১৯০৬ সালের শরৎকালের কোনও এক দিন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গালটন তাঁর প্লাইমাউথ শহরের বাড়ি ছেড়ে অদূরবর্তী এক আঞ্চলিক মেলার দিকে রওনা দিলেন। গালটনের বয়স তখন পঁচাশি; বয়সের জড়তা সে-সময়ে তিনি বেশ অনুভব করেন কিন্তু তাঁর কৌতূহল ও আগ্রহে কোনও খামতি নেই। যে-দেশীয় মেলাটিতে গালটন যাবেন, সেখানে স্থানীয় কৃষক ও আশপাশের শহরের মানুষ আসবেন এবং তাঁদের গবাদি পশু-পাখি, ভেড়া, ঘোড়া, শূকর, মুরগি প্রভৃতির প্রদর্শন ও গুণমান মূল্যায়ন করা হবে। গালটন তখন জেনেটিক্স ও প্রজনন বিষয়ক গবেষণায় রত; সে-উদ্দেশ্যেই এই মেলায় তাঁর আসা। সুতরাং গভীর আগ্রহের সঙ্গে প্রদর্শনী ঘুরে দেখছিলেন অশীতিপর এই বিজ্ঞানী। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল একটি প্রতিযোগিতা— যেখানে বেশ মোটাসোটা একটা ষাঁড়ের ওজন কত হতে পারে তা নিয়ে বাজি রাখা হচ্ছে। মাত্র ছ-পেন্স খরচা করলেই একটি টিকিট কেনা সম্ভব— যে-টিকিটে নিজের নাম-ঠিকানা আর ষাঁড়ের-ওজন-বিষয়ে-অনুমান লিখে জমা দিলেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা যাবে। আটশো লোক নিজেদের ভাগ্যপরীক্ষা করলেন— যাঁদের অনুমান সবচেয়ে ভাল, তাঁরা পুরস্কৃত হলেন। অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই পেশায় কৃষক বা কসাই— একটি ষাঁড় দেখে তার ওজন অনুমানে যাঁরা পারদর্শী; আবার অনেকেই খেলাচ্ছলে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন— ষাঁড়ের ওজন সম্পর্কে যাঁদের বিশেষ কোনও ধারণাই ছিল না। যাই হোক, প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ শেষ হলে গালটন আয়োজকদের কাছ থেকে টিকিটগুলি সংগ্রহ করলেন এবং পরে এ-নিয়ে পরিসংখ্যানগত একটি পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষা করার সময়ে তেরোটি টিকিট তাঁকে বাদ দিতে হয় (যেহেতু সেগুলি অপাঠ্য ছিল); বাকি ৭৮৭টি টিকিটের অনুমানকে তিনি একটি গ্রাফে সর্বনিম্ন-সর্বোচ্চ ক্রমে সাজান এবং সমস্ত অনুমানের গড় নিরূপণ করেন। ষাঁড়ের ওজন সম্পর্কে ৭৮৭ জনের অনুমানের গড় যে নেহাত উদ্ভট একটা সংখ্যা হবেই, এ-বিষয়ে গালটন প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু গালটনকে অবাক করে দিয়ে দেখা গেল, ষাঁড়ের ওজনের গড় অনুমান দাঁড়াল ১১৯৭ পাউন্ড— যেখানে ষাঁড়টির আসল ওজন ছিল ১১৯৮ পাউন্ড। এমন আশ্চর্য ফলাফল গালটনের পর্যবেক্ষণ-সহ ছাপা হল ‘নেচার’ পত্রিকায়। প্লাইমাউথের মেলায় জনগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত যে সেখানের যে-কোনও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবিশেষের তুলনায় উঁচু দরের, তা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকল না।
১৮৯৫ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয়েছিল ফরাসি লেখক গুস্তভ্ লে বঁ-র ধ্রুপদী গ্রন্থ The Crowd: A Study of the Popular Mind। বঁ প্রতীচ্যে গণতন্ত্রের ক্রমোত্থানে আতঙ্কিত ছিলেন এবং জনতার বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। কিন্তু এ-প্রসঙ্গে এমন একটা কথা তিনি বলেছিলেন যা উল্লেখযোগ্য। বঁ-র মতে, জনতা তার অন্তর্ভুক্ত সব সদস্যের সম্মিলন মাত্র নয়; জনতা স্বয়ংক্রিয়, স্বতন্ত্র— ব্যক্তিনির্বিশেষে তার নিজস্ব একটা চরিত্র ও অস্তিত্ব আছে, আছে নিজের ইচ্ছাও। জনতার যা অভিপ্রায় এবং ক্রিয়া, প্রায়শই দেখা যায়, তা ওই সমূহের অন্তর্ভুক্ত কোনও ব্যক্তির অভিপ্রায় বা সম্ভাব্য ক্রিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। জনতার সিদ্ধান্তে ভরসা রাখা উচিত নয় কেননা জনতা সাহসী, ভীরু অথবা নিষ্ঠুর হতে পারে কিন্তু তাকে বুদ্ধিমান বলা চলে না। জনতার বুদ্ধিতে, তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতায় গুস্তভ্ লে বঁ আস্থা রাখতে পারেননি ঠিকই কিন্তু জনতা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নেতিবাচকও ছিলেন না। জনতা যে দাঙ্গা, ভাঙচুর, গণধর্ষণের মতো অপরাধমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে এ তো আমাদের পরিচিত অভিজ্ঞতা— বঁ-ও সে প্রসঙ্গ তুলেছেন; তবু ভিন্ন পরিস্থিতিতে এহেন জনতাই বীরত্বের পরিচয়ও দিয়ে থাকে, পিতৃভূমি রক্ষায় প্রাণ দিতে পিছপা হয় না, বিপ্লবে-বিদ্রোহে শাসনতন্ত্র উলটে দিতেও পারে। জনতার কাজ মানবিক হোক-বা-না-হোক, তার ক্ষমতা যে দানবিক, এ-নিয়ে বঁ নিঃসংশয়; তাঁর মোদ্দা বক্তব্য শুধু এই যে—জনতা এক-জাতীয় আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়; আবেগের বশেই সে কাজ করে; পরিস্থিতি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিস্থিতি অনুসারে তার প্রতিক্রিয়া হয় দ্রুত; ভেবে-চিন্তে, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তার নেই।
ব্যক্তিনির্বিশেষে জনতার এই যে একটা স্বতন্ত্র ‘ব্যক্তি’-চরিত্র আছে, এ-চিন্তা অবশ্য গুস্তভ্ লে বঁ-এর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। যে-শেক্সপিয়রের নাট্যশিল্পকে বর্ণনা করা হয় ‘drama of individuality’ বলে (যেহেতু শেক্সপিয়র-সৃষ্ট নাটকের চরিত্রেরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে ভরপুর— চরিত্র হিসেবেও অভিনব, বাঁধাধরা ছকের বাইরে) সেই শেক্সপিয়রই যখন তাঁর নাটকে জনতাকে উপস্থাপিত করেছেন তখন ওই জনতা-ভুক্ত কোনও ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকেই আর লক্ষ করা যায় না; বরং সেখানে জনতাই হয়ে ওঠে ‘ব্যক্তিবিশেষ’। Crowd and Rumour in Shakespeare গ্রন্থের (Routledge: ২০১৬) লেখক কাই উই্গান্ট শেক্সপিয়রের নাটকে বিবৃত জনতার এই বিশেষত্ব লক্ষ করেই মন্তব্য করেছেন— ‘Metaphorically speaking, crowd and rumour illustrate that individuals are always ready to become part of a common body (the crowd) and to share a common voice (rumour).’ শেক্সপিয়রের নাটকে অবশ্য জনতার ইতিবাচক ভূমিকা তেমন কিছু দেখা যায় না; ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের শক্তিশালী ‘জনতাসংঘ’ কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতেই পারে না— সে নিয়ত দোদুল্যমান! দেশের রাজনৈতিক সমস্যার গভীর বিশ্লেষণেও তার স্পৃহা নেই। চটুল ও পরিহাসপ্রিয়; ক্রোধোন্মত্ত আর হিংস্র অথবা কখনও আতঙ্কগ্রস্ত এই জনতার আবেগপ্রবণতার উপর কি আস্থা রাখা চলে?
জনগণের উপর ভরসা ছিল না প্লেটোরও। আর তাই তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন না। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে দেখি সক্রেটিস জনতাকে একটা ‘বিরাটাকার হিংস্র জানোয়ার’ রূপেই কল্পনা করেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যারা চালক, তারাই এই বিপুল শক্তিশালী জনতা-পশুর পালকও বটে। জনতা নামের এই জানোয়ারটা কীসে খুশি হয় আর কীসেই বা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে; কখন শান্ত আর কখনই বা বিপজ্জনক— তা বোঝা, তার এসব আচার-আচরণ, গতিবিধি আর মেজাজ-মর্জি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করাই ওই পশুটার পালক ও রক্ষকদের কাজ। কাকে বলে ভাল আর কাকে মন্দ, কী উচিত আর কী অনুচিত, কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়— হিংস্র পশুটার রক্ষকেরা এসব জানে না, জানতে চায়ও না; সে শুধু ‘বিরাটাকার হিংস্র জানোয়ার’-টাকে খুশি রাখতে পারলেই খুশি। স্বাভাবিকভাবেই নির্বোধ অথচ ভয়ংকর এই জনতা নামক জানোয়ারটার প্রতিক্রিয়াই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চালক-প্রভুদের যাবতীয় নৈতিক জ্ঞানের ভিত্তি এবং বলা বাহুল্য সক্রেটিসের মতে রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে তা কাম্য বা ভালো হতে পারে না।
জনতা শব্দের একটা অর্থ ‘জনসমূহ’, অন্য অর্থ ‘ভিড়’। ‘দেশের জনগণ বা জনসমূহ’— এ-অর্থে যখন ‘জনতা’ শব্দটিকে ব্যবহার করি, তখন জনতা আসলে একটা বিমূর্ত ব্যাপার— তাকে চোখে দেখা যায় না, তার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় শুধু; কিন্তু ভিড় মূর্ত ব্যাপার— যে-কোনও একটা উপলক্ষে এই ভিড় জড়ো হতে পারে; সে জমায়েতকে চোখে দেখা যায়। কোনও একটি ভিড়ের আচরণ কেমন হবে, তা বহু কিছুর উপর নির্ভর করে। যেমন ভিড়টিকে নেতৃস্থানীয় কেউ নিয়ন্ত্রণ করছেন, না কি তা অনিয়ন্ত্রিত— সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যাই হোক, যে-কোনও ভিড়েরই ভাল-মন্দ একটা আচরণ থাকে, যেমনটা গুস্তভ্ লে বঁ বলেছিলেন, সে-আচরণ অপরাধমূলকও হতে পারে অথবা বীরত্বপূর্ণও হয়ে ওঠা সম্ভব কিন্তু যাকে বলছি ‘জনসমূহ’ তার আচরণ ঠিক কীরকম? কিংবা যা বিমূর্ত, যাকে চোখে দেখা যায় না, তার আচরণের পরিচয় পাওয়া যাবে কেমন করে? সুতরাং আচরণ বা কোনও রকম ক্রিয়া নয়, বিমূর্ত এই জনসমষ্টির যা থাকে, তা হল মত। জনমত।
এই জনমতের উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু জনগণ কি আদৌ কীসে দেশের ভাল আর কীসে মন্দ, এই সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম? জনতার বিচারবুদ্ধির উপর আস্থা রাখা উচিত নয়— গুস্তভ্ লে বঁ-র ছিল তেমনই মত। অথচ, সম্প্রতি জেমস সুরোওয়াকি তাঁর লেখা The Wisdom of Crowds (Anchor Books, ২০০৫) গ্রন্থে বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদাহরণ সহযোগে এর বিপরীত মতই প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করেছেন। ‘No one of us knows more than all of us.’— ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গালটনের পরীক্ষামূলক এই সিদ্ধান্তই The Wisdom of Crowds গ্রন্থে পুনঃপ্রমাণিত হয়েছে। স্বভাবতই যে-প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক এবং যে-প্রশ্ন জেমস সুরোওয়াকি তুলেওছেন, তা হল— যদি কোনও বিষয়ে জনতার প্রজ্ঞা, এমনকী সে-বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ ও প্রতিভাবান ব্যক্তির চাইতেও বেশি হয়ে থাকে, তাহলে মানবসভ্যতায় বিশেষজ্ঞতার প্রয়োজনই বা কী? বছর-বছর কয়েকজনকে বেছে নিয়ে তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেবারই বা কী দরকার আর বিশ্বজুড়ে শুধু জ্ঞানচর্চার জন্যই ব্যয়বহুল এত প্রতিষ্ঠান খুলে রাখারই বা কী প্রয়োজন? অযথা জটিল না করে, সহজ অঙ্কের হিসেবেই বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করা যাক। ষাঁড়ের যথার্থ ওজন অনুমানের বাজি যারা ধরেছিল, তাদের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যায় বিশেষজ্ঞ কসাই ও কৃষকের উপস্থিতি ছিল বলেই না গালটন সংখ্যাটার প্রায়-নিখুঁত গড় পেয়েছিলেন। ৭৮৭ জনের কারোরই যদি ষাঁড় সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকত, তাহলে আদৌ কি গালটন প্রায়-নিখুঁত ওই গড়মানটায় পৌঁছতে পারতেন?
দুজন ব্যক্তির জ্ঞানের যেমন কমবেশি এই তুলনামূলক বিচার সম্ভব, তেমনই দুটি ভিন্ন দলের— জনসমষ্টির প্রজ্ঞারও তুলনামূলক বিচার সম্ভব। অর্থাৎ ব্যক্তি বনাম সমূহ নয়; ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, সমষ্টি বনাম সমষ্টি— জ্ঞানের তুল্যমূল্য বিচার এভাবেই করতে হবে। জনতার প্রজ্ঞায় বিশ্বাসী জেমস সুরোওয়াকি তাই বলেছেন— ‘The more information a group has, the better its collective judgment will be, so you want as many people with good information in a group as possible.’ কোনও একটি দল বা জনসমষ্টি কখন প্রজ্ঞাবান? কোন পরিস্থিতিতে তার সিদ্ধান্ত নির্ভুল হবে? সুরোওয়াকি নির্ভুল-সিদ্ধান্ত-দেবার-ক্ষমতাসম্পন্ন জনগণের চারটি বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছেন— মতবৈচিত্র (প্রতি ব্যক্তির কাছে এমন কিছু ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকবে, যা ওই গোষ্ঠীর অন্য কারও থাকবে না; সেই ব্যক্তিগত জ্ঞান সম্পূর্ণ উদ্ভটও হতে পারে), মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (যেখানে ব্যক্তির মতের উপর তার চারপাশের লোকেদের মতের প্রভাব ন্যূনতম), বিকেন্দ্রীকরণ (নিজের অঞ্চল বা স্থান সম্পর্কে ব্যক্তির বোঝাপড়া যত বেশি হবে তত ভাল) এবং সমবায় (ব্যক্তির রায়কে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পরিণত করার পদ্ধতি)। যদি কোনও গোষ্ঠী এই শর্তগুলি পূরণ করে, তবে তার রায় ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেন? বিষয়টিকে এভাবে দেখা যেতে পারে। প্রত্যেকের অনুমানের মধ্যে দুটি উপাদান রয়েছে— তথ্য ও ত্রুটি। যখন যথেষ্ট-বৈচিত্রপূর্ণ, পরস্পর-স্বতন্ত্র ব্যক্তির একটি সমবায় কোনও কিছু অনুমান করবে— তখন ত্রুটিগুলি পরস্পরের মধ্যে কাটাকুটি করে পড়ে থাকবে নির্জলা তথ্যটুকুই। ষাঁড়ের ওজন বিষয়ক গালটনের পরীক্ষাটার কথাই ভাবা যাক। কিছু লোক ষাঁড়ের আসল ওজন যা (১১৯৮ পাউন্ড), তার চাইতে বেশি অনুমান করবে, কিছু লোকের অনুমিত সংখ্যাটা হবে কম। এই ‘বেশি’ আর ‘কম’ কাটাকুটি হয়ে পড়ে থাকবে আসল ওজনটাই। ফলত উপরোক্ত চারটি শর্ত যথাযথভাবে পূরণ করা গেলে, সেই আদর্শ পরিস্থিতিতে, কোনও একটি গোষ্ঠীর সম্মিলিত অনুমানের গড় হবে এক্কেবারে নির্ভুল। কারণ— ‘the crowd is holding a nearly complete picture of the world in its collective brain.’ (দ্র. The Wisdom of Crowds) । কিন্তু আমাদের এই জনবিস্ফোরিত দেড়শো কোটির দেশে অঙ্কটা কি এতই সহজ?
জেমস সুরোওয়াকির গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ের বিষয় ‘গণতন্ত্র’। দেশের ও দশের ভাল কীসে হবে এ-নিয়ে সিদ্ধান্ত দেশের জনতাই নিতে পারবে— এটাই গণতন্ত্রের প্রত্যয়। কিন্তু কুটিল ও বক্র বিদেশনীতি বা অর্থনীতিশাস্ত্রের জটিল হিসেব-নিকেশ দেশের কত শতাংশ মানুষ বোঝেন? সুতরাং গণতন্ত্রে, ‘কীসে দেশের ও দশের ভালো’— এ-সিদ্ধান্ত জনতা সরাসরি নেয় না; কে বা কারা দেশের-দশের জন্য ভাল, জনতা শুধু সেই সিদ্ধান্তটুকুই নিতে পারে। অথচ নির্বাচনী মারদাঙ্গা ও জোচ্চুরির কথা বাদ দিলেও দেখা যাবে, যেখানে ভোটদান প্রক্রিয়া নির্বাধ ও স্বচ্ছ, সেখানেও সব মানুষ ভোট দেন না। যাঁরা দেন সেই ৭০-৮০ শতাংশের মধ্যে, আমাদের বহুদলীয় গণতন্ত্রে, ৩০-৪০ শতাংশ ভোট পেয়েই নির্বাচিত হন জনপ্রতিনিধি। অর্থাৎ বহু ক্ষেত্রেই হিসেবটা দাঁড়াবে এই যে— কোনও একটি অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি সেই অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত! এ তো গেল আঁকাড়া অঙ্ক। এর বাইরে রাজনৈতিক দলগুলির জটিল প্যাঁচ-পয়জারকে হিসেবের মধ্যে নিলে মনে হবে গণতন্ত্র একটা ‘তন্ত্র’ বটে কিন্তু জনগণের ভূমিকা তাতে সামান্যই!
সর্বোপরি, দেড়শো কোটির এই বহুবিচিত্র দেশে মতবৈচিত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিকেন্দ্রীকরণ এবং সমবায়— নির্ভুল জনমতের পক্ষে উপযোগী এই চতুষ্কোটি শর্তপূরণের অনূকূল পরিস্থিতি কতটা রয়েছে তাও ভেবে দেখার। ধর্ম-ভাষা-খাদ্যাভ্যাস-পোশাক-পরিচ্ছদ-আচার-অনুষ্ঠানের বহুবিধ বৈচিত্রই ভারতের জনতার শক্তি। কিন্তু যে-কোনও রাজনৈতিক দলই এই বৈচিত্রকেই নির্মূল করবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়— যেহেতু তার এক-রঙা ছাতার তলায় যত বেশি সংখ্যক মানুষ জড়ো হবেন, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে শাসনক্ষমতা অধিকার করার সম্ভাবনা তার তত বাড়বে। ব্যক্তির মতকে যেন-তেন-প্রকারে প্রভাবিত করে নিজের অ্যাজেন্ডা-ক্ষেত্রে টেনে আনার জন্য গণতন্ত্রের পরিচালকদের ভাবনার অন্ত নেই। নিজ অ্যাজেন্ডা-ক্ষেত্রে জলসিঞ্চন করবার জন্যই গণতন্ত্রের পরিচালকেরা স্বপক্ষে চায় সংবাদ ও বিনোদনমাধ্যমকে। তাছাড়া আইটি সেলের ভাড়াটে সৈন্যদল তো তার আছেই। জনমতকে এভাবে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার প্রত্যক্ষ চেষ্টা ছাড়াও আছে পরোক্ষ নানা ফিকিরও। কিন্তু গণতন্ত্রে শুধু শাসকই তো নেই, আছে বিরোধীও। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, বিরোধীকণ্ঠ যেখানে যত শক্তিশালী, গণতন্ত্র সেখানে তত সবল। ইতির সঙ্গে কিন্তু নেতিটাও ভেবে দেখতে হবে। বিরোধীকেই কি ‘সত্যান্বেষী’ বলা চলে? তারও তো আছে নিজস্ব পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডা এবং তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আইটি সেল, বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী, সংবাদ ও বিনোদনমাধ্যমও।
পোস্ট-ট্রুথের এই যুগে সত্য আর তথ্য যখন ঘুলিয়ে উঠেছে, মিডিয়া ও সামাজিকমাধ্যমগুলি যখন জনতাকে দোমড়ানো-মোচড়ানো ‘সত্য’ নুন-মরিচের মুখরোচকে নিরন্তর জোগান দিয়ে চলেছে, অর্থ আর প্রতিপত্তি— এই দুই পাখায় ভর করে ক্ষমতাসীনেরা যখন বিপক্ষের স্বরকে ক্রমাগত কোণঠাসা করে চলেছে, সে-অবস্থায়, অধুনা, আমাদের গণতন্ত্রে ‘জনমত’ হিসেবে যা উঠে আসছে, তাকে কি জনতার প্রজ্ঞা— Wisdom of Crowds বলে বিবেচনা করা চলে? আদর্শ পরিস্থিতি হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে, আমাদের দেশের ধর্ম-ভাষা-খাদ্যাভ্যাস-পোশাক-পরিচ্ছদ-আচার-অনুষ্ঠানের বৈচিত্রকে যত্ন করে রক্ষা না করা গেলে, বাক্স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাস্রোতকে যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত না হয়ে উঠতে দিলে, ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ না করা গেলে ভারত হয়তো গাণিতিক অর্থনীতির শক্তিতে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান দখল করলেও করতে পারে কিন্তু সভ্যতার ইতিহাসে, মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে তার এ-গতিকে পশ্চাদ্গতি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।
শেক্সপিয়র তাঁর ‘হেনরি ফোর্থ’ নাটকে Rumour বা গুজবকে অসংখ্য মুখসম্পন্ন, মূর্খ, অতিকায় এক জন্তুর উপমায় উপমিত করেছিলেন— ‘the blunt monster with uncounted heads…’। শেক্সপিয়রের নাটকে গুজবই জনতার স্বর। জনতার জ্ঞানে, তার বিচারবুদ্ধিতে সক্রেটিস বা শেক্সপিয়রের মতোই যাঁদের আস্থা নেই, তাঁদের কাছে গণতন্ত্র নেহাত বুজরুকি ছাড়া আর কী? কিন্তু যাঁরা জনতার প্রজ্ঞায় বিশ্বাসী, নির্ভুল জনমত লাভের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাই তাঁদের কাছে চ্যালেঞ্জ। আজ মাটি-পৃথিবীর জাগতিক অস্তিত্বের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী আসল-নকলে মেলানো আমাদের ভার্চুয়াল অস্তিত্ব। ভার্চুয়াল এই জগৎ অর্থের বশীভূত। সুতরাং যারা জনতাকে, জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তারা বিষবৃক্ষে জলসেচন করতে থাকে; সত্য-মিথ্যে মিশিয়ে তৈরি-করে-তোলা আখ্যান আর উপাখ্যানগুলোকে মূর্খ, অসংখ্য-মুখসম্পন্ন, মুখরা পশুটার মুখে-মুখে ছড়িয়ে দিতে দ্বিধা করে না। ‘ভাইরাল’ এই মিথ্যাযাপনের যুগে, আমাদের দেড়শো কোটির সুবৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে, জনতা বহুমুখসম্পন্ন অতিকায় একটা জানোয়ার হয়ে দেখা দেবে, না কি পৃথিবীর সুমহৎ প্রজ্ঞারূপে তার আবির্ভাব হবে— সে ভবিষ্যদ্বাণী করবে কে?