পাঠক বিদ্যাসাগর
আউট অফ প্রিন্ট’। বইপড়ুয়াদের অভিমানের শব্দবন্ধ, প্রকাশকদের গর্বের। আবার সবসময়ে যে গর্বের তা কিন্তু নয়, অনেক প্রকাশক প্রকাশনার অনেক বই নিয়েই ভাবেন, কবে তা শেষ হবে। ওদিকে পাঠকমাত্রেই আক্ষেপ করেন, ‘অমুক বইটা এত চমৎকার, অথচ এখন আর প্রকাশক ছাপেন না!’ লেখকের কথা বাদই দিচ্ছি। প্রিন্ট অন ডিমান্ডে ছাপা বই আউট অফ প্রিন্ট হলে মাটিতে তাঁদের পা পড়ে না, আবার পাঁচশো কপি বই পনেরো বছরে শেষ হওয়ার পর তা কয়েক মাস পাওয়া না গেলেই প্রকাশকের নামে আড়ালে খিস্তিখেউড় চলে। তবু এই ডামাডোলে অনেক ভাল বই কালের নিয়মে হারিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে উঠে গেছে ছোট-বড় নানান প্রকাশনাও। লাইব্রেরির ক্যাটালগ ঘাঁটতে-ঘাঁটতে, পুরনো বইয়ের দোকানে কিংবা কোনও গ্রন্থকীটের বাড়িতে তারপরেও মাঝে মাঝেই হাতে উঠে আসে সেরকমই এক-একটা হারিয়ে-যেতে-বসা বই। আমরা, চুনোপুঁটিরা, সেসব বই হাতে নিয়ে আহ্লাদিত হই। বিস্ময় কাটে না এই ভাবনায় যে, এরকম একটা বই এতদিন আমাদের চোখের বাইরে ছিল! অতঃপর বইপোকাদের মধ্যে আদেখলেপনা দেখা যায়, যে প্রথম আবিষ্কারক তাকে দেখা হয় সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে, কয়েক সেট জেরক্স তৈরি হয়ে যায় মুহূর্তে, আর কপাল ভাল থাকলে কোনও প্রকাশক সেই সব বইয়ের পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন। এই লেখার মধ্যে দিয়ে সেইসব বইয়েরই কথা বলব, যার সামনে পড়ে, যা পড়ে নানা সময়ে চমকে গেছি। যারা চেহারায় ম্যাড়মেড়ে কিন্তু মেধায় তুখোড়। যাদের কথা এখন আর কেউ বলে না।
২
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। এক বছর আগের একটা বিকেল। গেছি ‘বোধশব্দ’ পত্রিকার কাজে। উদ্দেশ্য, বিদ্যাসাগরের সংগ্রহ থেকে ওঁর পাঠচিহ্ন আছে এমন বই দেখা। অশোক উপাধ্যায়কে মিনমিন করে বললাম, ‘শুনেছি, বিদ্যাসাগর বই পড়ার সময়ে নাকি পাশে-পাশে তাঁর নানা মন্তব্য লিখে রাখতেন! সেগুলো কি দেখা যায়!’ অশোক উপাধ্যায় বললেন, ‘আমিও শুনেছি। কিন্তু কোন বই তুমি কি বলতে পারবে?’ স্বাভাবিক ভাবেই তা আমার অজানা। দেখিইনি তো কোনওদিন, বলব কী করে! মুখ চুন হয়ে যায়। ‘না, মানে যদি ঘেঁটে একটু দেখতাম?’ ‘মানে, তুমি বলছ, ওই হাজার-হাজার বই তুমি ঘেঁটে দেখবে?’ আবারও আমি চুপ। আমতা-আমতা করি। মুখে কথা আসে না। ‘যদি করতে চাই, আপনারা অনুমতি দেবেন কী?’ সপাট উত্তর আসে, ‘না। সেটা সম্ভব নয়।’ ওস্তাদি করার সব জায়গা শেষ। বেরিয়ে আসব যখন ঠিক, অশোক উপাধ্যায় ডাকেন আবার। যাই। ‘একটা বই তোমায় দিচ্ছি, বসে পড়ো। উপকার কিছু হলেও হতে পারে।’ মিনিট কুড়ি পর হাতে আসে পাতলা একটা বই। ‘পাঠক বিদ্যাসাগর’। লেখক : পুলকেশ দে সরকার।
সাদার মধ্যে বিদ্যাসাগরের বাড়ির ফোটোগ্রাফ। সঙ্গে ছোট করে বিদ্যাসাগর-মূর্তির ছবি। এই হল প্রচ্ছদ। দাম পঁচিশ টাকা। ১৯৮৬ সালের আগস্ট মাসে বইটি লেখক নিজেই প্রকাশ করেন। ১৬০ পাতার বই। দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এই ধরনের বই কোন প্রকাশকই বা নিজ দায়িত্বে ছাপবে! কিন্তু বইটা পড়ার পর সে-ভুল ভাঙে। কেন, সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি। লেখকের একটা কথা এখানে বলে নিতে চাই। এই বইপ্রকাশ নিয়ে তিনি শুরুতে লিখেছেন, ‘আমার প্রকাশক নেই। তাই হয় প্রতারকের পাল্লায় পড়েছি, নয়তো পাণ্ডুলিপিগুলো ইঁদুরে কেটেছে অথবা অতি কষ্টে নিজ ব্যয় ছাপিয়ে অন্তত খরচ তোলার চেষ্টা করেছি… এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। কাগজ ছাপা ইত্যাদি দুর্মূল্য বলে সীমিত সংখ্যক ছাপলাম।’ পুলকেশবাবু যখন এই বই লিখেছেন, তখন তাঁর বয়স ৭৮ বছর। তিনি সাংবাদিক ছিলেন, পুরনো পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা দেখেছি। এর বেশি ওঁর সম্পর্কে কিছু জানি না। এই বইয়ের শেষে ওঁর নিজের দু-একটা বইয়ের কথা আছে, কিন্তু সেগুলোর প্রকাশক কারা জানতে পারছি না। যখন ‘পাঠক বিদ্যাসাগর’ প্রকাশিত হচ্ছে, সেই আশি ছুঁই-ছুঁই বয়সে পৌঁছেও নিজের পয়সায় কেন এ-বই ছাপতে গেলেন তিনি? তার একটাই কারণ। বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধা। নিজের দুঃখকে তুচ্ছ করে পুলকেশবাবু লিখেছেন, ‘দুঃখ হয়, যাঁর অন্তিমযাত্রা বিশ্বব্যাপী জয়ধ্বনির মধ্যে হওয়া উচিৎ ছিল সেই বিদ্যাসাগরকে এই কৃতঘ্ন দেশে অশেষ মনোকষ্টে দগ্ধ হতে হয়েছিল। তাঁর সযত্ন নির্মিত লাইব্রেরী গৃহটি নিয়ে আজ কোন কৌতূহল নেই। কোন সরকারকেই দেখলাম না এ নিয়ে কিছুমাত্র লজ্জিত বা উদ্বিগ্ন হতে।… জানি এর প্রকাশক নেই, সম্ভবত বাজারও নেই। কিন্তু আমার নিজের তৃপ্তি এই যে, এই অসাধারণ ব্যক্তিটির উদ্দেশে আমার একটি শ্রদ্ধার্ঘ মুদ্রাঙ্কিত হ’ল।’ বিদ্যাসাগর-কেন্দ্রিক নানা চর্চার মধ্যে তাঁর পাঠকসত্তাকে নিয়ে যে পুলকেশবাবু উত্তেজিত ছিলেন, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। অন্য চোখে তিনি বিদ্যাসাগরকে দেখতে চেয়েছিলেন।
৩
পুলকেশবাবুর বই পড়ে জানতে পারছি, দেনার দায়ে বিদ্যাসাগরের লাইব্রেরি বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। এরকম সময়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী শরণাপন্ন হন স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন লালগোলার রাজবাহাদুরকে বলেন এই সংগ্রহ কিনে নিতে। উনি কেনেনও, কিন্তু তা নিয়ে চলে যান লালগোলায়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তা চাননি। ফের তিনি গুরুদাসবাবুর কাছে যান, গিয়ে পুরো কথাটা ব্যাখ্যা করে বলেন যে তিনি চান ওই সংগ্রহ সাহিত্য পরিষদে আসুক। শেষ অবধি পরিষদের পক্ষ থেকে ১৯১০ সাল নাগাদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রমুখ লালগোলায় গিয়ে সেসব বই নিয়ে আসেন। জানা যাচ্ছে, সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহে রয়েছে বিদ্যাসাগরের মোট ৩৪৪৭টি বই। তার মধ্যে ৩২২টি সংস্কৃত ও হিন্দি, ১৯১টি বাংলা, বাদ বাকি ইংরেজি। এর বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের আরও কিছু বই বীরসিংহ গ্রামেই রয়েছে।
এবারে আসি বইয়ের মূল জায়গায়। পুলকেশবাবু এই বইয়ের সিংহভাগ জুড়ে পাঠককে জানান দিয়েছেন দুটো বিষয়। এক, বিদ্যাসাগরের বইয়ের সংগ্রহ কতটা বৈচিত্রময় ছিল। দুই, তিনি কীভাবে বই পড়ার পাশাপাশি তাতে কোনও পাঠচিহ্ন রাখতেন। পুলকেশবাবু সাহিত্য পরিষদে কেবল বিদ্যাসাগরের বাংলা বইগুলোই দেখেছেন এবং এই বই লিখেছেন তার ভিত্তিতেই। সেখান থেকেই আমরা জানতে পারছি, প্রথম কথা, বিদ্যাসাগর কিছু ফেলতেন না। যে-কারণে তাঁর সংগ্রহ থেকে পাওয়া গেছে ‘গ্যাঞ্জেস পাইলট কোম্পানির অনুষ্ঠানপত্র’ কিংবা ‘তামাকের উপর মাসুল হওয়া বিহিত কি না?’ বিষয়ক সরকারের ও ভারতর্ষীয় সভার পত্র। দ্বিতীয় কথা, তাঁর পড়াশোনার ধরন একমুখী ছিল না। তাঁর সংগ্রহে যেমন শেক্সপিয়র, বায়রন, দান্তের বই পাওয়া গেছে— তেমনই পাওয়া গেছে জগদীশ তর্কালঙ্কার, বিপিনবিহারী ঘোষাল অথবা পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অধুনা-বিস্মৃতরও বই। পুলকেশবাবু আরও অজস্র বইয়ের নামোল্লেখ করেছেন বইতে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিলাম না— তবে এটুকু বোঝা যায়, বিদ্যাসাগরের সংগ্রহে ছিল ভূবিদ্যা থেকে কবিতা, সব ধরনের বই। তাঁর চিকিৎসা-শিক্ষা সম্পর্কিত বাংলা বইয়ের সংগ্রহ নাকি সবচেয়ে বিস্ময়কর।
ব্যক্তিগত লাইব্রেরি চিরকালই একটা সময় পর্যন্ত ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। আসল লোক সরে গেলেই তাঁর বইপত্রের ঠাঁই হয় ফুটপাথে; আমরা চিল-শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন জানা যায়, বলাবলি হয়, ওমা উনি এরকম বইও পড়তেন! কয়েক বছর আগেই তো একবার কলেজ স্ট্রিটে কানাঘুষো শোনা গেল, এক পণ্ডিত ব্যক্তির নাম সই করা অনেক ‘পানুবই’ বাজারে এসেছে। লোকজন এমন ভাবে বলতে লাগল, বেদ পড়লে যেন ওসব বই পড়া চলে না। যাক গে, যে-কথা বলছিলাম, পণ্ডিতদের লাইব্রেরি সম্পর্কে কৌতূহল থাকলেও সচরাচর তা সাধারণ মানুষ জানতে পারে না; এবং কিঞ্চিৎ জানতে পারলেও তা নিয়ে বিস্তারে বই লেখার কথা কোনও লেখক সচরাচর ভাবেন না। সত্যজিৎ-শতবর্ষে এত যে লেখা চতুর্দিকে দেখা গেল, সত্যজিতের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি নিয়ে সেরকম কোনও লেখা কি আমরা পেয়েছি? পাইনি। বরুণ চন্দ কেবল স্বল্প পরিসরে তা নিয়ে দু-কথা বলেছেন। সেদিক থেকে ‘পাঠক বিদ্যাসাগর’ ব্যতিক্রমী বই। কেননা এই বই জ্ঞানের আরও নতুন জানালা পাঠকের সামনে খুলে দেয়, যেহেতু এর মধ্যে বিদ্যাসাগরের পাঠচিহ্নের কিছু-কিছু নমুনা আছে।
কীভাবে বই পড়তেন বিদ্যাসাগর? এই বই পড়ে জানতে পারছি, তিনি বইতে মূলত পেনসিলের দাগ দিতেন। কদাচিৎ কালির দাগ দেখতে পাওয়া গেছে। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বইতে কখনো তিনি ইংরেজি ও বাংলা পরিভাষা যাচাই করেছেন, কখনো লাইনের নীচে কিংবা একাধিক লাইন হলে পাশে লম্বা দাগ বা ক্রসচিহ্ন দিয়েছেন, ভুল বানান ঠিক করেছেন কিংবা নতুন শব্দ যোগ করেছেন। শব্দ নিয়ে তিনি যে নানান ভাবনাচিন্তা করতেন, তার বিভিন্ন নমুনা এই বই পড়লে টের পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, তার হাত ধরে বাংলা ভাষার নানান সংস্কার সে-সময়ে হচ্ছে। সবসময়ে চিহ্নের অভিসন্ধি, তার অন্তর্নিহিত অর্থ, টের পাওয়া না গেলেও আমরা এক-একটা পাঠচিহ্নে থেমে নানারকম করে ভাবতে পারছি, এও কি কম পাওনা? ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’র একটা পাতায় ‘সমিতি’ শব্দের তলায় বিদ্যাসাগর কেন দাগ দিচ্ছেন, কী ব্যাখ্যা দেব এর? এই বই হাতে না এলে আমি কি কোনওদিন দেখতে পেতাম বিদ্যাসাগরের মার্জিনালিয়ার নমুনা?
৪
বহুদিন হয়ে গেল এই বই আর পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে পুরনো বই হিসেবে কেউ কিনতে পারেন সৌভাগ্য হলে, নাহলে না। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল, অবশ্য একটু ঘুরপথে। সাহিত্য পরিষদ থেকে বেরিয়ে চলে গেছিলাম হরিনাথ দে রোডে। বইয়ে যে-ঠিকানা দেওয়া ছিল, সেই বাড়িতে। লেখকের পুত্র বর্তমান। তিনিই আমায় জেরক্স করে দিয়েছিলেন, এই বই। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই এখন মনে হয়, যে-‘বাজার’ নিয়ে পুলকেশবাবু শঙ্কিত ছিলেন, এই মূল্যবান বইটি পুনঃপ্রকাশিত হলে সত্যিই কি তার কোনও বাজার থাকবে না?