মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ভারী পাখাটা হঠাৎ খুলে পড়েছিল গত রাতে। আঘাত লাগার সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যু। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য, সারা বিছানা রক্তে লাল। বিকৃত মুখটা দেখে মোহনাকে আর চেনা যাচ্ছে না।
মোহনার এই পাখাটাকে ভয় ছিল প্রথম থেকেই। দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে সে নিলয়কে অনেকবার বলেছিল, ‘দেখো ছোট ঘর, তাতে আবার জিনিসে ভরা, খাটটা যে কিছুটা পাশে সরিয়ে দেব তার উপায় নেই। একদম পাখার নীচে শোওয়া কি ভাল? তার থেকে বরং একটা টেবিল ফ্যান কিনে আনি চলো।’
ইনভেস্টিগেশন চলছে। পুলিশ ময়না তদন্তের জন্য আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহ নিয়ে যাবে। থানার অফিসার নিলয়কে বললেন, ‘ইয়ংম্যান, লাকি লোক আপনি। একবার আমারও এরকম হয়েছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য বাস মিস করেছিলাম, তারপর শুনলাম সেই বাস ব্রিজের রেলিং ভেঙে সোজা নীচে গিয়ে পড়েছে নদীতে।’
অফিস থেকে ফিরতে-ফিরতে নিলয়ের রাত হয়। গতকালও তাই হয়েছিল। নিলয় বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ অন করে অফিসের কিছু কাজ সেরে রাখছিল। সন্ধে থেকে তার কাশি হচ্ছিল মাঝে মাঝে। রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে কাশিটাও বাড়তে থাকল। মোহনার ঘুমের ব্যাঘাত হবে এই মনে করে সে খাওয়া-দাওয়ার পর ডাইনিং স্পেসে গিয়ে বসেছিল। মোহনা যদিও তাকে অনেকবার ঘরে এসে শুতে বলেছিল, তবু সে শোনেনি। থানার অফিসার বীরেন রায় এইসব বক্তব্য নোট করে নিয়ে তাঁর দুইজন কনস্টেবলকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিতে লাগলেন।
মোহনা কিছু ভুল বলত তা নয়, ঘরে সত্যিই জায়গা ছিল না। মাত্র এক কামরার ফ্ল্যাট। সামনে এক চিলতে ডাইনিং স্পেস। ফ্রিজটাকে পর্যন্ত শোওয়ার ঘরে রাখতে হয়েছিল। কিন্তু নিলয় কখনওই তার স্ত্রী-র কথায় কান দিত না। সে মোহনাকে থামিয়ে দিত, ‘আরে ছাড়ো তো! ভয় নেই। কিছু হবে না।’ আবার কখনও বলত, ‘দাঁড়াও, আর কিছুদিনের মধ্যেই একটা এসি কিনে নেব। তখন শিলিং ফ্যান, টেবিল ফ্যান কিছু নিয়েই তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না।’
মোহনার ছোড়দা পুলক তাঁর বোনের মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ভেঙে পড়লেন একদম। তিনি এই প্রথমবার মৃত্যু দেখছেন না তাঁর এই চল্লিশ বছরের জীবনে। আসলে পুলক তাঁর বোনকে ভালবাসতেন খুব। ননদের মৃত্যুর বিবরণ শুনে পুলকের স্ত্রী অজন্তা বললেন, ‘একটা খটকা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, যাই বলো না কেন!’ স্ত্রী-র কথায় পুলক বললেন, ‘যার স্ত্রী মারা গেল, সেই অসহায় মানুষটাকেই তুমি সন্দেহ করছ! ওর মনের অবস্থাটাও একবার দেখার চেষ্টা করো!’ অজন্তা কথা বাড়ালেন না। তিনি মনে-মনে বললেন, ‘এরকম সহজ-সরল মানুষ কাউকে অবিশ্বাস করতে শেখেনি।’
পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে পুলক যা পেয়েছেন, তা কম কিছু নয়। যদিও অজন্তাকেই এই সমস্ত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। অজন্তা মনে-মনে বললেন, ‘দাদা বেঁচে থাকলে ব্যাপারটা এত সহজে মিটে যেত না, তিনি নিশ্চয়ই তলিয়ে দেখতেন।’ দাদা মানে পুলকের দাদা প্রশান্ত, মোহনার বড়দা। বছর দশেক আগে বিষধর সাপের কামড়ে প্রশান্তর মৃত্যু হয়েছিল। অজন্তা যদিও প্রশান্তকে কখনও দেখার সুযোগ পাননি, তবে তাঁর অদম্য জেদের কথা তিনি অনেক শুনেছেন। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই অজন্তা বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। তারপর বললেন, ‘কিছুদিন আগে কিন্তু মোনা তোমায় বলে গেছিল, ও সম্পত্তির অংশ চায় না। এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই এই ঘটনা। তুমি কি এখনও চোখ বন্ধ করে থাকবে?’ স্ত্রী-র কথায় পুলক চমকে উঠলেন যেন, তারপর বললেন, ‘এভাবে তো ভেবে দেখিনি।’
নিলয় পুলককে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কেঁদে ফেলল, ‘দাদা, আমার সব শেষ হয়ে গেল।’ একে তো বোনকে হারানোর যন্ত্রণা, তার উপর নিলয়ের এরকম অবস্থা দেখে পুলকের মন আরও ভেঙে গেল। তিনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে রইলেন কয়েকদিন।
ভালমানুষ স্বামীকে দিয়ে কিছুই হবে না বুঝে নিয়ে অজন্তা নিজেই উকিলবাবুকে ফোন করলেন। সব শুনে উকিল মনোজ গুপ্ত বললেন, ‘দেখুন ম্যাডাম, পুলিশ এটাকে নিছকই দুর্ঘটনা বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, কাজেই খুনের মামলা রুজু করে বিশেষ সুবিধে হবে না।’ অগত্যা অজন্তাকে দমে যেতে হল।
নিলয় আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে। তার একটা কাজ আছে ব্যক্তিগত। সে বাসস্টপে এসে দাঁড়াল। এখনও সন্ধে হয়নি তবে বিকেলের আলো মিশে যাচ্ছে শহরের আলোর সঙ্গে। হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে আসা একটা ভয়ঙ্কর বাজখাঁই গলার আওয়াজ শুনে নিলয় চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল। রাস্তার ধারে একটা গাছের নীচে বাঁধানো বেদিতে এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বসে রয়েছেন। সন্ন্যাসী আবার হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘আরে, এদিকে আয় বাচ্চা।’ ভয়ে-ভয়ে নিলয় তাঁর দিকে এগিয়ে গেল, তারপর পায়ে হাত দিয়ে সে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করল। সন্ন্যাসীর মাথায় বহুদিনের জটা, পরনে লাল বস্ত্র । সন্ন্যাসী বললেন, ‘আয়, বোস।’ একটু ইতস্তত করতে-করতে নিলয় তাঁর পাশে গিয়ে বসল। তিনি কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘তোর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবই দেখতে পাচ্ছি রে বাচ্চা। সবই ঠিক আছে, শুধু ওই বাতাসের গতিটা ভাল না। কী বুঝলি?’ সন্ন্যাসী থামলেন। নিলয় বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারলাম না।’ এ-কথা শুনে সন্ন্যাসী হেসে উঠলেন, তারপর বললেন, ‘নির্বোধ, নতুন যে-পাখাটা কিনে এনে টেবিলের উপর রেখেছিস, ওই পাখার বাতাস তোর জন্য মোটেও উপকারী নয়। তুই ঘরের ছাদ থেকে পাখা ঝোলানোর ব্যবস্থা কর আগের মতো।’ নিলয় চমকে উঠল সন্ন্যাসীর এই কথায়। মোহনার মৃত্যুর পর সে ঝুঁকি নেয়নি আর। একটা টেবিল ফ্যান কিনে নিয়েছে। কিন্তু সে-ব্যাপারটা তো এই সন্ন্যাসীর জানার কথা নয়! তাই সন্ন্যাসীর উপর নিলয়ের কেমন একটা সন্দেহ হল যেন। কিন্তু সে চুপ করে রইল, সন্ন্যাসীর কাছে তা প্রকাশ করল না। সন্ন্যাসী আবার বললেন, ‘দেখতে পাচ্ছি, জীবনটা তোর ভাল যাচ্ছে না।’
কথাটা সত্যি, চাকরিতে নিলয়ের একটুও উন্নতি হচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সন্ন্যাসী আবার বলে উঠলেন, ‘তোর কপালে একটা বিচ্ছেদযোগ দেখতে পাচ্ছি! তা কী করে হল?’ ইচ্ছে না থাকলেও নিলয় তাঁকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলল। সন্ন্যাসী বললেন, ‘হুম।’ ওই রকমের পাখার বাতাসেই তোর সব বাধা কেটে যাবে। তুই ওই রকম একটা পাখা চালিয়ে রাতে শুবি। বুঝলি!’ নিলয় আঁতকে উঠে বলল, ‘আবার সিলিং ফ্যান!’ তারপর সে মনে-মনে বলল, ‘কখনওই না।’ সন্ন্যাসী তাঁর ডান হাতটি পাশে রাখা একটা কাপড়ের ঝোলার ভিতর ঢুকিয়ে একখানা পাকা পেয়ারা বার করে আনলেন। ‘এই মন্ত্রপূত পেয়ারাটা আজ রাতে খাবি, আর কাল থেকে ওই পাখার বাতাস গায়ে লাগাবি।’
বাড়ি ফিরে নিলয় অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা ভেবে দেখল। একবার একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে মানেই যে সেটা বার বার ঘটবে তার তো কোনও কথা নেই! সেদিন তো ময়দান স্টেশন ছাড়ার পর মেট্রোরেলের কামরায় আগুন লাগল, তাই বলে কি নিলয় মেট্রোরেলে চড়া বন্ধ করে দিয়েছে? সন্ন্যাসীদের মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা থাকে, তাঁরা প্রকৃতই জ্ঞানী হন, তাছাড়া এই সন্ন্যাসী যে ভণ্ড এমন ভাবারও তো কোনও কারণ নেই! সুতরাং তাঁর কথামতো কাজ করে একবার দেখাই যাক না কী হয়! সর্বোপরি জীবনের বাধাবিঘ্নগুলো কেটে গেলে তার নিজেরই উপকার হবে। সবদিক ভেবে সন্ন্যাসীর নির্দেশমতোই সে পেয়ারাটা কেটে খেল রাতে।
পরদিন অফিস যাওয়ার আগে সে পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ান মিন্টুকে ডেকে একটা পাখা লাগিয়ে নিল ঘরে। তারপর দিনের বাকি সময়টা কেটে গেল গতানুগতিক ভাবে। নিলয় রাতে মনে-মনে সন্ন্যাসীকে একটা প্রণাম করে সিলিং ফ্যানটা চালিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাত তখন তিনটেও হয়নি, নিলয় ধড়ফড় করে উঠে বসল বিছানায়। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সে চোখ তুলে পাখাটার দিকে তাকিয়ে রইল। না, এভাবে বসে পাখার নাটটাকে দেখা যাচ্ছে না! তাই খাট থেকে নেমে নিলয় প্রথমেই পাখার সুইচ অফ করে দিল, তারপর একটা কাঠের চেয়ার এনে তুলল বিছানার উপর। পাখাটা এতক্ষণে থেমে গেছে একেবারে। নিলয় চেয়ারটার উপর দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখতে থাকল পাখাটাকে। নাটটা ঠিকই আছে, পাখা খুলে পড়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। নিলয় পাখার গায়ে হাত রাখল। অনেকক্ষণ চলায় পাখাটা বেশ গরম হয়ে আছে।
এর পর তিন-চারটে রাত একই ভাবে কাটল। রোজ রাতে নিলয়ের ঘুম ভেঙে যায়। রোজ রাতে খাটের উপর চেয়ারে দাঁড়িয়ে সে পাখার নাটটা ঠিক আছে কি না দ্যাখে। তার দু’চোখের তলায় কালি পড়তে শুরু করে দিল একটু-একটু করে।
একই ঘটনা ঘটল আজ রাতেও। নিলয় চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল, ‘আমি উন্নতি চাই না, একটু শান্তি চাই শুধু।’ পাখাটা দেখতে-দেখতে নিলয় ঠিক করে নিল, কালই মিন্টুকে ডেকে পাখাটা খোলাতে হবে। সে আবার টেবিল ফ্যানই চালাবে। ওই সন্ন্যাসীর খেল অনেক দেখা হল, আর দরকার নেই। পাখা থেকে চোখ সরাতেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল বিছানায়।
কী আশ্চর্য! তার বিছানায় একটা লোক শুয়ে আছে। লোকটির দৃষ্টি পাখার দিকে, হঠাৎ সেই লোকটি খেয়াল করল যে পাখাটা বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে। কোনওভাবে পাখার নাটটা খুলে পড়ে গেছে কোথাও। এমন সময় একটি মহিলা ঘরে এসে ঢুকল। তারপর মহিলাটি সুইচ টিপে পাখাটা চালিয়ে দিল। লোকটা খাট থেকে নেমে পড়ল। মহিলাটি তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল, ঘুমোবে না?’
‘তুমি শুয়ে পড়ো, আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসছি’ এই বলে লোকটি বাইরের ছোট্ট স্পেসটায় এসে বসল। লোকটির কথায় মহিলাটি একটু বিরক্ত হল, কিন্তু কিছু না বলে সে শুয়ে পড়ল। প্রথম সিগারেটটা শেষ করে লোকটি দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল এবার। কিন্তু এর মধ্যেই মহিলাটির ক্লান্ত চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেছে।
পাখা থেকে ঝুলে থাকা নিলয়ের মৃতদেহ পুলিশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে গেল দুপুরে। এই খবরটা পাওয়ার পর অজন্তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘পাপ’, তারপর আবার বললেন, ‘সব ফিরে আসে।’
বেশ কয়েকদিন সেই সন্ন্যাসীকে দেখা যায়নি কোথাও। সন্ধের দিকে তাঁকে দেখা গেল আজ। পেট্রোল পাম্পের সামনে দিয়ে তিনি হেঁটে যাছিলেন। একটি লোককে দেখে সেই একইরকম ভাবে তিনি হঠাৎ হাঁক দিয়ে উঠলেন, ‘আরে এই দিকে আয় বাচ্চা।’ তাঁর কণ্ঠস্বরে এমনই একটা কিছু আছে, যাকে উপেক্ষা করা যায় না। লোকটি এগিয়ে এল সন্ন্যাসীর দিকে। একটু ইতস্তত করে সে বলল, ‘বাবা, আমাকে ডাকলেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সন্ন্যাসী বললেন, ‘অমঙ্গল আসছে আগামীতে। তোর চোখ দেখে বলে দিচ্ছি, লিখে রাখ। বিষে-বিষে বিষক্ষয় কথাটা শুনেছিস তো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘তাহলে দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দিই।’ সন্ন্যাসী তাঁর কাপড়ের ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট গোলাকৃতি বাক্স বার করে আনলেন। তারপর বললেন, ‘আগামী সাত দিন ঘরে একা শুবি আর এই বাক্সটা খাটের নীচে রাখবি। ব্যাস, আর চিন্তা থাকবে না তোর। এর মন্ত্রে কাজ হবে। নে ধর।’ এবার সব অমঙ্গল কেটে যাবে এই কথা ভাবতে-ভাবতে উৎফুল্ল মনে লোকটি সন্ন্যাসীর হাত থেকে বাক্সটা নিল। তারপর সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, কী আছে এর ভিতর?’ সন্ন্যাসী বললেন, ‘সাপ।’ পুলকের হাত কেঁপে গেল।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র