে তাকে নিকৃষ্টতম জেলে চালান করে দেবেন। খুবই মুশকিলের ব্যাপার! অথচ তাঁকে পটাতে না পারলে এ-কেস থেকে ছাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাহলে উপায়?

    উপায় একটাই। যেভাবেই হোক এই হাকিমকে পকেটে নিতে হবে। কীভাবে?  ঢাকাইয়া বাঙালকে কুবুদ্ধিতে টেক্কা দেবে কে? একমাত্র হাই কোর্ট দেখা বাঙাল ছাড়া আবার কে?

    শীতের বেলা। আলো কমে এসেছে। প্রায় সন্ধ্যা। হাকিম সাহেব আদালত চত্বর ছেড়ে বেরতেই দেখেন, একজন লোক ছাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একে প্রায়ান্ধকার আলো। তাতে ঝলমলে আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে। এই সময় ছাতা মাথায় দিয়ে লোকটা কী করছে? হাকিমের খুব কৌতূহল হল। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। আফটার অল তিনি হাকিম। যার-তার সঙ্গে কথা বলা তাঁর পক্ষে শোভা পায় না। কিন্তু তিনি কিছুতেই আগ্রহ চেপে রাখতে পারলেন না। নিজের আর্দালিকে প্রশ্ন করলেন, লোকটা কি পাগল? নইলে এই ভরসন্ধ্যায়, ঝলমলে আকাশে ছাতা মাথায় দিয়ে কী করছেন?

    আরও পড়ুন : সমরেশ মজুমদার চিনিয়েছিলেন ক্যাসিনো,
    পড়ুন শুভঙ্কর দে-র কলমে কিসমাত কানেকশন : পর্ব ১…

    আর্দালি বলে উঠল, না হুজুর উনি পাগল না। বিরাট ব্যবসায়ী। মাঝে-মাঝেই কোর্টে আসেন।

    হাকিমের অদম্য কৌতূহল, যেভাবেই হোক জানতে হবে, ছাতা মাথায় দেওয়ার কারণটা কী? আর্দালিকে বললেন, এক্ষুনি গিয়ে জিজ্ঞাসা করো, এর মানে কী!

    আর্দালি গিয়ে লোকটাকে বলল, হুজুর জানতে চাইছে, কোন পাগল এই সময়ে ছাতা মাথায় দিয়ে ঘোরে? উত্তর পেল, হুজুরকে বলো এক্ষুনি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে। হুজুর নিজেই যেন ছাতা মাথায় দেন। নইলে ভিজে চুপসে যাবেন।

    আর্দালি হাকিমকে সে-কথা জানাতে হাকিম আকাশের চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। পরিষ্কার। ফ্যাটফেটে। চাঁদ আরও একটু ওপরে উঠেছে। হাকিম এই অবাস্তব কথা মানতে পারলেন না। নিজেই গিয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী আবোলতাবোল কথা বলছেন? এই আকাশে এক্ষুনি বৃষ্টি হবে?  লোকটি বিনয়ের সঙ্গে জোর দিয়ে বলল, জি হুজুর! এই বৃষ্টি হল বলে! আপনি আদেশ করলে আমার ছাতাটা আপনার মাথায় ধরতে পারি! হাকিম রেগে গেলেন না। বরং কৌতুকের কণ্ঠে বললেন, কী করে বুঝলে বৃষ্টি হবে? লোকটি আবার মাথা নিচু করে অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমাদের ইলিশের ব্যবসা। বাপ-ঠাকুদ্দার কাছে শিখেছি। বৃষ্টি এল বলে! হুজুর ছাতাটা মাথায় দিন।

    মায়ের চিৎকারে নিচে নেমে দেখি, বাড়ির একতলাটা এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা মিল পাওয়া যাবে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র সঙ্গে। ছবিটা তখনও রায়বাবু ভেবে উঠতে পারেননি। প্রেমচাঁদ ভেবেছিলেন, অনেক আগে। তখনও মুন্সিসাহেবের লেখাটি আমাদের পড়া হয়নি। কিন্তু আমরা গুটিকয় বখাটে ছোকরা নিজেরা প্রমাণ করেছিলাম, দেশ-রাজ্য রসাতলে গেলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা বুঁদ হয়ে আছি জুয়ায়।

    জেদ চেপে গেল হাকিম সাহেবের। উত্তেজিত গলায় বললেন, না হবে না। আমি তোমার মতো পাগলের কথা বিশ্বাস করি না। লোকটি মাথা আরও ঝুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, বাজি?

    হাকিম সাহেব তখন দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য। লোকটাকে বেইজ্জত না করলেই নয়। বললেন, হ্যাঁ। রাজি। লোকটি গলা আরও খাদে নিয়ে গিয়ে বলল, হুজুরের সঙ্গে বাজি লড়ব, এ তো আমার সৌভাগ্যের কথা। তবে পাঁচশো টাকার নিচে আমি বাজি লড়ি না। হুজুর কি রাজি? হাকিমসাহেব দেখলেন, পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই। মনে মনে বললেন, লোকটার পয়সার অভাব নেই। দেই শালার পাঁচশো খসিয়ে!

    পকেট থেকে ঘড়ি বের করে হাকিম সাহেব ঘড়ির কাঁটার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কাঁটা এগুচ্ছে। ততই অস্থিরতা বাড়ছে হাকিমের। ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। কোথায় বৃষ্টি? মেঘের নামগন্ধই নেই। আশ্বস্ত হয়ে লোকটির দিকে তাকালেন। তার কিন্তু কোনও ভাবলেশ নেই। নির্বিকার মুখে চোখ বন্ধ করে আছে।

    এইভাবে পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত। হাকিম সাহেব আরও দু-মিনিট ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে গর্জন করে বলে উঠল, কই বৃষ্টি হল? 

    লোকটি বিনীত গলায় বলে উঠল, হুজুর আমি হেরে গেলাম। এইবার প্রথম। বলেই ধুতির খুঁট থেকে পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল হাকিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভিড়ে মিশে গেল।

    হাকিম সাহেব বুদ্ধিমান লোক। বুঝলেন, এই প্রথমবার তিনি বাজির নেশায় জুয়া খেলতে গিয়ে হেরে গেলেন। হাত নষ্ট করলেন। আসলে ঘুষ খেলেন। কালকেই হয়তো লোকটাকে আসামির কাঠগড়ায় দেখব।

    গল্পটি সম্ভবত সৈয়দ মুজতবা আলী-র। স্মৃতি থেকে বেমালুম ঝেড়ে দিলাম।

    যে কোনও বিষয় নিয়েই জুয়া খেলা যায়।

    জুয়ার প্রথাসিদ্ধ খেলা হল তাসের তিনপাত্তি। হাতে তিনটে তাস নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের খেলা। টানটান উত্তেজনা। মুখ থাকবে পাথরের মতো। প্রতিপক্ষ যেন বুঝতে না পারে, হাতে ভাল তাস না খারাপ তাস পড়েছে। জেমস বন্ডের সিনেমায় এই ধরনের টানটান উত্তেজনার সিন আমরা দেখেছি। হিন্দি সিনেমায় প্রাণ, প্রেম চোপড়া, অজিত, মোনা এমনকী, বচ্চন সাহেবকেও দেখেছি। হাতের জাদুতে তাস বাটার সময় কী করে সব ভাল তাস নিজের হাতেই রেখে দেওয়া যায়— এইসব দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি।

    মনে আছে, আটাত্তর সালের প্রবল বানভাসিতে সারা রাজ্য জলের তলায়। কিন্তু আমাদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত চারটি যুবকের কাছে সে-খবর পৌছেছিল প্রায় তিনদিন বাদে। যখন বাড়ির বারান্দায় জল উঠে তা নিচের ঘর ডুবু ডুবু করে দিল, তখন। মায়ের চিৎকারে নিচে নেমে দেখি, বাড়ির একতলাটা এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা মিল পাওয়া যাবে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র সঙ্গে। ছবিটা তখনও রায়বাবু ভেবে উঠতে পারেননি। প্রেমচাঁদ ভেবেছিলেন, অনেক আগে। তখনও মুন্সিসাহেবের লেখাটি আমাদের পড়া হয়নি। কিন্তু আমরা গুটিকয় বখাটে ছোকরা নিজেরা প্রমাণ করেছিলাম, দেশ-রাজ্য রসাতলে গেলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা বুঁদ হয়ে আছি জুয়ায়।

    রাজনীতির ক্ষেত্রেও আমাদের মতো কিছু অকর্মণ্য মানুষ কোন না কোন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি। দেশ বা রাজ্য মায়ের ভোগে যাক। আমার কী? এমন ভাব!

    তখন আমাদের খেলতে হত এক পয়সা-দু’পয়সার বাজি রেখে। কাউকে বাপের, কাউকে দাদার, কাউকে জামাইবাবুর পকেট কেটে ওই এক বা দু-আনা জোগাড় করতে হত।

    আমাদের সবচেয়ে উত্তেজক জুয়া ছিল, বাজি ধরা।

    যে কোনও বিষয়েই বাজি ধরা হত। কত পয়সা জানি না। কেননা, বাজি হেরে কেউ পয়সা দিয়েছে, এমনটি শোনা যেত না। বাজি লড়ব, কিন্তু বাকির খাতায়।

    এটা সেই সময়, যখন ছেলেরা লাইন মারবে মেয়েদের, সেখানেও বাজি লড়া হত। একবার আমরা পাঁচজনই প্রেমে পড়েছি একজনের। একই বয়ানে চিঠি চালান হয়েছে পাঁচজনের নামে। যথারীতি কোনও উত্তর আসেনি। কিন্তু আমরা তো লাইন মারবই। একসঙ্গে পাঁচজন তো একজনের সঙ্গে প্রেম করতে পারে না! তাহলে? বিকেলের মায়া আলোয় মেয়েটি বান্ধবীদের সঙ্গে রাস্তায় বেরয়। মেয়েটির বাড়ির সামনের গলিতে আমরা পাঁচজন ঠায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু আজ কে লাইন মারতে যাবে? এখানেই বাজি।

    মেয়েটি কোন রঙের ফ্রক পরে বেরবে, তা যদি কেউ মিলিয়ে দিতে পারে, তবে সেদিন তার টার্ন। কেউ বলল লাল, কেউ বলল, সাদার ওপর ববি প্রিন্ট। কেউ বলল খয়েরি, কেউ কেউ ছিল অতি চালাক, তারা বলল, মাল্টিকালার।

    আমরা পঞ্চপাণ্ডব গলির মোড়ে ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকছি। টেনশনে দম বন্ধ হয়ে আসছে। যে যার মতো ঠাকুর-ঠাকুর করছি। একজন তো মানতই করে ফেলল, শকুন্তলা কালীপুজোর রাতে নিজের মুন্ডু বলি দেবে। এখন শুধু প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা। টেনশনে আমরা তখন উবু হয়ে বসে পড়েছি। যেন লোভী বালকের হাতে কেউ লাল বল দেবে বলেছিল।

    অবশেষে তিনি প্রকাশিত হলেন।

    কিন্তু এ কী! 

    আজ টুকটুকে লাল শাড়ি পরেছেন তিনি। গলির দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি দিয়ে গর্বিত গ্রীবা বাঁকিয়ে চলে গেলেন মোড়ের মাথায়। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার উঠতি মস্তান মাথামোটা খোকন। মেয়েটি তাকে যেন কী একটা ইশারা করল!

    টুকটুকে লাল শাড়ি আগে আগে। মস্তান খোকন পিছে পিছে।

    ব্যস, জুয়ায় হেরে আমরা শুরু করলাম অন্য পাড়া অভিযান। কিন্তু বাজি ছাড়তে পারিনি। আসলে জুয়া। প্রেমের ক্ষেত্রেও যে জুয়া চলে, তা প্রত্যক্ষ করেছি সেই বয়সেই।

    আমি দীর্ঘদিন রেলযাত্রী ছিলাম। কোন্নগর টু হাওড়া। ট্রেনে ওঠা ও নামা ছিল নরকযন্ত্রণা। কিন্তু বর্ধমান বা ব্যান্ডেল লোকালে স্বচক্ষে দেখেছি, ভেন্ডর কামরায় চারটে লোক বুকে বুক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    প্রত্যেকের কোমরে একটা বড় সাইজের রুমালের চারটে কোনা গোজা। প্রবল মনোনিবেশ করে তারা ব্রিজ খেলছে। আরেকজন ঘাড়ে চড়ে বসে খাতায় নম্বর টুকছে। মানে হিসেব। হাওড়ায় নেমে টাকাপয়সা মিটিয়ে দিতে হবে। অনেক সময় এমনও দেখেছি ট্রেন হাওড়া ঘুরে কারশেডে চলে গেছে, তাও খেলা চলছে।

    একটা চান্স আমারও এসেছিল।

    তাস বাটা হল। আমি তাস তুললাম। আমার ডানপাশের লোকটি কল দিল, নো ট্রাম। আমিও বললাম, নো ট্রাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল, আমি নিশ্চয়ই জাত প্লেয়ার! আবার আমার টার্ন। পাশের লোকটি কল দিল, ফোর স্পেড। আমিও বললাম, ফোর স্পেড। আমার পার্টনার বিরক্তির সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কী কল করলেন?  আমি বললাম উনিও তো ফোর স্পেড ডেকেছেন। তাই আমিও ডাকলুম।

    তখন রোজ লাস্ট ট্রেনে বাড়ি ফিরি। একদিন উঠলাম ভেন্ডর কামরায়। লাস্ট ট্রেনের ভেন্ডর মুক্তাঞ্চল। মদ, গাঁজা, জুয়া সব— কিছুই চলত। সেদিন উঠেই দেখি, তিনজন মুখ গোমড়া করে মাটিতে বসে আছে। কেন? আজ একজন আসেনি। তাই তাস খেলা হচ্ছে না। আমি সগর্বে বললাম, আরে আমি তো আছি?  একজন প্রশ্ন করল, তুমি ভাই ব্রিজ খেলতে পারো? আমরা কিন্তু পয়সা দিয়ে খেলি। বাকিবগ্যার ব্যাপার নেই।

    আমি কাধ ঝাঁকিয়ে বললাম, আলবাত পারি। পয়সা দিয়েই খেলব। ছোটবেলা থেকে খেলছি। এক্সপার্ট। আমার সঙ্গে খেলেই দেখুন না।

    তারা সরল বিশ্বাসে আমার কথা মেনে নিল। সত্যি কথাটা হল, আমি ব্রিজ কেন, তাসের কোনও খেলাই জানি না।

    তাস বাটা হল। আমি তাস তুললাম। আমার ডানপাশের লোকটি কল দিল, নো ট্রাম। আমিও বললাম, নো ট্রাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল, আমি নিশ্চয়ই জাত প্লেয়ার! আবার আমার টার্ন। পাশের লোকটি কল দিল, ফোর স্পেড। আমিও বললাম, ফোর স্পেড। আমার পার্টনার বিরক্তির সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কী কল করলেন?  আমি বললাম উনিও তো ফোর স্পেড ডেকেছেন। তাই আমিও ডাকলুম।

    তারপরের কথা আর না বলাই ভাল। লিলুয়া আসতেই দেখলাম, আমি শূন্যে উড়ে প্ল্যাটফর্মে পড়লাম। কিল-ঘুষি-চড়ে আমি অপমানিত হই না। কিন্তু একজনকে ধাক্কা দিয়ে নির্জন কোনও স্টেশনে ছুড়ে ফেলাতে বড্ড সম্মানে লেগেছিল।

    সাট্টা বা ডেলি লটারির খুব রমরমা বাজার ছিল একসময়ে। একবার পরপর তিনটে চাকরিতে বলপূর্বক গলাধাক্কা খাওয়ার পর বেমালুম অর্থাভাবে চলছি। তখন পয়সা রোজগার করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? আমার এক পরিচিত জন রোজ সাট্টা খেলত। তার কাছে গিয়ে বললাম, খেলব। কিন্তু নিয়ম তো জানি না। উনি আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ভাই সাট্টা তো লো ক্লাসের খেলা। তুমি খেলবা ক্যান? তোমরা উচ্চ বংশ। ব্রিজ খেলো। বুদ্ধি থাকলে জিতবা। আমি যে নো ক্লাসে বিলং করি, তা তাকে কী করে বোঝাই? তিনি কিছুতেই খেলা শেখালেন না, শুধু বললেন, তোমাদের ক্লাসের লোকের নম্বর আইব না। সত্যিই আসেনি। আচ্ছে দিন তো আসেইনি। নম্বরও আসেনি।

    সত্যিই আমার জীবনে কোনও নম্বর আসেনি। একমাত্র ৪২০ ছাড়া। সে এক মজার গপ্প। চাকতি ঘুরিয়ে ৪২০।

    রুলে একধরনের যন্ত্র-জুয়া। ক্যাসিনো রুলে বা জ্যাকপট একে-অপরের সঙ্গে জড়িত। হলিউড এবং বলিউডের সিনেমায় দেখেছি বহুবার। আমাদের দেশে ক্যাসিনো নিষিদ্ধ। শুনেছি, নেপালে আছে। একটা চাকতি ঘুরতে ঘুরতে যে নম্বরে গিয়ে থামবে, সেই নম্বর যার হাতে আছে, সে জমা পড়া টাকার মালিক হবে।

    কলেজে পড়ার সময় খুব অর্থাভাব। বাড়ি থেকে যে-ক’টা পয়সা পেতাম, তা উৎপল পাণ্ডের অনামিকা রেস্তোরাঁতে দু-দিনেই উড়িয়ে দিয়েছি। বান্ধবীদের কাছ থেকে আর কত অপরিশোধ্য ঋণ নেওয়া যায়! কোনও এক বন্ধু বুদ্ধি দিল বেথুনের সামনে নাকি রুলে প্যাটার্নে চাকতি খেলা হয়। যারা পয়সা লাগাবে, তাদের একটা করে নম্বর দেওয়া হয়। চাকতি ঘুরিয়ে দিলে যার নম্বরে এসে দাঁড়াবে, সে জিতে নেবে সব পয়সা।

    আশ্চর্য! আমার হাতে এল এক অমোঘ নম্বর— ৪২০। প্রথমে একটু বিব্রত হয়েছিলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য!  ওই নম্বরেই কাঁটা এসে দাঁড়াল। এবং আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, পঞ্চাশ টাকা লাভ করেছি।

    তারপর থেকেই ৪২০ নম্বরটা আমার গায়ে সেঁটে রইল।

    এখন ভাবি, আমি যদি ফুটবল প্লেয়ার হতাম, তাহলে জার্সিতে ৪২০ নম্বরটাই লেখা থাকত। তখন কোথায় মেসি, মারাদোনা, রোনাল্ডো! কথায় কথায় গোল দিতাম। কিন্তু ফুটবলের দুর্ভাগ্য কেউ আমায় খেলায় নেয়নি। চান্স পাইনি। পেলে দেখিয়ে দিতাম নম্বর-মাহাত্ম্য কী হতে পারে!

    এখন তো দেশটাই চলছে বাজির ওপর। মিউচুয়াল লস, জেমস বন্ড, আরআইপি (সঠিক শব্দ বা মানে কোনওটারই জানা নেই)। জুয়ার মহোৎসব। মানুষের কপালে লস ঝুলছে। পুরোটাই ৪২০।

    গত লোকসভা নির্বাচনে যে জুয়া খেলা হল, তার থেকে বড় ঢপের জুয়া আমরা অন্তত দেখিনি। আদার ব্যাপারী কয়েক হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া হল মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে। শাসক দল বাকি ৪২০ পার করে দেবে। ফলত, শেয়ার বাজারে ধুম লেগে গেল আদা কেনার। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, পুরোটাই ৪২০। কয়েক লক্ষ মানুষ এক রাতে নিঃস্ব হয়ে গেল।

    আমাদের দেশে জুয়া নাকি নিষিদ্ধ!  হায় সেলুকাস! সরকার যে প্রকাশ্যে জুয়া খেলে দিল, তার কৈফিয়ত কে চাইবে।

    আসুন, আমরা না-হয় ঘরে ঘরে হাউজি খেলি! ঘরের টাকা ঘরেই থাকুক।

    সরকারি জুয়া যে আসলে ৪২০— এটা কেন যে মানুষ বোঝে না, কে জানে!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook