ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • তুই, আমি, ববিদা আর বোর্হেস


    গৌতম সেনগুপ্ত (September 2, 2023)
     

    মল্লিকবাজারের কথা অমৃতসমান, অভাজনে বলে আর শোনে পুণ্যবান— তুই যে গল্পটা লিখতে বলেছিলি নর্মাল কোর্সে, এটাই হত তার ফার্স্ট লাইন। শালা ববিদার মার্ডার পুরোটা ঘেঁটে দিল। নিশানাবাজিতে ফেমাস ছিল ববিদা, পরে জেমিনি সার্কাসে জয়েন দেয়। চাকু-ছুরিতে গোল্লাদা, রড-চেন-নাকল ডাস্টারে মাহির ছিল পোনেদা। খুর-ব্লেড ছিল বড়ে মিঁয়া সাদিকদার ডিপাট। শুখায় পালক, মাগিবাজিতে তুই।

    এবার লেখা থামিয়ে ২/৪-টে অন্য কথা বলে নিই। ঠাকুরের কৃপায় তার সঙ্গে যদি গল্পের কোনও যোগ খুঁজে পাওয়া যায় তো ভাল, নাহলে তুই তো আছিস! লাইফে ৬০০/৭০০ মেয়েছেলে সেটলিং করেছিস আর একটা গল্প সালটাতে পারবি না?

    সপ্তরথী, মানে যে সাত ডাক্তার আমাকে ঘিরে রাখে, গল্প লেখা নিয়ে কমবেশি তাদের সকলেরই আপত্তি। সবচেয়ে আপত্তি তোর ফেবারিট (অনেকটা মিঠু মুখার্জির মতো দেখতে) ডক্টর ভার্গবের। বোকাচুদি কি গাছে ফলে? আমার নাকি কিছু মনে থাকে না। তাই! আমার জন্ম টুয়েন্টি সেকেন্ড মে, বেলভিউতে। তোর জন্ম ঠিক তার আগের দিন ন্যাশনাল মেডিক্যালে। ওই দিনই দূর কেরালার এলান্থুর গ্রামে আমার প্রিয় অভিনেতা মোহনলালের জন্ম। আরও দূর দেশে জন্ম বোর্হেসের জীবনীকার, ব্রাজিলিয়ান সংগীত ও বিটল্‌স বিশেষজ্ঞ জেমস উড্যাল-এর।

    মোহনলালের সঙ্গে ববিদার একবারই দেখা হয়েছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটের ফার্স্ট ক্লাসে। না, কথা কিছু হয়নি, কারণ ভদ্রলোক প্রায় পুরো রাস্তাটা ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলেন। উড্যালের সঙ্গে ববিদার দোস্তি হয় স্বামী সোমেশ্বরানন্দের আশ্রমে। ওখানে তখন হ্যারিসন লেনন একেবারে হইহই ব্যাপার। স্বামীজির নাম শুনে ঘাবড়ে যাসনি যেন। এ হল গড়িয়ার নটু মিত্তির, ঝি কেসে ফেঁসে মিসিরজির খাস ড্রাইভার কিশোরকাকার পাশের খুপচিতে থাকত। মালটা সলিড গাঁজা সাজত। তারপর কী করে আমেরিকায় গিয়ে জমিয়ে বসল কে জানে! সাহেব ভক্তরা ওর ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডারও করেছিল, বোঝো কাণ্ড!

    সেভেন্টি টু-তে ক্লাবের ক্যাপ্টেন কর্মকার, এশিয়ান অলস্টার লিগ জিতে, ফ্ল্যাগ তুলল। মেম্বার্স গ্যালারির ওপর থেকে দেখলাম। হাত ছাড়া সিটি দিতে পারি না বলে এট্টু-পালকরা হিউজ প্যাঁক দিল। পুরোটা সুদে-আসলে তুলে নিলাম ক্লাবের সামনে, ড্যান্সের টাইমে। স্টার্ট দিলাম কুড়কুড়িম্যানের পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে। তারপর এলভিসে সাম্মি পাঞ্চ। পুরো পার্ক স্ট্রিট ব্লক করে ড্যান্সের ফাঁকে টুক করে ঢুকে গেলাম পার্ক লেনের গলতায়, ববদার ঠেকে। গিয়ে দেখি, যা ভেবেছি তাই। কোণের ইজিচেয়ারে বসে তুই মেজাজে পাইপ টানছিস। স্পিকারে ডেনভারের ‘টেক মি হোম’ চলছে।

    বললি তোর টিম জিতেছে, ‘লেট্‌স সেলিব্রেট, চ বিয়ার খেয়ে আসি।’

    তোর ছ্যাকরা ল্যাম্বরটায় ববদার ঠেকের পেছনের গলতা দিয়ে মিনিট দশ। পর পর আর্মি কোয়ার্টারের মতো মরা হলুদ রঙের বাড়ি। তিন নম্বর বাড়ির দোতলার চার নম্বর ঘরে তুই বেল দিলি। ঢুকেই বাঁ-হাতে বাথরুম, রান্নাঘর। পর পর দুটো পর্দা ফেলা শোবার ঘর। ডানদিকটা ড্রয়িং কাম ডাইনিং। ওখানে কালো প্যান্ট, খালি গা, ক্ষয়াটে চেহারার এক বুড়ো। আমাদের দেখে ঝাঁটা ফেলে হাত ধুয়ে বিয়ার বার করে দিল। প্রথম চুমুক মেরে দেখলাম ঘোড়ার মুত। ঠিক করলাম লাইফে খাব না। মানুষ কী ভাবে আর কী হয়! জাম মে ডুব গয়ি মেরি জীবন কি হর সাম…

    ঠিক এই সময়ে— এই অবেলায় ‘কে বে’ বলে শেষ শোবার ঘরের পর্দা সরিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে-ভাঙতে, বেশ খোলামেলা পিঙ্ক নাইটি পরা যে বেরোল, তাকে মধুবালা বললেই ঠিক বলা হয়। আমার সামনে রাখা বোতলে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘অ তুই। তা এটি কে?’

    ‘গৌতম, আমদের ইলেভন বুলেট্‌স-এর চ্যাম্পিয়ন স্ট্রাইকার।’

    ‘চ্যাম্পিয়ান! দেখে তো মনে হয় নম্বরি আতাকেলানে, এখনও মুখ থেকে দুধের গন্ধ যায়নি।’

    কথাটা বলে অনেকক্ষণ ধরে হেসে বলল, ‘দুদু খাবে সোনা?’

    তুই বললি, ‘এই হল অনিতাদি, এর কথা তোকে অনেকবার বলেছি।’

    পুরো ঢপ, এই নাম লাইফে ফার্স্ট শুনলাম।


    দুদু নয়, বিয়ারই খেলাম। তারপর রাম। এর মধ্যে অনিতাদি ড্রেস করতে চলে গেল, কারণ গাড়ি আসার টাইম হয়ে গেছে। শুনলাম সপ্তাহে পাঁচ দিন— নাম বলব না এমন একটা হোটেলে ক্যাবারে করে। অনিতাদি বেরনোর বেশ পরে মিনি এল। ব্রাউন স্কার্ট, সাদা ব্লাউজ, নীল চোখ। তোকে  তো বটেই, এমনকী আমায় দেখেও এমন করে হাসল যেন কত দিনের চেনা। এর দু-বছর পর তুই বুচুর সঙ্গে শেয়ারে মিনিকে খেলি, আমাকে বললি না। সেবার ইস্টবেঙ্গলের ক্যপ্টেন কে ছিল? পিন্টু চৌধুরী না হেডমাস্টার অশোকলাল? ১৮/১৯ টা ওষুধ, হঠাৎ-হঠাৎ মেমারিটা ব্লার করে যায়, ওই পাহাড়ি রাস্তার কুয়াশার মতো। মেমারির আর দোষ কী বল?

    ‘স্মৃতিবিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশি’, এই বইটা মা-র লাইব্রেরিতে ছিল। পড়িনি, নামটা ইন্টারেস্টিং বলে মনে রয়ে গেছে। নীচের ফোনদুটো বাবা, ঠাকুরদার। আমার ইউজ করার পারমিশন ছিল না। আমি করতাম লাইব্রেরির ফোন থেকে, নম্বর ৪৭১৮২৭।

    না, এই নম্বরে নয়, এটা তো বালিগঞ্জ বাড়ির নম্বর। তখন কৃষ্ণা নায়ার, মানে যে-ছিপলিটা ট্র্যাপিজের খেলা দেখাত, তার সঙ্গে ববিদার তুমুল প্রেম! তার বাপ, সার্কাস ম্যানেজার, দেড় ব্যাটারি নায়ারকে ট্রাম গুমটির গলিতে ঝেড়ে দিল ববিদা। কী করবে? ট্রু লাভের মধ্যে অত হিচখিচাং হলে মার্ডার তো হবেই,?

    হবে বললে তো হল না, ওয়েপন চাই, সাইলেন্সার দেওয়া ওয়েপন। গোল্লাদা বলেছিল, ‘তাই না রামপুরিয়া গুসা দে বে। বাদ মে মসকা হি মসকা অর কেয়াবাত ব্লাড ভস্কায়িং।’ কিন্তু না, ছুরি-ফুরি ববিদার বিলকুল না-পসন্দ। ওসব তো অ্যারে-গ্যারে আইটেমকা কাম আর ববিদা তো ‘আটিস’!

    লিডার মিসিরজির সোর্সে কানি-কাবেয়াদা কালো থলিতে চেম্বার-দানা-সাইলেন্সার সব দিয়ে বলে গেল ঘণ্টাপিছু ভাড়া। তবে সির্ফ মিসিরসাহাবের কেস বলেই টোয়েন্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট।

    লাভারের ড্যাডি বাম্বু দিচ্ছে বলে তাকে খুন, বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে কিন্তু ববিদার কিচ্ছু করার ছিল না। পার্ক সার্কাস ময়দানে, যেখানে বাচ্চাদের টয় কার রেসিং হত, তার গ্যালারিতে বসে ববিদা বলেছিল, ও আর কৃষ্ণা জেমিনি ছেড়ে মাস চারেক মিসিরজির বাগানবাড়িতে থাকবে, মানে আন্ডারগ্রাউন্ডে। তারপর বেছে-বেছে বড় খেলা, মিটিঙের দিনগুলোতে বিভিন্ন হিরে-জহরতের দোকানে ডাকাতি করবে। যেহেতু লোক মাত্র দুজন, তাই কাজটা করতে হবে অসম্ভব কশাসলি। কৃষ্ণার মা ফুলটাইম খানকি হয়ে যাবার আগে যাত্রায় ছিল। মেক-আপের ব্যাপারটা কৃষ্ণা ওখান থেকেই শিখেছে। ‘ডাকাতি মানে নানান ড্রেসে দোকানগুলোতে ঢুকে ঠকানোরই চেষ্টা করব, ক্লিক না করলে চেম্বার তো আছে!’

    ‘ক্যাশ নাহয় ঠিক আছে, বাকি হিরে, গয়না-ফয়না নিয়ে…’

    ‘নো প্রব্‌স বস, রিপন স্ট্রিটের পুটাইকে মনে আছে? আই মিন কাটা সাহেব। ও যা দেব নিয়ে নেবে। চার্জ কেটে, কিছু টাকা আমাদের দিয়ে, বাকিটা পাঠিয়ে দেবে আশ্রমে।’

    ‘ডোনেশন?’

    ‘ধুর গান্ডু, এ হল ইন্টারনাল ধোপা, তুই যত কালো মালই পাঠা না কেন, ও তাকে বেচে-কেচে-ধপধপে করে তুই চাইলে যেখানে বলবি ডেলিভারি, না হলে ভাল কোথাও ইনভেস্ট করে দেবে।’

    ‘ব্যপারটা কি এতই সোজা? ডিপোজিট রিসিট বলতে একটা ছেঁড়া ডলারের নোট! নো পাসবুক, নো চেকবুক, নাথিং!’

    ‘যদি ঝেড়ে দেয়?’

    ‘ইম্পসিবল, ও আসলি বাত তোকে বলাই হয়নি, এই সাধুবাবা হল সেই নটু, এই ক-মাসে আমেরিকায় এমন সব ভক্ত জুটিয়েছে যে গভর্নমেন্টও ওকে সমঝে চলে।’

    খুনের রাতে কথা বলতে-বলতে কেঁদে ফেলে ববিদা। সব শুনে আমি বললাম, ‘ইশ্‌ক ক্যয়া চুতিয়া চিজ হ্যায় দেখা? তুমারি য্যায়সা গানমেটাল কা ভি আঁখ মে আঁসু!’

    ‘না রে বাঁড়া, সেজন্য নয়। সব মিটিয়ে চান সেরে ফ্রেশ চুড়িদার-পাঞ্জাবি পরে, সেন্ট-উন্ট মেরে গেলাম সিরাজে। চাটু-গরম কাবাব অ্যান্ড চাপ উইথ দো পরোটা। মকবুল মিয়া করেওছিল, একদম টোটাল ছকাস। আর কী বলব, পুরো মালটা সাট্টাওলা নুরের ঠেকের সামনে উলটি। আজ রাতেই বেরিয়ে যাচ্ছি। এরপর কবে আসব কে জানে…’ কান্নার চোটে  সে-রাতে কথাই শেষ করতে পারেনি ববিদা।


    এরপর আমার লাইফে যা যা হল তা হ্যান্ডেল করা আমার মতো ঊন-রাইটারের কম্মো নয়। কম সে কম শরৎবাবুর কব্জির প্রয়োজন। বাবার মৃত্যু, আত্মীয়দের ঠকবাজি, জলের দামে একটার-পর-একটা বাড়ি-ফ্ল্যাট বিক্রি। চা বাগানের শেয়ার, বেহালার জমি এমনকী বাবার পার্সোনাল ফোটো ডেভলপিং স্টুডিও, যেটা বাবা বেকার বন্ধুকে দিয়েছিলেন দেখভাল করতে। সেখানে উনি ছোটদের ছবি, ছড়ার বই বিক্রি করতেন। বাবা মারা যাবার দিন কতকের মধ্যে ভদ্রলোক মা-র কাছে এসে কেঁদে পড়ে ওটা লিখিয়ে নিলেন। স্লোলি সরতে-সরতে চলে এলাম মেন শহরের বাইরে।

    এভাবেই বয়স বাড়ল, চামড়ার জেল্লা গেল চলে। একটা-একটা করে অর্গান বিগড়াল আর ওই ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেল সাতটা ডাক্তার, ১৮/১৯টা ওষুধ। পুরনো বন্ধুরা অনেকেই বেঁচে নেই। এখন ইরফান বিশাল হেক্কড়। ওর ভাইপো টনি বলল, ‘চাচা আজ কা নিউজ দেখা?’

    ‘কিঁউ?’

    ‘আরে আপ দেখিয়ে তো সাহি।’

    চরসের সঙ্গে গ্লেনলিভেট বারো। মাথার ভেতর টলে যাচ্ছে রক্ত। দেয়ালজোড়া টিভির পর্দাজুড়ে ববিদার মুখ। তার চারদিকে নোটের পাহাড়। ব্লেজার পরা ঘোষিকা সম্পূর্ণ ভুল বাংলায় বলছেন, ‘এই হল বিরাম লজ। জয়গাঁ-র এই অখ্যাত হোটেলটি আজ সারা ভারতের আলোচনার কেন্দ্রে। মৃত ব্যক্তি আমেরিকান সিটিজেন। নাম ইমরান দারবার, বয়স ৬৭। সঙ্গী হেমাকে নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন স্কুলে নিশানাবাজির খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন। তার কাছে এত টাকা এল কী করে, এটাই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এছাড়াও খটকা আছে। হেমা-ইমরান আমেরিকা থেকে মুম্বই আসে। সেখান থেকে গাড়িতে গোয়ার গ্র্যান্ড হায়াতে দিন পনেরো। ওখান থেকে প্লেনে কলকাতা, তারপর গাড়িতে জয়ঁগা। কিন্তু লজের ঘরে কপালে গুলির দাগ নিয়ে ইমরান একাই ছিল। হেমাকে কেউ দেখেনি। অবশ্য কেই-বা দেখবে? কারণ বিরাম লজে লোক বলতে একজন উজরে থাপা। সেই একাধারে মালিক, কুক কাম বেয়ারা। এই খুনের পর স্বভাবতই সে উধাও। তার চেয়ে মজার কথা হল, অফিশিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী উজরে মারা গেছে তিন বছর আগে। খবরটা ভাইরাল হবার পর বেশ ক-জন পুলিশকর্মী সাসপেন্ড হয়েছে। মিডিয়া থেকে মুখ্যমন্ত্রী সকলেই পুলিশের বাপ-বাপান্ত করছে। ওখানকার সাতজন পুলিশকর্মী সাসপেন্ড হয়েছে। নামী ক্রাইম রিপোর্টার এম.কে. আব্বাস জানিয়েছেন, উজরের এগারোটা পাসপোর্ট। তার মুল ব্যবসা ছিল মানি লন্ডারিং-এর। এছাড়া আন্ডারওয়ার্ল্ডে ক্লিনার হিসেবে  আওয়াল নাম্বার। ক্লিনার মানে যারা খুন-টুনের পর লাশ সাফাইয়ের কাজ করে। এদের লোকে প্লেনভাড়া দিয়ে হায়ার করে নিয়ে যায়। কিন্তু ইমরান কি কোনও টেররিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত? নাহলে একটা মামুলি নিশানাবাজের কাছে এত টাকা এল কী করে? ইন্টারপোল স্বামীজির আশ্রম থেকে বহু আপত্তিকর নথিপত্র পেয়ে সেটাক সিল করে বেশ ক-জন ভক্ত-সহ তাকে জেরা করবে বলে তুলে নিয়ে গেছে।’

    স্কচে-চরসে মাথা পুরো ঢিস ডাউন। বললাম, ‘কেসটা কী?’

    ইরফান ঘাড় নাড়ে, ‘পাক্কা তিন বছর পুলিশের চোখে ধুল ঝুঁকে ইন্ডিয়া, সিলোন, মায়ানমার, বাংলাদেশ হাজার কড়োরপতিদের হাজারও তারিকায় ঠকিয়েছে। এছাড়া ডায়মন্ড-এর দোকান-টোকানে ডাকাতি তো আছেই! যেটা পাওয়া গেছে আমার মতে সেটা টিপ অফ দ্য আইসবার্গ। আসলি খবর হল অ্যামাউন্টটা ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে আড়াই থেকে তিন…’

    ‘কোটি!’

    ‘আবে চুতিয়ে, লাখ মে উঁহা তো দূর, ইহাঁ ভি কই লন্ড ভি নেহি হিলাতা।’

    নেশাটা ফাটছে। চটপট দুটো মেরে বেরিয়ে এলাম বাইরে। ওরা গাড়ির জন্য জোর করছিল। বললাম, ‘কসম আপনা মল্লিকবাজার কি, থোড়া পয়দল চলকে তো দেখে আপনা হাসিনা কিতনা বদলা।’


    প্রায় সব বদলে গেছে। স্টুডিও ডল্‌স নেই, পাশের জলযোগ নেই। লখনউ হোটেল উঠে গেছে, তার জায়গায় চলে এসেছে সিরাজ। আদি সিরাজটার এখন এমন চেহারা হয়েছে যে ঢুকতে ভয় লাগে। যদিও কিছু জিনিস বদলায়নি। যেমন পার্ক ম্যানসনে আমাদের ফ্ল্যাটটা। নীচে শ্বেত পাথরের ফলকে এখনও লেখা আছে S.C. Sengupta, আর আছে চারতলা ৬৬ সি পার্ক স্ট্রিট। এর ছাদের কার্নিশ থেকে রেন ওয়াটার ধরে অনেকটা ঝুঁকে আমরা জাহিদা ভাবির চান করা দেখতাম।

    আরও এগোলে মাবুব লেংড়ির এরিয়া। এই সাইডে সিঙ্গল যাওয়া বারণ ছিল। অলটাইম গ্রুপে যেতে হত। ব্যস, আর তো কিছু বলার নেই। এবার? এদিকে অনেকক্ষণ ধরে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল, এই বৃষ্টি শুরু। ময়দানের শেডটা খালি। নীচু বসতে কষ্ট হয়, তবু বসলাম। মেঘ-বৃষ্টি বছরের-পর-বছর একইরকম থাকে, মানুষের ভাল-মন্দে ওদের কিছু যায় আসে না।

    ময়দানের ওই সাইডটায় তুই মুন্নিকে খেয়েছিলি, পাইপের সাইড থেকে দেখেছিলাম বলে দশ টাকা নিয়েছিলি। আফজলদার ডেথটার কথা ভোলা যায় না। যে-শালা সাইকেলের জাদুকর, সে কিনা মরল সাইকেলে! না রাস্তায় নয়, এই ময়দানে। সাট্টায় জিতে লাল রেসিং কিনেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড লেকিন ফুল চমাচম। পরদিন হোলি। নয়া নভেলি রেসিংকে তো আর ওইদিন বার করা যাবে না। তাই আগের দিন সকাল থেকে পাগলা চক্কর।

    ময়দানে ঢুকে হাত ছেড়ে সিগারেটটা ধরাতে যাবে, ঠিক তখনই পড়ে থাকা ইটে মামুলি হোঁচট। পড়ল টেনিস কোর্টের পাশের দরজার ওপর। দরজা থেকে বেরিয়ে থাকা একটা লোহার টুকরো সিধা ফাল্লা করে দিল কলজেটা। হোলি বন্ধের ফতোয়া দিয়ে দিলেন মিসিরজি। রং, পিচকিরির দোকানগুলো জবরদস্তি বন্ধ করে দেওয়া হল। পোনেদারা ওই দরজাটা উপড়ে এনে জ্বালিয়ে দিল আমি এখন যেখানে বসে আছি তার থেকে ফুট চারেক দূরে। ফিরভি আপনা হোলি পে বুচ নেহি লাগা। ক্যায়সে লাগে! তব তো বডিতে এজ আসেনি, দিল মে হোলি জ্বল উঠা।

    আমারা দোল খেললাম চোরি ছুপে, আমাদের বালিগঞ্জ বাড়ির ছাদে উইথ রাম অ্যান্ড ভাং। তোকে বলা যায়নি কারণ তুই তখন অনিতাদিদের সঙ্গে দিঘা গেছিলি, গাড়িতে। আর কী লিখব বুঝতে না পেরে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। অনেক কাল বাদে, মাথাটা হালকা পাক মারল। বৃষ্টি বাড়ছে দেখে ফিরে গেলাম শেডে। বসে জমিয়ে টান দিতে-না-দিতেই একটা হারামি জলের ফোঁটা এসে ল্যান্ড করল ঠিক সিগারেটের ওপরে। ফলে ইন দ্য ভোগ অফ মা। চার অক্ষরের কাঁচা দিয়ে মালটা ছুড়েছি আর বাঁ-হাতে লুফে নিয়ে ববিদা পাশে এসে বসল।

    ‘তুমি তো, তুমি তো…’

    ‘কী, মারা গেছি? ধরে নে গেছি, তা বলে জুনা-পুরানা ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে দুটো কথা বলা যাবে না?’

    হাতে চিমটি কাটলাম, বেশ লাগল। ব্ল্যাক জ্যাক জোন্‌স স্লিম ফিট, হালকা সুপার লুজ আরমানি, খোলা হাতায় হিরের কাফলিং। সাইডের গুচি ব্যাগ থেকে দুটো রুপোর হিপ ফ্লাস্ক বার করে একটা আমাকে বাড়িয়ে দেয়। তারপর চুমুক, একসঙ্গে। ববিদা বলে, ‘আলকাটার্জ আমাদের সেলুলার জেলের মতো। ওখানে শো সেরে কৃষ্ণার চাপে গেছি গ্রেট স্টারে মুভি দেখতে। ফালতু মারদাঙ্গার ছবি। কৃষ্ণাকে বললাম, তুই দ্যাখ, আমি বারে বসছি। বারের সামনের ডেকর পুরো আমাদের নুরমহল হলের পাশের রেখা বারের মতো। ভেতরে উইন্সরের মতো  ছোট-ছোট খুপরি। সেখানে পাবলিক মাল খাচ্ছে, লাগাচ্ছে, কোক নিচ্ছে। আমি একটা জনি ওয়াকার ব্লু নিলাম। চুমুক দেওয়ার আগেই বাবা হাজির। সার্কাসের ড্রেস থেকে কবরের ধুলো ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল, কখনও রাশিয়ান রুলে খেলেছিস?’

    ‘তুই এতদিন যাদের প্রতি যত অন্যায় করেছিস, তাদের দীর্ঘশ্বাস সমস্ত ফরিয়াদ নিয়ে উঠে গেছে ওপরে ‘তাঁর’ উদ্দেশ্যে। তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগেই আকাশ ফাটিয়ে ব্জ্রনির্ঘোষ শোনা যায় : তোরা কি কিসাস বা বিনিময়ের কথা শুনিস নি? চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত।’


    বললাম, ‘শুরু থেকে বলো।’

    ‘অত টাইম নেই রে পাগলা। আগে বাবার কথাটা সেরে নিই। বাবা পকেট থেকে ছোট্ট একটা নাইন এম এম  রিভলবার বার করে একটা বুলেট ভরে সিলিন্ডারটা পাক মেরে মাথায় ঠেকিয়ে বলল, এরপর তোর দান।’

    ‘মানে?’

    ‘তুই এতদিন যাদের প্রতি যত অন্যায় করেছিস, তাদের দীর্ঘশ্বাস সমস্ত ফরিয়াদ নিয়ে উঠে গেছে ওপরে ‘তাঁর’ উদ্দেশ্যে। তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগেই আকাশ ফাটিয়ে ব্জ্রনির্ঘোষ শোনা যায় : তোরা কি কিসাস বা বিনিময়ের কথা শুনিস নি? চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত।’

    এই ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে নভোমণ্ডল বন্ধ করে দেয় তার সমস্ত দরজা। তখন নিষ্ফল আক্রোশে এরা নেমে আসে নীচে, অভিযুক্তর জন্য নানান রকম পানিশমেন্ট নিয়ে। ওই শাস্তির ভয়াবহতা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। তপ্ত ধাতব রমণীর সঙ্গে রমণ করতে হয়েছিল আমায়। তার চেয়ে এটা বেটার, গেলি তো গেলি, নাহলে আর পাঁচটা লোকের মতো মরবি।

    আমি শালা টপক্লাস গান্ডু, রাজি হলাম না। ঠকবাজির টাকা আর্মসে-হেরোইনে ইনভেস্ট করে হিউজ সাইজ হয়েছে। আমার ড্রেস, এডুকেশন সবটা পুরো পালটে গেছে। আজকের লিঙ্গতে বোধহয় একেই বলে প্যারাডাইম শিফ্‌ট। ‘গীতা’ থেকে ‘ডিভাইন কমেডি’ ফটাফট কোট করতে পারি। এখন যে-সার্কেলে আমাদের ওঠাবসা, সেখানে এডুকেশন যে কত বড় টুল, কৃষ্ণাকে হাজার চেষ্টা করেও বোঝাতে পারিনি। তখনই ডিসিশন নিই মালটাকে ঠুকে দেব।

    পরের কথা পরে, তখন আশ্রমে সুদর্শন জেমস উড্যাল এসেছেন, সঙ্গী লেননের বিধবা ইয়াকো ওনো। গান থেকে ধর্ম সব নিয়েই কথা হচ্ছে— ওইরকম অসাধারণ জীবনী লেখার পর বোর্হেস নিয়ে আর কোনও কাজ করলেন না কেন ? কথাটা শুনে দু’চোখে ঝিলিক মেরে উঠল হাসি— দস্তয়েভস্কি, কাফকা, বোর্হেস, এসব চক্করে একবার পড়লে আমার গান নিয়ে কাজের দফারফা হয়ে যেত। আলি ফারুকি-র কথাই ধরুন না, আমির হামজার রোমাঞ্চ-কাহিনি লিখতে গিয়ে লাইফ শেষ।

    যাবার আগে বোর্হেসের সাইন করা ইংলিশে ট্রান্সলেট করা একটা ছোট্ট গল্প, ‘দ্য ওয়েট’ দিয়ে গেল। উড্যাল বলল, এটা করে বুড়োকে দেখতে দিয়েছিলাম। তারপর জন্মদিনে আমার লেনন ওনোকে নিয়ে লেখা বইটা দিলাম। বুড়ো তখন একেবারেই চোখে দেখে না। বইটার মলাটে হাত বুলিয়ে নাম জিগ্যেস করল। শুনে বললও দুটো রেভ রিভিউ পড়েছি, তোমায় অনেক-অনেক ধন্যবাদ। তারপর একগাল হেসে এই লেখাটায় সই করে দিয়ে বলল, এবার ‘ডক্টর ব্রডিস রিপোর্ট’টা করো। ওয়েট-টা বেড়ে হয়েছে।

    ওরা চলে যাবার পর রাতে লেখাটা দু’বার পড়লাম। দারুণ। নিজের সুবিধের জন্য উর্দুতে ট্রান্সলেট করা শুরু করলাম। তখনও বুঝিনি ইট্‌স আ ট্র্যাপ। শাস্তিটা শুরু হয়ে গেছে।


    আমেরিকা থেকেই ওই তিনটে লোককে দেখছি। একটা রোগা ঢ্যাঙা, অন্য দুটো বেঁটে-লম্বা। গল্পের মতোই আমি দু’বার টাকার বদলে ডলার দিয়েছি আর সেটা নিয়ে মাতাল কৃষ্ণা বেশ বাওয়ালও করেছে। নেমে দেখি ওই তিনটে লোক ওষুধের দোকানের দেয়ালে ভর দিয়ে বলছে, ইহুদিরা ইতালিয়ানদের তাড়িয়েছিল, ইতালিয়ানরা লোকালদের। গল্পের মতো ওষুধের দোকানের কাচে নয়, বেঁটেটার গেঞ্জিতে লেখা আছে, ব্রেসলাউয়ের।

    তার মানে এরাই কি সেই ঘাতক? কিন্তু আমি এদের চিনিই না। রুমে ঢুকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। একেবারে গল্পের মতো নয়, ঝাঁ-চকচকে। ঘরে রাখা স্কচের বোতল থেকে হাফ গ্লাসমতো ঢেলে, ঠেসে বরফ দিয়ে চুমুক দিয়ে, আঃ, পুরো হেভেন, মদ যে ইনভেন্ট করেছে তাকে নোবেল দিল না কেন কে জানে!

    বৃষ্টি দেখতে ব্যালকনিতে এসে দেখি একটা অন্ধ পায়রা। অন্ধ পায়রা আমি লাইফে দেখিনি, তুই দেখেছিস? দেখতে-না-দেখতেই ব্রাউন ঝাপট। ঠিক যেন উগলিনোর দাঁত মোক্ষম কামড় বসাচ্ছে রুগ গিয়েরির ঘাড়ে। ঝরে পড়া জল ধুইয়ে দিচ্ছে রক্তের দাগ। না, আমি গল্পের হিরো ভিয়েরি নই। আমার সঙ্গে সবসময়ে থাকে ৩৮, স্কট অ্যান্ড ওয়েবসন। কাজেই ঘরে ঢুকলে ওরা খালাস।

    এরপরও রাতে ওরা এল, তিনজনের হাতেই চেম্বার। আমি বালিশের নীচে হাত দিয়ে দেখি, নেই। সামনের দুটো বেঁটে ওটা নিয়ে ক্যাচ-ক্যাচ খেলছে। চোখাচুখি হতে মিষ্টি করে হেসে মুখে বালিশটা চেপে ধরল। ওফ, মাগো, কী যন্ত্রণা! এটা কতক্ষণ চলল কে জানে, তারপর গুলি। কপালে। গরম দানা। মল্লিকবাজারের বুলেট নিয়ে কহাবতটা মনে আছে তো? ঘুসবে চুপকেসে। নিকলোবে হাতি কা চাল, টোটাল বুম।

    ঘুম ভেঙে দেখি সবটা ঘামে লতপত। ওফ, স্বপ্ন! কৃষ্ণা পাগলের মতো নাক ডাকছে। ওর প্যাকেট থেকে একটা স্টেট এক্সপ্রেস নিয়ে বারান্দায় গেলাম। ঠিক তখনই উজরের মেসেজ : সব জামা এসে গেছে। লিখলাম, ধন্যবাদ। একটা পুরনো মাল ফেলতে হবে। ‘নো প্রবলেম ,তবে কোভিডের পর রেট রিভাইজড হয়েছে।’ লিখলাম, ‘কিংস ডিজায়ার ইজ কিংস’স অর্ডার।’ জবাবে দুটো স্মাইলি ভেসে এল।


    কৃষ্ণার জোরাজুরিতে সিনেমা দেখার জন্য আইনক্স-এর দুটো টিকিট কেটে রেডি হয়ে দেখি ও সোফায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বার ২/৩ ডেকে সাড়া না পেয়ে একাই গেলাম। না, ওই তিনটের কোনও পাত্তা নেই। হয়তো, বাড়িয়ে ভাবছি। হয়তো এই পুরোটাই কাকতাল। হলে বসে ইয়ার প্লাগে রফি লাগিয়ে দিলাম। ওপরওলা গাইলে মনে হয় এরকমই হত। চারপাশ দেখে হিপ ফ্লাস্ক বার করে একটা চুমুক দিলাম। তখনই দেখি লম্বাটা একমনে আমায় দেখছে, তাকানোমাত্র মুখ ঘুরিয়ে নিল।

    নাহ্‌, আর নয়। হোটেলে ফিরে বললাম, দুটো কলকাতা ফ্লাইটের ফার্স্ট ক্লাস, পেমেন্ট প্লাস্টিকে নয়, ক্যাশে দেব।

    রিসেপশনের মেয়েটির রং পাকা গমের মতো। কোঁকড়া চুল, গালে টোল। পুরো খাপচু। তুই দেখলে পুরো চিপকে যেতি। সুন্দর হেসে নরম গলায় বলল, ‘টাকার কথা বলছেন কেন স্যার! টিকিটটা তো দিই!’

    ‘মানে টাকা লাগবে না বলছ?’

    মেয়েটি আবার হাসে, ‘ম্যাম অনেকক্ষণ কিছু অর্ডার দেননি, খাবার কিছু পাঠাব?’

    ‘দেখছি’, বলে আমি লিফটের দিকে পা বাড়াই।


    গোয়ায় পরের পুরো দিনটা ওদের দেখতে পেলাম না। কিন্তু প্লেনে ঘুম আসামাত্র ফিরে এল। ঘুম ভাঙল ঘামে ভিজে। হয়তো সিরিয়াস কিছু নয় কিন্তু জয়গাঁ-র কাজ সেরে চায়না বা রাশিয়ায় একটা ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে। কারণ ঘুমটা ঠিক না হওয়া কাজের কথা নয়। আসার দিন ড্রাইভার না নিয়ে সব বিচ, আশপাশ ছান মেরেও তিনটের টিকির দেখাও পেলাম না। ঠিক করলাম এবার যেখানেই পাব, নিশানাবাজির খেলাটা দেখাবো।

    ভাবলাম, কিন্তু হল না। বাগডোগরা ফ্লাইটে হাতের ব্যাগটা রাখার সময়ে পেছন থেকে কে ঠেলছে। মুখ ঘুরিয়ে দেখি বেঁটেটা। কড়া করে কিছু বলতে যাব, তার আগেই এমন ইনিয়ে-বিনিয়ে ক্ষমা চাইতে শুরু করল যে, আমিই ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’ বলে কাটিয়ে দিলাম। স্বপ্নের ভয়ে জোর করে জেগে রইলাম। শালা আজব প্যাঁচ!

    এয়ারপোর্টে উজরেকে দেখে কনফিডেন্স ফিরে এল। ও বলল, ‘ফ্ল্যাসি গাড়ি ইচ্ছে করেই আনিনি। এটা চুরির গাড়ি। কমিশনার গর্গ অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছেন। আপনার ৫৬% টাকা ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে, আমার বেসমেন্টে আছে। অল্প কিছু আছে আপনার রুমে। বাকি তো আপনি জানেনই নানা কান্ট্রিতে ইনভেস্ট করা আছে। আপনাকে চায়নায় ঢুকিয়ে আমি সামদোঝংকার দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাব। এই টাকা চাইনিজ আর্মস ডিলার ফু-র লোকেরা এখান থেকে ধীরে-আস্তে বার করে নেবে।’

    পেছন থেকে জড়ানো গলায় কৃষ্ণা বলে, ‘আমি কি বাল ছিঁড়ব?’

    ‘স্যার মানেই আপনারা দুজন। পার কন্টিনেন্ট ১০০০/১২০০ ফোন নাম্বার একটা পেন ড্রাইভে লোড করা আছে। যখন যেখানে যাবেন, ফোন করে নেবেন। যে-কারেন্সিতে যা দরকার পেয়ে যাবেন।’

    ‘যদি না দেয়?’

    ‘যা আপনার, তা তো আপনাকে দিতেই হবে ম্যাডাম!’ উজরে হাসে।


    বিরাম লজে ঢুকেই আঁতকে উঠলাম। সেই দু’নম্বর ঘর। লোহার খাটটার ডিজাইন মুছে এমন দশা, মনে হচ্ছে আঙুরের খেত। এক সাইডে পাইনউডের দুটো বেঢপ চেয়ার। ছোট আয়না। তার সামনে আদ্যিকালের শেভিং-এর মালপত্তর। দেয়ালে আধময়লা ক্রুসে-বেঁধা যিশুর পাশে ঝপসা হয়ে আসা কোনও দেশের ম্যাপ। দেয়ালে হাতে আঁকা কুৎসিত চেহারার ময়ূরের ছবি দেওয়া ওয়ালপেপার। মনে হচ্ছে ‘দ্য ওয়েট’ সামনে রেখে কেউ ঘরটা সাজিয়েছে। তাহলে কি এখানেই? আমি তো কাল, বড়জোর পরশু রাতেই ফুটে যাব।

    পেছন থেকে ফাটা রেকর্ডের মতো কৃষ্ণা বলে যাচ্ছে, ‘এখানে কী করে থাকব? ফুন্টশেলিং-এ কত ভাল-ভাল হোটেল আছে!’

    ‘তুমি জানো না আমরা এখানে কাজে এসছি, ফূর্তি করতে নয়!’

    তবুও ঘ্যানানি থামছে না দেখে টেনে একটা থাপ্পড় মেরে বেরিয়ে এলাম। পা বাড়ালেই অন্য দেশ। বেশ মজা লাগে। ঢুকেই রোলেক্সটা আধঘণ্টা এগিয়ে নিলাম। একেবারে কোণের দোকানটায় একটা বেঁটে মন দিয়ে কাগজ পড়ছে, অন্যটা স্যান্ডুইচ খাচ্ছে। ওদের পাশের বারস্টুলে বিয়ার নিয়ে বসে স্যান্ডুইচটাকে জিগ্যেস করলাম, ‘বেড়াতে?’

    চমকে বিষম খেয়ে, ঠিক যেন ভূত দেখেছে এইভাবে বেঁটেটা খাবার ফেলে অন্যটার হাত ধরে টানতে-টানতে ছুটে বেরিয়ে গেল। তারপর অনেকটা এলোমেলো হাঁটলাম। তাসি নামগেতে একটা রুম নিলাম। ঘণ্টাখানেক সাঁতার কেটে উজরেকে ফোনে বললাম, ‘তাসিতে আছি। দুপুরে ঘুমোব।’

    ‘খুব ভাল। আপনার মালটা প্লাস্টিকে মুড়ে বেসমেন্টের নীচের গর্তে ভাল করে সিমেন্ট দিয়ে সিল করে দিয়েছি।’

    ‘বিকেলে যাব।’

    কী অসাধরণ ঘুম হল বলার কথা নয়। উঠে দেখি বডি পুরো ফ্রেশ। লজে গিয়ে বললাম, ‘বহুত ফুরফুরে লাগছে, আজ খেলিয়ে মাল খাব।’

    গ্লাসে ঢালতে-ঢালতে উজরে বলে, ‘শুনেছি এই মালটা আলেকজান্ডার খেতেন।’

    ‘আলেকজান্ডার মানে ওই খেঁচাটা, যে তোর গাড়ি মুছত?’

    ‘আরে না না, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।’

    ১০
    মদের জেরে রাত কাবার। ভোরে, ঘুমের মধ্যে ওরা এল। এবার আর ভয় পাইনি। হাসিমুখে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই প্রতি রাতের মতো মুখে বালিশ চেপে (দু’ভুরুর মাঝখানে টোকা মেরে ববিদা বলে) ঠিক এইখানে চালাল। পর পর তিনবার। ব্যস, আমিও মরে গেলাম।’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook