একটি কবিতা, রচিত ও গ্রন্থিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে একাধিক সম্পাদনা-মুহূর্ত পেরিয়ে আসে। রচনাকালীন সংশোধন বা কাটাকুটি সরিয়ে রাখলেও, লেখার থেকে কিঞ্চিৎ দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরেই সম্পাদনা-চিন্তার জন্ম। তারপর, সে-লেখা কোনও পত্রিকায় পাঠাতে হলে, আরেক প্রস্থ সম্পাদনা। সবশেষে, সে-লেখা যদি গ্রন্থভুক্ত হয়, আরেকবার। প্রত্যেকবারই কিছু-না-কিছু বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা। দেখা যায়, প্রাথমিক ও গ্রন্থিত লেখাদু’টির মধ্যে যথেষ্ট ফারাক। এই ব্যবধান শেষ দুই ধাপ, অর্থাৎ, পত্রিকায় প্রকাশিত ও গ্রন্থিত লেখার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম। এ-দু’টি মাধ্যমই যেহেতু কবিতাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, ধরে নেওয়া যায়, কবির সম্পাদনা ও অনুমোদন রয়েছে তার নেপথ্যে। বলা বাহুল্য, কোনও কবিতা বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ছাড়াও প্রত্যেকটি ধাপ পেরিয়ে গ্রন্থিত হতে পারে, কিংবা পূর্ববর্তী যে-কোনও ধাপেই থমকে যেতে পারে। নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই; কবিতা রহস্যময়ী।
কিন্তু যদি সম্পাদিত হয়েই থাকে, তাহলে তা কীরকম? একজন কবি কোনও চিন্তার বশবর্তী হয়ে সেই কাজটি করেন? এককথায় বলতে গেলে, লেখাটিকে আরও তীক্ষ্ণ ও অভিঘাতপূর্ণ করে তুলতে। প্রাথমিক থেকে অন্তিম ধাপের সম্পাদনায়, এই লক্ষ্যই অনুসরণ করেন কবি। এই পরিবর্তন খেয়াল করলে, কবির চিন্তাজগতের পাশাপাশি, সম্পাদনার কৃৎকৌশল ও প্রয়োজনীয়তাও ধরা দেয় পাঠকের মনে। দেবারতি মিত্র-র হাত ধরে সেইটুকুই বোঝার চেষ্টা করব আমরা। তাঁর পাঁচটি কবিতা, পত্রিকায় মুদ্রিত হওয়ার পরে, গ্রন্থিত হওয়ার সময় কীভাবে সম্পাদিত হয়েছে— তা খেয়াল করা, এক অর্থে শিক্ষণীয়। জরুরি তো বটেই…
আরও পড়ুন : অটোমেটিক রাইটিং বলে কিছু হয় না, বলতেন মতি নন্দী…
নিজের কবিতা রচনার ব্যাপারে দেবারতির বক্তব্য— ‘কবিতার ব্যাপারে আমি প্রতিপদে জীবনের ওপর নির্ভর করি। জীবন আমাকে দিয়ে লিখিয়ে না নিলে আমার পক্ষে এক লাইনও লেখা সম্ভব নয়।’ তিনি আরও জানান, ‘সাধারণত প্রত্যক্ষ জীবন আমার মধ্যে ঢেউ তুললে তবেই আমার কবিতার জন্ম হয়।’ তাঁর কবিতাচর্চার মধ্যে এই ‘প্রত্যক্ষ জীবন’-এর প্রভাব অপরিসীম। দৃশ্যজগৎকে মনোজগতে রূপান্তরিত করে কবিতায় তুলে আনার যে-পথ, আজীবন তারই চর্চা করেছেন দেবারতি। সে-কারণেই তাঁর কবিতা ধরাছোঁয়ার মধ্যে থেকেও ব্যঞ্জনাবাহী। মৃদু রহস্যাভাস তাঁর কবিতাকে অলংকৃত করেছে, ভারাক্রান্ত নয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত ও পরবর্তীতে গ্রন্থিত লেখার রূপ, আমরা ধরে নিচ্ছি, হুবহু কবিরই অনুমোদিত। বইয়ের পাণ্ডুলিপি সাজানোর সময়, প্রকাশিত কবিতার কোন-কোন বদলের দিকে নজর রেখেছিলেন দেবারতি? উঠে আসে, সম্ভাব্য প্রতিটি দিকই— অর্থাৎ, যতিচিহ্ন, প্যারা ও স্পেসের ব্যবহার, পঙক্তির সংযোজন-বিয়োজন এমনকী, শিরোনামের পরিবর্তনও। বর্তমান আলোচনা দেবারতি মিত্র-র কবিতা নিয়ে হলেও, এইসব সম্পাদনা-চিন্তা সম্ভবত সব কবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আলোচ্য প্রথম কবিতাটির শিরোনাম ‘শ্যামলী-চিন্ময়’। ‘বারোমাস’ পত্রিকার শারদ ১৪১০ সংখ্যায় (২০০৩) প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে, তাঁর ‘অগাধ বিরহ’ (জানুয়ারি ২০২০) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ১৭ বছরের ব্যবধানে কবিতাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে, বেশ-কয়েকটি জরুরি পরিবর্তন করেন দেবারতি। প্রথম অনুচ্ছেদের তৃতীয় লাইন অর্থাৎ ‘তাকে চেনে কেউ কেউ’, বাহুল্যবোধে বর্জিত হয়। চতুর্থ ও শেষ লাইনে যোগ হয় কয়েকটি কমা। ‘রাস্তা’, ‘আকাশবাতাস’, ‘মেঘআলো’, ‘বৃষ্টিজল’— প্রত্যেকটির পরে কমা দিয়ে কবি চাইলেন, পাঠক একটু থামুক, চোখের সামনে ভেসে উঠুক মেয়েটির চলার দৃশ্য ও পরিপার্শ্ব।
পরের অনুচ্ছেদে, পত্রিকায় ছিল ‘এখন সে প্রতিবন্ধী/ গাড়ি চড়ে ধূপ বেচে’। বইয়ে দেবারতির পরিবর্তন— ‘এখন সে/ প্রতিবন্ধী-গাড়ি চড়ে ধূপ বেচে’। মেয়েটির স্বামী অর্থাৎ চিন্ময়ের প্রতিবন্ধী-পরিচয় আলাদা করে উল্লেখের বদলে, প্রতিবন্ধী-গাড়ির সওয়ারি হিসেবে তাকে দেখিয়ে সম্ভাবনার দিগন্ত বিস্তৃত করলেন আরও। সব শেষে, বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে, শেষ লাইন— ‘নিজেদের প্রতিচ্ছবি ভেবে কেঁদেছে বা হেসেছে কখনো’-র দু’টি শব্দ আগুপিছু করলেন কবি। ‘কেঁদেছে’-র আগে ‘হেসেছে’ বসে, প্রাথমিকভাবে হাসির আগমনই নির্দেশ করল লাইনটি। সে-হাসি নিয়তির প্রতি করুণাবশত নয়, বরং স্মিতহাস্য— প্রেমের, দাম্পত্যের।
দ্বিতীয় কবিতার শিরোনাম ‘আজ গন্ধরাজ ফুল’, প্রকাশিত হয় দেশ শারদীয় ১৪২৩ পত্রিকায় (২০১৬); পরবর্তীতে ‘অগাধ বিরহ’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। পরিমাণে কম হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু সম্পাদনা রয়েছে এ-কবিতায়। প্রথম অনুচ্ছেদের চতুর্থ লাইনে ‘ভারী পাথরটা সরে গেছে’-র পর একটা কমা বসালেন দেবারতি। পরের লাইন ‘ফনফন করে বেড়ে উঠছে গাছ’-এর পর দাঁড়ি, এ-ও সংযোজন। এ-দু’টি যতিচিহ্ন, বস্তুত, বাক্যদুটিকে স্পষ্টতর করে তুলল। বিশেষত দাঁড়িটি গাছের বেড়ে ওঠাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই যেন দেওয়া। সে-গাছ মৃত্যুর পরে ফুটে ওঠা গন্ধরাজ ফুলের অথবা মুক্তির। যেন-বা শূন্য থেকে জন্ম নিল, বেড়ে উঠল দাঁড়িই।
পরের অনুচ্ছেদে ‘অলিম্পিকে দৌড়ে ফার্স্ট হওয়া’-র বদলে ‘অলিম্পিক দৌড়ে’ করলেন দেবারতি। এ-ও একপ্রকার সংকোচনের মাধ্যমে তীক্ষ্ণতা বাড়ানো, যা আমরা আগের কবিতায় দেখেছি ‘প্রতিবন্ধী-গাড়ি’র ক্ষেত্রে। পরের লাইনে— এবার যতিচিহ্ন লোপ। ‘আজ নির্ভার, ঝরঝরে আমার প্রাণ।’ থেকে কমাটি সরিয়ে নিয়ে নির্ভার ও ঝরঝরে-র মধ্যে কোনও অন্তরায় রাখলেন না কবি। পোক্ত হল প্রাণের ভারহীনতাই।
তৃতীয় কবিতা, নাম ‘পুরোনো কবিতা’, প্রকাশিত হয় ‘শিলাদিত্য’ পত্রিকার উৎসব সংখ্যায় (২০১৭)। পরবর্তীতে কবির ‘করুণ ধুনোর গন্ধ’ (ফেব্রুয়ারি, ২০২১) বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। এ-কবিতার দু’টি রূপের মধ্যে ফারাক অত্যন্ত স্পষ্ট। কোথাও মেদ বর্জিত হয়েছে, কোথাও যেন সংযুক্তও। ফলে, পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাটিই সম্পাদনার পর গ্রন্থভুক্ত হয়েছে, না কি মূল লেখাটিই— তা নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই। কিন্তু দু’টি রূপের মধ্যে তুলনা করতে বসলে, দ্বিতীয়টির প্রথম অনুচ্ছেদে নতুন দু-লাইন উঁকি দিতে দেখি। ‘ভরা শ্রাবণ— নারকোল গাছের মাথায় বাজ পড়ল/ কড়কড়কড়াৎ। হু হু হাওয়া। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি।’— এই অংশটুকু না-থাকলে খুব ক্ষতিবৃদ্ধি হত কি? পত্রিকায় এ-দু’টি লাইন অনুপস্থিত। কবি কি ছেলেটির কাঁচুমাচু মুখের সঙ্গে তুলনা টানতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রসঙ্গ টানলেন? পরের লাইনেই, ‘মনে পড়ছে’-র আগে ‘কেন জানি না’ যোগ করলেন দেবারতি, যা নতুন কোনও ব্যঞ্জনা বহনে অক্ষম। তার ঠিক দু-লাইন পর, ‘রুমাল’ শব্দটিকে ঠেলে দিলেন পরের পঙক্তিতে, ফলে তা দাঁড়াল— ‘…প্রজাপতির স্বপ্ন আঁকা/ রুমাল উড়ে এসে পড়েছে…’। রুমালের পাশে উড়ে আসার ঘটনাটুকু বসে, তা জীবন্ত করে তুলল আরও। লক্ষণীয় ‘উড়ে আসত’-র বদলে ‘উড়ে এসে পড়েছে’— এই বদলও। অতীত থেকে জায়মান বর্তমানে প্রেক্ষিতটিকে নিয়ে আসা গেল অনায়াসেই।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে, লাইন-বিন্যাসের দু-একটি বদল ছাড়াও দেখা গেল, তৃতীয় লাইনে ‘মনে পড়ে’-র পর ‘মনে পড়ে যায়’ যোগ করলেন কবি— মনে পড়াটিকে প্রলম্বিত করতেই কি? ‘এপাড়া, বেপাড়া, সিনেমা থিয়েটারের/ সাধারণ সব ব্যাপার’ লাইনদু’টি পরিবর্তিত হল ‘আশেপাশের অতি সাধারণ সব ব্যাপার’-এ। ব্যাপারগুলো ঠিক কী, তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই কবিতায়; পাঠক নিজের মতো তা খুঁজে ও বুঝে নিক। ‘…নব নব আবিষ্কার এমন করে/ রহস্য খুঁজে বার করছি’, বদলে হল ‘…নব নব আবিষ্কার বলে ভাবছি।’ এ-ও একপ্রকার মেদ ছেঁটে ফেলাই। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শেষ লাইনে ‘ভবিষ্যৎ’ শব্দটির আগে যুক্ত হল ‘রাঙা’— ভবিষ্যতের কল্পনাগুলি যে সু, খানিক লজ্জা ও প্রেমমাখাও, একটি শব্দের হাত ধরে ভেসে এল সেই ইঙ্গিত। শেষ অনুচ্ছেদেও সম্পাদনার চিহ্ন স্পষ্ট। বস্তুত, এ-কবিতায় দেবারতি মিত্র যে বদলগুলি ঘটিয়েছেন, তা যে-কোনও কবিতা-প্রয়াসীর কাছেই শিক্ষণীয়। শব্দ তথা পঙক্তি সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে কীভাবে কবিতায় ভারসাম্য আনতে হয়— অনুশীলনের প্রাথমিক পাঠও কি নয় এ?
চতুর্থ কবিতাটির শিরোনাম ‘সেই সত্যি ছবি’, দেশ শারদীয় ১৪২৪ সংখ্যায় (২০১৭) প্রকাশিত। পরবর্তীতে ‘করুণ ধুনোর গন্ধ’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। বইয়ে পালটে গেছে শিরোনামই— ‘মায়ের সত্যি ছবি’। প্রথম শিরোনামে পাঠক কবিতাটি পড়ার পর, চরিত্র হিসেবে যে-কাউকে কল্পনা করে নিতে পারতেন। পরবর্তীতে সেই সম্ভাবনা সংকীর্ণ হয়ে গেল। প্রথম অনুচ্ছেদের তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনের শেষে জিজ্ঞাসাচিহ্ন ও কমার অবস্থান-বদল এক সরণিতে নিয়ে এল দু’টি লাইনের বক্তব্যকে, বিচ্ছিন্ন হল পরবর্তী লাইনটি। গেরস্থবাড়িতে আশশ্যাওড়ার গাছ জন্মানোটি প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে সরে নিশ্চয়তা পেল, বদলে প্রশ্নের মুখোমুখি হল কুটুরে পেঁচার বাসা— বলা ভাল, পাখির পরিচয়টিই।
পরের অনুচ্ছেদের প্রথম লাইনেই একটি জরুরি যতিচিহ্ন-পরিবর্তন। দাঁড়ির বদলে বিস্ময়চিহ্ন এনে, বাক্যের দীর্ঘশ্বাসটিকে স্পষ্ট করলেন দেবারতি। তৃতীয় লাইনে, ‘তিনটি মেয়ে সাতটি মেয়ে’ পরিবর্তিত হল ‘তিনটে মেয়ে, সাতটা মেয়ে’-তে। ‘টি’ থেকে ‘টা’-তে এই রূপান্তর, প্রকৃতপক্ষে, চরিত্রগুলির সাধারণীকরণ। যাদের প্রতি কারওরই ভ্রূক্ষেপ নেই, তাদের ‘বিশেষ’ না-করে অধিক ঘরোয়া করে তোলা। এছাড়া কয়েকটি ছোট-বড় যতি-পরিবর্তন থাকলেও,নজর টানে শেষ লাইন— ‘স্বপ্ন সে কি, নোনাগাঙের জ্বর?’-এর মধ্যিখানের কমাটি। কমা-ব্যবহারের মাধ্যমে নোনাগাঙের জ্বরটিকে আলাদা ও স্পষ্টতর করলেন কবি। ওই সামান্য পজ্-ই যেন জিজ্ঞাসাটিকে চুপিচুপি নিশ্চয়তা দিল— হ্যাঁ, নোনাগাঙের জ্বরই।
পঞ্চম অর্থাৎ শেষ কবিতা, ‘ন্যাংটাপুটো ছেলেটাকে’, প্রকাশিত হয় দেশ শারদ ১৪২৫ সংখ্যায় (২০১৮), পরবর্তীতে ‘ও-ও-ও-ও’ (জানুয়ারি, ২০১৯) গ্রন্থভুক্ত হয়। বইয়ে কবিতাটির শিরোনাম ‘আমার ন্যাংটাপুঁটো ছেলেটাকে’। ‘আমার’ শব্দটি যোগ করে নিজের সঙ্গে কবিতায় বর্ণিত শিশু-চরিত্রটির সম্পৃক্ততা আরও স্পষ্ট করলেন দেবারতি। প্রকৃতপক্ষে, এ-কবিতাটির সঙ্গে কবির ব্যক্তিজীবনের একটি ঘটনার সম্পর্কসূত্র প্রতিষ্ঠা করেন আলোচকরা। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রয়াত হন দেবারতি মিত্রর স্বামী, কবি মণীন্দ্র গুপ্ত। দীর্ঘ দাম্পত্যের পর এই বিচ্ছেদ দেবারতিকে ঠেলে দেয় একাকিত্বে। নবতিপর মণীন্দ্র স্ত্রী-র কাছে হয়ে উঠেছিলেন শিশুর মতো; নিজের মাতৃরূপ কল্পনা করে সেই শিশুর অনুপস্থিতি-জনিত যন্ত্রণাই ভোগ করছেন কবি। কবিতা নিয়ে আলোচনা-প্রসঙ্গে একজন কবির ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাসূত্র টেনে আনা আমাদের না-পসন্দ। তারপরও, স্বামীর প্রতি স্ত্রী-র এই বিরহ-রূপকল্পটিকে এড়ানো গেল না। ‘ও-ও-ও-ও’ বইটির উৎসর্গও, ‘আমার স্বামী মণীন্দ্র গুপ্তকে’।
পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাটি যৎসামান্য সম্পাদিত হয়ে গ্রন্থিত হয়েছে। সপ্তম লাইনে ‘চুল আঁচড়ে দেবে’-র পর দাঁড়ির বদলে জিজ্ঞাসাচিহ্নের আগমন সংগত ও যথার্থ। তবে কবিতার শেষ লাইনটিকে আলাদা অনুচ্ছেদে পাঠানো— যেখানে একটিমাত্র বাক্যের উপস্থিতি হাহাকারধ্বনি স্পষ্ট করছে আরও— দেবারতির সম্পাদনা-চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ। ‘কোন ছেলেধরা আমাকে সর্বস্বান্ত করলে!’— বাক্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে কবিমন তথা মাতৃহৃদয়ের যে-শূন্যতা ফুটিয়ে তুলল, আগের অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে তা সম্ভব হত না কিছুতেই।
‘কবিতা মায়া, বিভ্রম, আলো ও ছায়া— জীবন ও জীবনাতীতের মিশ্রণ।’— লিখেছিলেন দেবারতি। মায়া, বিভ্রমের পথে হেঁটে আলো ও ছায়ায় পৌঁছোতে সম্পাদনার ভূমিকা অনস্বীকার্য। পূর্বোক্ত পাঁচটি কবিতার হাত ধরে সেই শিল্পের কাছেই পৌঁছনোর চেষ্টা করলাম আমরা। দু’টি মাধ্যমে (পত্রিকা ও বই) মুদ্রিত একই কবিতার ভিন্ন-ভিন্ন রূপও আলো-ছায়ারই ফসল। খোঁজ নিলে, যে-কোনও কবির অধিকাংশ কবিতাতেই সম্পাদনার এমন চেহারা দেখতে পাওয়া যাবে। প্রবণতাগুলিও কমবেশি একই, শুধু কবি ও কবিতাভেদে বদলে-বদলে যায় তার রূপ। নিজের কবিতার সম্পাদনা করতে করতে, একজন কবি আত্মসম্পাদিতও হন বইকি! কবিতাবোধ, দক্ষতার পাশাপাশি সম্পাদিত আত্ম, দেবারতিকে এগিয়ে দিয়েছিল সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলির দিকে। আমরা, তৃষিত পাঠক, খুঁটে খুঁটে বোঝার চেষ্টা করলাম কবিতার সেই শিল্পটুকুই। আমাদের এই মুহূর্তের পাঠকসত্তাও কি খানিক আগের সম্পাদিত রূপ নয়?