আপ্তসহায়ক
চাকরি করা হয়ে ওঠেনি। ইন্টারভিউতে অপদস্থ হওয়ার ভয়। অফিসে গেলে কাজে ব্যর্থ হলে অনিবার্য অপমান। চাকরি চলে যাওয়ার আতঙ্ক। অনুদ্যোগীর কারণের অভাব হয় না। এদিকে যারা করছে, তাদেরও অপছন্দ। কত কী কেনাকাটা করতে পারে তারা। এটাই আসল ক্ষোভ। এখন যদিও অন্যরকম লাগে। বেশি রোজগার মানেই বেশি খরচ। এই গতকাল একজন থ্রিনাইটস-ফোরডেজ গোয়া ঘুরে এলো হাফ প্যান্ট পরে। ভিজে ম্যাক্সি পরা বান্ধবীর সঙ্গে নিজের সানগ্লাস ঝলসানো ছবি দিল। গোলাপখাস মুখ আখরোটের মতো করে আজ বলে কিনা ফ্ল্যাট বেচে দেবে। শুনে মনে মনে বলতে ইচ্ছে হয়নি, ‘বেশ হয়েছে।’ বরং ভেবে আতঙ্ক হয়েছিল। আমার অনেক ভয়। সেগুলো ঢেউয়ের মত ভাঙতে থাকে সকাল বিকেল। টিভি দেখা, কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি সেখানেও আতঙ্কের শেষ নেই। নোংরা কথা, মিথ্যে কথা, হিংসের কথা, ক্রমাগত মিথ্যে কথা, কত আর নেওয়া যায়? বীভৎস সুন্দর বাক্সের মধ্যে খোপে খোপে সাজানো টেনশনের সিরাপ ভরা দামি চকোলেট। একশো পার্সেন্ট ডার্ক, রাস্তার চাবড়া ওঠা পিচের মত। অন্যরা দিব্যি খাচ্ছে। অ্যাবনরমালের চেয়েও মারাত্মক নিউ নরমাল। আমি মানিয়ে নিতে পারছি না। ভয় তো করবেই। কাউকে একথা বলার উপায় নেই। পিষে পাউডার করে দেবে। আসলে আত্মবিশ্বাস বলে আমার কিছু নেই। এরপর হয়তো রাস্তায় হাঁটতে পারব না। আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যেতে হবে সাউথ ক্যালকাটা থেকে দক্ষিণেশ্বর।
এখন যেটা করছি, বছর খানেক হতে চলল, সেটা কিন্তু চাকরি। নিৰ্দিষ্ট সময়ে কার্ড পাঞ্চ করতে হয় না। কাজের জায়গা আমার আস্তানা থেকে হাঁটাপথ। যখন খুশি যাওয়া, বেরিয়ে আসা যায়। স্যালারিও আছে। বলা আছে, ‘ড্রয়ার থেকে নিয়ে নেবেন, যেমন লাগে।’ মন্দ কি? বিশেষত, কাজ বলে যখন কিছু নেই। টার্গেট নেই। টেনশন নেই। আবার আছেও। কথা বলা, প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়া, কিছু খুঁজে বের করে জানানো, মতামত দেওয়া, কাজ তো বটেই। আমার একজন বস আছেন। তাঁর ড্রইং রুম হলো আমার অফিস। আমার মতো অন্য কাজ না করা একটু লেখাপড়া জানা বাঙালি খুঁজছিলেন উনি।কর্মখালির বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল,’কাজে অনিচ্ছুক ব্যক্তি কোনো রকম বায়োডাটা ছাড়া এই ঠিকানায় সরাসরি চলে আসবেন। ফোন করবেন না।’ একটা ঝকঝকে বাড়ির তিনতলায় উঠে বেল বাজিয়ে দেখেছিলাম, দরজা খোলাই আছে। কোনো ইন্টারভিউ ছাড়াই চাকরি জুটে গিয়েছিল। আপ্তসহায়কের। অল্প কিছু কথার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্দেশ ছিল, ‘আপনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না, আমি করব। আপনি যেটুকু পারবেন উত্তর খুঁজে দেবেন।’ বেরোনোর সময় শুনলাম, ‘সময় পেলে চলে আসবেন।’
প্রশ্ন করা নিষেধ তাই ওনার নাম জানা হয় নি। স্বচ্ছল লোক। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা থাকার দরুণ একটা সপ্রতিভতা সর্বাঙ্গে। মনে হয় একাই থাকেন। আর কাউকে দেখিনি বাড়িতে। সত্তরের আশেপাশে বয়েস। ফিটফাট সুস্থ চেহারা। চশমা আছে। যত্নের গোঁফ। সবসময় পাটভাঙা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। কে কাচে, ইস্তিরি করে জানি না। কী খান, কখন খান, কে ব্যবস্থা করে তাও জানা নেই। চায়ের সরঞ্জাম আছে। ‘আপনার ইচ্ছে হলে নেবেন। আমাকেও দিতে পারেন।’ এর মানে হল, ‘আপনি কি চা খাবেন?’ জিজ্ঞেস করা চলবে না। সাধারণত সকালে ঘন্টা দুয়েক, সন্ধ্যায় আরো কিছুটা সময়ের জন্য আমি যাই। মনে হয়, উনি সেটাই চান। প্রথম কয়েকদিন নানা রকম কথা বললেন। সাধারণ কিছু ব্যাপারে খোঁজ নিলেন, যেমন, কলকাতায় এখনও ট্রাম চলছে কি না? ওনাকে একটু চিনে নেওয়ার পর আমি নিজেও অনেক খবর দিতাম। মেট্রো সম্প্রসারণের সাম্প্রতিক অবস্থা জানালাম। মন দিয়ে শুনলেন। এই মুহূর্তে রাজ্যে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে উনি উৎসাহী নন। সেলিব্রিটিদের ব্যাপারেও নয়। আমিও প্রসঙ্গ তুলি না। একদিন শুধু বললেন, ‘সবাই মিলে একসঙ্গে মিথ্যে কথা, অযৌক্তিক কথা বলাটা তো বেশ কঠিন কাজ। লোকে শুনছে? মানছে?’ এর স্পষ্ট উত্তর আমি দিতে পারিনি। উত্তর দিতে না পারায় চাকরি যাবে না, তা নিশ্চিত জানি। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন সবার হাতের মুঠোয়। যে কোনো প্রশ্নের উত্তর জোগাড় করা এখন ছেলেখেলা। কিন্তু আমার মতো একজনকে কেন রেখেছেন বুঝতে অসুবিধে হয় নি। একা মানুষ। কথা বলার লোক নেই। হয়তো তাই। তাছাড়া, ওই যে, লোকে মানছে না, তার উত্তর হয় না। বড়জোর একটা মতামত দেওয়া যেতে পারে। ওঁর বাড়িতে ইংরিজি, বাংলা খবরের কাগজ আসে। সেটা পড়াও আমার কাজ। টিভি দেখিনি। কাজ করতে করতে গত একশো বছরে দুনিয়ায় জরুরি যা কিছু ঘটেছে, এখন যা চলছে, সে ব্যাপারে আমার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেছে। পাকিস্তান কেন এখন সিভিল ওয়ারের মুখোমুখি বুঝতে বুঝতে সাতচল্লিশের ভাগাভাগির আসল ঘটনাটা জেনেছি। বলা যায়, অনেক ঘাটতি মেক আপ হয়ে গেছে। ‘আপনার কি মনে হয় কারুরই আর কাউকে দরকার হবে না? আমি কাজের কথা বলছি তা ঠিক নয়। অকারণেও কি দরকার নেই?’ খুব সাবধানে উত্তর দিলাম রিসার্চ করে। মনস্তাত্ত্বিকদের অ্যানালিসিস গুলো এক জায়গায় জড়ো করে জানালাম। উনি মন দিয়ে, চুপ করে শুনলেন। মতামত দিলেন। তবে সেগুলো আসলে প্রশ্নই।
চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকলেও বুঝতে পারছি আমার একটা পেশাদার সততা আছে। ভুলেও বেশি কথা বলি না, কোনো ব্যাপারে অযথা আগ্রহ দেখাই না। এই যেমন, ওঁর জীবনের যাবতীয় অন্য সব কিছুর ব্যাপারে, অস্বীকার করব না, আমার কৌতূহলের অভাব নেই। ভদ্রলোকের পরিপাটি ঘরদোর যেমন দেখছি তা কে সামলায়? উনি নিজেই কি? বই আছে, বিভিন্ন বিষয়ে। রামকৃষ্ণ থেকে স্যামুয়েল বেকেট। বিনোদবিহারী থেকে ম্যানটো। কামু। কালীপ্রসন্ন সিংহ। আছেন শীর্ষেন্দু। সত্যজিৎ চোখে পড়েনি। ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট থেকে অ্যানিমাল ফার্ম। রেকর্ড প্লেয়ার রয়েছে, এল পি গুলো নিশ্চয়ই অন্য কোথাও। গান বাজনা নিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। একদিন অবশ্য বলেছিলেন ‘ব্যান্ড কী করে বাংলায় হয়?’ মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গের সম্মুখীন হই। তথ্য জেনে যার উত্তর দেওয়া শক্ত। যেমন, ‘কত রকমের স্বাধীনতা আছে?’ কিছুদিন হল ওঁর টেবিলের ওপর রাখা ডেস্কটপ-টি আমি ব্যবহার করছি। কখনও শাট ডাউন করা হয় না। আমার ভেবে অবাক লাগে, উনি অনায়াসে এই কাজ নিজে করতে পারেন। অথচ করেন না। হয়তো প্রাপ্ত ইনফরমেশন আর নিজের মধ্যে একটি মানুষের মনের উপস্থিতি জরুরি মনে করেন। গুগলের সঙ্গে তো আর গ্যাঁজানো যায় না। এই বয়েসে জানার এত খিদে? বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, নেই কেউ? নাকি নিজেকে আলাদা রাখতে চান? আর একটা ব্যাপার। একবারও হাসতে দেখিনি।
মানুষের মন মানুষ না বুঝলেও কম্পিউটার বুঝতে পারবে, বা পারছে। প্রযুক্তি চৌকাঠ পেরলো বলে। একদিন সেটি জানানোয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বুঝলাম, আগ্রহ হয়েছে। বললেন, ‘মন পড়ে ফেলার পর কী হবে?’ আমি যথারীতি চুপ করে রইলাম। উনিও উত্তরের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলেন তা নয়। আমি নিজেও ভাবলাম, সত্যি তো, এরপর কী? কারুর মনের কথা জেনে নেওয়ার দরকার অন্যের থাকতেই পারে। যন্ত্র কাজে লাগিয়ে সে কাজ একধরনের অনুপ্রবেশ নয় কি? তাছাড়া, কেউ হয়তো কষ্ট পাচ্ছে। যন্ত্র কি তা বুঝে সমাধান খুঁজে দেবে? মেশিন নিশ্চয়ই মহাপুরুষ নয়। উল্টো দিকটাও ভাবার। যন্ত্র দিয়ে একটা মানুষকে খুশির অনুভূতি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? বা, তলানি আনন্দ শুষে নিয়ে অবসাদগ্রস্ত করে ফেলা সম্ভব? একদিন সন্ধ্যায় ওঁকে একটু উত্তেজিত বলে মনে হল। বললেন, ‘আমার ইচ্ছেকে অন্য কেউ মান্যতা দেবেই এমন আশা করি না। তাহলে, যদি সেই ইচ্ছে নিজের কাছে যুক্তিসঙ্গত হয়ও, চেপে রাখতে হবে। একজন হ্যাভ নট অন্য একজন হ্যাভের অতিরিক্ত সম্পদ চেয়ে বসলে কথায় কথা বাড়বে।’ কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও জড়িয়ে পড়লাম এই আলোচনায়। একটু বেশিই। আধঘন্টার মধ্যে কথোপকথনের স্রোত নতুন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল। ‘সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ডাইসি। কারুর দাবি খুবই মুশকিলের জায়গায় চলে যেতে পারে। উদারপন্থীরা মাথা নাড়লেও, কনজারভেটিভরা ঘোর আপত্তি করবে। মধ্যপন্থীরাও বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না।’ এরপর কোন ধরনের পরিস্থিতির প্রসঙ্গ এসে পড়তে পারে আন্দাজ করে আমি যথারীতি চুপ করে গেলাম। উনিও চাপাচাপি করলেন না। কখনোই করেন না। আজকাল আমার অন্য একটা কথা মনে হচ্ছে। উনি তো আর আমার ইয়ার দোস্ত নন। ঝগড়া বা সখ্যের ব্যাপার নেই। আমি ওঁর ইনফরমেশন সাপ্লাই এজেন্ট হলেও জীবনবোধ নিয়ে কথা উঠলে রোবট সেজে থাকা যায় না। ব্যাংকের ক্যাশিয়ার প্রত্যেকদিন ঠিক সময়ে এসে কাজে বসে যায়। কোনোদিন ভাবে না কেন সে টাকা গুনেই চলেছে। অভ্যেস হয়ে যায়। আমার সেটা কিছুতেই হচ্ছে না। চাকরিটা যাতে চলে না যায়, সেকথা মাথায় রেখে আমি কথার মুখের ক্লাচ-ব্রেকে পা রেখে পরিস্থিতি সামলে নিই। অসুবিধে হয়। কষ্ট হয়। উনি মানুষ। আমিও তাই। প্রশ্ন আমারও কম নয়। আমার সঙ্গেও তো বিশেষ কেউ কথা বলে না। আড্ডা মারা সেই কবে ছেড়ে দিয়েছি।
যখনই যাই দেখি উনি ওঁর চেয়ারে বসে আছেন। পাশের টেবিলে কোনো কোনো দিন কিছু বই চোখে পড়ে। একদিন দেখলাম একটা ডিভিডির বাক্স। গোদারের বিখ্যাত সিনেমা ‘ব্রেথলেস।’ নাম জানা ছিল। আমিদেখি নি শুনে বললেন,’আজই, এখনই দেখে নাও। কথা আছে।’ আমাকে কখনও তুমি বলেন, কখনও আপনি। একটা হেডফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ফ্রেঞ্চ ডায়ালগ, তাও থাক ওটা, সাবটাইটেল আছে।’ বুঝলাম এটাই আমার সেদিনের কাজ। উনি চান না ওঁর চারপাশে কোনো আওয়াজ হোক। দুম করে সিনেমা চালু হয়ে গেল। একটা বিদঘুটে লোক, গোলমেলে বলাই ভালো। এটা জ্যঁ পল বেলমোন্দ।পড়লাম টাইটেলে। খুব নাম শুনেছি। মেয়েটা জ্যঁ সিবার্গ। আপাত নিরীহ কিন্তু বেমক্কা বেখেয়ালের ঢালে গল্প গড়াতে শুরু করলো। প্যারিসে, শহরের বাইরে। নানারকম ঘটনা। বাঙালি আম-বুদ্ধিতে মেলানো মুশকিল। অবাস্তব দাবি। উদ্ভট নিরাসক্তি। নির্বিকার ক্রাইম। অস্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ। এই সিনেমার হাওয়া সুবিধের নয়। শেষে হ্যাপি মিলন করিয়ে মন-খুশ দর্শককে গুডবাই করবে এমন ভাবার কারণ নেই। সারাক্ষণ অস্বস্তি। শেষে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার ঘটল। সেটা এবং তার আগে যা যা ঘটেছে কোনোটাই মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। অথচ অসহায়ভাবে খেয়াল করলাম সিনেমাটা আমার মাথায় কেউ যেন পেরেক মেরে মেরে জ্যাম করে দিল। আমার বস বললেন, ‘ঠিক আছে, আগামিকাল কথা হবে।’ পরের দিন সকালে, এই প্রথম, আমার ভয় করতে লাগল কাজে যেতে।
ব্রেথলেস নিয়ে উনি কিছু বললেন না। আমিও কথা তুললাম না। সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে কথা শুরু হল। ‘আপেক্ষিক ব্যাপারটাই তো রিলেটিভ।’ সময় নিলাম, প্রশ্নের, আলোচনার গতিপথ কোন দিকে এগোতে পারে বুঝে নিতে। কিছুদিন ধরেই দেখছি স্রেফ তথ্য নয়, বিষয়ভিত্তিক অনুভূতি নিয়ে উনি কথা বলতে চাইছেন। ফলে, আমি নামক ব্যক্তির ওপর চাপ বাড়ছে। সাধারণ প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। এক্ষেত্রে ওঁকে প্রশ্ন না করে কথা বলা অসম্ভব। আমার উত্তর বা মতামতের কোনো বিরোধিতা উনি করেননি আজ অবধি। ভাবখানা হলো, কথা বলা কাজ, তাই বলছ। আমার যা শোনার শুনছি। কী ভাবছি সেটা জানার দরকার নেই। এ এক ধরনের উপেক্ষাও বটে। আমার রাগ হলেও আমি এখনও পর্যন্ত জিতে যাচ্ছি আমার মনোভাব ওঁকে বুঝতে না দিয়ে। একটা ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার, এমন বিবিধ বিষয় নিয়ে আমি আজ অবধি কারুর সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারিনি। বা আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমার বন্ধুরা, এখন আর কারুর সঙ্গেই সম্পর্ক নেই তেমন, একটাই কাজ করতো। একতরফা কথার রোড রোলার চালানো। আমি প্রায় নিশ্চিত যে, হনু নই বলেই আমাকে সব মেনে নিতে হত। আমার মতো দুর্বল, অসফল মানুষকেও দরকার পড়ে অনেকের। ওই একটিমাত্র কারণে। কথা শোনার কেউ নেই। আমি কিন্তু শুনে যাই। আমার বস মার্জিত রুচির মানুষ। অসভ্যতা করেন না। আমার সব কথা গ্রহণ করেন মূল্য দিয়ে। এই অবধি ভেবে আমার বেশ আরাম লাগে। উনি নিজেকে একবিন্দু খোলেন না। অস্বস্তি হলেও নিজেকে বোঝাতে পারি, এই বেশ ভালো আছি।
‘ব্রেথলেসে একটা জায়গা আছে, মনে থাকতে পারে আপনার, মাইকেল প্যাট্রিসিয়াকে বলছে, আমরা যখন কথা বলি, তখন আমি শুধু আমারটা, তুমি তোমার কথা। অথচ ওই সময়েই তো নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছু শোনার কথা।’ মনে আছে বইকি। উনি একথা বলছেন কেন? ওঁর সম্পর্কে আমার অন্যতম মনোভাব বুঝে ফেলেছেন কি? ফেললেও, আমি দোষী নই। কারণ আমি নিজের কাজ থেকে একবারও বিচ্যুত হইনি। এই মুহূর্তে আমার জীবনে একমাত্র কথা বলা, শোনায় আগ্রহী মানুষ হলেও ওঁকে আমি আজ অবধি চিনতে পারিনি। বরং নিজেকে বুঝিয়ে স্রোতের উল্টো দিকে হেঁটে চলেছি যুক্তি তর্কে প্রমাণ সাপেক্ষ নয় এমন অজস্র অনুভূতির বিরুদ্ধে। লোকটা কেমন যেন। ‘মাইকেলের মরে যাওয়াই স্বাভাবিক। বাঁচার স্বপক্ষে লাখো যুক্তি আছে, যারা বেঁচে থাকতে চায় তাদের তরফ থেকে। মাইকেল এমন ভাবে শেষ হয়ে যাবে নিজে অন্তত ভাবতে পারেনি। নাকি পেরেছিল? বা চেয়েছিল? যা করে যাচ্ছিল তার একটাও কি তুমি সমর্থন করো? ও নিজে করে? করার কথা নয়। গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ইতালিতে পালানোর চেষ্টা করছে আমরা সবাই দেখছি। দেশের সীমানা পেরোতে পারলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত?’ আমি বললাম, ‘ক্রিমিনালদের কোনোদিন মুক্তি হয় না। তারা নিজেরাও জানে। দৈব নয়। শেষ হয়ে যাওয়ার অজস্র অপশন তৈরি করতে করতে, জেনে বুঝে মৃত্যুর দিকে এগোয় এরা। কেন, বলতে পারব না। আসলে, আমি এই ধরনের কাউকে চিনি না।’ মিথ্যে বললাম। ‘চেনেন না, এটা অনেস্ট কনফেশন। আমরা সবাই নিজেদের একটু হলেও চিনি। অন্যকে চিনি না, কারণ চিনতে চাই না। আপনি কখনো নিজেকে ফেস করতে চেয়েছেন?’ আমি সাধারণত, ‘আজ তাহলে আসি,’ বলে উঠি। আজ সেটা বলতে পারছিলাম না। যদিও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘কদিন ছুটি পেতে পারি?’ শক্ত মুখে উনি বললেন, ‘আগামিকাল আসতেই হবে, আই ইনসিস্ট। তারপর আর না এলেও চলবে।’
একটা ঝড় আছড়ে পড়ার খবর আছে। প্রত্যেক বছর হচ্ছে। ঘরবাড়ি উড়ে যাচ্ছে। এবারে রেকর্ড গরম। অসহ্য। ঝড়ের সঙ্গে হয়তো বৃষ্টি আসবে ঝেঁপে। গরম কমবে। আবহাওয়া দপ্তর, মিডিয়া ক্রমাগত পূর্বাভাস দিয়ে চলেছে। দিনে চারবার চেক করি। ব্রেকিং নিউজ এমনই এক নেশা। দেখলে, শুনলে মন নেচে উঠছে। ভয়টা ফিরে এল সম্ভাব্য ধ্বংসলীলার খবর পেতেই। হাওয়ায় উড়ে আসা ধুলোর দানা, অ্যাসিড রেইনের নকশা ছোপানো সমুদ্রের একটা কার্পেট হামলে পড়বে উপকূলে। এক ঝাঁক অসভ্য বাইকবাজের মতো এগোবে কষ্টের ঘর, গাছ মট মট করে ভাঙতে ভাঙতে। কিন্তু কী দরকার ছিল ব্রেথলেস দেখানোর? তাকে বঁটি দিয়ে চিরে দুর্ভাগা মানুষের বোনলেস দেহাংশ এক্সপোজ করে নতুন কি মহান কথামৃত বেরুবে স্যার ? নিউ টেস্টামেন্ট লিখবেন নাকি? নতুন আর কী কী প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাকে? এখন তো দেখছি, আমাকে রীতিমত ইন্টারোগেশন করছেন। আমি কি এসবের উত্তর দিতে বাধ্য নাকি? নই। নির্ঘাত টের পেয়েছেন বডি ল্যাঙ্গুয়েজে। তাই ঠিক সময়ে ছুটির নোটিস ধরিয়ে দিয়েছেন। প্রজেক্ট ফুরোলে চাকরি তো যায়ই। আবার এটাও ঠিক যে, রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুর্ভাবনায় কাতর বলেই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এত বেশি উষ্মা প্রকাশ করছি। নিজের কাছে।
অনন্তকাল ধরে এই কাজ করার কোনো মানে হয় না। সুতরাং নটে গাছটি মুড়োলে ক্ষতি নেই। আগের জীবনে আবার ফিরে যাওয়া যাবে, অসুবিধে কী? এভাবেই তো চলে গেছে বহু বছর। রাতে ভালোই ঘুমোলাম। সকালে ফের ওয়েদার আপডেট। পূর্বাভাস খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। ভোর থেকে দেখছি মেঘলা। গরম নেই। গুগলও বলছে আকাশ মেঘলা। গরম কম। অ্যাকুওয়েদারও তাই। মৌসম ভবন শোনাচ্ছে আরও খুশির খবর। সাইক্লোন এগোচ্ছে অন্যদিকে। এখানে প্রভাব ফেলবে না তেমন। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবে ঝড়ের প্ররোচনা ছাড়াই। সকালে বেশ ঝরঝরে শরীরে ফেরত গেলাম কাজের জায়গায়। ওঁকে দেখে একটু অন্যমনস্ক মনে হল। আমাকে দেখে বললেন, ‘গোদারের শেষটা জানো?’ শেষ মানে? ‘মারা গেছেন কিছুদিন আগে। সুইৎজারল্যান্ডে। ভালোই বয়েস হয়েছিল।’ ‘তো কী হয়েছে?’ এই প্রথম বার প্রশ্ন করলাম। ‘আমি যদি ইউথেনেশিয়াতে যেতে চাই তাহলে কেউ মানবে না। অন্তত এদেশে নয়। যে দেশ অনুমতি দেবে সেখানে চলে যেতেই পারি। কিন্তু কেন যাব?’ এই কথোপকথনের মধ্যে আমি নিজের ফোনে জেনে গেলাম নতুন শব্দটার মানে কী। বললাম, ‘পারবেন না। ব্যাপারটা আর পাঁচটা সাধারণ সুইসাইডের মতো নয়। খুঁটিপুজো করতে হবে। লোক লাগবে। অনুমতি লাগবে। সে বা তারা আপনাকে যেতে দিলে তবেই যেতে পারবেন। নচেৎ জেলে বা উন্মাদাগারে ঢুকতে হবে, যতদূর জানি। সুইসাইড খুব ইজি। ফট করে হুশ হয়ে গেলেন। সবার নাগালের বাইরে। কিন্তু এর প্রিপারেশন খুবই বিড়ম্বনার ব্যাপার। অপমানকর। জ্যান্ত অবস্থায় করতে হয় কাজটা। মনে রাখবেন সেটা। সুইচ অফ করা এত সহজ নাকি?’ কিছুটা আক্রমণাত্মক গলায় এতটা বলে থামলাম। উনি চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। মাথা নিচু করে চুপচাপ পায়চারি করতে লাগলেন। একটু পরে, থেমে, আমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি আবার আসুন আগামিকাল থেকে। আজ এই অবধি।’