যদি, আমার মতো, কেউ পড়াশোনা করতে করতেই অন্য কোনও শিল্পকে নেশা ও পেশা হিসেবে নেয় (আমি নিয়েছি অভিনয়কে), তাহলে তার জীবনে কিছু কষ্টের আর কিছু বেদম হাসির অতিনাটকীয় কাণ্ড ঘটে।
এটা প্রায় খানিকটা উঁচু-ক্লাসের কেমিস্ট্রির সেই সব জটিল সমীকরণের মতো, যা আমি কক্ষনও ঠিকঠাক মেলাতে পারিনি। ব্যাপারটা তালগোল পাকানো হলে কী হবে, এগুলো থেকে দুরন্ত কিছু গল্প তৈরি হয়। সামান্য পিছিয়ে যাওয়া যাক।
পৃথিবীটা একটা ‘ব্ল্যাক মিরর’ সিরিজের এপিসোডে পরিণত হওয়ার আগে, আমার শিল্পের জীবন আর পড়াশোনার জীবনের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব তৈরি হত। অজস্র বার আমাকে ‘এই-গেল-গেল’ পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে, আর কখনও মনে হয়েছে শ্যাম রাখতে গেলে কুল কিছুতেই থাকবে না। একটা রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা বলি।
‘হ্যামলেট’ নাটকের ওপর আমার একটা ইন্টার্নাল পরীক্ষা ছিল, যেটা আসলে একটা রি-টেস্ট। প্রথমবার যারা পরীক্ষাটা দিতে পারেনি, তারা এটা দেবে। আমি প্রথমবার দিতে পারিনি, কারণ শুটিং-এর কাজে শহরের বাইরে ছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, এই রি-টেস্টের দিনেও আবার আমার শুটিং পড়ে গেছে। কলটাইম সকাল সাতটা।
এ তো ক্যারামেলের থেকেও বেশি আঠালো ও ঘোরালো পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি! তখন আমার দক্ষিণ-ভারতীয়-গাণিতিক-প্রতিভাধর অল্টার-ইগো (যার অস্তিত্বে আমি খুব বিশ্বাস করি), আর নিজের বাঙালিসুলভ দর-কষাকষির দক্ষতা— এই দুটো জোট বেঁধে আমার পিঠ বাঁচায়।
হিসেবগুলো পর পর এইভাবে আমার মাথায় আসতে থাকে:
‘দুপুর দুটো থেকে আমার পরীক্ষা রয়েছে।’
‘ওই একই তারিখে আমার সারাদিনের শুটিং রয়েছে, যেটা কোনও মতেই বাতিল করা সম্ভব নয়।’ (বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টা করেছিলাম)।
‘আমি পরীক্ষককে কিছুতেই বলতে পারি না, রি-টেস্টের একটা রি-টেস্ট নিন।’
‘আমার কলটাইম সকাল সাতটায়, ফলে দুপুর দুটোর মধ্যে শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।’
বলতে ভুলে গেছি, সেই সময়ে আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলাম, আর আমার কপালও যেমন, শুটিং-এর জায়গা পড়বি তো পড় একেবারে উত্তর কলকাতা!
যাই হোক, হিসেবের কথায় ফিরে আসি:
‘সেখানে এক-একবার যেতে-আসতেই সময় নেয় ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা।’
আর তারপরই একটা ভাবনা আমার মাথায় খেলে যায়। ঠিক বিদ্যুতের মতো নয় যদিও— বরং সেটা ছিল ম্লান, মিটমিট করে জ্বলতে থাকা একটা আশার মোমবাতি। খুব একটা নাটুকে করে বলছি না, কিন্তু ওই অসম্ভব ধাঁধাটির সমাধান হিসেবে আমার সামনে একমাত্র যা ছিল, তা হল: শুটিং-এর ফাঁকে লাঞ্চ ব্রেক!!
আমার খেয়াল হল, দুটো থেকে তিনটে পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের বিরতি আছে। ফলে তখন আমার হাতে একটাই কাজ, লাঞ্চের আগে এবং পরে অন্তত ৪৫ মিনিটের ব্যবস্থা করা, যেটা যাতায়াতে লাগবে। তারপরেই শুরু করলাম দর-কষাকষি, মানে, কথা-বলাবলি।
সত্যি বলছি, এমনকী শুটিং/পরীক্ষার দিন সকালেও নিশ্চিত ছিলাম না, আমার পরিকল্পনাটা খাটবে কি না। স্বাভাবিক ভাবেই, বাবা-মা এ-ব্যাপারে কিছু জানতেন না।
সৌভাগ্যক্রমে, আমার পরিচালক রাজি হলেন, লাঞ্চের আগে-পরে কয়েকটা এমন দৃশ্য শুট করতে, যেগুলোয় আমি নেই। লাঞ্চের আগে আমার শুটিং শেষ হয়ে যেতেই, রেকর্ড সময়ের মধ্যে আমি আমার জামাকাপড় বদলে ফেললাম (যার পুরো কৃতিত্বটাই নাটক চলাকালীন ব্যাকস্টেজে মুহূর্তের মধ্যে আমার পোশাক বদলানোর অভিজ্ঞতাকে দেওয়া উচিত)।
যদিও মাথার চুল আর মেকআপ তখনও একই রকম ছিল। আর যদি আমার নাজেহাল অবস্থার বিশদ বিবরণ আপনাদের জানাতেই হয়, তাহলে বলতে হবে তেল-চপচপে দুটো বিনুনির কথা। এখন ভেবে মনে হয়, এই বোধহয় একটা সময় যখন মাস্ক পরে মুখটা ঢেকে রাখতে পারলে খুব ভাল হত! হ্যাঁ, লজ্জায়-ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম, আর হ্যাঁ, বন্ধুরা খেপিয়ে শেষ করে দিয়েছিল। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া কী-ই বা করার আছে!
যাই হোক, পনেরো মিনিট দেরিতে আমি পরীক্ষার হল-এ পৌঁছই আর কোনওমতে একটা চলনসই উত্তর লিখে ঝড়ের বেগে সেটে ফিরে আসি। বলা বাহুল্য, গাড়িতে যাতায়াতের সময়ে টেনশনে মরে যাচ্ছিলাম, আর স্রেফ শুটিং-এ কন্টিনিউইটি বজায় রাখতে হবে বলেই বোধহয় হাতের সব নখগুলো খেয়ে ফেলিনি।
তবে সত্যি কথা বলতে, এই ভয়ানক চাপে পড়ে আমার যতগুলো মস্তিষ্ক-কোষই নষ্ট হোক না কেন, আমার মনে হয়েছিল, আমি একটা অবিশ্বাস্য কিছু করতে পেরেছি। মানতেই হবে, এটা একটা বিরাট কৃতিত্ব ছিল, একটা কঠিন ম্যাচ জেতা, আর সহজে এরকম একটা ট্রফি পাওয়া যায় না।
শুনতে পাতি লাগলেও, এর মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাসেরও জায়গা ছিল যে, হয়তো আমি আমার লাইফস্টাইলের ঘূর্ণিঝড়টাকে দিব্যি সামলাতে পারব।
বলছি বটে, তবে পরীক্ষার চাপে বা অন্যান্য পড়াশোনার কারণে অনেক শিল্প-প্রোজেক্ট আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। উল্টোদিকে, আমি হয়তো লেখাপড়ায় আরও অনেক সময় দিতে পারতাম, যদি না এই বয়সেই শিল্পী-কেরিয়ার তৈরির রোলার-কোস্টারে চড়তে চাইতাম।
কী জানেন, হানা মন্টানা অন্ততপক্ষে আমাদের এটুকু সতর্ক করতে পারতেন যে, ‘বেস্ট অফ বোথ ওয়ার্ল্ডস’-এর তালিকায় আবার দু’দিকেরই সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার-স্যাপারগুলোও আছে। তবে, আজ পর্যন্ত আমি এই ভজঘট-টার সঙ্গে দিব্যি লেগে রয়েছি, আর পুরোপুরি পাগলও তো হয়ে যাইনি। সুতরাং, আরও জানার জন্যে সঙ্গে থাকুন।