ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • যখন পাহাড় নীচে নেমে আসে


    জয়া মিত্র (September 21, 2024)
     

    তিরিশে জুলাই শেষ রাত্রে, তুমুল বৃষ্টিকালে সকলে যখন ঘুমে, কেরালার ওয়েনাড জেলার দুটি-তিনটি গ্রামের ওপর নেমে এল মাথার ওপরে থাকা পাহাড়। মাটি, পাথর, কাদা, কাঁকর— সবসুদ্ধ পাহাড় ধ্বসে পড়ল প্রায় আট কিলোমিটার নীচে, একটি নদীর ওপরে। তার নীচে চাপা পড়ে গেল তিনটি পাহাড়ি গ্রাম— চুরানমাল, মুণ্ডাক্কাল, আত্তমালা। প্রাথমিক ভাবে বলা হয়েছিল মৃতের সংখ্যা ২৩০জন। জেলাসদর কালপেট্টা থেকে মাইল চল্লিশেক দূরে অবস্থিত গ্রামগুলি ছিল তাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। পাহাড়ের গায়ে ধাপে-ধাপে সাজানো চা-বাগান, ঝরনার কলতান, গাড়ি যাবার মসৃণ রাস্তা, বিশ্রাম বাংলো, ট্যুরিস্ট স্পটের আর যা-কিছু, সব দিয়ে সাজানো সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থা। গ্রামগুলি থেকে ৩০-৪০ কিমি দূর দিয়ে প্রবহমান চালিয়ার নদী কেরালার বড় নদীদের মধ্যে অন্যতম। এক সময়ে ভবানী আর চালিয়ার নদীদুটি থেকে কেরালার এক বড় অংশের কৃষি স্বাভাবিক সেচ পেত। ধীরে-ধীরে গত প্রায় তিন দশকে চালিয়ারের দুইপাশে কারখানার সংখ্যা বাড়তে থাকে, নদীর চলাফেরার পথ ক্রমশ সংকীর্ণ হয়। উৎকট দূষণের ফলে এর জল সম্পূর্ণভাবে অব্যবহার্য হয়ে পড়ে। ধ্বসটি নেমে এসেছিল এই চালিয়ার নদীর পথ পর্যন্ত। পথে পড়া অন্য একটি ছোট নদী ইরুভাণিপুঝা-র গতিপথ বন্ধ হয়ে নদী অন্যপথ ধরে বইতে থাকে। নদীতীরের ঘরবাড়ি, জনবসতি সব কিছু চাপা পড়ে। যেখান দিয়ে চালিয়ার নদী বয়ে যেত, সেখান থেকে আগের রাত্রে ঘুমোনো মানুষদের প্রায় ২০০ মৃতদেহ খুঁড়ে তোলা হয়। ধ্বসটি নেমে আসবার পথে চুরালমালায় যা-কিছু তার সামনে পড়েছিল, সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এমনভাবে, যেন ওখানে নেমে আসা কাদামাটি-প্রকাণ্ড সব পাথরঝুরো-পাথরের স্তূপ ছাড়া আর কিছু কখনও ছিলই না। সরকারি সমস্ত সম্ভবপর ত্রাণব্যবস্থা-সেনাবাহিনী, জাতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার বাহিনী, অগ্নিনির্বাপক ও উদ্ধারকারী দল, বন এবং বন্যপশু সংরক্ষণ বিভাগ— সকলে একসঙ্গে উদ্ধারের কাজে নেমে পড়েন। বৃষ্টি চলতেই থাকে। তারই মধ্যে সেই নতুন তৈরি হওয়া ভূমিরূপের নী চ থেকে উদ্ধার করা হয় আরও মৃতদেহ। মানুষের ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে বেরিয়ে আসা ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সরকারি বয়ানে স্বীকার করা হয়, মৃতের সংখ্যা কমবেশি ৫০০০। অনেকে মনে করেন প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। যা ছিল ছোট-ছোট গ্রামে বসতি করা উচ্চাকাঙ্ক্ষাবিহীন সাধারণ মানুষদের জীবনযাপনের আধার, তাদের ছোট-ছোট জীবনের ঘরোয়া বেঁচে থাকার স্বপ্ন— সেই জায়গাটাই রাত পোহাতে-না-পোহাতে হয়ে গেল এক বিরাট শূন্যস্থান। পরদিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যার হিসেব দেন— রাজ্যের ৯১টি ত্রাণশিবিরে ৯,৩০০ মানুষ রয়েছেন।

    বলা হচ্ছে, ২০১৮-র বন্যার পরে এটাই কেরালার বৃহত্তম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আমরা দূরে থাকা সাধারণ মানুষরা শুনছি কীরকম এই বৃহত্তম বিপর্যয়টির চেহারা। ধ্বসটির স্খলন শুরুর বিন্দু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সমুদ্রতল থেকে ১৫৫০ মিটার উঁচু পুঞ্চিরিমাত্তমের ওপরে অবস্থিত একটি উপত্যকাকে। এলাকাটির আয়তন প্রায় ৮৬,০০০ বর্গমিটার অর্থাৎ কম-বেশি বারোটি ফুটবল মাঠের সমান। সেটি নামতে থাকে এবং নামার সঙ্গে-সঙ্গে তার গতি ও আয়তন— দুই-ই বৃদ্ধি পায়। পাহাড়ের গা বেয়ে আট কিলোমিটার নেমে আসতে তা সাক্ষাৎ এক বিধ্বংসের তাণ্ডব রূপ নেয়। পথের কোনও বাধাই আর তার কাছে বাধা হয় না।  

    কোনটি বৃহত্তম বিপর্যয়, তার হিসেব সাধারণ লোকেদের কাছে নিষ্প্রয়োজন। পাঁচ বছর পর হয়তো অন্য কোনও উপলক্ষে বলা হবে, ‘২০২৪-এর জুলাইয়ের ভূমিধ্বসে যত ক্ষয়ক্ষতি হয়, এবারের বিপর্যয়ে ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়েও বেশি।’ তাতে কীসের সান্ত্বনা হবে? অতীতের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব ততক্ষণই, যতক্ষণ তা ভবিষ্যতের কর্মপথে কাজে লাগানো হয়। কী দেখছি সেখানে? উপগ্রহ প্রদত্ত ছবিতে পুঞ্চিরিমাত্তমের উপরকার উপত্যকার ওই বিশেষ জায়গাটিতেই ২০২৩ সালের ২২ মে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট ভূমিধ্বসের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।

    দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতি যখন আর চাপা দিয়ে রাখার তুলনায় বড্ডই বেশি হয়ে যায়, তখন তার দায় ঠেলে দেওয়া হয় প্রকৃতিরই ওপর। ওয়েনাডের, সিমলা কিংবা যোশীমঠ— সর্বত্রই ধ্বস, হিমবাহ নেমে আসা, মাটি বসে যাওয়া, আচমকা নদীর সংহারমূর্তি— সব কিছুরই কারণ হিসাবে দায়ী করা হয় ক্লাউডবার্স্ট অর্থাৎ আচমকা প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতকে। কিন্তু যাঁরা খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন, প্রকৃতিতে একেবারে অকস্মাৎ কোনও কিছুই ঘটে না, আগে কোথাও-না-কোথাও সতর্কবার্তা দেখা যায়। কেরালাও ব্যতিক্রম নয়। ২০১৫ থেকে ২০২২-এর মধ্যে দেশে যত ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটেছে, জানা যাচ্ছে তার শতকরা ষাট ভাগই ঘটেছে কেরালায়। ৩৭৮২টির মধ্যে ২২৩৯টি। দুর্ঘটনার পর কেরালার Post Diaster Studies বলছে, বহুকাল ধরে মানুষের অনুচিত হস্তক্ষেপই এর জন্য মূল দায়ী। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেই ক’দিনের মাত্রাছাড়া বৃষ্টিপাত।

    কেবল কেরালা কেন, সমগ্র পশ্চিমঘাট পর্বতমালাই জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্বেগজনক শিকার। পৃথিবীর প্রাচীনতম পর্বতমালাগুলির একটি এই পশ্চিমঘাট। স্থানীয় লোকজন ও দেশসুদ্ধ পরিবেশকর্মীদের বাধা অগ্রাহ্য করে, সরকারের নিজের বন সংরক্ষণ আইন না মেনে এই সুগভীর প্রাচীন বনাঞ্চলের বড়-বড় অংশ কেটে ফেলে নগরায়ণ, রাস্তা, কারখানাজনিত উন্নয়ন হতে থাকে। একেবারে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় দুই দশকে সেইসব অঞ্চলের বনের নীচেকার জমির বাঁধন আলগা হয়ে যায়।

    ২০১১ সালে আজকের এই একই অঞ্চল মেপ্পাডির একটি গ্রাম সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ভূমিধ্বসে। পশ্চিমঘাট বাস্তুতন্ত্র-বিশেষজ্ঞ মাধব গ্যাডগিলের নেতৃত্বে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্রের সংকট বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করা দীর্ঘ রিপোর্টকে যে কার্যত গ্রাহ্যই করা হয়নি, ওয়েনাডের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বিপর্যয় তার প্রমাণ। উক্ত রিপোর্টে মাধব গ্যাডগিলের পরামর্শ ছিল উন্নয়নমূলক কাজকর্ম চালানোর প্রয়োজনে ওই পর্বতমালার অংশগুলিকে ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’ Ecologically Sensitive Zone-1 (ESZ-1) এবং ‘সংবেদনশীল’ Ecologically Sensitive Zone-2 (ESZ-2)— এই দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া হোক; এবং ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’ এলাকাগুলিকে কোনওরকম হস্তক্ষেপের বাইরে রাখা হোক। এই ESZ-1 এবং ESZ-2 অঞ্চলে কোনওরকম নির্মাণের কাজ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোর নিয়ন্ত্রণের স্পষ্ট নিষেধ জানানো হয়। কমিটির সদস্য ভি এস ভিজয়ন বলেন, ‘We proposed that quarrying and red category industries should not be allowed in ESZ- I. Also in areas where quarrying was permitted, we suggested that quarries should be at least 100 metres away from human settlements. However, later on, the government reduced the distance to a mere 50 metres.’ কেরালার ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা’ হিসাবে চিহ্নিত ১৮টি জায়গার মধ্যে ছিল ২০১১ সালের বিপদাপন্ন এলাকাটিও। সেই মেপ্পাডির সংলগ্ন মুণ্ডাক্কাই, চুরামালা, আত্তামালা, নূলপুঝা গ্রাম, এই তিরিশে জুলাই ঘুমন্ত অবস্থায় যেখানে ঘটল ন-দশ হাজার মানুষের প্রাণসংহার। আহত অগণন। যথাসর্বস্ব-হারানো জীবন্মৃত মানুষের সংখ্যা কত কারো জানা নেই। কোনও ক্ষতিপূরণেই যে সেই মানুষগুলো আর কখনও সুস্থ-স্বাভাবিক হবেন না— এতে তাদের কিছুই যায় আসে না, যারা দেশের প্রাকৃতিক পরিচয় বললে কিছু বোঝেন না কেবল কিছু মুদ্রার হিসাব ছাড়া।

    যাঁরা খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন, প্রকৃতিতে একেবারে অকস্মাৎ কোনও কিছুই ঘটে না, আগে কোথাও-না-কোথাও সতর্কবার্তা দেখা যায়। কেরালাও ব্যতিক্রম নয়। ২০১৫ থেকে ২০২২-এর মধ্যে দেশে যত ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটেছে, জানা যাচ্ছে তার শতকরা ষাট ভাগই ঘটেছে কেরালায়।

    মাধব গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্টে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সমগ্র পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকেই Ecologically Sensitive Area (ESA) হিসাবে ধরা হোক। এই পরামর্শ কেন্দ্রীয় সরকার ও তার অনুগামীদের স্বভাবতই মনোমতো হয়নি। তাঁরা বলেন এই রিপোর্ট অবাস্তব ও উন্নয়নবিরোধী। কস্তুরীরঙ্গন নামে অন্য একজন বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে অন্য একটি তদন্ত এবং উপদেষ্টা কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটি মত দেয় যে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মোটামুটি সাঁইত্রিশ শতাংশ এলাকাকে ESA হিসাবে ধরাই যথেষ্ট।

    কেন এত সতর্কতা চেয়েছিলেন মাধব গ্যাডগিল কমিটি? কেন তাঁরা অতখানি উদ্বিগ্ন ছিলেন বিশেষত ESZ-1 এলাকাতে কোনোরকম নির্মাণের কাজ বন্ধ করার বিষয়ে? পশ্চিমঘাট পর্বত হিমালয় নয়। (যদিও আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এ-কথা যে, মনোহীন নির্মাণ হিমালয়েরও বিপন্নতা বাড়িয়েছে বেহিসাব) তার শিলাপাথর-মাটি-জলের সংস্থান ভিন্ন। খনন হলে বা নির্মাণকাজ হলে সেই ভার পশ্চিমঘাটের পাহাড়ের ঢালে থাকা বড় এবং ঝুরো-কুচো পাথরের গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ঢালু জায়গার ওপরে ধাপ কাটা হলে, ওয়েনাডের চা-বাগানগুলোর ক্ষেত্রে যেটা বিরাটভাবে ঘটেছিল, সেই ঝুরো-কুচো পাথর এবং কাঁকরের ধাপগুলোকে প্রায়ই ঠিকমতো বিন্যস্ত করা হয় না। আলোচ্য অঞ্চলে তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল চা-বাগান পর্যন্ত পৌঁছবার উপযুক্ত পাকা রাস্তা, ট্যুরিস্টদের ওপর নির্ভর শিকড়বিহীন অর্থনীতি তৈরি করার উপযোগী আরাম ও মনোরঞ্জক ব্যবস্থা। পায়ের তলার যে-ভূমি, পাহাড়-ঝরনা-জঙ্গল, সেই সব কিছুর সম্মিলিত পরস্পরনির্ভর অস্তিত্ব, তার বুনিয়াদি শৃঙ্খলাগুলোকে অগ্রাহ্য করে নিজস্ব অবিমৃষ্যকারী স্পর্ধিত লাভের স্বপ্ন দেখা।

    এই প্রথম নয়। এই শেষও নয়। বাস্তবকে অস্বীকার করা অন্ধ লোভ নিজের পায়ের সামনের খাদকে দেখতে পায় না। সেই নির্বুদ্ধি লোভের মূল্য দেয় কিছু অসহায় মানুষ। নষ্ট হতে থাকে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মাবলি। কখন সামলাবার সময়, আমরা জানি না। কেউ-কেউ ডাক দেন। হয়তো দেরি হয়ে যায়।

    তিরিশে জুলাই ভোরে মেপ্পাডির ওয়াইনাড ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স-এর কর্মী নিত্তু জোজোর ফোন থেকে বাইরের পৃথিবীতে প্রথম আর্ত চিৎকার ভেসে আসে, ‘ধ্বস নেমেছে। নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে আমাদের ঘরবাড়ি। আমাদের বাঁচাও। আরেকটা ধাক্কা এলে আমরা বাঁচব না!’ ভাইরাল হয় এই আর্তনাদ। আগস্টের তিন তারিখে উদ্ধার হয় নিত্তু-র নিথর দেহ।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook