সমৃদ্ধি ডাকছে তোকে’— শুনেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিল জগৎ; খুলে রাখা জামাটা গায়ে টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘কই কোথায়?’
‘এ কি দুয়ারে সমৃদ্ধি নাকি যে তোমার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে!’ ঘরের বাইরে থেকেই বলেছিল জেঠতুতো বোন চঞ্চলা; ‘পুকুরপাড়ে, কদমতলায় বসে আছে!’
‘সে কী রে! বাড়িতে নিয়ে এলি না কেন? সাধুজ্যাঠার মেয়ে বলে কথা! যা ডেকে নিয়ে আয়।’
‘হ্যাঁ! আমি আবার এই রোদে এক কিলোমিটার ঠেঙিয়ে তাকে ডাকতে যাই আর কী!’
অগত্যা গায়ে জামা, পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল জগৎ। সাধুজ্যাঠার মেয়ে বলে কথা! একদা দুই পরিবারে হলায়-গলায় ছিল। তারপর পরিবর্তনের হাওয়ায় দাদা-ভায়ের সম্পর্ক ঘুচে গেল! এখন প্রতাপশালী পিতার, প্রভাবশালী পুত্রী সমৃদ্ধির জগৎকে কী প্রয়োজন হয়ে থাকতে পারে ভাবতে-ভাবতে পুকুরপাড়ে পৌঁছে গিয়েছিল জগৎ।
কদম গাছের নীচে বাঁধানো বেদীতে রোদচশমা পরে বসেছিল সমৃদ্ধি, রুক্ষ লালচে এলোচুল, মুখের দু-পাশ থেকে ঝুলছিল। কাছে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়েছিল জগৎ, ‘আমাকে…’
একটু সরে গিয়ে সমৃদ্ধি জগৎকে তার পাশে বসতে ইঙ্গিত করেছিল। জগৎ ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিঃশব্দে তার পাশে আলগোছে বসতে, বেশ কিছুক্ষণ পরে সমৃদ্ধি ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলেছিল, ‘মরে গেলেও আমি ওই চর্বির বস্তাটাকে বিয়ে করতে পারব না! তুমি বাবাকে বলো প্লিইইজ!’
কে চর্বির বস্তা, কে-ই বা তার সঙ্গে সমৃদ্ধির বিয়ে দিতে চাইছে— এসব কিছুই জানে না জগৎ, সে সাধুজ্যাঠাকে কী বলবে!
‘বলো তুমি আমায় বিয়ে করবে!’
‘কী!’ চমকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল জগৎ।
‘কেন? আমি কি খুব খারাপ? কিসে খারাপ? দেখতে? নাকি আমার চরিত্র খারাপ?’
‘না না, তা নয়, তা নয়!’
‘তবে?’
‘তুই আমার বোনের মতো…’
‘মতো! বোন তো আর নই?’
‘কিন্তু আমি তো তোকে… মানে তোমাকে কখনও সেভাবে ভাবিনি!’
‘তো কী! এখন ভাবো। অসুবিধেটা কোথায়?’
‘সেটা তো… তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না!’
‘আমাকে বোঝাতে হবে না! তুমি নিজে বোঝো! আমার মা আর তোমার মা যে কী ভীষণ বন্ধু সেটা জানো নিশ্চয়ই?’
‘সে ছোট থেকে এক স্কুলে পড়েছে বলে! কিন্তু তাই বলে…’
‘আমরা তোমাদের পালটি ঘর!’
‘পালটি ঘর হলেই বা কী? ধনে-মানে দু’ঘরের বিস্তর ফারাক! সাধুজ্যাঠার কত সব বড় বড় কাজ-কারবার, পুলিশের সঙ্গে কত জানাশোনা, পার্টির ওপর মহলে কত আনাগোনা, নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা! আর আমরা? বাবা মফস্বল কলেজের রিটায়ার্ড প্রফেসর…’
‘আর তুমি নিজে যে ইঞ্জিনিয়ার!’
‘সেটাই তো কাল! বাবা যে কেন আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্যে সাধুজ্যাঠার কাছে হাত পাতেনি!’ সেটাও ওঁর রোষের কারণ! কিন্তু সেসব কথা তো আর মেয়েকে বলা যায় না! জগৎ বলেছিল, ‘আমার সামান্য চাকরি, কোম্পানিটাও তেমনি! আজ আছে বলে কাল-ও যে থাকবে, কোনও গ্যারান্টি নেই!’
‘বুঝেছি! তুমি বাবাকে বলতে ভয় পাচ্ছ, তাই তো?’
‘আরে! আমার মতো লোক ওঁর মতো লোকের মেয়েকে বিয়ে করব, বললে উনি রাগ করবেন না?’
‘করুক না রাগ!’
‘লোক দিয়ে উদোম ক্যালাবে!’
‘ক্যালাক না যত খুশি! চিকিত্সার খরচা দিয়ে দেওয়া যাবে, মেরে তো আর ফেলতে পারবে না! সামনে ইলেকশন, পার্টির টিকিট চাই বাবুজির!’
জগৎ যখন সাধুজ্যাঠার দর্শনে গিয়েছিল, তখন উনি অনেকগুলো পকেটওয়ালা বারমুডা আর চকরা-বকরা টি-শার্ট পরে স্নিকার পায়ে গুদামে মাল তোলাচ্ছিলেন। জগৎকে দেখেই বলেছিলেন, ‘ও মা! এ কী কাণ্ড! জীবনজ্যোতির পুত্র জগৎজ্যোতি যে! আয়, আয়! কী খবর রে? ভাল আছিস তো সব?’
‘আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে…’
‘শুনব, সব শুনব! দাঁড়া, হাতের কাজটা একটু সেরে নিই। কাজ না করলে খাব কী? আমাদের তো আর মাস গেলে এমনি-এমনি মাইনে ব্যাংকে ঢোকে না! স্ট্রাগল করতে হয়… এই, এই, এটা কত নম্বর গেল বললি না তো? ব্যাল্লিশ! ব্যাল্লিশ কী করে হবে, আগেরটা ঊনচাল্লিশ ছিল না? এটা তো তাহলে চাল্লিশ হবে। গুণতে জানো না হারামিকা অওলাদ! ঠিক করে বল!’ তারপরেই জগৎকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ রে জগু! তুই আমাকে আপনি-আপনি করছিস কেন রে? তুই কি আমায় বরাবরই আপনি-আপনি করে কথা বলিস?’
সত্যি কথা বলতে কী জগৎ-এর মনে পড়ছিল না, কথাবার্তা যদি ওঁর সঙ্গে কিছু হয়েও থাকে, সে অন্তত কয়েক যুগ আগে! ওঁর মোবাইল ফোনটা তখনই বেজে উঠেছিল, ‘কার ফোন বাজছে রে, তোর না আমার?’ বলতে-বলতে তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে বারমুডার এ-পকেট, ও-পকেট থাবড়াতে থাবড়াতে শেষপর্যন্ত মোবাইলটা খুঁজে পেয়ে সেটা বার করতে না করতেই, তার বাজনা থেমে গিয়েছিল; ‘যাহ্ কলা, ছাতার মাথা! কেটে দিল শালা, বা… ঞ্ছাতের বাপ!’ বলেই ইয়া বড় জিভ কেটে বারমুডার হিপ-পকেট থেকে একটা চ্যাপটা ফ্লাস্ক বার করে, ছিপি খুলে মুখ লাগিয়ে খানিক চুষে কিছু গিলে ফেলেছিলেন।
জগৎ হাঁ করে দেখছে দেখে বলেছিলেন, ‘উঁ উঁ! এটা ওই না! সাত-দশটা তিত্থখেত্তর জল! হুট করে খিস্তি বেরিয়ে গেল কিনা, তাই মুখটা একটু শুদ্দু করে নিলুম! গুরুদেব বলেছেন!’, বলে ডান হাতের আঙুলের ডগাগুলো দ্রুত কয়েকবার কপালের ওপর দিকে ছুঁইয়ে নিয়েছিলেন। জগৎ-এর খুব ইচ্ছে করছিল বলে, মজুরগুলোকে যে খিস্তি করলেন তার জন্যে মুখশুদ্ধি করলেন না তো! কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি, আবার ওঁর মোবাইল বাজতে শুরু করেছিল। উনি শশব্যস্তে মোবাইলে কথা বলতে শুরু করেছিলেন, ‘আরে কী সৌভাগ্য! প্পাতোপোনাম! প্পাতোপোনাম! এই একটু ধরুন তো!’ বলেই মজুরদের থামতে বলে জগৎকে বলেছিলেন, ‘তুই এই রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা না, আপিস ঘরে ঠান্ডায় একটু বোস গিয়ে, এসি চলছে। যা, বোস! তোর সব কথা শুনব মন দিয়ে! কাজগুলো সেরে নিই।’
সাধুজ্যাঠার দেখিয়ে দেওয়া দরজার পাল্লা ঠেলে ঠান্ডা-ঠান্ডা ভেতরে ঢুকে, সামনে যে চেয়ার দেখতে পেয়েছিল তাতেই বসে পড়েছিল জগৎ। ফাঁকা টেবিলে ফাঁকা কলমদান ছাড়া আর কিছু ছিল না, দেয়ালে ছিল না কোনও ছবি। এ কীসের অফিস? গুমঘর নয় তো!
দরজা ফাঁক করে বাইরে থেকেই সাধুজ্যাঠা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মাছভাজা খাবি না ডিমভাজা?’
‘না, না, আমি কিছু খাব না!’
‘একটা কিছু না খেলে তো হবে না, কদু আমার চামড়া গুটিয়ে নেবে! কদুকে কী বলিস তুই?’
‘কদুমাসি।’
‘বোঝো কারবার! জ্যাঠার বউ মাসি? আমি ডিমটোস্ট খাব, খাবি? খাবি না? তাহলে ডিমভাজা খা। চা না কফি?’
‘না, না, ওসব কিছু লাগবে না!’ ককিয়ে উঠেছিল জগৎ।
‘আমার লাগবে! কফি বলেছি, তুইও তা’লে তাই খা! বোস, আমি আসছি এক্ষুনি, তোর সব কথা শুনব!’ বলেই দরজা বন্ধ করে চলে গিয়েছিলেন।
ডিমভাজা এল, কফি এল, উনি এলেন না।
‘উনি খেলেন না?’ যে কফি নিয়ে এসেছিল, তাকেই জিজ্ঞেস করেছিল জগৎ। সে বলেছিল, ‘হঁ হঁ, উনি সব খেয়ে লিছেন!’
‘আচ্ছা। এখানে হাত ধোবার কোনও ব্যবস্থা আছে?’
‘হঁ, হঁ, আছে না?’ বলে সে টয়লেটের দরজা দেখিয়ে দিয়েছিল। সন্তর্পণে সেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে, দরজার ছিটকিনি না আটকেই জগৎ ভারমুক্ত হয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে উদ্বেগের চোটে অতটা জল খাওয়া উচিত হয়নি। তার ওপর এই ঘরে এসির যা ঠান্ডা! ভাগ্যিস ব্যবস্থা ছিল! সমৃদ্ধিকে জগৎ ‘বিয়ে করব’ বললেই যদি সাধুজ্যাঠা গর্জন ছাড়তেন, তাহলে জলভার আর ধরে রাখা যেত না; জগৎ-এর জিন্সের প্যান্ট-ফ্যান্ট সব ভেসে যেত!
আরও আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করে, সারা ঘরে অজস্রবার ঘুরপাক খেয়ে, জগৎ দরজা খুলে ঝাঁ ঝাঁ রোদে মুখ বাড়িয়েছিল। কাউকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়েছিল; বাইরের দিকে এগোতে একজনকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সাধুজ্যাঠা…’
‘উনি তো চলিয়ে গেলেন!’
‘কোথায়?’
‘সে তো জানি না! গাড়ি করে চলিয়ে গেলেন।’
ওই গেঞ্জি আর বারমুডা পরে!
হাতি না কুকুর— কাদের শ্রবণশক্তি যেন খুব প্রখর! জগৎ-এর স্বগতোক্তি শুনে ফেলেছিল লোকটা। বলেছিল, ‘ওঁর সাজপোশাক সব গাড়িতেও থাকে!’
‘কখন ফিরবেন?’
‘সে বলতে পারব না!’
‘মানে, এখানে ফিরবেন তো?’
‘সে তো জানি না!’
মোবাইলে সমৃদ্ধিকে পাওয়া যায়নি বলে জানানো যায়নি— তার নির্দেশ মতো নির্ধারিত সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গায় এসে সাধুজ্যাঠার দেখা পেলেও, যে কথাটা তাঁকে বলবার ছিল সেটা বলা যায়নি! দ্রুত ফুরিয়ে আসছে ছুটির মেয়াদ। সাধুজ্যাঠাকে ব্যাপারটা জানাবার জন্যে অনন্তকাল তো আর অপেক্ষা করা যায় না, ইলেকশন আসতে যদিও দেরি আছে!
নিজের মাকে পূর্বাপর সব জানিয়ে পরামর্শ চাওয়া যায় কি না, ভাবতে ভাবতে বাড়ি পৌঁছে জগৎ দেখেছিল তার মা নেই, পড়ার টেবিলটার ওপরে দুপুরে খাবার জন্যে ভাত-তরকারি ঢাকা দেওয়া। রান্নাঘরে জ্যাঠাইমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা কোথায় গো জেঠুমা?’
‘কী হয়েছে বাপ? খিদে পেয়েছে? জ্যাঠাইমার কাছে দুটি ঝোলভাত খাবি?’
‘না, না, খাবার তো ঘরে রাখা আছে। মাকে একটা কথা বলব বলে ভাবছিলুম!’ ‘সে না হয় ফিরলে বলিস? ঠাকুরপো ফেরার আগেই তো রোজ ফিরে আসে।’
সাধুজ্যাঠার খোঁজে যাবার আগেই চান-টান সেরে জলখাবার খেয়ে নিয়েছিল জগৎ। ঠান্ডা ভাত-তরকারি দিয়ে পেট ভরিয়ে, একফালি ঘরের একচিলতে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙেছিল মায়ের ঝাঁকুনিতে।
‘দুষ্টু ছেলে! আমায় কিচ্ছু না জানিয়ে কেমন ঘুমোচ্ছে দ্যাখো!’
‘কী হয়েছে?’
‘কী হয়েছে! তুই এত বড় হয়ে গেলি কী করে রে? এত সাংঘাতিক ভাল খবরটা আমায় জানাবার দরকার বলে মনে করলিনি!’
‘কী হয়েছে সেটা বলবে তো!’
‘ওরে, কদু আমায় সব বলেছে! আমার প্রাণের মিতে কদু! আমার জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধু!’
‘কী বলেছে?’
‘সে যে কী খুশি হয়েছে খবরটা জানতে পেরে!’
‘আরে বাবা! খবরটা কী?’
‘জানিস না তুই, না? মুন্তু মুন্তু! কিচ্ছু জানিস না! সুখবরটা আমায় দিয়েই বলাবি? দুষ্টু ছেলে!’
‘কী সুখবর সেটা বলো না!’
‘তুই জানিস না, না? হি হি’
‘বলো না মা প্লিজ!’
‘তুই সমুকে বিয়ে করবি বলেছিস?’
‘আস্তে, আস্তে… মা! কে কোথায় শুনে ফেলবে, বিপদ হবে!’
‘জানি তো! তাই তো দরজা-জানলা সব বন্ধ করে তোর সঙ্গে কথা বলছি! প্রোফেসরের আসতে এখনও অনেক দেরি আছে।’
বন্ধ দরজা-জানলা আরেকবার পরখ করে এসে জগৎ-এর বিছানায় বসে মা বলেছিলেন, ‘কদু যে কী খুশি, কী খুশি, মাগো! আমি কদুকে তাই বললুম— অত আনন্দ কোরো না ভাই, সাধু বটঠাকুর জানতে পারলে সব আনন্দ বেরিয়ে যাবে! তোমরা কত বড়লোক আর আমরা গরিবগুরবো সামান্য মানুষ! ছেলেমেয়েরা যতই পেম-ভালবাসা করুক, তোমাদের সঙ্গে আমাদের সামাজিক সম্পক্কো হয় নাকি! তখন কদু বললে— বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যখন ভালবেসে ফেলেছে, তখন তাদের বিয়ে দিতেই হবে, সোনার ছটায় সাধুবাবাকে অন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দিতে হবে! আমি বললুম, অত সোনা কোথায় পাব ভাই? আমার সোনা বলতে তো বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া এই একছড়া সোনার হার, একটা আংটি, একজোড়া কানের দুল আর শাশুড়ির দেওয়া চারগাছি চুড়ি! তখন এই পোঁটলাটা দিয়ে কদু বললে, নিয়ে যা এটা!’
কাপড়ে মোড়া লম্বাটে তরমুজের মতো পুঁটলিটা তখন জগৎ-এর নজরে পড়েছিল।
‘কী আছে এটায়?’
‘গয়না, সব সোনার! আর কড়কড়ে বিশ লাখ টাকা!’
‘সর্বনাশ! তুমি নিতে গেলে কেন?’
‘আমি নিতে চাইনি, বিশ্বাস কর! মা কালীর দিব্যি! কিন্তু কদু খিঁচিয়ে উঠলে— এ কি তোকে দিচ্ছি? দিচ্ছি আমার মেয়েকে! বিয়েতে তাকে দিবি, দেখে সাধুর চোখ ধাঁধিয়ে যাবে একেবারে! বললুম, উনি জানতে চাইতে পারেন, এত সব গয়না আমরা পেলুম কোত্থেকে! তো বললে বলবি— এসব তোর মা’র ঠাকুমা-দিদিমার! বললুম, কত আগেকার দিনের মানুষ তাঁরা, তাঁদের এত হালফ্যাশানের গয়না! বলল, সাধু সোনা চেনে, ফ্যাশান চেনে না! আবারও বললুম, কিন্তু জানেন নিশ্চয়ই এসব তোর? ঘণ্টা জানে! কিস্যু জানে না! মেয়ে তো জানে? বলল— তা জানে, ও সব জানে! কিন্তু সাধুবাবাকে কিস্যু বলবে না! তার এখন জগৎকে চাই, জগৎজ্যোতি! টাকাটা আমার মেয়েকে দিবি, বিয়ে করে হানিমুন-টানিমুনে যাবে!’
‘কিন্তু এতসব টাকা-গয়না রাখবে কোথায় মা?’ জগৎ বলেছিল, ‘তোমার ঠাকুমার কাঠের আলমারিটার তালা তো ভাঙা! জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখছি সেটায় চাবি দেওয়া যায় না!’
‘সে-ও তো বলেছি কদুকে! শুনে ও বললে— ভয় নেই সদু, তোদের বাড়ি ডাকাত পড়বে না! ছিঁচকে চোরেরাও জানে তোদের বাড়ি চুরি করার মতো কিস্যু নেই!’
পরের দিন দুপুরে ঘুমোব না, ঘুমোব না করেও ভাতঘুমে চোখ জুড়ে আসছিল জগৎ-এর। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতে চোখ বুজেই ‘হ্যালো’ বলেছিল, অন্য প্রান্ত থেকে ‘আমি সমু বলছি’ শুনে ওর ঘুম ছুটে গিয়েছিল, ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিল।
‘কাল সকালে কত তাড়াতাড়ি শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছতে পারবে?’
‘শেয়ালদা স্টেশন! শেয়ালদা স্টেশনে কেন?’
‘কলকাতা শহরটা একটু ঘুরে দেখব বলে!’ হ্যা-হ্যা করে হেসে উঠেছিল সমু। তারপর হাসি থামিয়ে নিচুগলায় বলেছিল, ‘শোনো, হাওয়া ভাল নয়…’
‘কেন, ভাল নয় কেন? তোমার মা, আমার মা— সবাই তো সব জানে! মানে, আমাদের বাবারা ছাড়া!’
‘সেটাই তো কাল হয়েছে! বাবুজি আঁচ করেছে ওকে লুকিয়ে কিছু একটা হচ্ছে!’
‘এই রে! তাহলে কী হবে?’
‘পালিয়ে যাব! পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ।’
‘তার জন্যে তো নোটিশ দিতে হয়!’
‘দেব। মূল্য ধরে দিলে যদি নোটিশ দিতে না হয়, তাহলে মূল্যই ধরে দেব! ভাল কথা, আমার মা সদুমাসি, মানে তোমার মাকে যে পোঁটলাটা দিয়েছে, সেটা নিয়ে আসতে ভুলো না যেন, না আনলে কিন্তু সব ভন্ডুল হয়ে যাবে!’
‘সেটা তো মা আলমারিতে তুলে রেখেছে, বললেই দিয়ে দেবে!’
‘আবার মাকে বলতে যাবে কেন? লোক জানাজানি হয়ে যাবে! সে আলমারিটায় তো তালা নেই?’
‘না।’
‘তবে? আলমারিটা আস্তে করে খুলে পোঁটলাটা বার করে নেবে!’
‘না, আসলে…’
‘আবার আসল-নকল কী? জিনিসটা তো আমার, আমিই তো তোমাকে আনতে বলছি, তুমি ওটা এনে আমাকেই দেবে! তবে হাতে দোলাতে-দোলাতে এনো না যেন, আরেকটা ব্যাগে ভরে আনবে।’
‘ঠিক আছে! আজ রাত্তিরেই, মা শোবার ঘরে ঢোকার আগেই ওটা বার করে আমার ব্যাগে ভরে নেব। আর কী নিয়ে যাব বলো? প্যান, আধার এসব তো নিয়ে যেতেই হবে, লাগবে, মানে লাগতে পারে! আর কী?’
‘আর আবার কী? জামা-জুতো, গামছা-তোয়ালে, টয়েলেট্রিজ, কসমেটিক্স, কন্ডোম— এ সবই এখন সব জায়গায় পাওয়া যায়।’
‘কিন্তু এক সেট জামাপ্যান্ট তো নিতেই হবে, ব্যাগের মধ্যে ওইটা ঢাকা দেবার জন্যে?’
সময়মতো শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছেও সমৃদ্ধিকে দেখতে পায়নি জগৎ। মেন স্টেশনে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নর্থে ঘুরে এসে যখন ভাবছে সাউথটাও একবার দেখে আসবে কি না, তখন জগৎকে কেউ ডেকেছিল। কে ডাকছে সেটা দেখার জন্যে এদিক-ওদিক যখন খুঁজছে, বোরখা পরা একজন তার মুখের ঢাকা সরাতে জগৎ চমকে উঠেছিল, ‘আরে! আবার বোরখা পরে এসেছ কেন?’
‘বাহ্ রে! কেউ চিনে ফেলে যদি! সেইটা এনেছ?’
‘নিশ্চয়ই!’
‘আমাকে দিয়ে দাও তাহলে এই বেলা। এখানটা একটু ফাঁকা আছে।’
জগৎ তার ব্যাগ খুলে সেই পোঁটলাটা বার করে দিতে সেটা সমৃদ্ধি তার বোরখার আড়ালে অদৃশ্য করে দিয়েছিল! তারপর বলেছিল, ‘তুমি এরকম একটা মার্কামারা টুপি পরে এসেছ কেন?’
বত্রিশ-পাটি বার করে জগৎ বলেছিল, ‘এটা আসলে খুব পয়া! খেলার দিন এই টুপিটা পরলেই আমার টিম জিতে যায়…’
‘তাই বলে এখানে! সব লোক চিনে ফেলবে যে! এক্ষুনি খোলো ওটা!’
সঙ্গে সঙ্গে টুপিটা খুলে ফেলেছিল জগৎ।
‘ফ্যালো!’ সমৃদ্ধি বলেছিল; ‘তাই বলে আবার এখানে ফেলো না যেন!’
‘না… তাহলে কোথায় ফেলি বলো তো?’
‘ওই যে! ওই দিকে দেখো… ওইখানে, আবর্জনা ফেলার জায়গা আছে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখতে পেয়েছি! দাঁড়াও, ফেলে আসি।’ হড়বড়িয়ে সেই দিকে এগিয়েছিল জগৎ।
‘সাবধানে যাও, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে আবার একটা কাণ্ড বাঁধিও না!’
টুপি ফেলে এসে জগৎ দেখেছিল, সমৃদ্ধির পাশে এক যুবক দাঁড়িয়ে, মুখে ফুরফুরে দাড়ি, মাথায় বাবরি, তার ওপর ফেজটুপি।
সমৃদ্ধি বলেছিল, ‘এ মৈনাক, মৈনাক নাথ, সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, হ্যাক করার মাস্টার! আমি যেমন এখন সায়রা, এ তেমনি এখন মঈদুল!’
মঈদুল ওরফে মৈনাক করজোড়ে হতভম্ব জগৎকে নমস্কার জানিয়ে সমৃদ্ধিকে বলেছিল, ‘চলো জানু! এখনও কত কিছু করা বাকি, দমদম পৌঁছতেও টাইম লাগবে, আর দেরি করলে কিন্তু ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে!’
‘এক মিনিট’, আচমকা নিচু হয়ে দু-হাতে জগৎ-এর দু-পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিল সমৃদ্ধি, ‘তুমি আমার দাদার মতো! আমার জন্যে যা করলে জগুদা… জীবনে ভুলব না!’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র