ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভেঙে পড়ার শব্দগুলি


    শরণ্য বৈদ্য (August 5, 2023)
     

    সমালোচনা— সিনেমা, ‘ওপেনহাইমার’
    মুখ্য চরিত্র— কিলিয়ান মার্ফি, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, এমিলি ব্লান্ট, ম্যাট ডেমন, গ্যারি ওল্ডম্যান প্রমুখ
    পরিচালনা— ক্রিস্টোফার নোলান
    সম্পাদনা— জেনিফার লেম
    আবহসঙ্গীত— লুডউইগ গোরান্‌সন

    সভ্য কে জানেন? সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ যে আঙুলের একটি চাপে একটি বোতাম টিপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসী সমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য কারা জানেন? যারা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’

    সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবির এই সংলাপ ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ‘ওপেনহাইমার’ দেখতে দেখতে ভীষণভাবে মনে পড়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে আমেরিকা দুটি পরমাণু বোমা ফেলে জাপানের দুটি শহরকে— হিরোশিমা ও নাগাসাকি— প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন লক্ষ-লক্ষ মানুষ। পরমাণু বোমা তৈরির এই গোটা প্রক্রিয়া ও সামগ্রিক পরীক্ষানিরীক্ষা ঘটানো হয়েছিল খুবই গোপনে— ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এ। আর সেই গোটা প্রকল্পের মাথা ছিলেন জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার, যাঁকে ঘিরে এই সিনেমা।  

    কাই বার্ড ও মার্টিন শেরউইনের লেখা পুলিৎজার-প্রাপ্ত ‘আমেরিকান প্রমিথিউস: দ্য ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি অফ জে. রবার্ট ওপেনহাইমার’ (২০০৫) অবলম্বনে তৈরি এই ফিল্ম ধীরে ধীরে যত এগিয়েছে ততই তাতে স্পষ্ট হয়েছে দুটি আবর্ত— বিজ্ঞানী হিসেবে ওপেনহাইমারের কেরিয়ার, এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে এফবিআই নজরজারি ও তদন্ত। মোটামুটি এই দুই আবর্তেই তৈরি করা হয়েছে গল্পের কাঠামো। দুটি আবর্তের ভিত্তিও আবার দুটি ফ্ল্যাশ-ফরওয়ার্ড। আর এই ফ্ল্যাশ-ফরওয়ার্ডেও বার বার ঘুরেফিরে এসেছে দুটি পৃথক জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্য। প্রথমটি রবার্ট ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে এফবিআইয়ের (কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে), দ্বিতীয়টি মার্কিন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান লুই স্ট্রসের বিরুদ্ধে মার্কিন-কংগ্রেসের (ওপেনহাইমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রশ্নে), কারণ পদাধিকারবলে আমেরিকার সামগ্রিক পরমাণু-নীতি নির্ধারণে স্ট্রসেরই ছিল অগ্রণী ভূমিকা। সেই ক্ষেত্রে এক অর্থে পরমাণু বোমার আবিষ্কর্তা ওপেনহাইমারের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও মার্কিন-কংগ্রেস সদস্যদের কাছে তদন্তের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

    পরমাণু বোমার মূলমন্ত্র ‘নিউক্লিয়ার-বিভাজন’ অবশ্য আবিষ্কার হয় নাৎসি-জার্মানিতে, ১৯৩৮ সালে অটো হানের হাত ধরে। কয়েক বছর কাটতে না কাটতেই বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদঘণ্টা। হিটলারের পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস-সহ ইউরোপের একাধিক দেশ দখলের আগ্রাসী মনোভাব দেখে আমেরিকা ভীত হয়ে ওঠে। আমেরিকার আশঙ্কা, প্রাথমিকভাবে পরমাণু বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ বলে হিটলার ব্যঙ্গ করলেও, পরে সেই ইহুদি বোমাই তিনি ‘উরানভেরেইন’ (জার্মান নিউক্লিয়ার আর্মস) প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে পারেন মিত্রশক্তির উপর। তাই মিত্রশক্তির, বিশেষ করে আমেরিকার, তরফে পাল্টা আঘাত হিসেবে নাৎসি-জার্মানির উপর পরমাণু বোমার শক্তি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। টানটান উত্তেজনায় ভরা এই পরমাণু বিস্ফোরণের পটভূমি নিউ মেক্সিকোয় মরুভূমির মধ্যে গড়ে ওঠা প্রজেক্ট-ওয়াই বা লোস আলামোস সিক্রেট ল্যাবরেটরি— যা ঘটনাচক্রে ম্যানহাটান প্রজেক্টের অন্তর্গত। ১৯৪৩ সালে গড়ে ওঠে এই ল্যাবরেটরি। দু’বছর ধরে চলে পরমাণু বোমা তৈরির পরীক্ষানিরীক্ষা। তারপর ১৯৪৫ সালের সেই ঐতিহাসিক ‘ট্রিনিটি টেস্ট’। বাকিটা ইতিহাস।

    হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংসের জন্য ওপেনহাইমার অনুতপ্ত হলেও এত বছর পরেও আমেরিকা সেই ঘটনায় সরকারিভাবে ক্ষমা চায়নি— শুধুই অস্বীকার করেছে। পরবর্তীকালেও আমেরিকা একই রকম সামরিক অভিযান চালিয়েছে ভিয়েতনাম ও ইরাকের বিরুদ্ধে— ডেকে এনেছে আরও গণহত্যা।

    ওপেনহাইমারের বিজ্ঞানী হিসেবে কেরিয়ার ছাড়াও এই ছবিতে নোলানের হাত ধরে উঠে এসেছে তাঁর কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি দুর্বলতা। সেই ধারণা বদ্ধমূল হয় তাঁর ও মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির কার্ডহোল্ডার জাঁ ট্যাটলকের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। ছবিতে বেশ কিছু দৃশ্যে তাঁকে দেখা গেছে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সভায় বক্তৃতা দিতে। সেই বলশেভিক বিপ্লবের সময় থেকেই আমেরিকা কমিউনিজমের ভূত দেখত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর সঙ্গে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এর সময়ে তা আরও প্রকট হয়। স্বাভাবিকভাবেই হিরোশিমা-নাগাসাকি পর্বের পর গোটা আমেরিকা জুড়ে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠলেও, ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে শুরু হয় এফবিআই তদন্ত। সেইসঙ্গে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে ওপেনহাইমার সাফ জানান, হিরোশিমা-নাগাসাকির অভিঘাতে তাঁর হাতে রক্ত লেগে গেছে। ভগবদ্গীতাকে উদ্ধৃত করে বলেন যে— এখন তিনিই মৃত্যুর দ্যোতক, গোটা পৃথিবীকে তিনিই ধ্বংস করেছেন। তাঁর এই বোধোদয় ভালোভাবে নেননি সরকার বাহাদুর। ট্রুম্যান তাঁর এই প্রবণতাকে ‘ছিঁচকাঁদুনে মানসিকতা’ বলেও কটাক্ষ করেন। এর ফলেও ওপেনহাইমার মার্কিন সরকারের বিরাগভাজন হন। তাঁর অপরাধবোধ আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবার্ট লিফটন ও গ্রেগ মিচেল-এর বই— ‘হিরোশিমা ইন আমেরিকা: ফিফটি ইয়ার্স অফ ডিনায়াল’ (১৯৯৫)-এর কথা, যেখানে লেখা আছে—  ‘অস্বীকার করা মানে আসলে এই কথা বলা যে— খুনিরা খুন করেনি, গণহত্যার বলিরা নিধন হয়নি। এই অস্বীকার ভবিষ্যতে আরও গণহত্যা ডেকে আনে।’ হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংসের জন্য ওপেনহাইমার অনুতপ্ত হলেও এত বছর পরেও আমেরিকা সেই ঘটনায় সরকারিভাবে ক্ষমা চায়নি— শুধুই অস্বীকার করেছে। পরবর্তীকালেও আমেরিকা একই রকম সামরিক অভিযান চালিয়েছে ভিয়েতনাম ও ইরাকের বিরুদ্ধে— ডেকে এনেছে আরও গণহত্যা।

    ‘ওপেনহাইমার’ দেখতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছিল নোলানের ‘ডানকার্ক’ (২০১৭)-এর কথা। সেই ছবিটাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি। কিন্তু সেটা একটা বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হওয়ায়, অনেক বেশি ঘটনাবহুল। একটু উচ্চগ্রামের সেই ছবির পাশাপাশি ‘ওপেনহাইমার’ যেন অনেক নীচু তারে বাঁধা, একজন আপাতভাবে সফল মানুষের উত্থান-পতনের কাহিনি। এই বায়োপিকে, প্রত্যাশিত ভাবেই, পরিচালক বাহ্যিক ঘটনা-পরম্পরার চেয়ে বেশি নিবিষ্ট হয়েছেন ওপেনহাইমারের অন্তর্জগতের বিচ্ছুরণে। হস্টেলের বেডে একাকিত্বে কাতর অন্তর্মুখী ছেলেটির মাথায় খেলে যাচ্ছে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের দূরপ্রসারী চিন্তা, দ্বিধা, ভয়,— আর এরই পাশাপাশি রাজনৈতিক দর্শনের কমিটমেন্ট নিয়ে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছেন আগামী দিনের ‘Father of the atom bomb.’ তবে ছবির অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে ১৯৪৫-পরবর্তী ওপেনহাইমারের জীবন— খ্যাতির শীর্ষ থেকে নেমে এসে যখন তিনি সরকারি হেনস্থার মুখোমুখি।

    জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার

    দুটি আলাদা আবর্তে আবর্তিত হওয়ার ফলে ছবির চিত্রনাট্য জটিল হলেও, জেনিফার লেম-এর সম্পাদনায় ছবির গতি কোথাও হোঁচট খায়নি। ওপেনহাইমারের অন্তর্জগৎ বিশ্লেষণে নোলান ব্যবহার করেছেন দারুণ সব চিত্রকল্প। তরুণ ওপেনহাইমারের স্বপ্নে চিন্তার জগৎ আলো করে আসত এক মহাজাগতিক শক্তি, তাঁর বার বার মনে হত তিনিও হয়তো এই মহাজাগতিক বিচ্ছুরণের মতোই কিছু আবিষ্কার করবেন। ছবিতে দুটি জেরা করার দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য প্রথমটিতে— ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে এফবিআইয়ের জেরা কালারে আর দ্বিতীয়টিতে— লুই স্ট্রসের বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানি— সাদা-কালোতে শ্যুট করেছেন সিনেম্যাটোগ্রাফার হ্যয়টে ভন হ্যয়টেমা।

    ছবির অন্যতম ইউএসপি রিচার্ড কিং-এর সাউন্ড ডিজাইন ও লুডউইগ গোরান্‌সনের কানে ঝঙ্কার তোলার মতো ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। তিনটি দৃশ্যে প্রকট হয়েছে এই শব্দ-সম্পাত— প্রথমটি ট্রিনিটি টেস্ট; যেখানে প্রথমবার পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পরীক্ষা হয়। রাতের আকাশে বিপুল পরিমাণ আলোর সৃষ্টি করে ব্যাঙের ছাতার মতো মেঘপুঞ্জ তৈরি করে পরমাণু বিস্ফোরণ সাফল্যের মুখ দ্যাখে। দ্বিতীয়টি ওপেনহাইমারের স্ত্রী ক্যাথরিনকে তাঁর স্বামীর সম্পর্কে জেরা করার জন্য এফবিআইয়ের তলব। তৃতীয়টি অবশ্যই ওপেনহাইমারের বিভ্রম— হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বিস্ফোরণের পর গোটা দেশের কাছে তিনি যখন হিরো, সেইসময় ভিকট্রি স্পিচ দিতে গিয়ে বারবারই চাপা, গুমরে-ওঠা অপরাধবোধ তাঁকে যেন ভেতরে ভেতরে শেষ করে দেয়, চারিদিকের হাততালির আওয়াজ তাঁর কানে একাধিক পরমাণু বিস্ফোরণের মতো বেজে ওঠে। ভয়ার্ত চোখে তিনি দেখেন দর্শকদের শরীর থেকে চামড়া ও মাংস যেন গলে গলে পড়ছে। একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল ছবিতে কোথাও হিরোশিমা-নাগাসাকি বিস্ফোরণ দেখানো হয়নি, প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের রেডিও ভাষণে শোনানো হয়েছে মাত্র। কিন্তু বিস্ফোরণ না দেখিয়েও ওপেনহাইমারের বিবেক-দংশনের মধ্য দিয়ে এই বিস্ফোরণের আফটার-শক্‌ যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের স্তব্ধ করে রাখে।

    ওপেনহাইমারের কর্মব্যস্ত জীবন ও তাঁর মনোজগতের দ্বন্দ্ব— অনুতপ্ত মানুষটির ভেঙে পড়া এই ছবির গোপন শক্তির উৎস— নোলানের পরিচালনায় যার মর্মস্পর্শী প্রকাশ। তাই ছবি শেষ হওয়ার পরেও মাথার মধ্যে জেগে থাকে জিতে যাওয়া মানুষটির হেরে যাওয়ার মুহূর্তগুলি। গালিবের শায়েরি মনে পড়ে— ‘নহ গুল-এ-নগমা হুঁ, নহ পরদহ ইয়ে সাজ/ ম্যায় হুঁ আপনি শিকস্ত কি আওয়াজ’ [‘সুরের পর্দা নই কিছুতেই, নইকো গীতের সার/ আমি শুধুই শব্দ কেবল ভেঙে পড়ার।’] (অনুবাদ: শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও আয়ান রশীদ )

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook