মজার মরশুম
উইন্টার-এর গোড়ায় আছে উইন। লাউডস্পিকারে গাঁকগাঁক ছড়াতে ছড়াতে একটা ভ্যান যেই চলে গেল, অমনি বিছানায় মুন্ডু ঘুরিতং, ‘আমরা পিকনিক যাচ্ছি কবে?’ মানুষ টেমপ্লেট অনুযায়ী চলে। শীতকালে তাকে আনন্দ করতে হয়। জলসা-বিলাস, ভ্রমণ-পাঁইপাঁই, হইহই, ফুরফুর। সোয়েটার বা জ্যাকেটে শরীরের অনেকটা ঢেকেঢুকে দেয়, সকলেই প্রেজেন্টেবল ও রঙচঙে, সেই রং মর্মে লাগে, নেচেকুদে গুঁতিয়ে বের করে দেয় উদ্বেগ আর কমন-সেন্সকে, এবং প্যাংলা মানিব্যাগের তোয়াক্কা না করে মানুষ ইয়ায়া লংজাম্পে উড়ে পড়তে চায় বোগদাদে। দাদ-এর মতোই, বোগদাদও এমনিতেই চুলকোয়, তারপর বাচ্চার ছুটি পড়তেই চতুর্দিকে উড়ছে এ বান্ধবগড় সে বেলজিয়াম, ও আইফেল টাওয়ার সে চার নম্বর ট্যাঙ্ক। ভাই রে, আজ যদি না রেস্তরাঁয় খাই, কাল যদি না পিঠেপুলি মেলায় সেলফি তুলি, পরশু যদি না টেনশন-টেনশন কণ্ঠ কাঁপিয়ে বলি ‘রাত্তিরেই বেরিয়ে যাচ্ছি রাঁচি নেতারহাট, এদিকে তো শুনছি বাইটিং কোল্ড’, তাইলে মুখ দেখাই কেমনে?
সুযোগ বুঝে বিদেশি বন্ধুরাও হু-হু অবতরণ করেছে। তারা দাড়ি কামিয়ে প্রসন্নতা টাঙিয়েছে, কিন্তু কামায় ডলারে ডয়েশমার্কে দিনারে। চামড়া থেকে নিয়ন-জ্যোতি ফটফট, এখানকার ফ্ল্যাটে ইন্দোনেশিয়ার ব্যাঁকা পুতুল পাহারা দেয় ( দুবছর আগে গেছিল, এবছর পেরু, তবে তিন মাইল লম্বা আড়বাঁশিটা আনতে পারেনি, প্লেনে খোঁচা লাগবে), তাদের ছেলে আগের বছর আপনার মেয়ের সঙ্গে খ্যালেনি কারণ মেয়ের বগলে আইপ্যাড ছিল না, ফলে ওদের বাড়ি নেমন্তন্ন রাখতে আপনাকে বর্ম-শিরস্ত্রাণ গুছিয়ে যেতে হবে। এছাড়া ফিরতি ডাকতেও হবে একদিন আপনার বাড়িতে, তখন বউয়ের হাতের হালুয়া না সুইগি? ঘর মুছতে নিজস্ব ন্যাতা না কোম্পানি থেকে মোছনদার? আনন্দ সহজ নয়, সে-পাতেও উচ্ছে, কেউ কেউ ভুল স্ট্রোক খেলে চিরতা দিয়ে মুখ ধুচ্ছে।
বুকিং করতে গিয়ে দেখা গেল, সময় পেছনদিকে হাঁটুন্তি, প্লেন ফের প্রাগৈতিহাসিক কালের ন্যায়: উচ্চণ্ড ধনীদের বাহন। সেই যখন প্লেনে চড়ে কেউ এলে তার জন্য নতুন পাপোশ কেনা হত, সে যখন প্লেনের মোজা প্লেনের লজেন্স প্লেনের চোখঠুলি বিতরণ করত সকলে ‘চরণাম্মেতো দেহি’ চাউনি মেরে করতল বাড়াত, তার প্লেনের টিকিট নিয়ে খেলত বাড়ির ধন্য হয়ে যাওয়া বাচ্চা, যার সঙ্গে খেলে ধন্য হত পাড়ার বাছাই পাঁচ শিশু। প্লেনের বদলে অতএব ট্রেনের দিকে। ‘তোমার বন্ধুর বাবা ছিল না, রেলওয়েজ-এ? এর মধ্যে রিটায়ার?’ সত্যি, এ সমাজে বাঁচতে গেলে চেনা ডাক্তার, চেনা উকিল, চেনা পুলিশ, চেনা ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং চেনা চিড়িয়াখানার দারোয়ান প্রয়োজন। তা যখন নেই, একজন এ কম্পার্টমেন্টের আপার বার্থ, অন্যজন পাশের কম্পার্টমেন্টের মিডল বার্থ। অহি-নকুল আকচাআকচির বাকি রইল কী?
আসলে শীত আসবে সে প্রতিশ্রুতি থাকলেও, সম্বচ্ছর সূর্যের আত্যন্তিক ছ্যাঁকা খেতে খেতে ভাজা-হৃদয়ে সে-কথা ঠিক সেঁধায় না। দিনগুলো ঘাড়ে এসে পড়লে মনে হয়, ইয়াঃ, এ ন্যাড়া গাছের সমাহারে ও ডিউস বলের ছটফটানিতে সব্বার যদি আহ্লাদে আউলাইলো পরান, আমায় কেন ঈশ্বর পাশে সরান? মুশকিল হল, ফ্যান্টাসির উড়ান আর বাস্তবের বন্দোবস্ত হাত-ধরাধরি করে না, তুমি কোথায় ঘুরবে, প্ল্যান করতে হত বহুপূর্বে, কিন্তু তখন শীতের তুড়ুক-নাচন লাগেনি আকাঙ্ক্ষার আবডালে, আর হোটেলগুলোও কোভিডের তারিফ করে বলতে শেখেনি, টারিফ কমাব না। কোভিড-কালে তাদের ক্ষতি আজ দ্বিগুণ পুষিয়ে গেলেও, পাঁইপাঁই-বর্ধিত ঘরভাড়া আজিও গ্রাফের উচ্চমাথায় সটান দাঁড়িয়ে, কারণ বয়স, ঘরভাড়া ও অস্ট্রেলিয়ার ফর্ম— উঠলে আর পড়ে না।
ছুঁচলো প্রশ্ন: ডোভার লেন-এ গিয়ে ঢোলা ভাল, না বাংলা আধুনিকের পাল্লায়? জীবনমুখী উঠে গেছে, বাঁচোয়া। দিনকতক ব্যান্ডফ্যান্ড বোমা-বারুদ হাঁকড়ে একেবারে জান কয়লা করে ছেড়েছিল। অরিজিৎ সিং-এর শো দেখতে গেলে, অন্তত সম্মুখ-সিট বাগাতে গেলে, মোহর-ফোহর খুঁজে পেতে হবে, চলতি সিনেমার মতো গুপ্তধনের ছন্দোবদ্ধ ক্লু দরকার। অবশ্য পার্ক থেকে বা বস্তির সামনে থেকে কিংবা সিনেমা হল’এর গেট-এ লাল কার্পেট ছেতরে প্রিমিয়ারের ঘনঘটায় দেড়তলা সমান স্পিকার থেকে কম গান উপচোচ্ছে না। কিন্তু সামনে থেকে গায়কের হাঁ অ্যান্ড আলজিভ দেখার আলাদা শিরশির। অবশেষে পাড়ার মাঠে অ্যালাকার কাছের মানুস পাসের মানুসের বদান্যতায় বিসাআআল বিচিত্রানুসঠাআআন, তাতে কণ্ঠী থেকে শুরু করে মুম্বইয়ের শ্রেয়া-বোনটি। রাতের দিকে ব্যাপার অধিক জমাটি। কোমর বেঁকিয়ে নাচ থাকতে মেলোডির কী বা দাম, মঞ্চ থেকে অনন্ত লুপ-এ ‘কাঁচা বাদাম’।
বইমেলায় সাতাশ-আঠাশ কোটি লোক হুড়মুড়, অন্তত ১০১ জোকস কিনে আন বাপ। প্রকাশকের লোক ‘মাঠে যায়’, পণ্ডিতগণ ইউবিআই অডিটোরিয়ামে ফেসবুকলগ্ন ফিলসফি-নগ্নদের ছাল ছাড়ায়, বডিগার্ড-ব্যূহর ফাঁক দিয়ে ডটপেন বাড়িয়ে সই দেয় জনাদর-জমজমে লেখক, গায়ক নায়ক রূপের হাঁড়ি স্টলে স্টলে পোজ রিহার্সাল দিয়ে রাখে, অডিও-বুক ডাকে: ‘অযুত অক্ষর পড়েছেন, চোখেও প্রভূত পাওয়ার, এবার কথকঠাকুরের জমানা পুনরায়, উনি বিড়বিড় গল্প শোনান আপনি গাড়ি চালাতে চালাতে চান করতে করতে জেনে নিন উন্নাসিক ক্লাসিক বা কিশমিশে কিসসা, ব্লার্ব মুখস্থর শ্রম অ্যাদ্দিনে ঘুচল।’ লিটল ম্যাগের টেবিলে অভিমান-টোবলা ইগো-টাবলা অকালবৃদ্ধ সিনিক-ওষ্ঠ কামড়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে, সহসা স্বাস্থ্যঋদ্ধ পাঠিকা দেখে ভাবে ইস মলিন মলাট ছিঁড়ে চাগিয়ে উঠিবে কি নিহিত নিৎশে? এই জটজটিল বায়ুস্তরে আপনি আনপড় আনাড়ি, শ্বাসে টেনে নিন অপ্রচলিত অক্সিজেন। মাস্কে নাকমুখ ঢাকা? চাউনিতে শুষে নিন নাজুক নাইট্রোজেন।
গ্রীষ্মের সেরা দান যেমন পাখার হাওয়া, শীতের সেরা সম্পদ রোদ পোয়াতে ছাদে বারান্দায় চওড়া ফুটপাথে পিঠ-পত্তন। বাঙালি এমনিতে একটু কুঁজো, এ সময় সেটা আরাম-ভোগের পেটেন্ট ভঙ্গি, আর জমিদার-লীলায় পা ছটকে ছটকে ইতিউতি বেড়াতে বেড়াতে সে দোকানপাট দ্যাখে মানুষ জরিপ করে ও ভাবে, সান্ধ্য মশার ঝাঁক বেরিয়ে পড়ার আগেই সিধে ঘরে, কাল নেটফ্লিক্সের আধ-পো মেরেছি, আজ বাকিটা সাবাড়। কে এখন হুড্রু ফলসের নিচে থরথরিয়ে কাঁপছে আর ট্যুরিস্ট-ছকে টিক মারছে, কে পিকনিকের কুটকুটে ঘাসে নিতম্ব চেপে ভাবছে এই নোংরা বাথরুমেই শেষমেশ প্রেস্টিজ অক্কা, কে শিং ভেঙে বাছুরকে ‘দেখি বল কর তো’ বলে হাঁটুতে খতরনাক ঠক্কাস খেয়ে দাঁত ছরকুটে পড়ল— এসবে দুচোখ পেড়ে নেহারি তার হেভি আমোদ। আরে ভাই, ভগবান কমলালেবু বানিয়েছে, একটা করে কোয়া মুখে দে আর বিচিগুলোকে ফুঃ ফুঃ করে ফ্যাল, পরে জানলার শিক টিপ করে মারবি। কেউ এমন বেধড়ক খেটে ঋতু উদযাপন করে না কি? জীবন কি ভয়াল ভারোত্তোলন, না কুকুর-তাড়া নিশি-গলি? শীত এসেছে একটাই কারণে: নইলে লেপের কদর কেউ বুঝত না। মাথা অবধি মুড়ি দিয়ে দিনে বাইশ ঘণ্টা হামলে হাইবারনেশন যা, নেশন উথলে উঠবে।