ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • একলা চলা


    দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত (January 13, 2025)
     

    “—উড়নচন্ডে স্ত্রীলোককে কেউ ভালোবাসে?

    —কেউ না।

    —কেউ আহা-উহু করে?

    —কেউ না।

    —কেউ তার ধূলিধূসর জামাকাপড় কেচে দেয়? না ঝকঝকে থালায় করে ভাত বেড়ে দিয়ে পাখাটি হাতে নিয়ে কাছে এসে বসে।

    —কেউ না, কেউ না। উড়নচন্ডীর পথক্লেশ দূর করতে কারুর মাথা-ব্যথা নেই।

    যত গল্পের বই পড়েছি, জীবনে সর্বত্রই আমি দেখেছি যে, পুরুষমানুষ যত উড়নচণ্ডে, কাছাখোলা হয়, মেয়েরা তাকে তত ভালবাসে। কত আহা-উহু করে, কত যত্নআত্তি করে, তার গেঞ্জি-ইজের কেচে দেয়, ধুতি কুঁচিয়ে দেয়। জামা ইস্ত্রি করে দেয়। মেয়েরা ধড়াদ্ধড় তাদের প্রেমে পড়ে যায়, সেই মা-দের সময়ের শরৎচন্দ্র, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, প্রবোধ সান্যাল থেকে আমাদের কালকূট বুদ্ধদেব গুহ পর্যন্ত সক্কলের দেখি এক অভিজ্ঞতা…।

    …এই যে এত ঘুরি, অনবরত ঘুরে বেড়াই, এ দেশ–ও দেশ—, এ তীর্থ-ও কনফারেন্স, কোথাও কি কোনওই সম্ভাব্য প্রেমিক লুকিয়ে থাকতে পারত না আমার জন্যে?— খুব পারত। কিন্তু আমার স্বভাবদোষেই তা পারে না। এখন কথা হচ্ছে গিয়ে, কোনটা বেশি জরুরি? স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো না পরাধীন ভাবে প্রেম করা?”

    আরও পড়ুন : খুন এবং অপরাধীর সম্পর্কের ছক পরপর ভেঙেছেন আগাথা ক্রিস্টি…

    ১৯৮৪ সাল।

    বাঙালি মেয়েরা যখন এই লেখা পড়ছে, ১৯৮৪ সাল।

    যিনি লিখছেন, তাঁর চোখে চশমা, পরনে তাঁত বা রেশম শাড়ি, কপালে একটি উজ্জ্বল গোল টিপ। সিঁথি করা ঈষৎ এলো খোঁপা অথবা, একঢাল কালো চুল, কনুই অবধি লম্বা-হাতা ব্লাউজ। কোনও ফ্যাশনদুরস্ত পোশাকআশাক নয়। আশপাশের মাসিমা-কাকিমাদের মতোই কেজো কিংবা আটপৌরে সাজ। যদিও এই মানুষটির চেয়ে আইকনোক্লাস্টিক জীবন চোখের সামনে খুব কম বাঙালি মেয়েই দেখেছে। বিশেষত সেই আটের দশকে, বিশ্বায়ন যখন এদেশের চৌকাঠ পেরয়নি, এই মানুষটিই হয়ে উঠছেন বাঙালি নারীমনে ভুবনায়নের প্রতীক।

    নারীর ভেতরের যে মানুষ সত্তাটিকে কতগুলো জেন্ডারের ঘেরাটোপ আর বাধানিষেধের আড়াল দিয়ে লুকিয়ে রাখতে চায় গোটা বিশ্বসংসার, ইনি সেই ইমেজকে ছিঁড়েখুঁড়ে জলজ্যান্ত একজন মানুষ হয়ে ধরা দিচ্ছেন প্রতিদিনের বাঙালি জীবনে তাঁর ভ্রমণকাহিনিগুলোর মধ্য দিয়ে। একজন মানুষ, যিনি ইউনিভার্সিটির চাকরিজীবন, অধ্যাপনা, ক্লাসরুম, গবেষণা, সেমিনার, পেপার পড়া, সংসারের কাজকর্ম, একা হাতে দু’টি কিশোরী মেয়েকে মানুষ করা এবং বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা করার পাশাপাশি নিরন্তর ছুটে চলেছেন নতুন নতুন দেশদুনিয়া জানতে, নতুন নতুন মানুষকে চিনতে। সম্পূর্ণ একা। ঘনাদার গল্পের চেয়ে কোনও অংশে কম রোমহর্ষক নয় সেসব অভিজ্ঞতা। কিন্তু তিনি কোনও এক্সপ্লোরার নন, কোনও এক্সপিডিশনের শরিক নন। কোনও রেকর্ড ভাঙতে বা গড়তে বা কারও কোনও উপকারে লাগতেও নয়, কেবল আপন মনের খেয়ালখুশিতে, কেবলই জীবনের স্বাভাবিক কৌতূহলে, বেঁচে থাকার আহ্লাদে।

    অসম্ভবকে দিনের পর দিন সম্ভব করেছেন তিনি, নবনীতা দেবসেন

    “এটা কি ভ্যালিড নয়, রিজন হিসেবে?”

    “ছোট থেকেই শুনে আসছি আমি জংলি, আমি বুনো, আমি খ্যাপাটে, আমি অসভ্য। “সারাক্ষণই অন্যমনস্ক”, “উঠল-বাই-তো-কটক-যাই” স্বভাবের মুক্তপক্ষ মানুষ।

    “বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষও মাঝে মাঝে যখন কূলে এসে ঠেকে, তখন বালি ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ঘর না পেয়ে জঙ্গলে চলে যায়।

    একা।

    বেপরোয়া।”

    আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মনে হবে, এ আর এমন কী! কত মেয়ে একা-একা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেয়েদের সোলো ট্রাভেল নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ওয়েবসাইট, বাস-গাড়ির সার্ভিস, হোম স্টে। অচেনা-অজানা মেয়েরা একসঙ্গে, এক দঙ্গল বেরিয়ে পড়তে চাইলেও কতশত গ্রুপ, এমনকী, এই পোড়া দেশেও। তারা ট্রেকিং করছে, হাইকিং করছে, মরুভূমিতে, পাহাড়ে, জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটাচ্ছে। একলা জিপ নিয়ে সাফারি করছে। ক্যাম্পিং কার নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রোদে-জলে-ঝড়ে-বৃষ্টিতে এক্কেবারে একলাটি। বেড়ানো নিয়ে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে, এডিট করে নিজেরাই ট্রাভেলগ চ্যানেলে তুলে দিচ্ছে। সেসবের সাবস্ক্রাইবারও তো কত লক্ষ, হাজার মেয়ে।

    উড়নচণ্ডী হওয়াকেই উদযাপন করেছেন আজীবন

    কিন্তু চল্লিশ বছর আগে কি এ-কাজ এত সহজ ছিল? ভারতের মতো দেশে একলা একজন মেয়ের বেরিয়ে পড়া? কোনও জিপিএস নেই। গুগল ম্যাপ নেই। স্মার্ট ফোনই নেই। কোথাও যাওয়ার জন্য পথ খুঁজে বের করা, গাড়ি-হোটেল বুক করা, বিপদে-আপদে পড়লে লোকেশন শেয়ার করে সাহায্য চাওয়া কিংবা কাছে-পিঠে কোনও হাসপাতাল, পাকা রাস্তা, সরাইখানা বা জরুরি পরিষেবা আছে কি না, কোনও কার সার্ভিস বা তেলের পাম্প আছে কি না— দেখে নেওয়ার প্রশ্নই যখন নেই? সবচেয়ে বড় কথা, সমাজটা যে-সময়ে মেয়েদের প্রতি মানসিকভাবে আরও পিছিয়ে?

    অথচ ঠিক এইরকমই সময়ে এক মাঝবয়সি বাঙালি নারী সম্পূর্ণ একার উদ্যোগ ও খামখেয়ালে কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়া চলে যাচ্ছেন কোটি কোটি মানুষের থিকথিকে অকথ্য ভিড়ের কুম্ভমেলায়, যেখানে পদপিষ্ট হয়ে মরে যাওয়ার খবর বা চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো লোকমুখে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় মিথ-এ পর্যবসিত! কিংবা চলে যাচ্ছেন কোনও পাণ্ডববর্জিত, লোকালয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ‘গডফরসেকেন প্লেস’-এ, যেখানে মিলিটারি, ট্রাইবাল আর সন্নিসি ছাড়া কেউ থাকে না!

    অকল্পনীয়।

    দুঃসাহসিক।

    অসম্ভব।

    অথচ এই অসম্ভবকে দিনের পর দিন সম্ভব করেছেন তিনি, নবনীতা দেবসেন।

    “ভ্রমণের নেশা এক তীব্র নেশা, প্রায় কৃষ্ণপ্রেমের মতো…”

    …সেই মেয়েমানুষ একজন মাতাল, একজন ডাক্তার আর এক লরিচালকের পাশে বসে ট্রাকের সামনের সিটে করে চলেছেন সারা রাত ধরে। ট্রাক থামছে পাহাড়ি রাস্তার অন্ধকার পথ পেরিয়ে, পথের ধারের চটিতে। চটির বাইরে তক্তাপোশ। সেখানে বসে মদ খাচ্ছে ড্রাইভার, ক্লিনার, গাইড, খালাসিরা । আর এই সমস্ত আঁধার রাতের বিপজ্জনক লিটল রেড রাইডিং হুড-রা হয়ে উঠছেন তাঁর ভাই, তাঁর চাচা,
    তাঁর বাবুজি।

    আশৈশব মা-বাবার সঙ্গে সারা ভারত আর ইউরোপের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিদেশে পড়াশোনা, কাজ, বিয়ের পরের প্রথম সংসার। হ্যাঁ, স্বাবলম্বী মানুষ, যাঁর অর্থোপার্জনের স্বাধীনতা আছে এবং জীবিকার সূত্রে বছরে বেশ কিছু লম্বা ছুটিরও সুযোগ আছে— তাঁর পায়ের তলায় সরষে থাকতেই পারে। কিন্তু এতই যদি সহজ হত, তাহলে বাঙালি মাস্টারমশাই-মাত্রেই এক-একজন জলজ্যান্ত লিভিংস্টোন হয়ে উঠতেন। সে-কারণেই অফিসকাছারি করা, অর্থাৎ উপার্জনক্ষম বাঙালি মা-মাসিদের মধ্যে নবনীতা দেবসেন সম্পর্কে প্রগাঢ় আবেগ, শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা আর ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও কাউকেই কখনও তাঁর জুতো পায়ে গলাতে দেখা যায়নি। কারণ শুধু অর্থ আর সময় থাকলেই চলে না, কলজের জোর লাগে। প্রচণ্ড অবুঝ জেদ লাগে।

    আর যা লাগে, তা হচ্ছে বিশ্বাস। মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। ভাবলে বিস্ময় জাগে, জীবন তাঁকে সমস্ত ভালর পাশাপাশি যত কিছু যন্ত্রণা, আঘাত দিয়েছিল, সেইসব অপ্রেমের, অবিশ্বাসের বিষ তো তাঁকে তলিয়ে দিতে পারত, যে দুঃখবিলাস বাঙালির সিগনেচার স্বভাব! অথচ, তিনি সাঁতরে গেলেন আজীবন। আলোর দিকে ঘুরে ঘুরে উঠে এলেন একের পর এক ‘নূতন সিন্ধুপারে’। ঠিক কঙ্কাবতীর মতোই। নবনীতার জীবন কি রূপকথাই নয়? যে রূপকথায় তিনিই দক্ষিণারঞ্জন। তিনিই লালকমল। আর তিনিই নীলকমল?

    “—মেয়েমানুষের অত খামখেয়াল ভাল নয়।

    —মেয়েমানুষের অত জেদ ভাল নয়।

    —মেয়েমানুষের অত সাহস ভাল নয়।”

    আর সেই মেয়েমানুষ একজন মাতাল, একজন ডাক্তার আর এক লরিচালকের পাশে বসে ট্রাকের সামনের সিটে করে চলেছেন সারা রাত ধরে। ট্রাক থামছে পাহাড়ি রাস্তার অন্ধকার পথ পেরিয়ে, পথের ধারের চটিতে। চটির বাইরে তক্তাপোশ। সেখানে বসে মদ খাচ্ছে ড্রাইভার, ক্লিনার, গাইড, খালাসিরা । আর এই সমস্ত আঁধার রাতের বিপজ্জনক লিটল রেড রাইডিং হুড-রা হয়ে উঠছেন তাঁর ভাই, তাঁর চাচা, তাঁর বাবুজি।

    “কে বলেছে আমি একা ট্রাভেল করি? কক্ষনও নয়। সপরিবারে। সর্বদা সপরিবারে। মানুষের পরিবার কি একটা?”

    যে দুর্গম তাওয়াং যাওয়ার ইচ্ছার কথা শুনেই প্রায় মূর্ছা গেছেন সকলে, সেই তাওয়াং-এর তিব্বতি মোম্পা লামাদের গ্রামের বাড়িতে থেকেছেন। ছুর্পি-মাঠা আর চমরি-র ঘি মিশিয়ে তৈরি একরকম শাকমেশানো নুন-লংকা দেওয়া ঝোল ‘পা’ আর ‘ঝ্যান’ খেয়েছেন।  ধান, কদ্দু আর গেঁহু দিয়ে তৈরি রক্সি খেয়ে তাঁর মনে হয়েছে, খানিকটা এগনগ, খানিকটা ব্র্যান্ডির মতো। ভাবছেন, “আমি সাঁওতালদের মধ্যে এরকমভাবে কখনও যাইনি, গেলে নিশ্চই মহুয়া খেতুম, হাঁড়িয়া খেতুম। কলকাতার ড্রইংরুমে বসে কখনও কেরোসিন এবং লোডশেডিং অথবা পিকাসো এবং ত্রুফো, কি রেগন এবং থ্যাচার গভীর ভাবে আলোচনা করতে করতে, ঘামতে ঘামতে, রাম-জিন-হুইস্কি গলাঃধকরণ, নাঃ মশাই— থ্যাংকিউ, ওতে আমার রুচি হয় না।”

    এই যে এত ঘুরেছেন কখনও অসুখবিসুখ কি বিপদ-আপদ হয়নি? মেয়ে হিসেবে লাঞ্ছনা? তাঁর স্বভাবসুলভ রসিকতায় এ-নিয়ে লিখছেন, “মায়েরা বড়ো একবগগা অবুঝ জাত। যতই বলি- দ্যাখো, চে গুয়েভারা অত জোর হাঁপানি নিয়ে বনে-জঙ্গলে কী যুদ্ধই না করে বেড়িয়েছেন। দ্যাখো, চারু মজুমদার ওই কার্ডিয়াক হাঁপানি এবং আরও পাঁচটা রোগশুদ্ধ দেশে কী কান্ডটাই বাধিয়ে গেলেন।” মা ইম্প্রেসড হন না মোটেই।

    “রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন না, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ? আমি সেটাকে জীবনে ধ্রুবতারার মতো মেনে চলতে চেষ্টা করি। আমি জানি, রিপু-তাড়িত, মৃত্যুশাসিত, অমানুষিক এই মানুষই আবার পারে দেবোচিত অসাধ্য সাধতে।” তাই ‘যুক্তিবাদী ঈশ্বরবিশাসী’ নবনীতা কুম্ভমেলার “কোনো এক বিশাল প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর নিদ্রাভঙ্গের মতো” নড়ে ওঠা ভিড়ের মধ্যে মলেস্টেড হয়েও মানুষের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন না।  “ঐ হাতের সঙ্গে শুরু হয়েছে আমার প্রবল স্নায়ুর যুদ্ধ। প্রবল রাম-চিমটি কেটেও দেখলুম ফল হল না। আমি এবার খপ করে হাতটি চেপে ধরলুম। তারপর গলা একেবারে উঁচু না করেও স্পষ্ট শ্রোতব্যস্বরে ইংরিজি ভাষায় বললুম— “যদি এবার চেঁচিয়ে উঠি, আপনি কিন্তু খুন হয়ে যাবেন। এই ভিড় আপনাকে এখুনি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে দেবে।” বলে হাতটা ছেড়ে দিলুম। ইংরিজিতে বললুম কেন না আমার মনে হল এই কুৎসিত লোভাতুরতা নির্ঘাত আমাদের ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত’ লক্ষণ।”

    কিশোরী বয়সে এ-লেখা পড়তে পড়তে ক্ষুণ্ণচিত্তে মনে হয়, এত কিসের ভক্তি ভরে ছুটে চলা? যে মানুষ তুলনামূলক সাহিত্যের অধাপনা করেন, মাত্র বারো বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে নরওয়ে বেড়াতে গিয়ে মধ্যরাতের সূর্য দেখেন, ব্রহ্মপুত্রকে দেখে যাঁর রাইন নদীর কথা মনে পড়ে যায় তাঁর কীসের মৌনী অমাবস্যায় শীতের রাতে পুণ্যস্নান? সে তিনি যতই বলুন, “মানুষের কাছে আমি অনেক পেয়েছি, প্রাপ্তির যেন শেষ নেই। এত সমাদর এত অনাদর এত ভালবাসা এত প্রতারণা জীবনের একূল-ওকূল ভাসিয়ে দিয়েছে যে, আমার যে-কোনওদিনই মনে হয় আজই যদি মরি, তবে কোনও দুঃখু থাকবে না। আমার মতো সুখী, সুভগা আর কে?”

    জীবনের মধ্যভাগে এসে ফিরে দেখলে বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে। ওই যে আড়াই সের রেশমসুতোর কাঞ্জিভরম শাড়ি পরা, সোয়েটার চশমা পুঁটুলি সমেত চটিজুতো-সমেত আমারই বয়সি মেয়েটি, যে জীবনে ভয়ের চেয়ে ভালবাসাকেই এগিয়ে রাখতে চেয়েছিল সব সময়, যে ডুব দিয়ে ভেতর অবধি হু হু শীতে কাঁপতে কাঁপতে এই অনন্তের রাতে পুণ্য ত্রিবেণীতে দাঁড়িয়ে ভেবেছিল, এই এক কোটি তন্ময় মানুষের একসঙ্গে মুক্তির প্রার্থনা— এই কোটি মানুষের মন যেখানে মিশে যায় সেই তো সংগম। এই অমৃতের আকাঙ্ক্ষাই তো অমৃতের স্বাদ। তার সেই চরণধূলায় ধূসর হয়ে আসনতলে লুটিয়ে থাকার সাধকে কোন যুক্তিতে নস্যাৎ করি? উত্তর মেরুর তুন্দ্রা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তমাশা অন্তরীপ— সব ঘুরেও নিজের দেশকে যে এমনি করে চিনতে চেয়েছিল…

    মানুষের প্রতি তার বিশ্বাসকেই বা খারিজ করি কোন সাধ্যে? ধুলোয় শুয়ে থাকা নির্বান্ধব মেয়েকে যারা, “তুলে আনে দলের আশ্রয়ে, জলে পড়ে যাওয়া অজানা মেয়েকে এরা শক্তহাতে  জল থেকে ডাঙ্গায় ওঠায়, পথক্লান্ত, নামগোত্রহীনকে এরাই আপন কম্বল পেতে জায়গা করে দেয় একটুখানি শোয়ার”। তার ভালবাসার বারান্দায় এসে একে একে জড়ো হওয়া সেই লাল্লন সিং, লতিফ, শার্দূল সিং, লালা, গোঙা, পেম্পা লামা, ইয়েশি আনি, ডাক্তার লালওয়ানি…

    সেই ডাক্তার লালওয়ানি, যাঁর সঙ্গে এক ঘরে রাত্রিবাস করতে গিয়ে চিন্তিত ও ভীত পুরুষটির কুন্ঠা দেখে তিনি বলছেন, “ডোন্ট ওয়ারি ডক্টর, প্লিজ রিল্যাক্স, আই প্রমিস ইউ কমপ্লিট মর‍্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সেফটি— হাহাহাহাহাহাহাহা বালকের দল, মার কোলে যাও চলে ভয় নাই!” পুরুষদৃষ্টির মোনোপলিকে সপাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া রসিকতা।

    নবনীতা একজনই। বাঙালি নারীর মনের গহিনে রোমাঞ্চ স্বপ্নকল্পময় এক-এক অগম্য বিপদসংকুল ভ্রমণের অভিযাত্রী একক নারী। এভারেস্টের চুড়ো কিংবা দুর্গম আন্টার্কটিকা অভিযানে জয়ী বাঙালি নারীদের চেয়ে স্বতন্ত্র। কারণ তা “চিরকেলে রুগ্ন মেয়ের আশাতীত ইচ্ছাপূরণের কাহিনি” । নিজেকে মাঝবয়সে এসেও যিনি “লেডিলাইক” মনে করেন না। ঠিক যেমনটা মনে করে না কোনও বালিকা বা কিশোরী। শিশু বয়সের সেই নির্ভেজাল সত্যদর্শনে অভ্যস্ত মনটাকে তিনি মরতে দেন না কখনও।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook