ইম্যাজিন
সাউথ সিটি মলের বোলিং অ্যালি থেকে বেরিয়ে জুতো পরছিল নীলা। আচমকা কাঁধে দুটো হালকা টোকা, ‘এই যে!’
ঘুরে দেখে এক মুখ দাড়ি নিয়ে নীলাব্জ দাঁড়িয়ে। ‘ও বাবা! গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে এখানে?’
নীলাব্জ : খেতে এসেছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। ওরা চলে গেল, ভাবলাম চারপাশটা একটু ঘুরে যাই।
নীলা : বুকে জন লেনন নিয়ে ঘুরছ? ‘ইম্যাজিন’?
নীলাব্জ : হ্যাঁ, আমার এক বান্ধবী গিফ্ট করেছে।
নীলা : যত সব বুজরুকি।
নীলাব্জ : মানে? আমার বান্ধবী বুজরুক?
নীলা : না, না, লেননের বুজরুকি। শান্তির দূত না হাতি! একজন মাল্টি মিলিয়নেয়র হাইফাই বাড়িতে নেশা করে বলছে, ‘ইম্যাজিন নো পোজেশন’। একজন মানুষ, যে সকাল থেকে রাত অবধি খাটছে শুধুমাত্র তার এক কামরা ঘরের লোনটা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য, সে এই কথাগুলো কোনওদিন বলবে? তার এটা শুনলে মেজাজ ঠিক থাকবে?
নীলাব্জ : আহা, লেনন তো এই সমস্ত পার্থিব অধিকার, সম্পত্তি, হাবিজাবি মায়া ত্যাগ করে একটা আদর্শ…
নীলা : যার কিছু নেই এবং যে এই মেটিরিয়াল দুনিয়ার একটু কাছাকাছি আসার জন্য ছটফট করছে, তার কথা ভাবেনি লেনন।
নীলাব্জ : আরে একটা গান লেখার সময়ে কি দুনিয়ার সবার জন্য ভাবতে হবে না কি?
নীলা : ওমা! বিশ্বের ঐক্য চাইছে আর সবার কথা ভাববে না? কাদের ঐক্য হবে তাহলে, মিলিয়নেয়রদের? শোনো, সব পেয়ে যাওয়ার পর যখন আর বিশেষ কিছুই করার থাকে না, তখন এইসব চলে। স্টিলি ড্যানের গান আছে এটার উত্তরে, ‘ওনলি আ ফুল উড সে দ্যাট’…
নীলাব্জ : তাই? ওই গানটা লেননকে নিয়ে লেখা?
নীলা : ওদের সাক্ষাৎকারে কোথাও পাইনি কিন্তু ইন্টারনেটে এই নিয়ে কিছু লেখাপত্তর পড়েছি।
নীলাব্জ চট করে ফোন বের করে গুগুল করতে থাকে। ‘আচ্ছা! ‘আ ওয়ার্ল্ড বিকাম ওয়ান’ কিংবা
‘দেয়ার অন দ্য স্ক্রিন,/আ ম্যান উইথ আ ড্রিম’! বাড়ি গিয়ে ভাল করে একটু মিলিয়ে দেখব। ‘ইম্যাজিন’ বোধহয় লেনন আর ইয়োকো ওনো দুজনের লেখা।
নীলা : ওই আর এক! এল্টন জন একবার ওদের একটা কার্ড পাঠিয়েছিল—
‘Imagine six apartments,
it isn’t hard to do,
one is full of fur coats,
another’s full of shoes.’
নীলাব্জ : হাহাহা! এটা কোথাও একটা দেখেছিলাম।
নীলা : খুব বড়-বড় বুকনি মেরে লেখা হয়েছিল, ‘আই হোপ সামডে ইউ উইল জয়েন আস’, মানে স্বপ্নের ফেরিওয়ালাগুলো ধরেই নিয়েছে আমরা স্বপ্ন দেখতে জানি না, অতএব আমরা একদিন ওদের দলেই ভিড়ব। এদিকে ইয়োকো ওনো এখন লেননের সব ‘পজেশন’ হাতিয়ে বসে আছে! চলো ওকে গিয়ে শোনাই ‘ইম্যাজিন নো পোজেশন’।
নীলাব্জ : আহ্! ওরা কী সুন্দর কিউট একটা কাপল ছিল! তোমার লেনন ইয়োকো-কে ভাল লাগে না?
নীলা : কী বলছ? ইয়োকোর চিৎকার শোনোনি? ওরা নাকি আবার একসঙ্গে গান বাজনা করত!
নীলাব্জ মাথা নাড়ে, হেসে ফেলে।
নীলা : লোকে বলে লাভ ইজ ব্লাইন্ড। লেননের ক্ষেত্রে লাভ ওয়াজ ডেফ-ও বটে।
নীলাব্জ : বাপ রে! তুমি তো আজ প্রচণ্ড খেপচুরিয়াস! চলো গিয়ে কোথাও বসি।
ওরা দুজন মলের ভেতরে হাঁটতে থাকে।
নীলাব্জ : আজ কিন্তু আমি ঝগড়া শুরু করিনি।
নীলা : তুমি শুরু করিয়েছ।
নীলাব্জ : একটা ‘ইম্যাজিন’ লেখা জামা পরলাম আর…
নীলা : আমাকে প্রোভোক করলে। মেয়েদের পোশাক যেরকম রেপিস্টদের প্রোভোক করে। সেই একই লজিকে তুমি দোষী।
নীলাব্জ : যাসসালা! এটা কী লজিক হল?
নীলা : এই লজিকেই তো দুনিয়া চলছে। চার বছরের শিশু যখন ধর্ষিত হয়, মানুষ পারলে তখনও একই প্রশ্ন তোলে, কী পোশাক ছিল ওর গায়ে?
নীলাব্জ চুপ, মাথা নীচু করে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
নীলা : কী হল? নেতিয়ে পড়লে দেখছি!
নীলাব্জ : না দ্যাখো, মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তোমার সমস্যা একজন অসম্ভব ধনী মানুষ কেন ‘ইম্যাজিন’-এর মতো একটা গান লিখল, তাই তো? এই একই গান একজন গরিব ভিখিরি লিখলে তোমার ভাল লাগতে পারত, তাই তো?
নীলা : গরিব ভিখিরি কোনওদিন এইসব গান লিখবে না। লোকগান শুনবে, নয়তো কোনও পরবের বা প্রেমের বা দেবতার আরাধনা এই ধাঁচের। সমাজব্যবস্থা কীরকম হওয়া উচিত, মানুষের কী ভাবা উচিত, এইরকম গান কেউ গায় না।
নীলাব্জ : তা মানুষ কি আজন্ম আদিম হয়ে থাকবে না কি? সভ্যতা এগিয়েছে, চিন্তাভাবনা আরও এগিয়েছে, গানের বক্তব্যও পালটাচ্ছে। এই ধরনের আদর্শবাদী গানের শ্রোতাও তৈরি হয়েছে।
নীলা : আমার সমস্যাটা এই আইডিয়ালিজম নিয়েই। আদর্শবাদী মহাপুরুষদের নিয়ে। যাকে খাওয়া-পরার চিন্তা করতে হচ্ছে না, তার হাতে অনেক সময়। সে বসে-বসে ভাবতে পারে পৃথিবী কীরকম হওয়া উচিত, কিন্তু সে তো বাস্তবের থেকে অনেক দূরে। আদর্শ বলবে ভ্রাতৃহত্যা অন্যায় কিন্তু তোমার ভাই যদি তোমার দিকে কুঠার নিয়ে তেড়ে আসে, তাকে তো তোমায় মারতে হবে। সেখানে সাদা পতাকা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি তোমার আদর্শ নিয়ে এই মর্ত্য থেকে জাস্ট ভ্যানিশ।
নীলাব্জ : কিন্তু যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। এই কথাতে কী অন্যায় আছে? তাহলে তুমি কি যুদ্ধের পক্ষে?
নীলা : আমি যুদ্ধের পক্ষেও নই, বিপক্ষেও নই। আমি বিচার করব আদর্শ দিয়ে নয়, পরিস্থিতি দিয়ে। প্র্যাক্টিকালিটি দিয়ে। যদি দেখি আলাপ-আলোচনার প্রতিটি দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আইন-আদালত অকেজো, চারিদিকে শুধু দুর্নীতি এবং অপচয়, মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে তখন যদি সাধারণ মানুষ অস্ত্র তুলে নেয়, আমি সেটাকে অন্যায় বলে দেখব না। তখন শান্তির বাণী প্রচার করার কোনো মানে হয় না। তখন মানুষ মানুষকে মারতে বাধ্য হবে নাহলে সে যে নিজে মারা পড়বে!
নীলাব্জ : কেলেঙ্কারি করেছে, তুমি তো দেখছি মাওবাদী! তুমি এই ঝাঁ চকচকে সাউথ সিটি মলে বিপ্লব এনে ফেলবে। কেউ শুনে ফেললে কিন্তু একদম জেল।
নীলা : আমি এসব মাও-ফাও এত জানি না। যা মনে হয় তাই বললাম।
নীলাব্জ : কিন্তু এভাবে যদি ভাবো যে সমাজের উচ্চস্তরে বিচরণ করা মানুষেরাই তো ঠিক করে দেয় সভ্যতা কোনদিকে যাবে। আজকে পেনিসিলিন কি পাড়ার পাঁচু আবিষ্কার করছে? না! চাঁদে কী করে রকেট পাঠাতে হবে বা নদীতে বাঁধ কী করে দিতে হবে সেটা দেখার লোক কিন্তু সাধারণ বুদ্ধির কেউ নয়। অতএব আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব তাই নিয়ে বুদ্ধিমান মানুষরাই বক্তব্য রাখবে। আমরা শুধু ফলো করব।
নীলা : আমি কিন্তু লেননের বুদ্ধিমত্তা বা শিল্পীসত্তাকে কোনোভাবেই আক্রমণ করছি না। লেননের সঙ্গীতে পারদর্শীতা নিয়ে আমি একটা বক্তব্যও রাখছি না। হি ইজ গ্রেট! কিন্তু যেই মুহূর্তে বিশ্বের ঐক্য স্থাপন করার জন্য বলছে যে দেশ থাকবে না, সম্পত্তি থাকবে না, এই থাকবে না, ওই থাকবে না তখনই মেজাজটা যাচ্ছে গরম হয়ে। এটা ওর একটা আধা রান্না করা থিওরিমাত্র। কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার জায়গায় লেনন নেই। যে ব্যক্তি বাঁধ বানাচ্ছে, তার বাঁধ ব্যর্থ হলে কিন্তু মানুষ নিজের চোখে তা দেখতে পাবে। সে দায়বদ্ধ। লেননের কল্পনার পৃথিবী হয়ত দু মিনিটে ভেঙে পড়বে কিন্তু সেটা প্রমাণ করবে কে? দায়বদ্ধতাটা কোথায়? এগুলো সম্পূর্ণ হাওয়ায় ছুঁড়ে দেওয়া কয়েকটা বুকনি। লেনন বিশ্বে ঐক্য, শান্তি এইসব আনার ফর্মুলা বানাচ্ছে না গান বানাচ্ছে?
নীলাব্জ : একটা মানুষের কি নিজস্ব ফিলোজফি থাকতে পারে না?
নীলা : অবশ্যই পারে। কিন্তু লেননের রেলাটা দেখো। লিখছে যে, আমি যদি ওর দর্শনে বিশ্বাস না করি তাহলে ও আশা করে যে আমি আমার দর্শন পরিত্যাগ করে, একদিন নিশ্চয় ওর সঙ্গে একমত হব আর তখনই বিশ্বে ঐক্য আসবে। এটা কী ধরণের ঔধত্য? আমার দর্শনটাই সেরা দর্শন? এটা ফ্যাশিজম নয়?
নীলাব্জ : সে যাই হোক, গানটা শুনতে কিন্তু আমার দারুণ লাগে। শুরু হলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। চারপাশে আলো হয়ে যায়।
নীলা : সে আমারও ভালোই লাগে।
নীলাব্জ : যাক্কলা! তাহলে?
নীলা : লিরিকে মন চলে গেলে বিগড়ে যাই। আমি ওর ফর্মুলাতে বিশ্বাস করি না।
নীলাব্জ : আমার করতে ইচ্ছে হয়।
নীলা : সে তো বুঝতেই পারছি নাহলে বুকে ইম্যাজিন নিয়ে ঘুরে বেড়াবেই বা কেন?
নীলাব্জ হেসে ফেলে : আজ আসি বুঝলে। পরে একদিন আবার নাহয়…
নীলাও একটা মিষ্টি করে হাসি এঁকে নেয় মুখে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী